নোমান আলি খান
يَسْأَلُهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
(সূরা আর-রাহমানঃ ২৯)
‘আকাশ ও পৃথিবীর সবাই তার কাছে চায়।’ প্রথমে আয়াতের এই অংশটা বুঝে নেই। আরবি ভাষায় সূ’আল سؤال , চাওয়া, দুই ধরণের হয়। তার আগে বলে নেই কেন এই আয়াতটা বুঝতে অনেকের ভুল হতে পারে। আল্লাহ বললেন যে সবাই তার কাছে চায়। ফেরেশতারা তার কাছে চান। পশুপাখি, আমরা মানুষেরা – সবাই তার কাছে চাই। তো, কেউ এসে যদি আপনাকে বলে, ‘আমার এক নাস্তিক বন্ধু আছে, সে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না।‘ বা ‘আমার এক বন্ধু আছে যে ধার্মিক না, সে কখনোই আল্লাহর কাছে কিছু চায় না।‘ অথবা বলল, ‘আমার ফিলসফির প্রোফেসর তো আল্লাহর কাছে কোন কিছু চান না। তাহলে তুমি কি করে দাবি করো যে আল্লাহর কাছে সবাই চায়?’
এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই বুঝতে হবে যে ‘চাওয়া’ শব্দটার আরবিতে দুটো অর্থ আছে।
একটি অর্থ হলো সজ্ঞানে চাওয়া। আরেকটা অর্থ হচ্ছে চাহিদা বা প্রয়োজন। যেমন ধরুন সূরা দুহার আয়াতেঃ
وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ
যে ভিক্ষা চায় তাকে ধিক্কার দিয়ো না।
এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে, যার [সাহায্য] প্রয়োজন তাকে ধিক্কার দিয়ো না। এমন অনেকে আছে যাদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা চায় না। আপনার উচিত তাঁর প্রয়োজনের ব্যাপারে জানা লাগবে এবং তাঁ চাওয়ার আগেই তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়া।
তাই শুরুর আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেক জিবেরই কোন না কোন চাহিদা সবসময়ই থাকে। এবং সেগুলো একমাত্র আল্লাহ পূরণ করতে পারেন। হোক সে বিধর্মী, হোক সে পাপী মুসলিম। এমন মানুষও আছে যে জানে সে খারাপ কাজ করছে, তার এমন করা উচিত না, তাও সে করছে এবং আল্লাহকে অমান্য করে যাচ্ছে। তারপরও আল্লাহ তাকে দেন, দিতেই থাকেন।
আপনাদের মধ্যে যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়েন, এবং যে কোন সালাতই পড়ে্ন না, এবং যে এখানে প্রথমবার এসেছেন, আপনাদের সবাইকেই আল্লাহ দেন। এমন কেউ নেই যাকে আল্লাহ দেন না। সবার ফুসফুস আল্লাহ বাতাসে ভরে দেন। সবার হৃদপিণ্ডে স্পন্দন তৈরি করেন। আমার এই হৃদপিণ্ড, যেটা আমার ভেতর ধুকধুক শব্দ করেই চলেছে, প্রত্যেক স্পন্দনের আগে সেটা আল্লাহর কাছে দুয়া করে, ইয়া আল্লাহ, আমি কি আবার স্পন্দিত হবো? এবং আল্লাহ সেটাকে অনুমতি দেওয়ার পরই সে আবার স্পন্দন তৈরি করতে পারে।
আমার দেহের প্রত্যেকটি শিরা উপশিরার আল্লাহকে প্রয়োজন। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া –
وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ
(সূরা আন’আমঃ৫৯)
গাছের একটা পাতাও পড়বে না। আমার শরীরের একটি কোষও নড়াচড়া করতে পারবে না তার আদেশ ছাড়া।
আমি পারি আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে। আল্লাহই আমাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছেন, আমার আত্মাকে সুযোগ করে দিয়েছেন চাইলে তাঁকে ভুলে যাবার, নিজের যা ইচ্ছা করার, যেভাবে ইচ্ছা কথা বলার, যেই পথে ইচ্ছা টাকা অর্জন করার, যার সাথে ইচ্ছা অবৈধ সম্পর্ক করার, শুক্রবার ছুটির রাতে ক্লাবে গিয়ে গুনাহ করার। অনেকে শুক্রবার দিনের বেলা জুমুয়াহ পড়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করছে, আলহামদুলিল্লাহ্, কিন্তু তারপর রাতের বেলা শয়তানকে সন্তুষ্ট করছে, নাকি? সাওয়াব আর পাপের পাল্লা সমান সমান করছে। আল্লাহ তখন তাদের উপর বজ্রপাত করেন না, আল্লাহ তাদের জোর করে আবার মাসজিদে যেতে বাধ্যও করেন না। তিনি চাইলেই এসব করতে পারেন। তিনি আগের অনেক জাতিকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সেরকম শাস্তি দিচ্ছেন না। যেই হাত চুরি করছে তা অসাড় হয়ে যাচ্ছে না। যে ব্যাভিচার করছে তার হার্ট এটাক হচ্ছে না। যারা হারাম খাচ্ছে তাদের পেটে ক্যান্সার হচ্ছে না। তারা হাসতে হাসতে হারাম খেয়ে যাচ্ছে।
তাদের প্রত্যেকের আল্লাহকে দরকার।
يَسْأَلُهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ
এবং আয়াতের পরের অংশ হচ্ছে –
كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
প্রত্যেকটি মুহূর্তে, প্রত্যেকটি দিন … ইয়াওম শব্দটার ব্যাবহার এখানে مسطلح لجميع الأوقات মুসতালাহ লি জামি’ইল আওকাত হিসেবে, অর্থাৎ সবসময়, সব দিন, সব মুহূর্তে, তিনি এমন কিছু করছেন যা একমাত্র তিনিই করতে পারেন। এবং এই সূরাতে কথাটা আসলে সাবধানবাণী বোঝায়নি, বরং খুব সুন্দর একটা ব্যাপার বুঝিয়েছে। আমি এটা দিয়েই শেষ করতে চাই।
يَسْأَلُهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ
كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
আমার কথা ধরুন, একজন শিক্ষক হিসেবে, ধরুন আমার ৫০ জন ছাত্র আছে। আমি তাদের পড়াচ্ছি, তখন একজন আমাকে একটা প্রশ্ন করলো, আরেকজন বললো তার একটু হেল্প লাগবে। আরেকজন বলছে তার একটা সমস্যা আছে। আরেকজন বলছে সে বুঝতে পারছে না। এমন করে পঞ্চাশজনের আমাকে প্রয়োজন পড়লো। এবং আমি প্রত্যেককে ৫ মিনিট করে দিলাম। তাহলে ৫০ জন ছাত্রকে কত মিনিট দিচ্ছি? ২৫০ মিনিট! আমি তো শেষ হয়ে যাব! এদের সবাইকে সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আর যদিও সম্ভব হতো, যদিও ৫ মিনিট করে দিতাম, প্রত্যেকে অভিযোগ করতো যে আমাকে মাত্র ৫ মিনিট দিয়েছে! কেউ সন্তুষ্ট হতো না। তাই না? আর তাঁদের সবার সব আবেদন আমার মনেও থাকবে না। আমি তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারবো না। কিছু উত্তর হয়তো আমি নিজেও জানব না। কিছু অনুরোধ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কোন ছাত্র যদি এসে বলে, আমাকে আপনার ৩ ঘণ্টা সময় দিতে হবে, আমি বলতে বাধ্য হবো, দুঃখিত আমি এতো সময় তোমাকে দিতে পারবো না। পারলে খুশি হতাম, কিন্তু আমার আরও অন্যান্য দায়িত্ব আছে।
যখন কারো অনেক দাবিদার থাকে, মানে অনেকগুলো মানুষ একসাথে তার থেকে অনেক বেশী কিছু আবদার করছে, তখন তার কী অবস্থা হয় জানেন? সে ভেঙে পড়ে। সে বলে, ‘আমি আর পারছি না এতো সব সামলাতে। আমার ছুটি দরকার। আমি চললাম।“
ক্রিসমাসের সেলের সময় দোকানের ম্যানেজারদের যেমন অবস্থা হয়। তারা তখন কারো সাথে কথা বলারও অবস্থায় থাকে না। কারো কাছে যদি আর্জির উপর আর্জি আসতে থাকে, সে আর কতক্ষণ মাথা ঠিক রাখতে পারবে? যেমন বাড়ির কর্তার অবস্থা হয় যখন তার দিকে সব দিক থেকে ডিমান্ড আসতে থাকে, সবসময় চাপের উপর থাকতে হয়। এমন অবস্থায় সে কারো চাহিদা পূরণ করতে পারবে এবং কারোটা পারবে না। যারা বেশী দামী মানুষ তাদেরটা শোনা হবে, এবং যারা তেমন জরুরী কেউ না তাঁদেরটা হবে না।
আর আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল? খেয়াল করুণ। কুল্লা ইয়াওমিন – প্রত্যেকটা মুহূর্তে তাঁর কাছে সবাই চাইতে থাকে। মুসলিম চায়, অমুসলিম চায়। অমুসলিম বাদ দিন, মুসলিমদের মধ্যেই যারা গুনাহগার, যারা প্রকাশ্যে, এমন কি গর্বের সাথে হারাম কাজ করে, যাদের মুখ থেকে আজেবাজে কথা বের হয়, যারা একে অপরের সাথে অন্যায় আচরণ করে। তারা খোলাখুলিভাবে পাপ করছে। কিন্তু তাদের হৃদপিণ্ড পরের স্পন্দনের জন্য আল্লাহর কাছে ঠিকই ভিক্ষা চাইছে, এবং আল্লাহ দিচ্ছেন। তাদের জন্যও আল্লাহ ফেরেশতা পাঠান, তাদের গাড়িকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যখন তারা শুক্রবার রাতে ক্লাবে যাচ্ছে। তাদেরও আল্লাহ সুরক্ষা দেন। তাদের সবাইকে আল্লাহ দেন। এবং আল্লাহ যা দেন তা একমাত্র তিনিই দিতে পারেন। এটাই শা’ন শব্দের অর্থ। এই শব্দটি আম্রুন ইয়াখতাসসু বি আহাদিন أمر يختص بأحد, অর্থাৎ এমন কাজ যা একজনই করতে পারে। যেমন ধরুন, আপনাদের অনেকে ব্যাবসা করেন, এবং সেখানে কিছু কাজ আছে যা শুধু আপনিই করতে পারেন, অন্য কাউকে সেই কাজের জন্য চাকরিতে রাখলে সে সব গুলিয়ে দিবে। তাকে কাজটা দিয়ে আপনি চলে গেছেন, এবং ফিরে এসে দেখছেন কিছু না কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তাই কাজটা শুধু আপনিই করতে পারেন। এটাকেই শা’ন বলে।
এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো শুধুমাত্র আল্লাহই করতে পারেন। আর কেউ পারে না। কেউ না। এবং যখন আপনি উপলব্ধি করবেন যে আল্লাহ আপনার জন্য এই কাজগুলো করেই যাচ্ছেন, সব সময়, সারাক্ষণ, তখন একটা খুব বোকার মতো প্রশ্ন আপনি কখনোই করবেন না, এই প্রশ্নটা শায়তান আপনার আমার মাথায় আনার চেষ্টা করে – ‘আমার যখন আল্লাহকে দরকার ছিল তখন তিনি কোথায় ছিলেন? যখন আমার ওই সমস্যাটা হয়েছিল তখন তিনি কোথায় ছিলেন? কেন তিনি আমাকে সেই সময় সাহায্য করেন নি?’ মানুষ এই ধরণের প্রশ্ন করে। তাই না? মাঝে মাঝে আপনার মনেও এমন প্রশ্ন আসে। আল্লাহ কোথায় ছিলেন? এবং আল্লাহর উত্তর হচ্ছে, আমি সবসময়ই ছিলাম ও আছি, এবং যখন তুমি এই প্রশ্নটা তোমার জিব দিয়ে উচ্চারণ করলে, তখন আমিই তোমার জিবকে সজীব রেখেছি।
এই প্রশ্নটা আমাদের স্বরযন্ত্র থেকে ধ্বনিত হলো, আমাদের ফুসফুসের থেকে বাতাসের সাথে বের হয়ে এলো, কীভাবে হলো এসব? আল্লাহই আমাদের শক্তি দিয়েছেন এটা করার। এবং এটাই কুল্লা ইয়াওমিন হুয়া ফি শা’ন – এর অর্থ।