আবু বকর (রা)

আমি আপনাদের ভাই ওমর সুলেইমান। সুপারস্টার সিরিজে স্বাগতম। ইনশা আল্লাহ, আজকে আমরা নবীদের পরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে জানবো, আর তিনি হলেন আবু বকর সিদ্দীক (রা)। আর এটা রাসূলের (স) নিজের করা একটি উক্তি থেকে প্রমাণীত। আবু বকরকে (রা) যদি লক্ষ্য করেন, আপনি দেখতে পাবেন যে তিনি যেন রাসূলের (স) অবিকল প্রতিচ্ছবি ছিলেন। তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন দানশীলতায়, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন শালীনতায়, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন নামাজ আদায়ে, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন কুরআন তিলাওয়াতে, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন সবকিছুতে। আর এ কারণেই আলী (রা) আবু বকর (রা) সম্পর্কে বলেছেন, ( كَانَ سَبَّاقََا لِكُلِّ خَيْرِِ ) । আপনি যে কোন ভাল কাজের কথাই চিন্তা করেন, আবু বকর (রা) ইতিমধ্যেই সেটা করে ফেলেছেন। কিন্তু যেটা আমাদের কাছে তাঁকে বিষ্ময়কর করে তোলে, তা হলো তিনি ছিলেন আস-সিদ্দীক। তিনি ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যার সত্যবাদীতার সাক্ষ্য রাসূল (স) নিজে দিয়েছিলেন। রাসূলের (স) সাক্ষ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। কেন ? কারণ, যখনই তিনি বলেছেন যে তিনি কোন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, যখনই তিনি বলেছেন যে তিনি রাসূলকে (স) বিশ্বাস করেন, তিনি হৃদয়ের গভীর থেকেই বলেছেন।

তাঁর কথা এবং বাস্তবতর মাঝে যেমন সামঞ্জস্য ছিলো, তেমনি মিল ছিলো কথা এবং কাজে – যখনই তিনি বলেছেন তিনি আল্লাহ এবং রাসূলকে (স) ভালোবাসেন। একারণেই আমরা দেখতে পাই, যখন তাঁর বন্ধু রাসূল (স) তাঁর কাছে এসে বললেন, আমি আল্লাহর নবী, আবু বকর (রা) সেদিনই ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং প্রভাবশালীদের মধ্যে অনেককেই ইসলামে নিয়ে আসলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন, তালহা, যুবাইর, উসমান (রা), আব্দুর রহমান ইবনে আউফ। তিনি ইসলামে নিয়ে আসলেন অর্ধেকেরও বেশী আশারা মুবাশশিরীন, যারা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জন সহাবী, যাদেরকে নিয়ে আমরা এই সিরিজে আলোচনা করছি। কিন্তু আজকে আসলেই যে বিষয়ে নজর দিতে চাই, তা হলো, রাসূলের (স) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে তাঁর সিদক, তাঁর সত্যবাদীতা।

ইনি সেই ব্যক্তি, যখন রাসূলকে (স) প্রকাশ্যে প্রহার করা হয়েছিলো, তিনি তখন চলে গিয়েছিলেন রাসূলকে (স) আড়াল করার জন্য, যদিও তিনি শারিরীকভাবে ততোটা সামর্থবান ছিলেন না। এবং এর ফলে এতটাই আঘাতের শিকার হয়েছিলেন যে অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁকে এতটাই প্রহার করা হলো যে তাঁর আপন মা চেহারা দেখে শনাক্ত করতে পারলেন না, প্রহারের দরুন মুখমন্ডল ফুলে ওঠার কারণে। কিন্তু যখনই জ্ঞান ফিরে পেলেন, নিজের স্বাস্থের কথা চিন্তা করেন নি; মোটেই অসচেতন ছিলেন না তিনি, যা করছিলেন সচেতনভাবেই করছিলেন, আর তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন। তিনি বললেন মুহাম্মাদ (স) কোথায় ? আমি নবিজীকে (স) দেখতে চাই। তাঁর মা খাবার খাওয়াতে চাইলেন, সাহায্য করারও চেষ্টা করলেন যাতে নিজের পায়ে ভর করে চলতে পারেন। তিনি বললেন, আমি দারুল আরকামে যেতে চাই। আমি রাসূলকে (স) দেখতে চাই তিনি ভালো আছেন এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। সুবহানাল্লাহ, দেখুন তাঁর ভালোবাসা কি প্রবল ছিলো নবিজীর (স) জন্য।

আবু বকর (রা) হলেন সেই ব্যক্তি যিনি হিজরতের সময় রাসূলের (স) সাথে ছিলেন। বিষয়টি একটু চিন্তা করুন। রাসুল (স) আবু বকরের (রা) বাড়ীতে আসলেন। এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে হিজরতে আবু বকরই (রা) হবেন তাঁর সঙ্গী । রাসূল (স) শুধুমাত্র মক্কারই মোস্ট ওয়ান্টেডই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন আশ – পাশের অঞ্চলেরও মোস্ট ওয়ান্টেড। তিনি সকলের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। আর রাসূল (স) আসলেন আবু বকরের (র) বাড়ী। তিনি বললেন, আমি চাই এই সফরে তুমি আমাকে সঙ্গ দিবে। এটা এমন কোন সফর না যে আমরা লিমোযিনে চড়ে দেহরক্ষী সাথে নিয়ে যাবো, কারণ আমি আল্লাহর রাসূল। আমরা মৃত্যু পরোয়ানা সাথে নিয়ে এই যাত্রা শুরু করবো। আর আবু বকর (রা) আনন্দের আতিশয্যে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। আয়েশা (রা) বলেন, আমি জানতাম যে, কোনো কোনো মানুষ আনন্দে কেঁদে ফেলতে পারে, কিন্তু আমার বাবাকে সেদিন দেখার আগে আমি আসলেই আনন্দ-অশ্রু কি, তা বুঝতে পারি নি। তখন আবু বকর (রা) কাঁদতে শুরু করলেন এবং রাসূলকে (স) জড়িয়ে ধরে বললেন, আস-সুহবা ইয়া রসূলাল্লাহ ! আমি আপনার সান্নিধ্য পাবো ! আস-সুহবা ইয়া রাসূলাল্লাহ ! তিনি এতটাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি রাসূলের (স) নৈকট্য পাবেন।

আর হিজরতের সময়ও, যখন আবু বকর (রা) ছিলেন রাসূলের (স) সাথে, কল্পনা করুন গুহার ভেতরের সেই মুহুর্তগুলো, কল্পনা করুন যখন শুধু তাঁরা দুজনেই গুহার মধ্যে ছিলেন। যে মুহুর্তগুলো সবচেয়ে ভীতিকর হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু সেই সময়টুকু আবু বকরের (রা) জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে রইলো। যখন রাসূলুল্লাহ (স) ঘুমিয়ে ছিলেন আর আবু বকর (রা) দেখছিলেন একটি বিচ্ছু গুহার মধ্যে প্রবেশ করছে, আবু বকর (রা) তাঁর পা দিয়ে সেই গর্তটিকে বন্ধ করে দিলেন, তখন বিছাটি বের হওয়ার চেষ্টায় কামড়ের পর কামড় দিয়ে তাঁর পায়ে ছিদ্র করে চলছিলো, কিন্তু রাসূলের (স) ঘুম ভেঙে যাক, এটা তিনি পছন্দ করলেন না; এমনকি অনবরত বিছার কামড় সহ্য করেও আবু বকর (রা) সামান্যতম কাঁপলেনও না, বরং তার চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা অ‍শ্রু রাসূলের (স) পবিত্র চেহারায় এসে পড়লো। আর রাসূল (স) শুধুমাত্র আবু বকরের (রা) চোখের পানির স্পর্শেই জেগে উঠলেন।

আর হিজরতের সময়ও যখন তাঁদের যাত্রাপথে উম্মে মাবদের (রা) বাড়িতে পৌছুলেন, ঐ অবস্থায় তাঁদেরকে কয়েকদিন যাবৎ অনাহারে কাটাতে হয়েছিলো, এবং অবশেষে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তাঁরা দুজনেই কিছু দুধ পান করার সুযোগ পেলেন। তখন আবু বকর (রা) বললেন, (فَشَرِبَ الحَبِيْبُ) আমার প্রিয়তম পান করলেন, (حَتَّى ارْتَوَيْتُ) এতেই আমার তৃষ্ণা মিটে গেলো। শুধুমাত্র এ দৃশ্য দেখে যে, রাসূল (স) পান করছেন ! রাসূলের (স) প্রতি আবু বকরের (রা) ভালোবাসা এতই প্রবল-প্রগাঢ় ছিলো যে সে ভালোবাসা মানবীয় প্রেমের সকল সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। …..

আর এ কারণেই রাসূল (স) সবসময় আবু বকরের (রা) প্রশংসা করেছেন। এমনকি তাঁর (স) জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি মসজিদে দাঁড়ালেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য, যা ছিলো শেষ বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটি, আবু বকর (রা) বুঝতে পারলেন যে, ঐ বক্তব্যে রাসূলের (স) আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত রয়েছে। আবু বকর (রা) কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর রাসল (স) বললেন, …. অন্য সকল সাহাবাদের জন্য নিমীর্ত মসজিদের সকল দরজা বন্ধ করে দাও, শুধু আবু বকরের (রা) দরজাটি ছাড়া। অন্য সকলেকে তাদের অবদানের প্রতিদান আমরা দিতে পেরেছি, কিন্তু কখনোই আমি আবু বকরের (রা) প্রতিদান দিতে পারি নি। আমি তার প্রতিদান দিতে পারি নি। সুবহানাল্লাহ, কল্পনা করুন, রাসুল (স) বলছেন, আমি কখনোই তার প্রতিদান দিতে পারি নি। কারণ, আবু বকর (রা) আসলেই রাসুলকে (স) ভালোবেসেছেন; ভালোবেসেছেন তাঁর নিজের জীবনের চেয়েও বেশী। এতো বেশী ভালোবেসেছেন যে, আপনারা জানেন আবু বকর (রা) তাঁর বাবা আবু কুহাফাকে ইসলামে নিয়ে আসার জন্য কতোটা চেষ্টা করেছেন, অবশেষে আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করলেন। এই দিনটি হওয়ার কথা ছিলো আবু বকরের (রা) জীবনের সবচেয়ে অনন্দময় দিন, অথচ তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন কাঁদছেন ? তিনি বললেন, কারণ, আমার মনে পড়ছে আমার প্রিয়তমোর (স) কথা, তাঁর চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর সময়, রাসূল (স) কতো ব্যাকূলভাবে চাইছিলেন যেন আবু তালেব ইসলাম গ্রহণ করেন, কিন্তু আবু তালেব ইসলাম গ্রহণ করলেন না। আর রাসূল (স) এজন্য কতোটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ! তিনি বললেন, আমার ইচ্ছা হয়, আমার বদলে আনন্দঘন এ মুহুর্তগুলো যদি রাসুলকে (স) এনে দিতে পারতাম !

সুবহানাল্লাহ, আবু বকর (রা) এতটাই ভালোবেসেছেন রাসূলকে (স), যে রকম ভালোবাসা আমাদের হৃদয়েও লালন করা উচিৎ । এ বিষয়টা সামনে রেখে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, কতোটা ভালোবাসেন আপনি মুহাম্মাদ (স) কে ? কারণ একমাত্র এই ভালোবাসার কারণেই আপনি শেষ বিচারের দিনে তাঁর একান্ত নৈকট্য পেতে পারেন। তাঁর ভালোবাসা, তাঁর অনুসরণ। সুবহানাল্লাহ, কতোটা আকুলভাবে আপনি তাঁর মত বাঁচতে চান, আর কতটা আকুলভাবে আপনি তাঁর মতো মরতে চান ? আবু বকর (রা) তাঁর ৬৩ বছর বয়সে এক সোমবার দিনে উপলব্ধি করলেন যে তিনি জ্বরে আক্রান্ত এবং বুঝতে পারলেন যে, তিনি মারা যাচ্ছেন একই দিনে যেদিন রাসূল (স) মারা গেছেন, একই বয়সে যে বয়সে রাসূল (স) মৃত্যুবরণ করেছেন । আর তিনি অনুরোধ করলেন তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে যাতে রাসূলের (স) মতো একই রকম কাপড়ে তাঁকেও কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। আর এটা নির্ধারিত হয়ে রইলো যে, যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে, আবু বকর (রা) রাসূলের (স) ঠিক পাশেই শায়িত থাকবেন, এবং তাঁর মাথা ঠিক রাসূলের (স) কাঁধ বরাবর, যেন তিনি এখনো পরম নির্ভরতায় রাসূলের (স) কাঁধে মাথা রেখে আছেন, যেমনটি ছিলেন জীবিত অবস্থায়।

আর এটা আমাদেরকে এই চমৎকার হাদীসটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন এক ব্যক্তি জান্নাতে রাসূলের (স) সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করলেন। রাসূল (স) বলেন, তুমি কি প্রস্তুতি নিয়েছো ? তিনি বলেন, আমি তেমন বেশী নামাজ এবং রোজা প্রস্তুতি হিসেবে নিতে পারিনি। প্রস্তুতি হিসেবে একমাত্র যে জিনিসটি আমার রয়েছে, তা হলো, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনাকে আমি ভালোবাসি ইয়া রসূলাল্লাহ ! আর রাসূল (স) বলেন, ( سَتَكُوْنُ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ) তাঁর সাথেই তুমি থাকবে যাকে তুমি ভালোবাসো। আপনি কতটুকু ভালোবাসেন রাসূলকে (স) ? কতটুকু ভালোবাসেন আপনি আল্লাহকে ? এই ভালোবাসা ছাড়া আমরা জান্নাতুল ফিরদাউসের সেই সুউচ্চ স্থান, বেহেশতের সেই সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করতে পারবো না। সেজন্য আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে সেই সততা এবং আন্তরিকতা দান করেন যখন আমরা বলি, আমি আল্লাহকে ভালোবাসি এবং আমি রাসূলুল্লাহকে (স) ভালোবাসি। এবং আরো প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে রাসূল (স) এবং তাঁর সাহাবীদের সাথে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে মিলিয়ে দেন! আল্লাহুম্মা আমীন।