আমাদের জীবনের কয়েকটি পর্যায় (২য় পর্ব)

এক সময় আপনি কলেজে ভর্তি হন। হাইস্কুল জীবন শেষ, এখন আপনি কলেজে বা ভার্সিটিতে। কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রদের দিকে তাকালে অনেক সময় ‘বাস্তুহারা’ মানুষদের মত মনে হয়। চুলগুলো এলোমেলো, দাঁত ব্রাশ করে না, কোনো রকম একটা গ্যাঞ্জি এবং পেন্ট পরে ক্লাসে হাজির হয়; বিছানা থেকে উঠেই ক্লাসে এসে হাজির হয়। এসব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের মাথায় সব সময় একটা চিন্তা কাজ করে কখন পাশ করবো। খুব সিরিয়াস ছাত্ররা এভাবে চিন্তা করে। তাদের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার বিষয় হলো – জি পি এ, ইন্টার্নশিপ ইত্যাদি। কেন তারা এভাবে চিন্তা করে? কারণ নতুন একটি আকাঙ্খার আবির্ভাব ঘটেছে।

আর আমি বলছি না যে পূর্বের আকাংখাগুলো হারিয়ে গেছে। পূর্বের আকাংখাগুলো কী ছিল, ক্রমানুসারে কি বলতে পারবেন? এক নাম্বার – খেলা করা। দুই নাম্বারটা কী ছিল? বিনোদন। তিন নাম্বারটা কী ছিল? সৌন্দর্য্য। এখন শুনুন চার নাম্বারটা – ‘ভাব দেখানো’ – وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ – পারস্পরিক অহমিকা। আপনার মূল্য অন্যের কাছে উপস্থাপন করতে চান।
কেউ হয়তো এসে আপনাকে জিজ্ঞেস করছে যে, সমাবেশের জায়গাটা কোন দিকে?
আপনি তখন এভাবে বলেন – হ্যাঁ, আমি NYU তে পড়ি।
– আমি শুধু ডিরেকশন টি জানতে চাচ্ছি।
– আমি আসলে মেডিক্যাল কলেজে পড়ি।
হা, হা, হা। আপনার মেডিক্যাল কলেজে পড়া নিয়ে কেউ কেয়ার করে না।

আপনি হয়তো ওয়ালমার্ট বা কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন, আর তারা আপনাকে একটি ব্যাজ দিয়েছে। আপনি এটা জামার উপর সব সময় ঝুলিয়ে রাখেন। এমনভাবে রাখেন যেন মানুষ দেখতে পায়।
— ”ও, তুমি ওখানে চাকরি পেয়েছো?”
— “হ্যাঁ, তারা আমাকে পার্কিং লটেও জায়গা দিয়েছে। এই যে আমি তার ছবি তুলে রেখেছি, দেখুন।”

এভাবে আপনার ভেতরে এক ধরণের গর্ববোধ কাজ করে, আপনি মানুষকে দেখতে চান যে কি অর্জন করেছেন। যখন লোকজন ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়, তখন তারা কী পায়? সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেট কি তারা ড্রয়ারে রেখে দেয় নাকি ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে? একটি ফ্রেমে আটকিয়ে ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। এটা আপনার গর্ব। আপনি মানুষকে দেখতে চান জীবনে কি অর্জন করেছেন। মানুষ বিখ্যাত কারো সাথে ছবি তুললে অন্যদের সেটা দেখতে চায়। “দেখো দেখো আমি কার সাথে।”

সত্যি বলছি, এই কনভেনশনে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে স্ট্যাচুর মত মনে হয়। মানুষ এসে এভাবে বলে – “ভাই এদিকে আসেন, আপনার সাথে আমার একটি ছবি তুলতে হবে।” লোকটা এমনকি সালাম ও দেয় না, (রাগতস্বরে বলে) আমার একটি ছবি তুলতে হবে। আমি ও ভয় পেয়ে যাই, আর বলি – ঠিকাছে, ঠিকাছে ছবি তুলুন, আমাকে আবার মারতে যাবেন না। হা, হা, হা।

যাইহোক, জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনি মানুষকে দেখতে চান আপনি কোন নামকরা ভার্সিটিতে পড়েন, কোন জায়গা থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছেন, কি চাকরি করছেন, আপনার প্রথম এপার্টমেন্ট, প্রথম গাড়ি… ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকে গাড়ি কিনে মানুষকে দেখানোর জন্য। আপনার ভেতরে একটা অদম্য ইচ্ছা কাজ করে। আল্লাহ আমাদের ভেতরে এটা দিয়েছেন। বিশেষ করে তরুণরা, তারা যখন পরিবারের ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বের হয়ে বৃহৎ পৃথিবীতে বিচরণ শুরু করে, তারা সবাইকে দেখাতে চায় যে, তারা এখন বড় হয়ে গেছে এবং নিজের মত করে জীবন যাপন করছে।

তাদের আলোচনায় এপার্টমেন্টের ব্যাপারটি চলে আসে, কেউ যদি জিজ্ঞেস না করে, তবুও। কারণ তারা আসলেই গর্বিত যে এখন তারা নিজেদের মত করে বসবাস করছে। অথবা, তারা খুবই গর্বিত যে তারা জীবনের প্রথম গাড়িটি কিনেছে। তাদের কথাবার্তায় বার বার এই গাড়ির ব্যাপারটি উঠে আসে, যদিও কেউ এ বিষয়ে আগ্রহী নয়। সুতরাং এই ‘তাফাখুরুম বাইনাকুম’ এখন জীবনের পর্যায়গুলোর মাঝে যুক্ত হয়েছে। আপনি এখনো গেইমস পছন্দ করেন, বিনোদন পছন্দ করেন, নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আপনি এখনো খুব সচেতন থাকেন এবং অন্যদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে চান। তারউপর, এখন আপনি নিজের কৃতিত্বও অন্যের কাছে জাহির করতে চান। এই পর্যায়টিও এক সময় গত হয়ে যায়।

আপনি বিয়ে করেন, সন্তানসন্ততি জন্ম লাভ করে…… এখানে কত জনের বাচ্চাকাচ্চা আছে? তাহলে আপনারা জানেন, আমি কী নিয়ে কথা বলছি? এখন আপনার সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা আপনার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সারাক্ষণ এটা নিয়েই চিন্তিত থাকেন। তাদের কী প্রয়োজন, আমাদের আগামীকালের নাস্তার জন্য সদাই কিনেছি কি? স্কুলের ইউনিফর্ম কি রেডি আছে? গ্রীষ্মকালীন ছুটি কখন শুরু হবে? এই ছোট্ট এপার্টমেন্টে আমরা আর থাকতে পারছি না, আমাদের বড় কোন বাসায় উঠতে হবে, কারণ এতজন ছেলেমেয়ের জন্য এখানে আর জায়গা হচ্ছে না। জামাকাপড়, প্রতিনিয়ত জুতার সাইজ বড় হয়ে যাচ্ছে, বড় বোনের ব্যবহৃত পিঙ্ক কালারের জুতা ছোটবোন ব্যবহার করতে চায় না …ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাই আপনাকে এখন নতুন জুতা কিনতে হবে।

ফলে এখন আপনি টাকা উপার্জন নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকেন। আপনার নিজের জন্য এবং ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য সেভিংস নিয়ে আপনি সর্বদা চিন্তামগ্ন থাকেন। আপনার মোবাইলের অ্যাপ থেকে প্রতি কয়েক ঘণ্টা পর পর অ্যাকাউন্ট চেক করতে থাকেন। ”টাকাগুলো কি এখনো আছে? আবার চেক করে দেখি, আচ্ছা এখনো আছে। হায়! হায়! গ্যাস কোম্পানি অটোম্যাটিক ভাবে বিল কেটে নিয়ে গেছে।’’ আর এভাবে যতবার অ্যাকাউন্ট এ মাইনাস দেখেন, আপনার অন্তর পুড়ে যায়। আপনি বুকে হাত দিয়ে এমন করেন, আহ!

আল্লাহ বলেন – وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ – “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র।” প্রসঙ্গত, আপনি যখন জীবনের এই পর্যায়ে আসবেন যে সময় আপনি টাকা পয়সা উপার্জন, সেভিংস, অবসর প্ল্যান ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন অথবা আপনার ছেলেমেয়েদের কলেজের খরচ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তরুণরা যারা এখনো জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে আছেন – আর প্রাথমিক পর্যায়গুলো কি কি? খেলাধুলা, বিনোদন, সৌন্দর্য্য – তাদেরকে আপনি যদি টাকা জমানো নিয়ে প্রশ্ন করেন,
তারা বলে – ” আমি সেভিংস নিয়ে কোনো পরোয়া করি না। আপনি কিসব নিয়ে কথা বলছেন? আমি কখনোই আমার বাবা মায়ের মত হবো না। আমি বাসা-বাড়ি নিয়ে কেয়ার করি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ”
ওকে, ২০ বছর পর আমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করবেন। আপনিও সেই একই পথের মধ্য দিয়ে যাবেন, আপনার পূর্বে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ একই কালচক্রের মধ্য দিয়ে গত হয়েছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যেসব জিনিস আমাদের সুখী করবে বলে আমরা মনে করি, তার একটি সারাংশ আল্লাহ এই আয়াতে তুলে ধরেছেন, এই যে এইসবের পেছনে তোমরা ছুটে চলো। একজন শিশু মনে করে সে সুখী হবে যখন সে খেলাধুলা করে, আরেকটু বড় হলে মনে করে বিনোদন পেলে সুখী হবে, আরেকটু বড় হলে মনে করে নিজেকে সুন্দর দেখালে, সুন্দর কিছু পেলে অথবা সুন্দর কিছুর পাশে থাকলে সে সুখী হবে। আরেকটু বড় হলে মনে করে কিছু একটা করে দেখাতে পারলে নিজেকে সুখী মনে হবে, তারপর আরো বড় হলে মনে করে অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করতে পারলে সুখী হবে।

সারা দুনিয়ার মানুষ তারা যে ধর্মের অনুসারীই হউক না কেন, যখন কেউ কোনো বাড়ি ক্রয় করতে পারে তখন মনে করে যে আমি জীবনে কিছু একটা অর্জন করতে পেরেছি। যদি না পারে, তখন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী চাও? তখন বলবে, ইস! আমি যদি কোনো সম্পদ অর্জন করতে পারতাম! তারা ভাড়া বাসায় বাস করে। তারপর সুন্দর কোনো বাড়ির সামনে দিয়ে ড্রাইভিং করে যাওয়ার সময় – এমনকি এটা যদি ছোট বাড়িও হয় – তাদের চোখের পলক পড়ে না। মনে মনে ভাবে – ইশ! যদি এরকম একটি বাড়ির মালিক হতে পারতাম! ব্যাপারটা খুব সুন্দর হতো।

আপনি নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেন না। রিয়েল এস্টেট ওয়েব সাইটে গিয়ে বিভিন্ন বাড়ির সুন্দর সুন্দর ফটোগুলো দেখতে থাকেন। আপনি হয়তো ভাবছেন তিন চার বছর পর অন্য শহরে চলে যাবেন, কিন্তু আপনি এখন থেকেই ঐ শহরের বিভিন্ন বাড়ির ছবি দেখতে শুরু করেন। বউকে ডেকে বলেন – দেখো, দেখো, এই বাড়ির বেড রুমটা দেখো, বাড়ির বাইরের অংশটা দেখো। আর আপনি নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেন না। আল্লাহ আমাদের ভেতরে এটা দিয়েছেন। এটা হলো আয়াতের অর্ধেক। ব্যাপারটা ভালো, কারণ আমিও আমার নির্ধারিত সময়ের অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছেছি। এটা হলো আয়াতের অর্ধাংশ, এই দুনিয়ায় আমি আপনি যেসবকিছুর পেছনে ছুটে চলি এই অর্ধাংশে আল্লাহ তার একটি সারাংশ তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয় অংশে আল্লাহ এই বিষয়গুলোকে একটা কিছুর সাথে তুলনা করেছেন। আমি আশা করছি আপনারা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আমি জানি সাউন্ড সিস্টেম এ প্রচুর প্রতিধ্বনি শুনা যাচ্ছে। আমি আশা করছি আপনারা শেষ অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, কারণ সুখের সন্ধানে ছুটে চলা এই বিষয়গুলোর জন্য এই অংশেই রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত বা পথনির্দেশনা।

ইনশাআল্লাহ চলবে ….

[যে আয়াতটি এখানে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তার বঙ্গানুবাদ: “তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া, কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।” (৫৭-২০)]