”বস্তুতঃ আমি সাগর পার করে দিয়েছি বনী-ইসরাঈলদিগকে। তখন তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে পৌছাল, যারা স্বহস্তনির্মিত মূর্তিপুজায় নিয়োজিত ছিল। তারা বলতে লাগল, হে মূসা; আমাদের উপাসনার জন্যও তাদের মূর্তির মতই একটি মূর্তি নির্মাণ করে দিন। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে বড়ই অজ্ঞতা রয়েছে।”। (সুরা আল-আরাফঃ ১৩৮)
মূসা (আঃ), যিনি একজন মহান রাসুল ছিলেন, তাকে আল্লাহ দুইটি জাতির কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।এক হলো মিশরের ফারাওদের কাছে এবং তাদের প্রজন্মদের জন্য এবং একই সময় উনি যেখানে জন্মেছিলেন, সেখানের লোকদেরও পথ দেখাবার দায়িত্ব ছিল তাঁর, অর্থাৎ বনী ইসরাইলীদেরকে।তাঁর জীবনের প্রথমভাগ ছিলো মিশরে এবং পরবর্তীভাগ ছিল:যখন তাঁরা আল্লাহ্র সাহায্যে মিশর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
একসময় তারা পানিপথ পার হলেন। আজকের যেই আয়াত আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করতে চাই, তা হলো: পানিপথ পার হওয়ার পরের ঘটনা। আমার মনে হয় সেটি খুবই জরুরী এবং আমাদের এখনকার সময়ের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপুর্ণ। তো আল্লাহ্ বলেন,
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ
আমি বনী ইসরাঈলদের পানি পার করালাম।
فَأَتَوْا عَلَىٰ قَوْمٍ يَعْكُفُونَ عَلَىٰ أَصْنَامٍ لَّهُمْ
ওরা এখন সিনাঈ মরুভূমিতে এবং এখন তারা এমন এক জাতির কাছে এসে পৌঁছালো, যারা তাদের মূর্তিগুলোর সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে বসে ছিলো।
একটু ভেবে দেখুন: আমরা যখন প্রার্থনা করি, যখন নামাজ পড়ি, তখন আমরা খুবই অমনোযোগী হয়ে পড়ি। আমরা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ি। আমরা বেশিরভাগই যখন প্রার্থনা করি, এমনকি সবচেয়ে ছোট সুরাটাও,যেমন, ইন্না আ’ত্বাইনাকা-ল কাওসার—এটা পড়ার সময়ও আমরা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ি। আর রোজার সময়, ক্বারী যখন পুরো এক পারা তেলাওয়াত করছেন, সেকথা না হয় না-ই বললাম, আমরা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ভাবি, “রুকুতে যাবো কখন?” আমরা সেটাই বার বার চিন্তা করতে থাকি। কিন্তু আপনি দেখবেন, অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা,বিশেষত যেসব ধর্মে অনেক ছবির ব্যবহার রয়েছে,দেখবেন: যিশুর মূর্তির পেছনে মানুষ এক ঘন্টা ধরে বসে আছে।
তারা একটা গির্জায় কোনো এক মূর্তির দিকে অপলক তাকিয়ে আছে,আবার অনেকে অনেক লম্বা সময় ধরে ধ্যানে বসে থাকতে পারে।আপনি জানেন, মানুষ অনেক দীর্ঘ সময় ধরে যোগ ব্যায়াম করতে পারে,আর আপনার তখন মনে হয়, “এদের কী গভীর মনোযোগ!”অথচ, যখন মুসলমানরা প্রার্থনা করে, তাদের কোনো মনোযোগ নেই। যদিও আমরা খুব চেষ্টা করি মনোযোগ দিতে, কিন্তু আমরা পারি না। এখন বনী ইসরাইলীরা এমন এক জাতিকে পেলো যারা যে শুধু মূর্তি পুজাই করছে, তা নয়,তারা দেখলো: ওরা তাদের মূর্তিদের সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে বসে আছে। “ওরা ওদের মূর্তির সামনে সবকিছু ভুলে পূর্ণ একাগ্রতায় বসে আছে।” এটা দেখে বনী ইসরাইলিরা ভাবছে, ‘এরা নিশ্চয়ই কিছু একটা জানে! আমার মনে হয় ওরা যা করছে, এর কোনো একটা উপকার তো আছেই। আমার মনে হয় আমাদেরও মনোযোগ বাড়াতে ওদের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিৎ। যদিও আমরা এক ঈশ্বর এ বিশ্বাস করি।’ তারা মূসা (আঃ)-কে বলল,
قَالُوا يَا مُوسَى اجْعَل لَّنَا إِلَٰهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ
“আপনি ওদের প্রভুর মতো আমাদের জন্যও একটা প্রভু বানিয়ে দিন”।
দেখুন,ওরা কীরকম মনোযোগ দিতে পারছে?” সত্যি বলতে কী, এর পিছনে আসল রহস্য হল: শয়তান চায় ঐ মানুষগুলো যাতে তাদের শিরকে মনোযোগ দিতে পারে। তাই শয়তান ওদের ছেড়ে দেয় আর শয়তান চায় না আপনি আল্লাহ্র প্রতি একাগ্র হন, তাই সে ক্রমাগত আপনার মনযোগ-এ বাঁধা দেয়।আপনার ক্রমাগত অমনোযোগী হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে,শয়তান আপনার কাজে বিরক্ত, তাই আপনি অনবরত তার (ওয়াস-ওয়াসা) প্ররোচণা শুনতে পান। কিন্তু যারা শিরক করছে, তারা গভীর মনোযোগ দিতে পারে,এমন কী ঘন্টার পর ঘণ্টা, কোনো সমস্যা ছাড়াই। শয়তান তাদের মনযোগ-এ বাঁধা দেবে না। শয়তান যা চায়, তারা এক্কেবারে ঠিক সেই কাজটিই করছে।
আর আপনি বাইরে থেকে ব্যাপারটা দেখে ভাবেন, “দেখ! ওরা কত গভীর মনযোগী, আর আমাদের কোনো মনযোগ নেই”আপনি ভাবতে থাকেন যে, “আমাদের ও বোধহয় ওদের কিছু আচার ব্যবহার গ্রহণ করা উচিৎ” আমার মনে হয়, এই আয়াতের সাথে আমাদের কিছু মিল আছে। কেন? এই আয়াতের সাথে আমাদের মিল আছে কারণ, আজকাল আমরা প্রায়ই ভাবি, “ইসলাম আজকের যুগের অবস্থার সাথে কীভাবে মানিয়ে চলতে পারে?” —তাই না? পৃথিবী বদলে গিয়েছে। ১৪০০ বছর আগে মরুভূমিতে ইসলাম যা ছিলো, এখন তা নেই। প্রযুক্তি বদলে গিয়েছে। সমাজ বদলেছে। ভাষা বদলেছে। আমাদের আশপাশের সবকিছু বদলে গিয়েছে।
আমাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে।তো ইসলাম কেন বদলাতে পারে না? আমরা আমাদের আশপাশে ঘটনাগুলো দেখি, আর ভাবি, মনে হয় আমাদের বর্তমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ইসলামের কিছু রীতিনীতি পরিবর্তন করা উচিৎ”। আমি এটা বলছি, কারণ যখন আমাদের আধ্যাত্মিকতার কথা আসে,বিশেষ করে, যখন আমাদের প্রার্থনার কথা আসে, যখন আমাদের সাথে আল্লাহ্র সম্পর্কের কথা আসে,সেটাতে কোনো পরিমার্জন সম্ভব নয়। আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কের সবচেয়ে সেরা উপায় আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে যখন আইন প্রয়োগের কথা আসে, যখন ইসলামিক অনুশাষনের কথা আসে, আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে বোঝার জন্য যে,কোনটার অনুমোদন আছে, কোনটা নিষিদ্ধ —সেটা বিজ্ঞ আলেমদের চর্চার বিষয়, যেহেতু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।
যেন তারা আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানাতে পারেন এটা সুনিশ্চিতভাবে নিষিদ্ধ, বা এটা নিষিদ্ধ নয়। কারণ আমরা এমন পরিস্থিতিতে আছি, যা আগে ছিলো না। তাই আমাদের অবশ্যই কিছু ইজতিহাদ এর প্রয়োজন আছে।
কিন্তু এই আয়াত আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। আধ্যাত্মিকতার পরিমার্জন হবে না। আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়, রাসূলাল্লাহ্ (সাঃ)-কে যা দেয়া হয়েছে, তার(সাঃ) মাধ্যমে ইতোমধ্যেই সেটা অর্জিত হয়েছে। আল্লাহর সাথে ভালো সম্পর্ক করার জন্য নামাজের চেয়ে ভাল কিছু আসবে না। তাই আমরা যখন এই আধুনিক বিশ্বে দেখি মানুষ কোনো কন্সার্টে গিয়ে আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্তে পৌঁছে যায়, কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনে আর বলে, “আমার মনে হয়, আমি যখন গান শুনি, তখন আমি একটা কানেকশন অনুভব করি”। বলে, “কুর’আন আমি ঠিক বুঝি না। এর বদলে যদি মিউজিক থাকতো” বলে রাখা ভালো, এই ভিডিওটি মিউজিক বিষয়ক কোনো ফতোয়া নয়।
এই ভিডিওটি হলো: কখন আমরা বিকল্প খুঁজতে শুরু করি —সে বিষয়ে। বনী ইসরাইলিরা বিকল্প খুঁজছিল। বলেছিল, “এটা আমাদের বেশি কাজে লাগবে। এদেরকে দেখো। এরা এমন একটা কিছু বের করেছে, যেটা তাদের বেশি কাজে লাগে”। এবং মূসা (আঃ) এর উত্তর ছিলো খুব সুন্দর। উনি বললেন,
إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ
তোমরা; তোমরা এমন এক দল মানুষে পরিণত হয়েছো, যারা তাদের কামনা, আবেগের দাস হয়ে গেছে।
ওগুলো সত্যি সত্যিই চিরন্তন।
এবং যদিও অন্য কোনো রেওয়াজ রীতি বা অন্য কোন সামাজিক আচার আপনার আকর্ষণীয় লাগতে পারে, কিন্তু যদি সেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়,ওটা হবে অনর্থক এটা বলার মতো যে,“আমাদের বোধহয় আমাদের ধর্মকে আধুনিক করা দরকার, যাতে এটা আরো ভালোভাবে খাপ খায়”।
অনেক আগে একজনের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো যে বলেছিলো, “আমি দেখেছি আমি যখন বসে প্রার্থনা করি, তখন আমি অনেক বেশি মনযোগ দিতে পারি কারণ আমি আগে চার্চে যেতাম এবং আমি দুই ঘন্টা ধরে ধর্মীয় কথা শুনতাম এবং খুবই ভালো লাগতো।” “তো আমার মনে হয় আমাদের মসজিদে চেয়ার রাখা উচিৎ, যেন সবাই বসতে পারে এবং আমাদের একটা মঞ্চ থাকা উচিৎ”।
এরপরে হয়তো বলা হবে, “আমাদের একটা বিশাল অর্গান এবং পিয়ানো ও থাকা দরকার” “কারণ জানো তো পাশাপাশি গানটা থাকলে আরো ভালো হয়।” “কারণ জানো তো” একটার পর একটা আসতে থাকবে। “এবং জানো এই যে নামাজ, উঠ-বস ব্যায়াম, আমি এর ঠিক কোনো মানে খুঁজে পাই না। “আমাদের শুধু ওসব শুনলেই হয় এবং আমরা যদি শুধু ইংরেজীতে নামাজ পড়ি সেটা আরো ভালো হয়।” “সেটাই তো যথেষ্ট তাই না?” —আমরা এভাবে বলতেই থাকবো, “এভাবে করলে সুবিধা হয়, এটা করলে ভালো, এতেই সুবিধা।” আর আপনি টের পাওয়ার আগেই দেখবেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে যা দেয়া হয়েছিলো, এটা আর সেই ইসলাম-ই নয়। কিছু কিছু জিনিষ আছে যা সর্বকালীন, যা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতিতে টিকেছে, এবং এই সমাজে না টেকার আদৌ কোনো কারণ নেই। যেই মুহূর্তে আমরা ভাবতে থাকবো, “না, না, আমাদের পরিস্থিতি আলাদা।” “আমরা একদম ভিন্ন রকম আধুনিক অবস্থানে আছি, যা সবকিছু নতুন করে ভাবার দাবী রাখে”। দয়া করে এটা বলবেন না। সব প্রজন্ম এভাবেই ভাবে। আমাদের আগের প্রতিটি প্রজন্ম এভাবে ভেবেছে।
ইসলামের ৮০০ বছর পর পৃথিবী পুরো অন্যরকম ছিলো, আর এখন ইসলাম আসার ১৪০০, ১৫০০ সাল পরবর্তী অবস্থা। তাই আমাদের এভাবে ভাবা উচিৎ নয়। আমি প্রার্থনা করি আমরা যাতে আমাদের ধর্মের চিরন্তন, নিখুঁত দিকটা দেখতে পাই এবং মূল্যায়ণ করতে পারি এবং আমরা যাতে বণী ইস্রাঈলের এই মানুষদের মতো না হই যারা মূসা (আঃ) এর কাছে এসে বলেছিলো, “শুনছো, তুমি কি আমাদের ধর্মকে আমাদের জন্য একটু সংশোধন করে দিতে পারো কারণ।” আমরা অন্য কিছু আচার-আচরণ দেখছি, যাতে আমরা অনেক বেশি মুগ্ধ?” সুবহান আল্লাহ্! আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে আমাদের ধর্মের আসল এবং চিরন্তন শিক্ষা গ্রহণের একাগ্রতা দান করুন।
বারাকআল্লাহু লি ওয়ালাকুম। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।