যখন ইগো-ই মুল সমস্যা। #ইগো কোথা থেকে আসে?
আপনার মধ্যে ইগো তখনই জন্মায় যখন আপনি প্রকৃতভাবে আল্লাহর মাহাত্ম্যকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। তখন আপনি আল্লাহকে প্রশংসা করার স্থানে নিজের ব্যাপারে উচ্চধারনা পোষণ করতে শুরু করেন। তখনই এটা শুরু হয়; এটাই এই সমস্যার ভিত্তি গড়ে দেয়। তাই প্রথম যে পয়েন্টটা আমি বলবো ইনশাআল্লাহ তা হল অনেক মানুষই ধর্মের বেশ ধরে থাকে। তাদেরকে দেখে ধার্মিক মনে হয়, তারা ধর্মীয় কথা বলে, তাদের জ্ঞানও আছে। আল্লাহ যেন আমাদের এ থেকে রক্ষা করেন। এটা খুবই গুরুতর সমস্যা। এদেরকে যে মানুষটার দাড়ি নেই তাঁর থেকে বেশী প্র্যাকটিসিং মনে হয়। অনেক বোনদের যেসব বোনেরা হিজাব পালন করেন না তাদের তুলনায় বেশী আল্লাহভীরু মনে হতে পারে। তাদেরকে বাইরে থেকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে ইগো আছে। আপনার ভেতরে অন্যের সামনে নিজেকে মহানরূপে উপস্থাপন করার তাড়না কাজ করে। আপনার মনে হয় যে আপনি বেশী ধার্মিক, বেশী যোগ্য, আপনি অন্যদের থেকে ভালো অবস্থানে আছেন। আর আপনি যদি মনের ভেতর আরেকজন মুসলিমকে ছোট করে দেখেন তাঁর অবস্থা যেমনই হোক না কেন, তাহলে আপনার হৃদয়ে যে জিনিসটা বাসা বেধেছে তা হল ‘কিবর’। অহংকার। আর আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপদেশ থেকে জানতে পারি যে, যাদের হৃদয়ে সরিষাদানার সমান, অর্থাৎ বলতে গেলে কিছুই না, এমন অণু পরিমাণ অহংকার থাকে তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খোলা নেই।
তাই আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, ধরুন একজন মুসলিম খারাপ কাজ করে। হয়তো সে মদ্যপান করে বা যেকোনো ধরনের খারাপ কাজ করে। তাঁর কুকর্মগুলো বাহ্যিক, চোখে দেখা যায়। কিন্তু আপনার খারাপ কাজটা কোথায় ঘটছে? অন্তরের মধ্যে। বাইরে থেকে আপনাকে দেখতে ভালোই লাগে। মনে হয় যে আপনি ঠিকঠাকই আছেন। নিঃসন্দেহে সেই লোকটা তাঁর খারাপ কাজগুলোর কারণে শাস্তিযোগ্য। আপনার খারাপ কাজটাও কি নয়? আর যদিও কেউ তাঁর কাজগুলোকে উপেক্ষা করছে না; কিন্তু যদি তুলনা করা হয় তাহলে আপনার আর তাঁর মধ্যে কার সমস্যাটা দূর করা বেশী কঠিন? এদিকটা ভেবে দেখেন। জানেন দাম্ভিকতা দূর করাটা বেশী কঠিন কেন? কারণ আপনি একে দেখতেও পান না। সেই মানুষটার মদ্যপান ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ নিয়ে তাঁর সাথে কথাও বলা যাবে। কিন্তু অন্তরের এই ব্যাপারটা সমাধান করা অনেক বেশী কষ্টের, আর একমাত্র যে ব্যক্তি এটা অনুভব করতে পারে সে কে? আপনি। অন্য কেউ আপনাকে এটা বলতে পারবে না। আমরা কেউ অপরকে এই সম্পর্কে বিচার করতে পারব না। আর আমি যখন আপনাদের এই ব্যাপারে কথা বলছি এসময় আপনার যেন এমনটা মনে না হয়, “আমার অহংকারী একজনের কথা মনে পড়ছে যার এই কথাগুলো শোনা উচিত” তাহলে আপনার এই চিন্তাই তো অহংবোধের চিহ্ন। কার কথা আপনার মনে আসা উচিত? আপনার নিজের। ধর্মের নাসীহাগুলো প্রথমত কার জন্য প্রযোজ্য? নিজের জন্য। আমরা এতই অন্ধ হয়ে গেছি যে আমরা ভাবি, কুরআনের আদেশ-নিষেধ, রাসুল (সাঃ) এর উপদেশগুলো কেবল অন্যদের জন্য। প্রথমে সেগুলো কার মানার কথা ছিল? কার সেগুলো প্রথমে অন্তরে পালন করা দরকার ছিল? আপনার নিজের। এই ব্যাপারটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর হয়ে পড়ি। যখন একজন মানুষ স্বামীর অধিকার সম্পর্কে কোন হাদিস জানতে পারে, তারপর সে প্রথমে কি করে? সে তাঁর স্ত্রীকে যেয়ে বলে “জানো আজকে আমি কি শুনেছি? মনে রেখো….”। একইভাবে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের প্রথম কোন আয়াতটা শোনায়?
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
“তোমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার করো”।
এটা কি আত্মসেবা হয়ে যায়না? আমরা কি এখানে নিজেদের সেবা করতে এসেছি নাকি আল্লাহর দ্বীন পালন করতে এসেছি? এটা পুরো আচরণই বদলে দেয়। তো এটিই প্রথম সমস্যা যা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম- ইগো, যা কেবল আপনিই উপলব্ধি করতে পারবেন। আর কেউ সেটি আপনার জন্য তা করতে পারবে না। যদি অন্তরের মধ্যে ইগো থাকে তাহলে বাইরে থেকে যতই ভালো দেখাক না কেন তার কি আর কোন মূল্য থাকবে? না। কারণ তার হৃদয়টা সুস্থ নেই। আর আল্লাহ বলেছেন,
إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
“(যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না)… কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।”
তাই আমাদের ভেতরের এই ইগোটাকে ঠিক করতে হবে। দ্বিতীয় পয়েন্টে যাওয়ার আগে আপনাদের কিছু টিপস বলি কিভাবে বুঝবেন যে আপনার মধ্যে ইগো জন্মেছে। যদি কেউ আপনাকে কোন বিষয়ে শুধরে দেয় আর আপনি খুবই অপমানিত বোধ করেন, আপনার যদি মনে হয় “ তুমি কিভাবে আমাকে এটা বলতে পারলে, হ্যাঁ? নিজেকে কী মনে করো?” “তার কী এমন যোগ্যতা আছে আমার ভুল ধরিয়ে দেবার?” এটা যদি আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় তবে আপনার মধ্যে ইগোর এই সমস্যা আছে। সেই লোকটা যদি ভুল হয়েও থাকে, তার হয়তো সেটা বলা উচিত হয়নি। তারপরও আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমন হবে না যে “সে আমাকে কী করে এমন কথা বলে?” । বরং আপনার প্রতিক্রিয়া হবে, “হয়তো এই অনুচিত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমাকে আমার নিজের কোন দিকে নজর দিতে ইঙ্গিত করছেন। তাঁর কথার মধ্যে সামান্য অংশও কি সত্য? এর মাঝে কি এক পারসেন্টও সঠিক? তাঁর কথার মধ্যে যতটুকু সত্য সেটুকুই আমি গ্রহণ করি। আমার নিজেকে বাঁচাতে হবে”। “সে কে আমাকে এগুলো বলার?” নিজের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলবেন না। বাজে কথার মধ্য থেকেও ভালটুকু বের করে আনুন আর বাকিটা বাদ দিন।
যদি আপনার ভেতর সব আলাপের মাঝে অংশও নেওয়ার তাড়না কাজ করে; যদি আপনার মনে হয় আলোচনার মধ্যে যেকোনোভাবেই নিজের মতামত অন্যদের শোনাতেই হবে; আলোচনা শেষে আপনার মত গ্রহণ না করা হলে আপনি যদি খুবই অপমানিত বোধ করেন; হয়তো আপনি একটা মত দিয়েছেন আর অন্যজন আরেকটা মত দিয়েছে, আর শেষে তাঁর মতটাই গ্রহণ করা হয়েছে। আর তখন আপনি রাগান্বিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। তাহলে আপনার ইগো প্রবলেম আছে। বিশেষ করে ধর্ম সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে যদি এমনটা হয়। হতে পারে কোন মসজিদে বসে কয়েকজন কোন বিশেষ ব্যাপারে তাদের কি করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করছে। সেখানে আপনি আপনার মতামত দিলেন, সাথে অন্যেরাও দিল। আর এই আলোচনা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হচ্ছে, তাইনা? আপনি মসজিদ বিষয়ে অথবা অন্য কোন ব্যাপারে যে মতটা দিলেন সেটা কাকে খুশী করার উদ্দেশ্যে? আল্লাহকে। আপনি তো সেটা নিজের জন্য আর দেননি। “দেখা যাক আমার মতামতটাই প্রাধান্য পায় কিনা।” এটা তো আপনার লক্ষ্য ছিলনা; আর যদি সেজন্যই দেন তাহলে আপনার চিন্তায় বিরাট সমস্যা রয়েছে। তো আপনি যদি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কোন বিষয়ে আন্তরিক মত দেন তাহলে কি আপনি সেজন্যে সাওয়াব পেয়ে গেলেন না? আল্লাহই আপনাকে আপনার প্রাপ্য পুরস্কার দেবেন। তাই লোকেরা আপনার মত গ্রহণ করুক বা না করুক সেটা নিয়ে আপনি আর চিন্তা করবেন না, আপনি যেই জিনিসটা চেয়েছিলেন তাতো পেয়েই গেছেন। কিন্তু আপনার নিয়ত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না হয় তাহলে কী হবে? আপনি মনে মনে কষ্ট পাবেন। আপনি বলবেন “ না, আমি আমার মত দিয়েছি যেতে এটাই প্রধান মত হয়। আর সেটা না হওয়াতে আমি অপমানিত বোধ করছি।” এভাবে নিজেকে সহজে যাচাই করা যেতে পারে। যদি আপনি কষ্ট পান তাহলে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। এ ব্যাপারগুলো চর্চা করা অনেকটাই কঠিন। তারপরেও আমাদের নিজেকে যাচাই করা চালিয়ে যেতে হবে।
সুতরাং প্রথম অদৃশ্য সমস্যাটা হল ইগো; যাদের বাইরে থেকে ধার্মিক মনে হয় কিন্তু তাদের ভেতরে নিজেকে অন্যদের থেকে বড় করে উপস্থাপনের তাড়না কাজ করে। দ্বিতীয় সমস্যাটাও অনেকটা একই ধরনের। বাইরে থেকে বেশ ভালো লাগে, জ্ঞানী মনে হয়, মুখে ভালো কথাও বলে, ভালো পোশাক পরে, সবকিছুই চমৎকার! তাকে দেখে যে কেউ বলবে, “এই ভাইটা আসলেই অসাধারণ একজন মানুষ!” কিন্তু ভেতরে ভেতরে কি হয় জানেন? প্রথম ক্ষেত্রে নিজের মধ্যে ইগো জন্ম নেয় আর দ্বিতীয় সমস্যা হল হৃদয় কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আল্লাহর কথা আপনাকে আর নাড়া দেয় না, কুরআন শুনেও আপনি কিছু অনুভব করেন না। অনেকদিন হয়ে গেছে আপনি সালাতে দাঁড়িয়ে কাঁদেন না, আপনার হৃদয়ে কোন অনুভুতি ছুঁয়ে যায়না। আপনি নিয়মিতই তা শুনে যাচ্ছেন আর আপনার শুধু মনে হয় “আমি তো এগুলো আগে থেকেই জানি।” “আমার এসব শুনে লাভ নেই, এগুলো তো আমি অনেক আগেই শুনেছি। আমি জানি এরপর তিনি কি বলবেন।” সালাতে দাঁড়িয়ে আপনি ভাবতে থাকেন “ইমাম সাহেবের তিলাওয়াতটা আরো শুদ্ধ হতে পারতো…তাঁর ক্বলক্বলাটা ঠিক হয়নি… আহা, তিনি মাদ্বটাও যথেষ্ট লম্বা করেননি।” এসবই আপনার সালাতের মাঝে হচ্ছে। এটা কীসের লক্ষণ জানেন? আপনার তাজবীদ ভালো কিন্তু হৃদয় কঠিন। আল্লাহর কালামও আপনাকে নাড়া দেয় না? সেগুলো শুনেও আপনার মনের মধ্যে কিছু বয়ে যায়না? আপনি কেবল সেগুলোকে অবচেতনভাবেই শুনে যাচ্ছেন।
একদিকে আপনার ঈলম বৃদ্ধি পাচ্ছে, লোকজনের সামনে আপনাকে খুবই ধর্মভীরু বলে মনে হয়, কিন্তু যেসময় একা থাকেন, যখন আর কেউ আপনাকে দেখতে পায়না তখন আপনার ভেতরের খারাপ সত্ত্বাটা বেরিয়ে আসে। যার কিছু আলাদা আচরণ আছে; যে কিছু গোপন কাজ করে। তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরা দেখে কেউ বলতেই পারবে না যে সে এরকম খারাপ কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা নির্জনে একদম ভিন্ন এক মানুষে রূপ নেয়, যাকে দেখে আপনি চিনতেও পারবেন না। তো সেই মানুষটার ভেতরে একটা দানব বাস করছে। তার কিছু সাংঘাতিক সমস্যা আছে, কিন্তু তাকে বাহ্যিক দিক থেকে অনেক ভালোই লাগে। কেউ আপনার এই সমস্যা দূর করতে পারবে না কারণ তারা জানেও না যে আপনার ভেতরে এমন সমস্যা বিরাজ করছে।
তাই প্রথম সমস্যা হলো ইগো, দ্বিতীয়টা হলো কঠিন হৃদয়; আর এ দুটোই আত্মিক সমস্যা, সমস্যাগুলো হৃদয়জনিত। কেবল আপনিই নিজেকে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ্ শেষের দিকে যেয়ে এ সমস্যাগুলো দূর করার জন্য কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করবো। আমি দ্বিতীয় পয়েন্টটা গুছিয়ে আনতে চাই, হৃদয় কঠিন হয়ে পড়ার ব্যাপারে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, যে আয়াতটা আমি শুরুতে তিলাওয়াত করেছিলাম সুরা হাদীদ থেকে, সেখানে আল্লাহ প্রথমে আহলে কিতাবদের সাথে এবং তাঁর পরে আমাদের সাথে কথা বলছেন; তিনি বলেন,
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ
“যারা ইমান এনেছে তাদের কি এখনো সময় আসেনি…”
أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ
“…..যে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে যাবে, তাদের হৃদয় সশ্রদ্ধ ভয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে?”
যখন আপনার পেশী নরম আর দুর্বল হয়ে পড়ে, জানেন সেটা আসলে খুশু’। তখন পেশীগুলোকে শক্তিহীন মনে হয়। আপনার মনে হয় যে কেউ আপনাকে বশীভূত করে ফেলছে। আল্লাহ বলছেন তাদের হৃদয় আল্লাহর ভয়ে, তাঁর কথা স্মরণ করে বশীভূত হয়ে পড়বে।
“যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে তার কারণে হৃদয় গলে যাওয়ার সময় আসেনি?…”
وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ
“…এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে তার কারণে?”
আর সেই সত্যটা কী? আল কুর’আন।