দ্বিতীয় সমস্যাটি কী ছিল? দ্বিতীয় সমস্যাটি ‘ওয়া তারাব্বাস্তুম’। “তোমরা (সব সময় সুযোগের) প্রতীক্ষা করেছ/দীর্ঘসূত্রতা করেছ”। এখানে দীর্ঘসূত্রতা বলতে কি বুঝানো হয়েছে? আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা খারাপ, আপনার নিজের বিবেকের মাধ্যমে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার নিজেকে পরিবর্তন করা উচিত; কিন্তু নিজেকে বুঝিয়েছেন “ইনশাআল্লাহ আমি দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করবো’, আমি জানি নিজেকে পাল্টাতে হবে, আমি জানি এটা খারাপ, শুধু এই সপ্তাহ পরেই আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে পরিণত হবো।” “বেশী না, আর একটা সেমিস্টার/দুটো মাস এই ‘বখে যাওয়া’ বন্ধুদের সাথে থাকবো, তারপর আমি অন্য কোর্স নিব। এখন ওদেরকে রাগানো ঠিক হবে না”। “শুধু এই এক মাস আমি এসব করবো, এই আর এক সপ্তাহ, এই আর একটা বা দুইটা পার্টি, একটা দুইটা ড্রিঙ্কস… এভাবে আপনি নিজেকে বলতে থাকেন আর সামান্য একটু, সামান্য একটু।
“এই নয়/দশ মাস পরেই তো রামাদান। রামাদানে সব ছেড়ে দিব। পুরাই চেইঞ্জ হয়ে যাবো। আমার প্ল্যান আছে হজ্জে যাওয়ার, হজ্জ থেকে আসার পর দেখবেন আমি কেমন ভালো মানুষে পরিণত হয়ে যাই“। কিন্তু সে পর্যন্ত … আমার জন্য দোয়া করতে থাকেন।
এটাই ‘ওয়া তারাব্বাস্তুম’। আপনি এই মুহূর্ত থেকে নিজেকে পরিবর্তন করতে চান না, আপনি শুধু নিজেকে খারাপ পরিবেশে ফেলে রাখছেন না, আপনি এখনো নিজেকে পরিবর্তনের জন্য কোন পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুন নন। মনে হচ্ছে আপনার কাছ থেকে অনেক বেশী কিছু চাওয়া হচ্ছে। আপনি যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকতে চান, আরও কিছু খারাপ উপভোগ করতে চান। এটাই ‘ওয়া তারাব্বাস্তুম’। আপনি ধারণা করে আছেন … আপনার প্রথম ধারণা ছিল – খারাপ পরিবেশে থাকলেও এটা আমার উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না, কিন্তু প্রভাব পড়েই। সময়ের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর খারাপ কিছু আপনার কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এখন তারাব্বুস বা অপেক্ষা করতে থাকা, দীর্ঘসূত্রতা করার প্রভাব কী? আপনি ভাবছিলেন আপনি যেকোনো সময় এই খারাপ কর্ম পরিত্যাগ করতে পারবেন। সব খারাপ সঙ্গ থেকে যে কোন সময় সরে আসতে পারবেন। “আমি তো আর আসক্ত না, আমার তো আর এটার দরকার নেই, আমি শুধু একটু উপভোগ করছি, আমি তো আর এর সাথে আটকে যাইনি, আমি যখন তখন বেরিয়ে যেতে পারবো”। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। যত বেশী সময় আপনি এর সাথে জড়িয়ে থাকবেন, আপনি ততো বেশী এতে আসক্ত হবেন। তারপর এর থেকে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আপনি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, সম্পূর্ণ ডুবন্ত অবস্থায় নিজেকে আবিস্কার করবেন। আপনি এখন জানেনও না এই পরিবেশের বাইরে সুস্থ জীবনের মানে কী? এর পর আপনি নিজেকে বলতে শুরু করেন – অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর সম্ভব না। এ রকম ঘটার পর এক অপরাধবোধের জন্ম নিবে। “আমি ভয়ঙ্কর খারাপ, আমি বহুদিন ধরে এত এত পাপ কাজ করে আসছি। আমার আরও অনেক আগেই তাউবা করা উচিত ছিল। এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা নাই”।
নিজকে খারাপ ভাবতে অথবা মনের ভেতর অনুশোচনা নিয়ে বেশীদিন কাটাতে কেউই পছন্দ করে না। মনের যখন এহেন নড়বড়ে অবস্থা চলছে ঠিক তখন শয়তান এসে বলবে, “তুমি এতো অপরাধবোধে ভুগছ কেন? তোমার তো কোন দোষ নাই। এই ‘ইসলাম’ নামের জিনিসটাই তোমার মনের ভেতরে যত অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছে। এই ইসলাম বলছেঃ এটা হারাম, ওটা গুনাহ, এটা পাপ, এভাবে কথা বলবে না, ওটা খেও না, অমুকটা দেখ না, ওখানে যেও না। এই ইসলাম তোমাকে নিজের সম্পর্কে খারাপ ধারনা দিচ্ছে, অথচ আমি (শয়তান) চাই তুমি নিজের সম্পর্কে ভালো ধারনা করো। আচ্ছা, এই ইসলাম যে এত কঠিন সব নিয়মকানুন মেনে চলতে বলছে, এটা সত্য কিনা তুমি কি নিশ্চিত? শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা শুনে বিভ্রান্ত ব্যক্তি ভাবতে থাকে, “আমি আসলে কেন ইসলামে বিশ্বাস করি? মনে হয় যেন ইসলাম চায় না আমি আনন্দে থাকি। আমি শুধু আমার জীবন উপভোগ করতে চাই, আমি সুখী হতে চাই। আমি স্বাধীন ভাবে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মৌজমাস্তি করে, জীবনকে সর্বচ্চ উপভোগ করতে চাই। আমি তো এমনিতেই কুরআনের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নই। আল্লাহ বলে কেউ আছে কিনা এই ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। আর এই হাদিস জিনিসটাই বা কি? এই কুরআন-হাদিস কতটা নির্ভরযোগ্য?”
আমাদের আশেপাশে এইরকম বিভ্রান্ত অবস্থায় অনেক আব্দুল্লাহ, জায়নাব, আলী, ফাতিমা, আব্দুল কারিম, আহমেদ, রুকাইয়া, হামজাহ, আই’শা, মুহাম্মদ — এইসব চমৎকার আরবি নামধারী তরুন-তরুণীদের আমরা দেখতে পাই। তারা খুব নির্ভীকভাবে বলে, “ইসলাম নিয়ে আমার মনে অনেক সন্দেহ আছে। আর এ মানুষগুলো এমন নয় যে তাদের দর্শন শাস্ত্রে পি এইচ ডি রয়েছে বা ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপক জ্ঞান রয়েছে এবং এসব বিষয় বহু দিন অধ্যয়নের ফলে তাদের মনে ধীরে ধীরে সংশয়ের জন্ম নিয়েছে। না, না, না, আসল ব্যাপার তা নয়। বরং আসল ব্যাপার হলো এরা নিজেদের জন্য জেনে-বুঝে খারাপ সঙ্গ এবং অসৎ পরিবেশ বেছে নিয়েছিল। তারা নিজেদের পরিবর্তন করেনি। এটাই ঈমান হারানোর প্রক্রিয়া। আমি এমন শত শত মানুষের সাথে কথা বলেছি। তারা আক্ষরিক অর্থে এই আয়াতের ভেতর জীবনযাপন করছে!! (তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। প্রতীক্ষা করেছ, সন্দেহ পোষণ করেছ এবং অলীক আশার পেছনে বিভ্রান্ত হয়েছ, অবশেষে আল্লাহর আদেশ পৌঁছেছে। ৫৭ঃ ১৪)
তারপর এক সময় তারা ধর্ম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে থাকে। কিন্তু তাদের এই সন্দেহের সাথে যুক্তি বা বুদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই। আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ হতে না হতেই আরেকটা প্রশ্ন করবে। কোন উত্তরেই তারা সন্তুষ্ট হবে না, কোন উত্তরেই তাদের সন্দেহ কাটবে না। কারণ তাদের কোন স্বদিচ্ছাই নাই যেন তাদের বিভ্রান্তি কেটে যায়। আপনি উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ভাববেন আসলে এদের সমস্যাটা কি? তখন যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, “কতদিন থেকে তোমরা এই অসৎ পরিমণ্ডল জেনেশুনে বেছে নিয়েছ?” তখন আপনি বুঝতে পারবেন এদের আসল সমস্যা কোথায়। ‘وَارْتَبْتُمْ’ অর্থাৎ (নানা রকমের) সন্দেহ পোষণ করেছ। জানেন? সন্দেহ কী করে? সন্দেহ প্রথমে তাদের ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দিবে। তারা এভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিবে- “এটা তো আসলে পুরোপুরি সত্য না। সুতরাং এটা না মানার কারণে আমার খারাপ অনুভব করার দরকার নেই।” যখন তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। এবং সময়ের পরিক্রমায় এই ‘দানা’ দেয়ালে পরিণত হয়। তখন তারা এই দেয়ালের আড়ালে নিজেকে লুকাবে এবং নানাপ্রকারের অনৈতিক কাজের বৈধতা দিবে। একবার যখন তারা এই পর্যায়ে এসে উপনীত হবে, তখন দুটো জিনিস তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়া হবে।
১) জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা কেড়ে নেয়া হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষা কেড়ে নেয়া হবে। অন্তরে সেই বিশেষ নূর ধারণের স্পৃহা (যা শেষ বিচারের দিনে পথ চলতে সাহায্য করবে) — এইসব কিছু পাওয়ার বাসনা হারাবে। তাদের এই দুনিয়াতেই সেটা নেই। যে লোক আল্লাহর নিকট থেকে সেই সফলতা পেতে চায়, আল্লাহ তাদেরকে তা এই দুনিয়াতে দিবেন। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা তো এখন আর অবশিষ্ট নেই। তাদের এ সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে।
২) জাহান্নামের ভয় হারাবে।
এই দুইটা জিনিস তারা হারাবে। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা এবং জাহান্নামের আতংক — এইদুটো মুল্যবান বোধ তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়া হবে। এই ব্যক্তির কাছে এখন আখিরাত বা বিচারদিবসের কোন মুল্য নাই। কেউ তার সামনে জান্নাত-জাহান্নাম-শেষ বিচার এর কথা বলতে এটা তার কাছে তামাশা মনে হবে, এমনকি এইসব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে। যখন কারো অন্তর থেকে আখিরাতের প্রাপ্তির আশা হারিয়ে যায় এবং জাহান্নামের শাস্তির ভয় মন থেকে দূর হয়ে যায়, তখন কি হয় জানেন ? তখন তার কাছে শুধু একটা জিনিসই গুরুত্ব পায়, দুনিয়া! সে তখন মনেপ্রাণে পুরোপুরি দুনিয়ামুখী হয়ে যায়। যেহেতু পরকাল বলে কিছু নাই, তাই এই দুনিয়াতেই যা কিছু করার/পাবার জন্য মরিয়া হয়ে যেতে হবে। অর্থ, বিত্ত, সাফল্য, সম্পদ, জনপ্রিয়তা, বিনোদন, মৌজ-মাস্তি, সব ধরনের ম্যাটেরিয়াল থিং — যে কোন ভাবে, যে কোন পথে অর্জন করাটাই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সে ভাববে দুনিয়াদি এইসব প্রাপ্তি ভেতরেই রয়েছে সব আনন্দ ও চূড়ান্ত মানসিক তৃপ্তি। তাই, পরবর্তী ধাপটি হচ্ছে ‘وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ’ অর্থাৎ “অলীক আশার (দুনিয়ার মোহ) পেছনে বিভ্রান্ত হয়েছ”। সে মিথ্যা আশার পেছনে ছুটেছে এবং মনে করেছে পার্থিব অর্জন তাকে সুখী করবে। সে তার সম্পূর্ণ জীবন শুধু এই লক্ষ্যেই ব্যয় করেছে।
ইনশাআল্লাহ, চলবে…