ওরা কেন ইসলামকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে?

আমার আসল পয়েন্ট হলো এখন কেন মানুষ মানুষ ইসলামকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে? কেনই বা ওরা রাসুল (সঃ) কে নিয়ে মজা করে? কেন রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে অপমান করে কার্টুন বানানো হয়? কেন মুসলিমদের উপর এত প্রোপাগান্ডা, এত জঘন্য কথাবার্তা যেগুলো এখন সাংবাদিকতার নামে চলছে সম্পাদকীয় কলামে? এ ব্যাপারটিকে দিনকে দিন আরও আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। আগে তারা উগ্রপন্থীদের নিয়ে কথা বলতো তাই না? তারা কথা বলতো কিছু উগ্রপন্থী আর জঙ্গি ইসলামের ভার্সন নিয়ে যেখানে ওরা সবাইকে খুন করতে চায়, আর নারীদের ডাস্টবিনে ফেলতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আস্তে আস্তে এই উগ্রপন্থীর সংজ্ঞা ঢিলা হতে হতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে আপনি এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়লেই উগ্রপন্থী। উগ্রপন্থী আগে যা উন্মাদদের বেলায় প্রযোজ্য ছিল এখন তারা বলে আপনি যদি একটুও ইসলাম প্রকাশ করেন, অথবা আপনি দেখতে যদি মুসলিম হন, বা মহিলা যদি হিজাব পরেন সে নিশ্চয়ই উগ্রপন্থী। পুরুষদের বেলায় যদি দাঁড়ি থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই উগ্রপন্থী।

আমেরিকায় এত খারাপ অবস্থা এখনও হয়নি কিন্তু ইউরোপে খুবই খারাপ অবস্থা। আমি ইউরোপে গিয়েছিলাম, আমি বলতে পারি অবস্থা সেখানে ভালো নয়। এটা উগ্রপন্থী হিসেবে দেখা হয় কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? আমাদের এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে যে তারা(কাফিররা) আমাদের ধরতে আসবে, এই কাফিররা আমাদের ঘৃণা করে, ওরা প্রতিনিয়তই আমাদের বিরুদ্ধে কার্টুন আঁকছে, তারা প্রোপাগান্ডা চালায়, তারা ইসলামের সব ব্যাপারকেই ঘৃণা করে, তারা এটার পিছনে ছুটছে , ওরা ওরা ওরা……। আমরা নিজেদের আয়নায় দেখার একটুও সময় পাই না। নবী-রাসুলদের (সঃ) নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল, আমি বলেছিলাম সাহাবাদের নিয়েও হয়েছিল। যেমন কুরআনে এসেছে… وَيَسْخَرُونَ مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا আর তারা ঈমানদারদের প্রতি লক্ষ্য করে হাসাহাসি করে। (বাকারা; ২১২)। কাফিররা তাদেরকে নিয়ে মজা করে যারা বিশ্বাস করে।

এখন মৌলিক প্রশ্ন হলো রাসুল (সঃ) ও সাহাবাদের নিয়ে কেন ব্যঙ্গ করা হত? আর এখন ওরা আমাদেরকে কেন ব্যঙ্গ করে? এই দুটির কারণ কি একই? আমি বলবো, না একই কারণ নয়। তাঁদেরকে ব্যঙ্গ করা হতো, কারণ ইসলামকে বন্ধ করে দেয়ার এটি একটি উপায় ছিল। এটি ইসলামের প্রসার ঠেকানোর একটি উপায় ছিল। কারণ তারা জানতো না আর কী করার আছে। ইসলাম ছিল এতোটাই চিন্তা জাগ্রতকারী , ইসলাম ছিল এতোটাই দৃষ্টি উন্মুক্তকারী, ইসলাম ন্যায়ের ডাক দিয়েছিল, এটা সব ধরণের অবিচারকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। মানুষ ইসলামের দিকে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল, যুবক বৃদ্ধ সবধরনের মানুষকে ইসলাম টেনে আনছিল, আর ওরা জানতোনা কীভাবে তা বন্ধ করা যায়? তাই ওরা কৌশল অবলম্বন করলো যে রাসুল (সঃ) কে মিথ্যাবাদী ডাকবে কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না । ‘‘হয়তো আমরা তাঁকে উপহাস করতে পারি, আর হেসে উড়িয়ে দিব যাতে সবাই মনে করে তারা কিছুই না।‘’ এটা তাদের কৌশলগুলোর অন্যতম ছিল। যখন সেটাও কাজ করেনি তারা আরেকটি কৌশলে চলে গেল। আর এই সবগুলো কৌশল ছিল ইসলামের প্রসার ঠেকানোর জন্য কারণ তা খুবই শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে একই জিনিস হচ্ছে তা আমি বলবো না।

আমি মনে করি ইসলাম নিয়ে যা উপহাসমূলক কার্যক্রম হচ্ছে তার কারণ আমাদের বর্তমান মুসলমানদের আচরণ। মুসলমানদের অবস্থা কী হয়ে দাঁড়ালো ! আমরা যেভাবে আমাদের জীবন যাপন করি তার জন্য। আমাদের মুসলিম সমাজ কেমন দেখায়? আমাদের পাড়ার রাস্তাগুলো কেমন দেখায়? আমাদের বাসা কেমন দেখায়? আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের চর্চা কেমন? আমাদের সরকারগুলো কেমন? আপনি যদি দুর্নীতির উদাহরণ দেখতে চান, আপনি যদি সভ্য দুনিয়ার ঠিক উল্টোটা দেখতে চান, মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণ করুন। বেশিরভাগই এ রকম। এমনকি মসজিদের পার্কিং এর জায়গাতেও আমাদের সভ্য হতে খুব কষ্ট !! একটা সময় আমরা সুশৃঙ্খল থাকি যখন কাতার সোজা করে দাঁড়াতে হয় নামাজের সময়। এর বাইরে? ভুলে জান। নূন্যতম মানবিক শিষ্টাচারও নেই আমাদের মাঝে। মুসলিম সভ্যতা কী? আমরা খুবই পছন্দ করি ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিতে যখন মুসলিমরা উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতায় অগ্রগামী ছিল, যখন তারা পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, পৃথিবীর সব জায়গা থেকে মানুষ আসতো বাগদাদে পড়ালেখা করার জন্য, ইউরোপিয়ানরা তাদের সাহিত্য হারিয়ে ফেলেছিল আর মুসলিমরা তা সংরক্ষণ করেছিল, তা শিখতে ওরা আমাদের কাছে এসেছিল, যখন স্পেন সারা বিশ্বের জন্য আদর্শ ছিল। আমরা খুবই পছন্দ করি ঐসব উদ্ধৃত করতে । কিন্তু এখন আমরা কী উদ্ধৃত করব? আমরা কী করেছি? আমরা কী তৈরি করেছি মানুষ হিসেবে? পৃথিবীতে কী অবদান রেখেছি? আমরা তখনই খবরের কাগজে আসি যখন বোমা মেরে কিছু উড়িয়ে দেই। অথবা কোন ঝামেলা করি। এইসব বাইরের দৃষ্টিকোণ থেকে একটু চিন্তা করুন। এই মানুষগুলো উন্মাদ।

আমি বাকি বিশ্বের মুসলিমদের কথা নাই বা বললাম। এখন শুধু পশ্চিমা মুসলিমদের কথা বলি কিছুক্ষণের জন্য। আমি আমেরিকার মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে উঠাবসা করেছি অনেক দিন ধরে, আমার ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে ভালই কথাবার্তা হয়েছে। আমি কিছু কথা বলি যা আপনি মুসলিম সমাজে দেখতে পাবেন, সুবহানাল্লাহ! আমি জানি ব্যবসায়ীরা মিথ্যা বলে যখন তারা ট্যাক্স দেয়।

– ‘’আমি কাফিরদের টাকা দিতে চাই না।‘’
– ‘’সত্যিই তাই? আপনি কাফিরদের ট্যাক্স দিতে চান না? আপনি মদ বিক্রি করেন তখন আপনার ইসলাম আসে না। এখন হঠাৎ করে আপনার ওয়ালা আল বারা উদয় হল যখন আপনি তাদের ট্যাক্স দিতে যাচ্ছেন ? ‘’

আমরা, আমাদের নৈতিক অবস্থা এতোটাই নিম্নমানের যে আমাদের ব্যবসায়ী ভাইরা আছেন যারা ঠিকভাবে বেতন দেয় না। এমনকি তাদের স্ত্রীদেরও মাহর দেয় না। তারা পৃথিবীর অবিচার নিয়ে কথা বলছে কিন্তু তাদের ঘরেই ন্যায়বিচার নেই। কেউ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে কেন? যে আয়াতটি আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই এটি কুরআনের অন্যতম একটি ভয়ংকর আয়াত যখন উম্মার অবস্থা সামনে আসে।

رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلَّذِينَ كَفَرُوا وَاغْفِرْ لَنَا رَبَّنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে কাফেরদের জন্য পরীক্ষার পাত্র করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৬০; ৫)।

অন্য কথায় এই আয়াতের একটা অর্থ হলো – ইয়া আল্লাহ! আমাদের এত অভাগা, লজ্জাজনক মানুষে পরিণত করো না এবং ইসলামের সুন্দর শিক্ষা থেকে এতো দূরে রেখ না যে যখন অমুসলিমরা আমাদের দেখবে তারা যেন না বলে কেন আমি ইসলামের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে যাব ? কেন আমি মুসলিম হব? আমি কি এই মানুষগুলোর মত হব? তারা ব্যঙ্গ করার ক্ষেত্রে বৈধতা পেতে পারে না। কিন্তু আমরাও ন্যায়সঙ্গত নই যখন আমরা আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে অস্বীকার করি। আমাদেরকে আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা শুরু করতে হবে। আয়নায় আমাদের নিজেদেরকে দেখতে হবে, এই সমস্যার সমাধান করতে হবে । আর এটাই মোক্ষম সময় আমাদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার অবস্থান নিয়ে অভিযোগ বন্ধ করার।

আমরা সেই দলের মানুষ, যাদের বিশ্বাস “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। আমাদের পাশে আছেন আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল, তাঁর সাহায্য যাবতীয় সকল সমস্যার চেয়ে শক্তিশালী। এমন কোনো সমস্যাই নেই যা বিশাল ভাবার কোনো উপায় আছে যদি আল্লাহ আপনার পাশে থাকেন। সমস্যা হল আমরা আল্লাহর সাহায্যই চাইছি না, অন্তত সেটি অর্জন করার কোনো প্রচেষ্টা আমাদের মাঝে নেই। এটি বিনামুল্যে পাওয়ার মতো কোনো জিনিস নয়, এটি অর্জন করার জিনিস। সেজন্যে আমার ঘরের ভিতরটিকে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, আমার পরিবারকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, আমার চারপাশের মানুষগুলোকে সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আমরা, আমরা আমাদের নৈতিকতার মানদণ্ড হারিয়ে ফেলেছি । আর আমি দ্বীন, ফিকহ বা শরিয়ার সুগভীর জ্ঞানের কথা এখানে বলছি না, আমি বলছি খুবই মৌলিক নৈতিকতার কথা, খুবই খুবই মৌলিক নৈতিকতার কথা। ইউ.এস এমনকি পুরো পৃথিবীজুড়ে কত না মসজিদ আছে সেখানে অর্থ সংগ্রহের কাজ চলে, তারা অর্থ সংগ্রহ করার সময় বলেন আমরা এই খাতে, ঐ খাতে টাকা ব্যয় করবো…কিন্তু পরে তা অন্য খাতে ব্যয় করেন। আর বলেন, না না ঠিক আছে, ব্যয় করা যায়, এই তো আমাদের ফাতওয়া…। অসৎ হওয়ার ফাতওয়া !! সেটি কোথায় পেলেন আপনি ?? কিন্তু এমনটাও করা হয়, যেন সেটি কোনো ব্যাপারই নয় আমরা এমনকি ধর্মের নামেও দিব্যি মিথ্যাচার করে যাচ্ছি, মিথ্যা বলে যাচ্ছি। সুবহানআল্লাহ!এটি কেমন করে সম্ভব? কেমন করে এমনটি হতে পারে আমি বুঝি না! এটি কেমন করে সম্ভবপর হতে পারে যে আপনাকে আপনার ঘরে বলে বুঝাতে হবে, আপনার পিতামাতাকে আলোচনার মাধ্যমে রাজি করাতে হবে এই বলে যে, “বাবা, আমার মনে হয় আমাদের যাকাত দেয়া উচিত।” ঠিক আছে, ঠিক আছে…আর এই ধরনের আলোচনা, তর্কবিতর্কগুলো হচ্ছে মুসলিম ঘরগুলোতে…। তাহলে আল্লাহর সাহায্য কেনো আসবে এই ধরনের মানুষদের জন্যে? এদের দেয়া হয়েছে সবচেয়ে সুন্দর ধর্ম, সবচেয়ে সেরা ধর্মীয় শিক্ষা আর এই মানুষগুলো একটি দিনের জন্যে, একটি মুহূর্তের জন্যেও আয়নার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করছে না যে “কী ভুল করছি, কোথায় ভুল করছি?”

আপনাদের মাঝে অনেকেই উলামা নন, ফাকিহ নন, মুফতি নন ‒ আর আপনাদের তা না হলেও চলবে। কিন্তু আপনি জানেন আপনি কী ভুল করছেন। আমি জানি আমি কী ভুল করছি। আর আমরা ক্রমাগত সেগুলো আড়াল করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ এই মানুষগুলোর অবস্থার পরিবর্তন করবেন না। আল্লাহ এই উম্মাহর অবস্থার পরিবর্তন করবেন না। নাহ। তিনি করবেন না। আল্লাহ তাঁর আয়াতে স্বয়ং এমনটি বলেছেন। মানুষ বলে থাকে, এতো আয়াতের কথা। হ্যাঁ, আয়াতের কথাই প্রকৃত সত্য। আয়াতের চেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি কিংবা বায়োলজির চেয়েও ঊর্ধ্বে কুর’আনের আয়াতের সত্যতা। “ইন্নাল্লাহা লা ইয়ু গাইরু মাবি কাওমিন হাত্তা ইয়ু গাইরু মাবি আনফুসিহিম” (১৩; ১১)‒ আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন সেই পর্যন্ত করবেন না, যতক্ষণ তারা নিজেরা প্রথমে সচেষ্ট না হয়। মাবি আনফুসিহিম … আমাদের মধ্যে কিছু না কিছু সমস্যা আছে। আল্লাহর জবাব অনুযায়ী উম্মাহর প্রকৃত সমস্যা হল উম্মাহর সদস্যদের মাঝে উপস্থিত সমস্যা। এই হচ্ছে আল্লাহর উত্তর যেখানে স্পষ্ট বলা আছে উম্মাহ আজ কোন সমস্যার সম্মুখীন আল্লাহ যখন বলেন, “ওয়া আনতুম ওয়া আ’লাউনা কুনতুম মু’মিনীন” ৩;১৩৯‒ তোমরা পৌঁছবে সবচেয়ে উঁচু স্তরে, যদি তোমরা প্রকৃত অর্থে হয়ে থাকো বিশ্বাসী।আর কোনো সন্দেহ নেই যে সবচেয়ে উঁচু স্তরে যেহেতু আমরা নেই এই মুহূর্তে, তার মানে কোথাও কোনো সমস্যা অবশ্যই আছে। কারণ আল্লাহর কথা সম্পূর্ণ নির্ভুল। আল্লাহ সর্বদা নির্ভুল।

এটি ভীষণ দুঃখজনক একটি ব্যাপার। একটির পর আরেকটি, তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি, আবার আরেকটি(সন্ত্রাসী আক্রমণ দুনিয়াজুড়ে)…আর এতেই শেষ নয়, এটি চলতে থাকবে। আমরা জানি এটি চলতে থাকবে, আমরা জানি এটি চলতে থাকবে । একটি মাত্র কাজ যা আমরা করতে পারি এই সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আচ্ছন্ন হওয়ার পরিবর্তে আর “আমরা খারাপ না” ‒ অন্যদেরকে বার বার এই কথা বলে বুঝানোর পরিবর্তে…কারণ যাই হোক না কেনো, আমরা যাই বলি না কেনো, তারা কখনই বিশ্বাস করবে না যে, “আমরা খারাপ না”। আপনি কখনই তাদের বুঝাতে সক্ষম হবেন না। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন… নবী-রাসূলেরা (আঃ) চেষ্টা করে দেখেছেন, পারেন নি। যদি নবী-রাসূলেরা (আঃ) না পেরে থাকেন, তবে আমাদেরও পারার কথা নয় আমি বলে রাখছি, আপনি কখনই তাদের বুঝাতে সক্ষম হবেন না আপনি যতই ভালো হোন, ভালো করুন ‒ কিছু যায় আসে না তাতে। আমাদের মুসলিমদের যারা ঘৃণা করে তারা সবসময়ই আমাদের ঘৃণা করে যাবে। যারা আমাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, তারা ক্রমাগত ঠাট্টা-তামাশা করেই যাবে। বরং সেক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয়, তা হল আমাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার জন্যে যেনতেন উপলক্ষ তৈরি না করে প্রকৃত উপলক্ষ তৈরি করা। আর প্রকৃত উপলক্ষ হল যখন আমরা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে থাকবো।

আমরা যুক্তি বুঝি, আমরা জ্ঞান ধারণ করি। আমরা এমন ইসলামের অনুস্মরন করি যে ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর সেনাবাহিনীর সংখ্যায় ছিল না…এই কথাটি দিয়েই শেষ করবো আমি। ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর সেনাবাহিনীর সংখ্যায় ছিল না, তলোয়ারেও ছিল না, অস্ত্রেও ছিল না ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল এর চিন্তার বহুমুখিতায় আর এটি প্রয়োগ করেই অবিচারের দিকে আঙুল প্রদর্শন করা সম্ভব হয়েছিল। প্রশ্ন করা সম্ভব হয়েছিল প্রচলিত সমসাময়িক নীতি আর দর্শনের বৈধতাকে ‒ কীভাবে এমনটি ভাবতে পারো তোমরা, কীভাবে এমনটি করতে পারো তোমরা, কীভাবে এমন বিচার করতে পারো তোমরা???

“আমলাকুম কিতাবুন ফীহি তাদ’রাসুল”
“আ’ফালা তা’কিলু” ‒ তোমরা কেনো চিন্তা করো না?

কীভাবে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো?

ইসলাম হলো সেই ধর্ম, যেই ধর্মে বলা আছে, “আদ’উ ইলাল্লাহি আলা বাসীরা” ‒ আমি আল্লাহকে স্মরণ করি আমার চিন্তার জানালা খোলা রেখে, কেননা ইসলাম হচ্ছে চিন্তাশীলদের ধর্ম। কিন্তু আজ আমরা আর চিন্তাশীলদের মতো আচরণ করি না আর তাই আমাদের ইসলামেও সেই ধাঁর আর নেই। আমরা মনে করি পশ্চিমের আতঙ্ক হলো ইসলাম, ইসলামের আতঙ্ক হলো এর সমরনীতিতে। সমরনীতি আসলে কোনো বিষয়ই নয়। কুরাইশদের আতঙ্ক ছিল, তারা ভয়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, বদরের যুদ্ধের সময় নয়, বরং তারও অনেক আগেই, মক্কাতেই… তারা কেঁপে কেঁপে উঠেছিল আল্লাহর কিতাবের কথায়, আল্লাহর কিতাবের আয়াতই তাদের আতঙ্কের জন্যে যথেষ্ট ছিল। এটিই যথেষ্ট ছিল যে হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতি-সংস্কৃতি ভেঙে যেতে, পরিবর্তিত হতে শুরু করবে আল্লাহর কিতাবের মাত্র কয়েকটি শব্দের প্রভাবে… মাত্র কয়েকটি শব্দ!!! কিন্তু আজ?? কিছু হয়েছে আমাদের, আমরা আর সেই শব্দগুলোর সাথে নেই ।

দেখুন, যখন কেউ তর্কে লিপ্ত হয়, যখন আপনি তর্কে লিপ্ত হন কিন্তু ওপাশ থেকে কোন প্রতিউত্তর আপনি পান না, আপনি রেগে ওঠতে থাকেন, আপনার স্বর উঁচু হতে থাকে, আপনি ওলটপালট বলতে থাকেন…আর আপনি যখনই ওলটপালট বলতে থাকেন তখন এর মানে দাঁড়ায় যে আপনি ইতিমধ্যে হেরে গিয়েছেন। আপনার কাছে আসলে যৌক্তিক কোন জবাব আর অবশিষ্ট নেই। এটা আপনাকে হতাশ করে তোলে, আপনি হয়ে পড়েন রাগান্বিত। আপনি যখন কারো সাথে বিতর্কে লিপ্ত হন এবং হেরে যান, হেরে যাওয়ার পর যদি আপনি অপর জনকে আঘাত করেন। এতেও প্রমাণিত হয় আপনি প্রকৃতপক্ষেই হেরে গেছেন। যেহেতু আপনি তাকে যুক্তি দিয়ে হারাতে পারেন নি, তাই আপনি তাকে হাত দিয়ে হারাতে চান। এতে আসলে বুঝা যায় যে আপনি আপনার যুক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী নন । আপনাদের প্রতি আমার যুক্তি হল- আল্লাহ আমাদেরকে এমন শক্তিশালী বক্তব্য সম্বলিত গ্রন্থ দান করেছেন যার চেয়ে শক্তিশালী কিছুর অস্তিত্ব নেই। এর চেয়ে শক্তিশালী কোন বাণীর অস্তিত্ব নেই। আমাদের অন্য কিছুর আশ্রয় নিতে হবে না। আর যখন আমরা অন্য কিছুর আশ্রয় নিই, এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমরা স্বীকার করে নেই যে কুরআন আসলে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। কিন্তু এটা যথেষ্ট শক্তিশালী, আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী নই। কারণ আমারা এই গ্রন্থের সাথে ভালোভাবে যুক্ত নই।

সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আর যৌক্তিক জবাব আমাদের কাছে থেকেই আসার কথা ছিল। যা বিশ্বের অনৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় সবচেয়ে গভীর আর চিন্তা উদ্বীপক পন্থায়। আমাদেরই তো কথা ছিল অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক, খ্রীষ্টান সহ সবার সাথে গভীর আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার। ইউরোপে ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ শত শত বছরের পুরনো। এখন সারা দুনিয়াতে। ধার্মিক মানুষ বদ্ধ মস্তিস্কের , ধার্মিক মানুষ উন্মত্ত , ধার্মিক মানুষ অসহিষ্ণু , ধার্মিক মানুষ সমালোচনা সহ্য করতে পারে না , ধার্মিক মানুষ আলোচনার জন্য উন্মুক্ত নয়। তাই আপনি যদি ধর্ম থেকে মুক্তি পেতে পারেন তবেই আপনি পেতে পারেন মুক্ত বুদ্ধি চর্চার একটি সমাজ যেখানে মানুষ নিজেদের জন্য চিন্তা করতে পারবে। এটা তাদের অভিযোগ। খ্রিস্ট ধর্মের ক্ষেত্রে তাদের এ অভিযোগ সত্য। যা শত শত বছর যাবত ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে –আল্লাহ তার রাসুল (স) কে ঠিক তার উল্টোটা দিয়েছেন। এটা এমন ধর্ম যা আলোচনাকে স্বাগত জানায়, هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর।( সুরা বাকারা – ১১১, সুরা আন নামল – ৬৪) কেন তুমি কুরআনের বিরুদ্ধে তোমার সকল অভিযোগ উপস্থাপন কর না ? আমি তোমাকে আহ্বান জানাচ্ছি, নিয়ে আস তোমার সকল অভিযোগ। একটা বই কীভাবে মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছে শুধু বিশ্বাস করার জন্য নয় বরং একত্রিত কর তোমার সব অভিযোগ, সব সমালোচনা এবং নিয়ে আস। এটাকেই বলা হয় মনের প্রকৃত উদারতা। আল্লাহর বই উদার, কিন্তু আমরা নিজেরাই বদ্ধ মনের। আমাদের মনের উন্মুক্ত করণের মাধ্যমে এই উম্মাহকে আবার শক্তিশালী করতে হবে। এই বই খুলে দেখার মাধ্যমে এবং সেভাবে চিন্তা করার মাধ্যমে যেভাবে এই বই আশা করে। এটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য যে ধর্ম মানুষের দৃষ্টিশক্তি আর মনের জানালা বন্ধ করার জন্য নয়। বরং ধর্ম এসেছে মানুষের মনের জানালা খোলার জন্য , আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য এবং মানুষকে সভ্যতা শেখানোর জন্য।

তারা মনে করে সমাধান হলো যখন আপনি ধর্ম থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু আমরা বলি, সমাধান হলো যখন আপনি প্রকৃত ধর্মকে ফিরিয়ে আনবেন। হ্যাঁ , মিথ্যা ধর্ম অন্যায়- অত্যাচার নিয়ে আসবে। কিন্তু যখন আপনি আল্লাহর দ্বীনকে ফিরিয়ে আনবেন – এটা সৌন্দর্যমন্ডিত একটা জিনিস। যদি আমরা তাদেরকে তা দেখাতে না পারি তাহলে কে দেখাবে ? এজন্যই আল্লাহ আমাকে আপনাকে এই দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এই উম্মাহর একজন সদস্য হওয়া সম্মানের ব্যাপার , এটা কোনো ছোট বিষয় নয়। আমরা সম্মিলিতভাবে আমাদের কাঁধে সে বোঝা বহন করছি যা বহন করেছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এই দায়িত্বের বোঝা আমরা প্রতিদিন বহন করে চলছি আমরা এটা স্বীকার করি বা নাই করি। যখন আমরা সে দায়িত্বের বোঝা থেকে কিছু না করি, আমরা মানবতাকে না দেখাই এটা কী, তাহলে আমরা সমস্যায় পতিত হব। এই সমস্যা বিভিন্ন অথরিটি, বা মিডিয়ার সাথে নয়, আমরা আল্লাহর সাথে সমস্যায় পতিত হব।

আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ আমাদেরকে আবার কুরআন প্রেমিক মানুষে পরিনত করুক , যেভাবে আল্লাহ চান আমরা যেন সেভাবে চিন্তা করতে পারি। এবং আমরা আমাদের চরিত্রকে উপস্থাপন করতে পারি সমাজে , ব্যবসায়ীক লেনদেন এর ক্ষেত্রে , আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে , আমাদের বক্তৃতা – বিবৃতিতে, আমরা যাতে তা চিত্রিত করতে পারি যা আমাদের দ্বীনকে নিখুত বানিয়েছে , যা এই দ্বীনকে বানিয়েছে এত সুন্দর। আল্লাহ তায়ালা এই হেদায়াতের আলোকবর্তিকা আমাদের সকলের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত করুক। একে শক্তিশালী রাখুক , এর শক্তি আরো বৃদ্ধি করুক। আল্লাহ তরুণ প্রজন্মকে এমন নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা দান করুক যারা এই অন্ধকার যুগকে স্বর্ণ যুগে পরিণত করবে।