উস্তাদ নুমান আলী খানের কুরআন উইকলি তে দেয়া কুরআনের রত্ন সিরিজ থেকে।
فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ
অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল।সূরা আল আরাফঃ ২২
আসসালামু আলায়কুম, Quran Weekly.
সূরা আল আরাফ এর ২২ নম্বর আয়াতটি দীর্ঘ একটি আয়াত, কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায়, আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই এর প্রথম অংশ, যার মধ্যে আছে জীবনের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের প্রজ্ঞা। আমরা কিভাবে শয়তানের মোকাবেলা করবো, আল্লাহ বর্ণনা করছেন, শয়তান কিভাবে আমাদের আদি পিতামাতা আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে ভুল করার জন্য প্ররোচিত করেছিল। তার কি এমন পদ্ধতি ছিল, যাতে তারা তার কথা মত কাজ করেছিলো?
এটা শুধু তার কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আমরা সবাই জানি যে সে তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল, আমরা জানি যে সে তাদের কে অনন্ত জীবনের লোভ দেখিয়েছিল এবং বলেছিল যে তারা জান্নাতে থাকতে পারবে। এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু সে আসলে কিভাবে তা করেছিল, তার পদ্ধতি কি ছিল? এই পদ্ধতিটি বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এটাই তুলে ধরা হয়েছে আয়াতটির প্রথম অংশে – ফাদাল্লাহুম্মা বি গুরুরিন।
“দাল্লা” ব্যবহার করা হয় যখন আপনি বালতি টেনে তুলেন। আরবিতে “দাল্লু” বলতে বালতি বুঝানো হয় আর “আদলা” মানে হল বালতি নীচে ফেলে আবার টেনে উপরে উঠানো। যেমন পুরনো দিনে কুয়াতে বালতি ফেলে পানি টেনে উপরে উঠানো হত, মানে বালতি টেনে টেনে তুলতে হত, এটাই হল “আদলা”। কিন্তু “দাল্লা” হল খুব ধীরে ধীরে বালতি নামানো, যেমন খুব পুরনো পশু শিকার করার পদ্ধতি। যেমন আপনার কাছে একটি গাজর বা কিছু খাবার আছে, আপনি তা বালতিতে রেখে দিলেন, এবং বালতিটা দড়িতে বাঁধা। যখন কোন প্রাণী তাতে আকৃষ্ট হয়, আপনি ধীরে ধীরে বালতিটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসেন, আর প্রাণীটি পিছু পিছু আসে। এটাই হল “দাল্লা”।
আক্ষরিক ভাবেই, শয়তান তাদের কে বলেনি, “আল্লাহকে অমান্য করো”। সে তাদেরকে অল্প অল্প করে আপস করতে বলল আর তারা তা শুনল। তারপর সে তাদেরকে আরেকটু আপস করার প্রস্তাব দিল- “এটাতে কোন ক্ষতি নেই, আমি যা বলছি তা হারাম নয়, আমি শুধু বলছি একটু ছাড় দিতে, তোমাকে এই গাছের ফল খেতে হবেনা, (আমাদের আদি পিতামাতার ক্ষেত্রে), আমি বলছিনা যে তোমাদের এই গাছের ফল খেতে হবে, আমি শুধু বলছি যে গাছটিকে একবার ভাল মত পর্যবেক্ষণ কর, গাছটির দিকে তাকানোর মাঝে তো কোন দোষ নেই, তাইনা?”।
আপনারা জানেন আল্লাহ্র হুকুম ছিলঃ “ওয়ালা তাক্রাবা হাজিহি আস-শাজারা”, গাছটির কাছেই তোমরা যেওনা। তাই শয়তান প্রথমে তাদের বলল “দেখ, তোমরা তো গাছটিকে স্পর্শ করছনা, ঠিক আছে? শুধু গাছটির কাছে যাও, এতে এমন আর কি ক্ষতি হবে?” যখন তারা এর কাছে গেল, তখন সে বলল “এমন কোন নিয়ম নেই যে তোমরা গাছটির উপর চড়তে পারবেনা, তোমাদেরকে শুধু এর ফল খেতে নিষেধ করা হয়েছে। একটু চড়েই দেখ, এতে কোন ক্ষতি হবেনা। ” আর এটা সে একবার মাত্র বলেনি, “দাল্লা” বলতে এটাই বুঝায় যে সে এসব কুপরামর্শ দিনের পর দিন দিয়ে আসছিল। এটাই ছিল তার পদ্ধতি।
এটা এমন নয় যে সে আদম (আঃ) কে একবার বলল আর আদম (আঃ) তৎক্ষণাৎ গাছটির কাছে যেয়ে এর ফল খেয়ে ফেলল। এখানে সত্যিকার অর্থেই খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ছিল তাকে প্ররোচিত করার –“ফাদাল্লাহুম্মা বি গুরুরিন” । আর এটাই সে বর্তমানে প্রয়োগ করে আমাদের উপর। এই কারনেই কুরআনে এর উল্লেখ করা হয়েছে। যে সে তাদেরকে টেনে আনল – “বি গুরুরিন”। আমি এখনও এর অর্থ বলিনি – এর মানে হল প্ররোচিত করা, এটা একধরনের ধোঁকা দেয়া।
অন্যভাবে বলতে গেলে, কিছু জিনিষ আছে যা পরিস্কারভাবেই খারাপ। আপনি আর আমি উভয়েই জানি যে, কিছু জিনিস পরিষ্কারভাবেই মন্দ। কিন্তু এমন অনেক জিনিষ আসে যেটা সম্বন্ধে পরিষ্কার ভাবে খারাপ বলা যায়না, কিন্তু এদের সম্বন্ধে আপনার এতটুকু সচেতনতা থাকা দরকার যে, আমি যদি এই ছোট ধাপটি পার হই, কালকে আমি আরও একধাপ বেশি করব, আর এইভাবে দিনে দিনে আমার অজান্তেই আমি খারাপ কাজ করে বসব। তাই আপনাকে আত্মরক্ষার ব্যাবস্থা নিতে হবে। আর যখন আপনি এমন প্রস্তুতি নিবেন, তখনই আপনি নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। যখন শয়তান আপনার কাছে আসে, তখন সে আপনাকে সরাসরি হারাম কে হালাল বলতে বলেনা। এটা খুবই সরাসরি আর যেকোনো মুসলিম বলবে, “না, এটা অবশ্যই হারাম, আমি কখনই এটা করবনা”।
তাই সে যখন আসে, তখন বলে- ‘শোন, এই ছোট যে কাজটি করতে বলছি তা স্পষ্টতই হারাম না, এটা খারাপ না, তুমি এতটুকু করতেই পার, কেউ তোমাকে এর জন্য দোষ দিবেনা”। তারপর মানুষজন শেখ, আলিম, দায়ি বা খাতিব দের কাছে যেয়ে বলে, ”আমি জানি যে মদ্যপান হারাম, কিন্তু আমি কি এমন বন্ধুদের সাথে মিশতে পারব যারা মদ্যপান করে? আমি বারে যাবনা, কিন্তু তারা কখনও অফিস এ মদ্যপান করে, আমি কি তখন তাদের সাথে থাকতে পারব? মানে, তারা আমার বন্ধু। আমি কি শুধু এতটুকু করতে পারিনা? এটা করা কি সত্যি সত্যি হারাম?”
তো সেই শেখ তাকে এমন বলবে যে “আমার পরামর্শ হল এমন করা ঠিক না, এটা ভাল নয়, তোমার এমন বন্ধুদের সাথে মেশা ঠিক নয়”। কিন্তু এটা কি হারাম? এটা কি সত্যি সত্যি হারাম? তারা বলবে, “আসলে আমি জানিনা এতকে হারাম বলা যায় কিনা”। “আচ্ছা, ধন্যবাদ। আমার জবাব পেয়ে গেছি, এটা সত্যিকার হারাম নয়, তার মানে আমি এটা করতে পারব।” আর এভাবেই শয়তান আপনাকে প্ররোচিত করে এমন বন্ধুদের সাথে মিশার জন্য।
তারপর তারা একদিন বলবে “আমরা বারে যাচ্ছি, তুমি কি আসবে?” তারপর আপনি বারে গিয়ে কোক বা অন্নকিছু খান, আর তারা বিয়ার খায়। তারপর কোন এক গভীর রাতে, এমন কিছু ঘটে- “আমাকে অল্প একটু দিতে পারো?” কেউ একজন আপনাকে এগিয়ে দিল, বা আপনার অজান্তেই আপনার কোকের সাথে মিশিয়ে দিল। আপনি নিজেকে বললেন “আমি তো এটা ইচ্ছা করে করিনি”। আর এভাবেই একটার পর আরেকটা তারপর আরেকটা সুবহানআল্লাহ। এটাই হল – ফাদাল্লাহুম্মা বি গুরুরিন।
এটাই সেই সূরা যেখানে আল্লাহ বারসিসার কাহিনি বর্ণনা করেছেন, যে অল্প অল্প করে পাপের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে পুরো গল্পটি বলা সম্ভব নয়, কিন্তু মূল শিক্ষা একই। শয়তান আপনাকে সরাসরি খারাপ কাজ করতে বলবেনা। শয়তান আপনাকে অল্প অল্প করে আপস করতে বলবে, অথবা আপনাকে শুধু পাপের পথ ধরিয়ে দিবে। আর যখন আপনি এই রাস্তায় আসেন, যতক্ষণ আপনি খারাপ কাজটি না করছেন, ততক্ষণ কেউ এসে আপনাকে সরাসরি বলতে পারবেনা যে, “শোন, তুমি যা করছ, এটা খারাপ”। কারন এটা খারাপ না, কিন্তু এটা আপনাকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে! যদি আপনি বুঝতে না পারেন যে আপনাকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই টেনে নেয়া হচ্ছে, তাহলে আপনি একমাত্র নিজেকেই দোষ দিতে পারেন।
এই জন্যই আদম (আঃ) এর প্রতি আল্লাহ্র নির্দেশ এটা ছিলনা যে, গাছটির ফল খেয়না, বরং বলা ছিল এর কাছেও যেওনা। এই দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, আর তাই আপনাকে আমাকে বুঝতে হবে যে, কিছু জিনিস পরিষ্কারভাবেই হারাম, আর কিছু রাস্তা আমাদেরকে এদের দিকে নিয়ে যায়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন আমরা সেই রাস্তায় না যাই যেদিকে শয়তান আমাদের টেনে নিতে চাচ্ছে।