জীবনে কেন বিপদাপদ ঘটে? পর্বঃ ০৩ (শেষ পর্ব)

জীবনে কেন বিপদাপদ ঘটে? পর্বঃ ০৩ (শেষ পর্ব)

এটা ছিল দু’টো আয়াতের একটি যে ব্যাপারে আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম। বিপদের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া হল- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন”। কিন্তু এখন শেষ কিছু মিনিটে আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, জীবনে যত বিপদ আপদ, সমস্যা, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো নিয়ে।

আর সেটা হল কুরআনে দুই ধরনের আয়াত আছে। এক ধরণের আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন যে যা কিছুই তোমাদের ক্ষেত্রে ঘটে

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا
‘’পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।‘’( সূরা হাদিদ -২২)

জীবনে যত রকম বিপদ হয়, যেখানেই হোক, যার উপরেই হোক, এমন কোন বিপদ নেই আকাশে মাটিতে যেখানেই হোক, যেটা আগে থেকেই কিতাবে লেখা নেই। এটা পূর্ব নির্ধারিত। অর্থাৎ এটি আল্লাহ পাকের কদর, যে এটা হবেই, হবারই ছিল। ধরুন কেউ একজন খুব অল্প বয়সে মারা গেল, আপনি এটা বলতে পারেন না যে আহা বেচারার পুরো জীবনটা সামনে পড়ে ছিল। না, তার ছিল না। এই রকম কিছুর অস্তিত্ত নেই। তার জীবনটা ওইটুকুই নির্ধারিত ছিল। এই দুনিয়াতে তার সময় ওইটুকুই ছিল, বেশিও নয়, কম ও নয়। আমার এই দুনিয়াতে থাকার সময়ও নির্ধারিত, আপনার সময়ও নির্ধারিত। আপনি বিভিন্ন কবরস্থানে গেলে দেখবেন যে কারও কারও জন্ম ১৯০১ সালে, মারা গেল ২০১৩ সালে। আবার এটাও দেখবেন যে কেউ জন্ম নিল ২০১৩, আবার মারাও গেল ২০১৩ সালে। এমন কবরও আপনি পাবেন। আর এটা আল্লাহ পাক আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন যে কতটুকু সময় আমরা প্রত্যেকে এই দুনিয়াতে থাকব। এটা নির্ধারিত।আপনি বলতে পারেন না যে আজ যদি সে বেঁচে থাকতো !না, না, না । কারণ এটা ঠিক করা ছিল, আগে থেকেই!

আরেকটি ব্যাপার আল্লাহ পাক বলেন যে,

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ
“আল্লাহ পাকের অনুমতি ব্যতীত কোন বিপদ আপদ তোমাদের উপর পড়ে না” (সূরা তাঘাবুন-১১)

আর সত্যিকারের ঈমানদারদের দিকে তাকান, তারা কি দারুন কথাই না বলে! তারা বলেঃ 

قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا
“আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন; তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক। (সূরা আত-তাওবা ৫১)

আমাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হয় না তা ব্যতীত যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তারা বলতে পারতো যে যা আল্লাহ পাক আমাদের বিপক্ষে লিখে রেখেছেন। কারণ আমরা যখন বিপদ-আপদের কথা ভাবি, আমরা ভাবি এইগুলো সব আমাদের বিরুদ্ধে আসছে। কিন্তু আয়াতটি বলছে, مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন! هُوَ مَوْلَانَا আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাক বিশ্বাসীদের শেখাচ্ছেন যে যখন বিপদ-আপদ আসে এগুলো আমাদের বিরুদ্ধে লেখা নয়, বরং আমাদের জন্যই লেখা ! আর এইভাবেই একজন বিশ্বাসীকে ভাবতে হবে বিপদ-আপদ নিয়ে, যে এটা তার জন্যই।

পবিত্র কুরআনে আরও কিছু আয়াত আছে, একটি দুটি নয়, কয়েকটি। যেখানে আল্লাহ বলেন- তোমাদের উপর যা-ই ঘটে,

فَأَصَابَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا عَمِلُوا সুতরাং তাদের মন্দ কাজের শাস্তি তাদেরই মাথায় আপতিত হয়েছে। (সূরা নাহল: ৩৪)
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। (সূরা আশ শুরা:৩০)

আল্লাহ বলছেন এটা তোমাদের দোষ। কিছু আয়াতে আল্লাহ পাক এটাই বলছেন যে এটা আল্লাহর সিদ্ধান্তের কারণে নয় বরং তোমাদের নিজেদের কারণেই তোমাদের উপর বিপদাপদ পতিত হয়। এটা তোমাদের দোষ। তিনি অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।

এখন এই দুটো ব্যাপারে আমারা কিভাবে সিদ্ধান্তে আসব যে আসলে এটা কেন হল? আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় নাকি আমার দোষে? প্রথম যে উপদেশটি আমি দিব- আল্লাহ পাক কখনই বলেননি, “কুল”(বল) বল, এটা তোমারদেরই দোষ। শুধুমাত্র সূরা আলি ইমরানের এক আয়াত ছাড়া,

قُلْ هُوَ مِنْ عِندِ أَنفُسِكُمْ
“এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছেছে তোমাদেরই পক্ষ থেকে।‘’ (৩: ১৬৫)

অন্য কথায়, আমরা এটা কখনই কাউকে বলতে পারব না যে এইরকম কিছু তোমার সাথে হচ্ছে, এটা তোমার দোষ। কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত, তাকে গিয়ে এটা বলতে পারব না যে, জানো তোমার কেন ক্যান্সার হয়েছে? কারণ তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড় না, এই জন্যই তোমার ক্যান্সার হয়েছে। এটা আপনি বলতে পারবেন না।

আবার অন্যদিকে, উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছিল তাদের বল যে, এটা তোমাদেরই ভুলের কারণে। যখন বিশ্বাসীরা জিজ্ঞেস করল, কেন এরকম হল, কিভাবে হল? তাদের বল, তোমাদেরই কারণে। এই ব্যতিক্রমের কারণ (তথা মানুষকে বলা যে, তোমাদের কারণেই তোমাদের উপর বিপদ আপতিত হয়েছে) হল উহুদের যুদ্ধের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? বিশ্বাসীরা জয়ের মুখ দেখেছিল, তারা প্রায় জিতে গিয়েছিল। তারা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল আর শত্রু পক্ষ পালিয়ে যাচ্ছিল। তখনই কিছু তীরন্দাজরা তাদের নির্ধারিত স্থান ফেলে চলে গিয়েছিল। এর কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। এখন আপনারা তো আল্লাহ পাককে দোষ দিতে পারেন না । কারণ আপনারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান থেকে সরে গিয়েছিলেন! আপনাদের কাজ কর্মের জন্য আপনাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।

এই আয়াত থেকে আমরা এটাই শিখছি যে, সব কিছুতেই আল্লাহ পাকের দোহাই দিলে চলবে না। আপনি স্পিড লিমিট অতিক্রম করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, এরপর আপনি দুর্ঘটনায় পতিত হলেন, তখন আপনি বলেন, না এটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, আল্লাহ পাকের ইচ্ছায়ই এটা হল। না না, সেটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যাবেনা। আপনি স্পিড অতিক্রম করেছেন, আপনি উম্মাদের মত গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাই এটা আপনারই দোষ। আপনার হয়তো গাড়িতে তেল ভরার কথা ছিল, কিন্তু আপনি ভরলেন ঘি অথবা অন্য কিছু :)। আপনার গাড়ি আর চলছে না, তখন আপনি বলছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি কি করতে পারি? না না, এটা আপনার কর্মেরই ফল, তাই আপনাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।

সবকিছুতে আল্লাহ পাকের দোহাই দিলে চলবে না। আপনি নিজে কোন চাকরির জন্য আবেদন করছেন না, সারাদিন বাসায় বসে আছেন, আপনি কোন চাকরি পাচ্ছেন না, আল্লাহ পাক কোন ফেরেস্তাকে অফার লেটারসহ পাঠাচ্ছেন না আপনার কাছে । আর আপনি বলছেন আল্লাহ পাক যখন চাইবে, তখনই হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! না! কুরআনে এভাবেই ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।

যখন এমন কোন ঘটনা ঘটে, যেটি আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে, সেটি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকেই এসেছে। বন্যার আক্রমণ আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে, কারও গাড়ি আপনাকে এসে ধাক্কা দিল, এটা আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। আপনার কোন গুরুতর অসুস্থতা ধরা পড়লো, এটি আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
কিন্তু এই অসুস্থ হবার কারণ যদি হয় আপনার দিনে চার প্যাকেট সিগারেট খাওয়া। আপনার ডাক্তার বলে যে, আপনি কিন্তু ডায়াবেটিসের দিকে যাচ্ছেন। আর আপনি আপনার চিনিতে একটু চা ঢালেন। (অতিরিক্ত চিনি খাওয়া বুঝাতে তিনি ব্যাঙ্গ করে এটা বলেছেন) আপনি এইরকম যদি করেন, তাহলে আল্লাহ পাককে দোষারোপ করতে পারেন না ! এটা من عِندِ أَنفُسِكُمْ আপনারই দোষ! কুরআন এই সমস্যাকে কী চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ ভাবেই না বর্ণনা করেছে! বিশ্বাসীদের এটা বুঝতে হবে, কি করে দায়িত্ব নিতে হয়, নিজের কর্মফলের।

তবে যেটাই হোক, বিপদ যে কারনেই আসুক, যদি সেটা মৃত্যু না হয়, এটা আল্লাহ পাকের কাছ থেকে একটি পুরস্কার যেন আমরা শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি আর ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু করি। কিছু মানুষ তাদের চাকরি হারায়। আর তাদের মাঝে দুই ধরণের মানুষ আছে, কেউ নিজেকেই দোষারোপ করে, কেউ আবার আল্লাহ পাককে দোষারোপ করে।(না’উজুবিল্লাহ) কখনও কখনও এটা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারনে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসেন, আপনার কাজ আপনি শেষ করছেন না, আপনি যোগাযোগ ঠিকমত রাখছেন না, প্রতিদিন ৩০ টা ই-মেইল আসছে, আপনি সেগুলোর জবাব দিচ্ছেন না। তারপর আপনি বরখাস্ত হলেন, তখন আল্লাহ পাককে দোষারোপ করলে চলবে না। আপনার চাকরি যাওয়ারই ছিল। আর যখন আপনি বরখাস্ত হলেন, এটি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে একটি পুরস্কার কারণ, পরের বার আপনি যখন চাকরি করবেন আপনি আগের বারের মত ওই ভুলগুলো আর করবেন না। শিক্ষা আপনি নিয়ে নিবেন। এই বিপদ আপদ গুলো আমাদের আগের চেয়ে ভালো মানুষে পরিনত করে, ভালো বিশ্বাসীতে, মানসিকভাবে আমাদের আরও শক্ত করে, আরও দায়িত্ববান করে।

এখন পুরোটার একটা সারমর্ম এই শেষ কিছু মিনিটে। প্রথমত, যখনই কোন বিপদ-আপদ আসবে, আপনার জবানকে শিক্ষা দিন, যেন সে এটা বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দ্বিতীয়ত, অন্য কাউকে এটা বলবেন না যে তারা এই বিপদে পড়েছে আল্লাহ পাকের কারনেই। কাউকে এমন কিছু বলবেন না। আপনি যদি কাউকে এগুলো বলতে চান, কারও কথা ভাবার আগে নিজের কথা ভাবুন। অদৃশ্য থেকে যা হল, আল্লাহ পাকের কাছ থেকে যা হল, সে ব্যাপারে আপনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেননা যে আল্লাহ পাক এটা কেন করলেন! আল্লাহ পাক আপনার নিকট সে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেননি যে কেন তিনি এটা করছেন। সেই অনুমতি আপনার নেই।

আর আমাদের নিজেদের জন্য, আমাদেরকে এই পার্থক্যটা করতে হবে যে, যখন ব্যাপারগুলো আমাদের হাতের বাইরে, নিয়ন্ত্রনের বাইরে, আমরা তখন বলব ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আর যখন ব্যাপারগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রনে, আমাদের সাধ্যের মাঝেই, তখন আমাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, আমরা নিজেরাই এই ভুল করেছি। এটা করা আমাদের উচিত হয়নি। এটা আমাদের কৃতকর্মেরই ফল।

আল্লাহ পাক আমাদের দায়িত্ববান মুসলিম হবার তৌফিক দান করুন, বিশেষ করে আমরা যে কথাবার্তা বলে থাকি সে ব্যাপারে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদের আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিনন্দন জানাবেন, ধৈর্যশীল হিসেবে। আমাদের তিনি ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলার তৌফিক দান করুন আমাদের মুখ দিয়ে ও মন দিয়ে। যখনই কোন বিপদ আপদে আমরা পড়ব। আল্লাহ পাক আমাদের অন্তরকে শক্তিশালী করে দিন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন যারা এই দুনিয়ার সকল পরীক্ষায় পাস করে যান, তা যেই পরীক্ষাই হোক, কিয়ামতের দিন তার সাথে সাক্ষাতের সময় যেন আমাদের বক্ষ আলোকিত থাকে এবং ডান হাত থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে।

(সমাপ্ত)