জুম্মাবারের স্মরণিকা – ১ (দরুদ শরিফ পাঠের ফজিলত)

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাকুল সালাত পাঠায় নবীর ওপর। কাজেই হে ঈমানদাররা! তোমরাও তার ওপর যথাযোগ্য মর্যাদায় সালাত পাঠাও, আর সালাম জানাও”। (সূরা আহজাব : ৫৬)।

“আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীর প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ নবীর প্রতি সীমাহীন করুণার অধিকারী। তিনি তার প্রশংসা করেন। তার কাজে বরকত দেন। তার নাম বুলন্দ করেন। তার প্রতি নিজের রহমতের বারি বর্ষণ করেন।

ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তার প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, তারা তাকে চরমভাবে ভালোবাসেন এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ যেন তাকে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তার শরীয়াতকে প্রসার ও বিস্তৃতি দান করেন এবং তাকে একমাত্র মাহমুদ তথা সবোর্চ্চ প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেন”।

আল্লাহ তায়ালা দরুদ ও সালাম পাঠাচ্ছেন নবীর ওপর, সেই কাজটি কত বড় মাহাত্ত্বের হতে পারে একবার চিন্তা করুন। আল্লাহ নিজেও চাচ্ছেন যেন আমরাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এবং তাঁর সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে দরুদ ও সালাম প্রেরণ করে এই গুরুত্বপুর্ণ, মাহাত্ত্বের কাজে আমরাও অংশ নেই।

সহীহ বুখারীর হাদীস অনুযায়ী, আল্লাহর দরুদ হলো ফেরশতাদের নিকট রাসূলের প্রশংসা ও গূণাবলীর বর্ণনা দেওয়া। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহর রাসূলের এতই গূনাবলী যে সেগুলোর প্রশংসা আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে কুরআন নাযিলের সময় থেকে করতেছেন আর কিয়ামাত পর্যন্ত করতেই থাকবেন!! সুবহানাল্লাহ, কত বিশাল গূণাবলী সম্পন্ন লোক ছিলেন তিনি। আমরাও কি এই সুযোগ নেবো না? আল্লাহর আদেশ মেনে তাঁর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করবো না?

“আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরুদ পাঠের উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো তাঁর উচ্চতর পরিষদবর্গের (ফেরেশতাগণ) সামনে তিনি তাঁর প্রশংসা করেন। আর তাঁর ফেরেশতাদের দরুদ পাঠ করার যে উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ হলো, তারা তাঁর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। ভাবতে অবাক লাগে, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদা কত উঁচূ যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ তাঁর নবীর যে প্রশংসা করেন, তা-ই সমগ্র সৃষ্টিজগত কর্তৃক প্রতিধবনিত হয় এবং তা সমগ্র সৃষ্টিজগতে চিরদিনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরপর সম্মান ও অনুগ্রহের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এরপর মানুষ যা দরুদ ও সালাম পাঠায়, তা আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেশতাদের দরুদ ও সালামের পর নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়। এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এটাই চান যে, মোমেনরা তাদের দরুদ ও সালামকে আল্লাহর দরুদ ও সালামের সাথে সংযুক্ত করে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করুক এবং এভাবে তারা মহান আল্লাহর শাশ্বত, চিরন্তন ও উচ্চ মার্গের সাথে যুক্ত হোক”

(অনূদিত তাফসির ফি যিলালিল কুরআন – সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, ১৬তম খন্ড, পৃষ্ঠা – ১৯৭)

“আয়াতের আসল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদেরকে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করার আদেশ দান করা। কিন্তু তা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রথমে আল্লাহ স্বয়ং নিজের ও তাঁর ফেরশতাগণের দরুদ পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর সাধারণ মুমিনগণকে দরুদ প্রেরণ করার আদেশ দিয়েছেন। এতে তাঁর মাহাত্ম ও সম্মান এত উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে যে, রসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শানে যে কাজের আদেশ মুসলমানদেরকে দেয়া হয়, সে কাজ স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণও করেন। এতএব যে মুমিনগণের প্রতি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুগ্রহের অন্ত নেই, তাদের তো একাজে খুবই যন্তবান হওয়া উচিত। এ বর্ণনাভঙ্গীর আরও একটি উপকারিতা এই যে, এতে করে দরুদ ও সালাম প্রেরণকারী মুসলমানদের একটি বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এমন এক কাজে শরীক করে নিয়েছেন, যা তিনি নিজেও করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও”

(তাফসির মা’রেফুল কুরআন, পৃ-১০৯৪, মূল মাওলানা মুফতি শফি)

রাসুল (সাঃ) বলেন,

“যে ব্যক্তি আমার উপর ১ বার দরুদ পাঠ করে, সেই ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০বার রহমত বর্ষণ করেন, তার ১০টি পাপ মোচন করেন, এবং তাকে ১০টি মর্যাদায় উন্নীত করেন”। (সহিহ আন-নাসাই-১২৩০)

রাসুল (সাঃ) বলেন,

যে ব্যক্তি সকালে ১০বার ও সন্ধ্যায় ১০বার আমার উপর দরুদ পাঠ করে সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করবে।
(তবারানি, সহিহ তারগিব-৬৫৬)

নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ করলে আমাদের জন্য লাভ আছে অনেক। আমরা সবাই আল্লাহর দয়া চাই। কিন্তু সেই দয়া লাভের সহজ পথ খুঁজে পাই না। দেখুন, দরুদের বিনিময়ে সেই দয়া লাভের কী সুন্দর ও সহজ সুযোগ আছে। নবীজি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পড়ে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার ওপর ১০ বার রহমত নাজেল করেন। (মুসলিম শরিফের বরাতে রিয়াদুস সালেহিন, হাদিস : ১৩৯৭)।

অন্য রেওয়ায়েতে আছে,

আল্লাহ তায়ালা নবীজির প্রতি একবার দরুদ পাঠের বিনিময়ে দরুদ পাঠকারীর প্রতি ৭০ বার রহমত নাজিল করেন। আল্লাহর নবীর প্রতি আনুগত্য ও অনুসরণের অনুভূতি তাৎপর্যময় হওয়ার জন্যই প্রয়োজন তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করা, আর তাঁর ভালোবাসার দাবি হচ্ছে তাঁর তারিফ করা ও সকাল-সন্ধ্যা বেশি বেশি করে দরুদ শরিফ পড়া।

সহী মুসলিম, সূনানে তিরমিযি, সূনানে নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ এবং এছাড়া আবু হোরায়রা থেকে এসেছে ৪ যে, রাসূল (সাঃ) বলেন مَن صَلّي عَلَيَّ و احِداً صلَّي اللهُ عَلَيهِ عَشراً যে কেউ আমার উপর একবার দূরুদ পড়ে মহান আল্লাহ তার উপর দশবার দূরূদ পাঠান। [সহী মুসলিম কিতাবুস সলোত, সুনানে তিরমিযি – ২৭০, সুনানে নাসাঈ, রিয়াজুস সালেহীন পৃঃ ৩৮১। তাফসীওে কুরতুবী খঃ১৪ পৃঃ ২৯৪]

প্রচলিত দরুদটি হলোঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ».
(আল্লা-হুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিউওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা ‘আলা ইবরাহীমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিউওয়া ‘আলা আলি মুহাম্মাদিন, কামা বা-রাকতা ‘আলা ইব্রাহীমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদ)।

“হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার পরিজনের উপর রহমত নাযিল করুন যেমন আপনি রহমত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর। নিশ্চয় আপনি অত্যন্ত প্রশংসিত ও মহামহিমান্বিত। হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার পরিজনের উপর বরকত নাযিল করুন যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর। নিশ্চয় আপনি অত্যন্ত প্রশংসিত ও মহামহিমান্বিত”। (বুখারী)

আল্লাহ আপনার ওপর দরুদ পাঠাবেন, রহমত নাযিল করবেন, আপনার পাপ মোচন করবেন, আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে – এতগুলো জিনিস আপনি পাবেন কেবল আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওপর দরুদ পাঠ করার কারণে। আল্লাম আমাদের বেশি বেশি দরুদ পাঠ করার তাওফিক দিন। আমিন।