লোক দেখানো সৎকাজের পরিনাম এবং আত্মসমালোচনার গুরুত্ব

আল্লাহ প্রদত্ত একটি চমৎকার উপমার মাধ্যমে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। আল্লাহ সূরা নূরের ৩৯ নাম্বার আয়াতে বলেন, وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً ‘’যারা কাফের…’’, এর আরো একটি অনুবাদ করা যায় যারা গোপন করেছে, অর্থাৎ যারা তাদের আলোকে গোপন করেছে। আপনি কুফর শব্দটাকে এভাবেও চিন্তা করতে পারেন। যাইহোক – যারা অস্বীকার করেছে (অকৃতজ্ঞ, নিজেদের আলোকে গোপন করেছে) তাদের তাদের কর্ম সেই ব্যক্তির মত যে ভর দুপুরে কোন এক মরুভূমির মাঝ দিয়ে ভ্রমণ করছে তারপর সে হঠাৎ করে ‘সারাব’ দেখতে পায়। অর্থাৎ মরীচিকা দেখতে পায়।

তো, সেই পুরুষ বা মহিলাটি পিপাসা কাতর, মরুভুমিতে হারিয়ে গেছে, জীবন বাঁচানোর জন্য কোন জায়গা খুঁজছে…। ভর দুপুরে তপ্ত রোদে মরুভূমিতে এভাবে হাঁটলে সামনের বালুকারাশিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সেখানে তো কোন সমুদ্রের ঢেউয়ের অস্তিত্ব নেই। দূর থেকে মনে হয় পানি দেখা যাচ্ছে। এটাকেই বলা হয় মরীচিকা। আপনি যেহেতু পিপাসায় মারা যাচ্ছেন, তাই ভাবেন অন্তত গিয়ে দেখি পানি পাই কিনা। يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً – তাই পিপাসা কাতর ব্যক্তি সেই মরীচিকাকে পানি মনে করে তার দিকে দৌড়ে যায়। حَتَّىٰ إِذَا جَاءَهُ – এমনকি, সে যখন তার কাছে যায়, لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا – তখন ‘’সেখানে সে কিছুই পায় না।’’ এটা তো শুধু বালুই ছিল। এটা কেবল একটা মিথ্যা চিত্র ছিল। وَوَجَدَ اللَّهَ عِندَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ ۗ وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ – ‘’এবং পায় সেখানে আল্লাহকে, অতঃপর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দেন। আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।’’

সে সেখানে শুধু আল্লাহ তায়ালাকে পায়। সেই লোকটি পানির খোঁজে সেখানে গিয়েছিল, কিন্তু এই উদাহরণের মাঝখানে আল্লাহ আশ্চর্যজনক একটি বাঁক নিয়েছেন। পানি পাওয়ার পরিবর্তে সেখানে সে তার প্রভুকে পায়। وَوَجَدَ اللَّهَ عِندَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ ۗ وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ সে সেখানে আল্লাহকে পায় আর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দিবেন। সে যা পাওয়ার যোগ্য আল্লাহ তাকে তা দিয়ে দিবেন। وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। আপনি আমি যা করেছি আল্লাহ তার হিসাব গ্রহণে খুবই দ্রুত।

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের আলোকিত মনে করে। মরুভূমিতে থাকা লোকটির মতো যার চতুর্দিক আলোকিত। দিনের বেলা মরুভূমির আলোর চেয়ে বেশি আলো তো আর আপনি আর কোথাও পাবেন না। সুতরাং এমন মানুষ যারা ভালো পরিবেশে থাকে, তাদের আচার-আচরণেও ধার্মিকতার প্রকাশ ঘটে, তাদের দেখতে ও ধার্মিক দেখায়, ধর্মের কথা বলে, তাদের পরিবার ধার্মিক, তাদের সমাজ ধার্মিক, তারা ধর্মীয় কাজের সাথে যুক্ত, মসজিদের কাজের সাথে যুক্ত, মোটকথা তাদের গোটা পরিবেশ ধার্মিক। তারা এমন মানুষ নয় যারা মদ পান করে, তারা পার্টি করে বেড়ায় না, ক্লাবে রাত কাটায় না, তারা এমন খারাপ কোনো পরিমণ্ডলে যুক্ত নয়। তারা ধর্মীয় পরিমণ্ডলের সাথে যুক্ত। তারা একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে থাকে, তারা আলো দিয়ে বেষ্টিত।

অনেক সময় আমরা মনে করি, এ ধরণের মানুষরা তো সোজা এক টিকিটেই জান্নাতে চলে যাবে। তারা ভালো মানুষ, তারা এটা অর্জন করেছে। তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত, আপনি এতো আলো দ্বারা বেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে কি হয় জানেন? আপনি ঘোরের মধ্যে পড়ে যান। আপনার বাহ্যিক ধার্মিক পোশাক-পরিচ্ছদ, আপনার ধর্মীয় কথা, বাইরের দিক থেকে দেখে আপনাকে যে ধার্মিক মনে হয়, আপনাকে দেখতে অনেক আলোকিত মনে হয়, এগুলোর কোনোটাই আপনার ভেতরে কী ঘটছে তার সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে না। ভেতর এবং বাহির হতে পারে দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা।

আল্লাহ এই বিষয়ে কুরআনে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমি এখন খুবই সাধারণভাবে বিষয়টা তুলে ধরছি। মূলত, আপনি এমন অনেক মানুষের দেখা পাবেন যাদের দেখতে ধার্মিক মনে হয়, আলোকিত মনে হয়, ধর্মের প্রতি খুবই অনুরক্ত মনে হয় বাইরের দিক থেকে। তারা এমন কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করে যার ফলে তাদের দেখতে এমন দেখায়। তাই পোশাক-পরিচ্ছদ তাদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাহ্যিক রূপ গুরুত্বপূর্ণ, কিছু নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের মানুষ যা যা দেখতে পাবে তার সবকিছুই তার নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

কিন্তু আপনার ভেতরে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেমন লোভ, হিংসা, অহংকার, ক্রোধ, ঘৃণা। কারো সফলতা আপনি সহ্য করতে পারেন না, চরম বিরক্ত হয়ে উঠেন। পরিবারের বাচ্চাদের প্রতি যখন আপনি নির্দয় হয়ে উঠেন; সামান্যতম সহমর্মিতাও আপনার মাঝে দেখা যায় না। এমন কারো অধিকার হরণ করায় আপনি বিরত থাকেন না; কারণ এর সবই ব্যক্তিগত, কেউ তো দেখছে না। আপনি বুঝতেও চান না। কারণ এটা তো মানুষের সামনে ঘটছে না, তাই ব্যাপার না। যা কিছু মানুষের সামনে ঘটছে, তা যেন সম্মানজনক দেখায়। কিন্তু ভেতরে যা ঘটছে তা কুৎসিত, কদাকার।

আর এই মানুষগুলো মনে করে তারা তো ভালোই আছে। তারা স্বেচ্চাসেবামূলক কাজ করছে, তাদের দাড়ি আছে, তারা (মহিলারা) বোরকা পরে, তারা এমনকি কুরআনের কিছু অংশ মুখস্ত করেছে। তাদের তাজবিদ ও ভালো। বাইরের সব কিছুই খুবই ভালো। তারাও ভাবতে শুরু করে যে, আল্লাহ মনে হয় আমাকে অনেক পুরস্কার দান করবেন; আমি তো সেইরকম ভালো। তার চেয়ে তো আমি অনেক ভালো যে ভালোভাবে সূরা ফাতিহাও পড়তে পারে না, বা ঐ লোকের চেয়ে যে মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়ে না। আপনি এভাবে নিজেকে তুলনা করতে শুরু করেন, আপনার বসবাস তো আলোর মাঝে।

প্রসঙ্গত, নিজেকে এভাবে সবার চেয়ে ভালো মনে করা এটাই সম্ভবত যত খারাপ গুণ আমি বর্ণনা করেছি তার মাঝে সবচেয়ে খারাপ। যখন আপনি আমি মনে করতে শুরু করি যে, আমি আল্লাহর নিকট অন্য মানুষের চেয়ে উত্তম… এই অহংকার আসলে ইবলিস শয়তানের অহংকারের একটি অবিকল প্রতিরুপ। কেন সে বলেছে আমি উত্তম? تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا ۚ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ “এই হচ্ছে আখিরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না।” তাদের ‘উলুউ’ এর জন্য কোনো আকাঙ্খা নেই। তারা এমন ভাব ধরতে চায় না, যা দেখে মনে হয় অন্যরা তাদের চেয়ে অধম, তাদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। তারা এটা চায় না।

কখনো কখনো আমাদের মাঝে কেউ কেউ আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের কারণে, আমাদের ধর্মীয় অবস্থানের কারণে, অন্যদের সম্পর্কে ধর্মীয় ধারণার কারণে – আমরা ও চিন্তা করতে শুরু করি যে, আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো। আমরাও অন্যদের ছোট করে দেখতে শুরু করি। যেসব মানুষ মনে করে যে তারা আলোর মাঝে আছে, এবং তারা ধর্মীয় ভাবে খুবই ভালো আছে। কিন্তু আপনি তো মরুভূমিতে থাকা ব্যক্তির মত, পিপাসায় মারা যাচ্ছেন, পানি মনে করে ঐ মরীচিকার দিকে ছুটে যান … অর্থাৎ আপনি মনে করেন যে আমি তো জান্নাতে যাচ্ছি, এবং আমার সব কাজের পুরস্কার পেতে যাচ্ছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আল্লাহ কে পান। তিনি আপনাকে জানিয়ে দিবেন যে, তুমি তো মানুষ কে দেখানোর জন্য সব করেছো; তোমার অন্তরে কোনো আলো ছিল না। তুমি এখন কিছুই পাবে না। আল্লাহ খুব দ্রুত তার হিসেব নিয়ে নিবেন।

আমাদের এমন মানুষ হতে হবে যারা সবসময় নিজেদের পরীক্ষা করে, আত্মসমালোচনা করে। মানুষ আমাদের প্রশংসা করুক আর নাই করুক কিছু যায় আসে না। এর কোনো মূল্য নেই। পক্ষান্তরে, মানুষ আমাদের সমালোচনা করুক আর নাই করুক তাতেও কিছু যায় আসে না। আপনাকে আমাকে এভাবে চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ যদি এখন আমাকে প্রশ্ন করেন আমি কি তাঁকে উত্তর দিতে পারবো ? আল্লাহর দৃষ্টিকোণ থেকে আমি কি সঠিক কাজ করেছি? কারণ এই ভ্রমণের শেষে একমাত্র তাঁর সাথেই আমার সাক্ষাৎ করতে হবে।

– উস্তাদ নোমান আলী খানের Light Up Your Heart লেকচার অবলম্বনে