শাস্তি আসার পূর্বেই ফিরে আসুন, দেরি করবেন না

—নোমান আলী খান 

গুনাহ বা মন্দ কাজগুলো আমাদের হতাশ করে দেয়। এগুলো এমন অনুভুতি আনে যে— “আল্লাহ তো আর আমাকে ক্ষমা করবে না। আমার অবস্থা তো খুব খারাপ। ক্ষমা চাবার অর্থটাই বা আর কি? আমি কী করছি জানেন? আমি কি কি কাজ করি সেগুলো জানেন? আপনি না জানলেই ভালো ভাই। আমি খুব খারাপ।” 

ভাবছেন, এই সময়ে এসে ক্ষমা চাবার মানেটাই বা কি? আর আল্লাহ জানেন এই চিন্তাগুলো ওসব মন্দ কাজের থেকেই উৎপন্ন হয়। আবার কেউ বলে, “ক্ষমা চাওয়া নিয়ে আমি আর ভাবতে পারবো না। আসলে যারা ভালো মানুষ তারা তো ইস্তিগফার ইত্যাদি করে। আমি তো অনেক খারাপ কাজের মধ্যে জড়িত। তাছাড়া এসব থেকে দূরে থাকবো সেটাও আপাতত হচ্ছে না।” আল্লাহ বলছেন—لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰهِ নিজেদের আলাদা করে ফেলো না। আশাহত হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো না। আল্লাহ্‌র ভালোবাসা, যত্ন আর ক্ষমা থেকে একেবারেই আশাহীন হয়ে যেয়ো না। আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসা বন্ধ করেননি, তোমার খেয়াল রাখাও বন্ধ করেননি। এমন কখনোই না যে আল্লাহ তোমার প্রতি ক্ষমা দেখাতে আর আগ্রহী নন। এমন কিছুই না।

আপনি নিজেকে বলেন, “আল্লাহ মনে হয় আমাকে শাস্তি দিতেই চান।” না! এটা আপনার ধারণা! আল্লাহ বলেননি, আপনিই বলছেন। আল্লাহ কুরআনে কখনোই বলেন না যে আপনাকে শাস্তি দিতে চান। বরং তিনি উল্টোটাই বলেন। مَّا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ আপনাকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহ্‌র কি লাভ? তিনি কেন শাস্তি দেবেন আপনাকে? হুবুহু এটাই বলছেন আল্লাহ!

আল্লাহ আযযা ওয়াজাল এই আয়াতে বলছেন, إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا – দয়া করে খোলা কানে এই আয়াতগুলো শুনুন। নিজের জন্যে আর আপনার পরিবারের জন্যে হলেও। “আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন সমস্ত গুনাহ, সব একত্রেই।” 

 এটা কুরআনের একটি মিরাকল, কুরআনে সবচাইতে বড় উপহারগুলোর একটি যে আল্লাহ বলছেন যুনুব, তিনি সায়্যিআত বলেননি। কারণ আরবিতে সায়্যিআত হলো বড় ধরণের গুনাহ। আর যুনুব তার চাইতে ছোট। আল্লাহ বলছেন, তিনি ছোটগুলাও ঢেকে রাখবেন। আসলে ছোটগুলোর নাকচ করা বড়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। যেমন আল্লাহ যদি বলেন, আমি তোমার বড় গুনাহগুলো মাফ করে দেব। এর মানে তিনি ছোট গুনাহগুলো হয়তো রেখে দেবেন। তিনি বলছেন, আমি তোমার ক্ষুদ্রতম গুনাহটিও ক্ষমা করবো। তোমার আমলনামা এতোই পরিষ্কার করে দেবো যে তাতে একটুও দাগ থাকবে না। সবকিছু চলে যাবে। জামি’আন। সবকিছুই একত্রে। ۚ إِنَّهُۥ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ – কোন সন্দেহ নেই, তিনিই একমাত্র যিনি প্রচণ্ডভাবে ক্ষমাশীল। প্রচণ্ড ক্ষমাশীল তিনি। আর তিনি সর্বক্ষণই প্রেমময়ী, সর্বক্ষণই করুনাময়, সর্বক্ষণই যত্নশীল।

এটাই ক্ষমার ব্যাপারে প্রথম বার্তা দেবার কথা ছিল। আল্লাহ সবকিছু মাফ করে দিতে প্রস্তুত। তবে সেটাই কিন্তু একমাত্র নয়। কেউ এই আয়াত পড়ে ভাবলো এটাই আয়াতটির বার্তা। না না না না! দেখুন, নির্দেশ কিন্তু এখনো চলছে। তাই পরের আয়াতটি পড়ার পদ্ধতি হলোঃ قُلْ يٰعِبَادِىَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلٰىٓ أَنفُسِهِمْ وَأَنِيبُوٓا إِلٰى رَبِّكُمْ এর মানে হলো, আমার বান্দারা, এখন যেহেতু জানো যে আমি সবকিছুই ক্ষমা করে দেব, আমার কাছে ফিরে আসো। নিজের মালিকের কাছে ফিরে আসো। 

এই বার্তার পরের অংশ এটাই। ক্ষমার আলোচনা ওখানেই শেষ হয়নি। তাঁর কাছে ফিরে আসুন। তিনি বলছেন, আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার ক্ষমা বিনামূল্যে নয়। এটা অর্জন করতে তোমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমার কাছে ফিরে আসো। أَنِيبُوٓا إِلٰى رَبِّكُمْ নিজের অন্তর তোমার রবের দিকে ফিরিয়ে দাও।

দেখুন আরবিতে তওবা আক্ষরিকভাবেও হতে পারে। আল্লাহ্‌র দিকে অন্তরের ফিরে আসা তওবা হয় আবার শারীরিকভাবে ফিরে আসাকেও তওবা বলা যেতে পারে। কিন্তু ইনাবাহ শুধু অন্তরের জন্য। আরবিতে ইনাবা ব্যবহৃত হয় যখন অন্তর আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।

তাই আল্লাহ বলছেন, তোমার অন্তর কোথায়? কী নিয়ে ব্যস্ত তুমি? কী নিয়ে বিভ্রান্ত তুমি? তোমার মালিকের কাছে ফিরে যাও! তিনি ক্ষমা করতে প্রস্তুত! وَأَسْلِمُوا لَهُۥ – (এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর।) যেহেতু তোমার অন্তর আমাকে দিয়েছো, এখন তোমার সত্ত্বাকেও আমার প্রতি সমর্পন করো। 

ইসলামে থাকো, নিজেকে সমর্পন করো। মান্য করতে প্রস্তুত হও। وَأَسْلِمُوا لَهُۥ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ শাস্তি আসবার পূর্বেই! এরপর আর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না! 

এখন আল্লাহ শাস্তির কথা বলছেন। এমন না যে আয়াতে শাস্তির কথা নেই। আছে। কিন্তু শুরু হয়েছে কী দিয়ে? শুরু হয়েছে উৎসাহ দিয়ে যে, “দেখো আমি সব ক্ষমা করতে প্রস্তুত। কোনো শাস্তিই তোমাকে দেয়া হবে না। তুমি যদি তা চাও তবে আমার কাছে ফিরে আসো। নিজেকে আমার কাছে সমর্পন করে দেয়া উচিত তোমার। আর তাড়াতাড়িই করো এটা। এমন ভেবো না অনেক সময় হাতে আছে। এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না বিচার দিবসে যাদের বলা হবে “তারাব্বাসতুম” (আর তোমরা অপেক্ষা করেছিলে)। ভেবেছিলে তোমাদের হাতে অনেক সময় যে দেরী করলেও হবে। 

তাই না? তুমি বিলম্ব করছিলে। অনেক সময় আছে আরও! থাকুক, বাদ দাও! – এই ধরণের কথাবার্তা। এমন ধরণের লোক হবেন না!

আল্লাহ বলছেন, “শুরু করে দাও মিন কাবলি!” এই মিনকে বলে মিনাত তা’জিল! শাস্তি আসার ঠিক আগে আগে! আমি বলছি শাস্তি হতে কিন্তু দেরী নেই। কাছেই। 

বিচার দিবসের কথা বললে অনেকে মনে করেন বিচার দিবস অনেক দেরী, তাই না? ইন্নাহুম ইয়ারাওনাহু বা’ইইদা। তারা মনে করে ওটা হতে অনেক দেরী। ওয়ানারাহু কারিবা। আল্লাহ বলছেন, আমি দেখছি যে এটা শীঘ্রই। 

কিন্তু আমাদের প্রত্যেকে, আমরা কখন যাবো? আমরা কি ঈদের দিন আদৌ দেখতে পাবো? কে জানে? কে জানে আমরা কবে যাবো? কে জানে মৃত্যুর ফেরেশতার কাছে আল্লাহ কী লিখে দিয়েছেন? আমরা পার্কিং লট পর্যন্তও কি যেতে পারবো? কে জানে? আমরা কেউই জানি না! 

 আমাদের মৃত্যু হলেই “মান মাতা ফাকাদ কামা কিয়ামাতুহু।” যে চলে যায়, যেই মারা যায় তার কিয়ামাত শুরু হয়ে যায়। আপনার কিয়ামতের জন্য ইয়াওমাল কিয়ামাহ, পুনরুত্থান দিবসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এক সেকেন্ডেরই ব্যাপার এটা! আর ফেরেশতা যখন চলে আসবেন তিনি বলবেন না, “দুঃখিত! আপনার পাঁচটায় একটা মিটিং আছে? তবে পরে আসছি।” এমনটা কিন্তু হবে না। যখন যাবার সময় আসবে চলে যেতেই হবে। কোন দেরী হবে না।

তাই আল্লাহ বলছেন, আর দেরী করো না। নিজের অন্তরকে আমার দিকে ফিরিয়ে আনতে আর সমর্পণ করতে বিলম্ব করো না। وَأَنِيبُوٓا إِلٰى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ –  “তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই তার কাছে আত্মসমর্পণ কর।”