শির্‌ক যে কতটা জঘন্য তার একটি অসামান্য উদাহরণ

শির্‌ক যে কতটা জঘন্য তার একটি অসামান্য উদাহরণ

নুমান আলী খানের “Brilliance of the Book” লেকচারের অংশ বিশেষ।

 

আপনি নিশ্চয় জা্নেন মহান আল্লাহ তাআলা যিনি পবিত্র ও মহিমান্বিত, পবিত্র কোরআনে প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন। শুরু করার আগে আপনারা কেউ কোন উদাহরণ শুনতে চান? এটি আমার প্রিয় একটি উদাহরণ। তাহলে আমার প্রিয় একটি উদাহরণ দিয়ে আমরা শুরু করছি। আপনারা কেউ হয়ত এটি আগেও শুনে থাকবেন, সমস্যা নেই, এটি মনে রাখা ভালো।

পবিত্র ও মহিমান্বিত আল্লাহ তাআলা সুরা হাজ্জ-এ বলেছেনঃ সুরা হাজ্জ, ২২ নম্বর সুরা এবং এই আয়াতটি হল ৩১ নম্বর আয়াতঃ

“حنفاء لله غير مشركين به”

“আমরা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে নিবেদিত,তাঁর সাথে শিরক না করে”

“وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ”
“এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শিরক করলো অথবা শিরক করে”

“فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ”
“সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো”

এখন আমি চাই আপনারা এই উদাহরণটি মনে করুন। যেই আল্লাহর সাথে শিরক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো।

“فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ”
মহান আল্লাহ আমাদের যে উদাহরণটি দিয়েছেন এটি তার প্রথম অংশ; এটি একটি তুলনা, যেখানে একজন মুশরিক এবং
আকাশ থেকে পড়ন্ত ব্যক্তিটির মাঝে তুলনা করা হয়েছে। তারপর তিনি বলেছেনঃ

“فَتَخْطَفُهُ الطَّيْر”
“অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল”

পাখিরা এই লোকটিকে দিয়ে দুপুরের খাবার সারছে। পাখিরা এই লোকটিকে খাচ্ছে।

“أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ”
“এবং বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো”

এই উদাহরণের তিনটি অংশ।

প্রথম অংশঃ সে কোন জায়গা থেকে পড়ছে? – আকাশ থেকে।

দ্বিতীয় অংশঃ তারপর কী হচ্ছে? – পাখিরা তাকে খাচ্ছে।

তৃতীয় অংশঃ এরপর বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করছে।

নদেকিয়া, একজন বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ,অন্যতম অনুসরণীয় প্রাচ্যবিদ যিনি কোরআন এর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন। কোন বিষয় শ্রোতাদের বোধগম্য করে তোলায় উদাহরণের উদ্দেশ্য। সর্বোপরি একজন শিক্ষক কেনো উদাহরণ দেন। অবশ্যই বিষয়টিকে সহজ করে তুলে ধরার জন্যে। তাই না? বিষয়টি যদি কঠিন হয়, তাহলে আমি আপনাকে উদাহরণ দিয়ে বুঝাবো। এখন যদি আমার উদাহরণ মূল বিষয় হতেও কঠিন হয় তাহলে শ্রোতাদের বুঝানোর উদ্দেশ্য সফল হয় না। তাই আপনাকে এমন উদাহরণ দিতে হবে যেন শ্রোতারা বিষয়টি ধরতে পারেন। এমন উদাহরণ যা বিষয়টির সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

নদেকিয়া তর্কের খাতিরে বলেছিলেনঃ আকাশ থেকে পড়া, এটা তো কেউ কখনো দেখেনি। আমি ব্যাপারটি বুঝতে পারছিনা না, তবে আরবরা পারছে। এমনকি আজকালকার বিমান-এর যুগেও কেউ এটা কল্পনা করতে পারবেনা।

উদাহরণটি বোধগম্য ছিল না। নদেকিয়া বললেন পাখিরা মানুষটিকে খাচ্ছে। তিনি জোর গলায় বললেন এগুলো কী ধরণের পাখি যা এমন একটি মানুষকে খাচ্ছে যে অভিকর্ষের ত্বরণে উপর থেকে পড়ছে এগুলো কত বড় যে একটি পড়ন্ত জীবন্ত মানুষকে খাচ্ছে? ব্যাপারটি কল্পনার বাইরে, এমনটা ঘটা তো অসম্ভব। তারপর নদেকিয়া বললেন, যখন আকাশ থেকে পড়তে থাকে  তখন আপনি কোন অখ্যাত বা বিখ্যাত যে স্থানেই পড়েন, কোনো পার্থক্য আছে কি? উভয় ক্ষেত্রেই আপনি কি মৃত্যুবরণ করবেন না? তাই নদেকিয়া উদাহরণটির সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন উদাহরণটি বোধগম্য নয়।

এখানে একমাত্র সমস্যাটি হল, সমালোচনাটি কোন রকম প্রাচীন আরবির জ্ঞান ছাড়াই শুধুমাত্র বর্তমান আরবির উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
আমি আপনাদের যে ব্যাপারটি বলিনি সেটি হল প্রাচীন আরবি ভাষার নিজস্ব কিছু অভিব্যক্তি, বাগধারা রয়েছে। ইংরেজিতে এমন একটি হল “that’s cool”। আপনি যদি এই অভিব্যক্তি ১০০ বছর আগে প্রয়োগ করেন তাহলে তখনকার মানুষ ব্যাপারটি বুঝবেনা। খেলার সময় কোন ছেলে বললো “that’s cool”, আরেকজন বললো “that was hot”. বিপরীতার্থক শব্দার্থ অথচ দুটো ছেলে একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় অভিব্যক্তি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।

কোরআন এ প্রাচীন আরবির ভাব ব্যবহৃত হয়েছে। এই ভাব বা অভিব্যক্তি কি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে। এই ব্যাপারটি আপনাদের বুঝতে হবে। যদি আপনি এটি আক্ষরিক অর্থে বুঝতে চেষ্টা করেন তাহলে এটির প্রকৃত অর্থ বুঝবেন না। এই ক্ষেত্রে অর্থটি আক্ষরিক নয়। বরং এটি একটি অভিব্যক্তি।

যেমন কেউ আপনাকে বললো “অরণ্যে রোদন” করে লাভ নেই। আপনি বললেন, কই আমি তো বনে কাঁদছি না। আমি আমার চাকরি হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আপনি ব্যাপারটির প্রকৃত অর্থ ধরতে পারেননি। অথচ এটি একটি বাগধারা, অর্থাৎ নিছক অভিব্যক্তি। যাই হোক, আমরা দ্রুত উদাহরণটি শুরু করি যেন সময়ের মধ্যে আমরা শেষ করতে পারি। আমার আর কতক্ষণ আছে? ঠিক আছে ১৫ মিনিট। আমি এর থেকেও কম সময়ে শেষ করবো ইন-শা-আল্লাহ।

তাহলে এটি হল ব্যাপার যে, মহান আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে পড়ে এমন একজন ব্যক্তির কথা বলেছেন। কিন্তু এই পড়ন্ত ব্যক্তিটিকে কার সাথে তুলনা করা হয়েছে? কে সে? সে একজন মুশরিক। কারণ সেই সময়ের অধিকাংশ আরব পরকালে বিশ্বাস করতো না। অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতো যে তাদেরকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তারপর আর কিছু নেই। তারপর সব শেষ। তাহলে জীবন শেষে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে? মৃত্যু।
যখন আপনাকে দোজখের আগুন আর পুনরুত্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়া হবে তখন আপনি বলবেন, না না

“إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَ”
আমাদের জীবন পৃথিবীময়

“نَمُوتُ وَنَحْيَا”
আমারা বেঁচে থাকি, তারপর মারা যাই। এতোটুকুই। এরপর আর কিছু নেই। আমি এই পরকালের ব্যাপারগুলো একদম বুঝি না। মহান আল্লাহ তাআলা এই কঠিন, অবিশ্বাসী হৃদয়ের কথা বলেছেন। আপনাকে শুধুমাত্র মৃত্যুর জন্যে তাকিয়ে থাকতে হবে। যদি আপনি আরবদের সম্পর্কে জেনে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে তারা লড়াকু জাতি ছিল।

তারা তাদের গোত্রের যুদ্ধ নিয়ে খুব গর্বিত ছিল।এখন যেমন আমাদের খেলার দল আছে। আমরা আমাদের দল নিয়ে গর্ব করি। আরবদের গর্ব ছিল তাদের গোত্র ও তাদের যুদ্ধ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ধরনের মৃত্যু হল কাপুরুষের মৃত্যু। যত যাই হোক যখন আপনি মৃত এবং যেহেতু কোন পরকাল নেই তাহলে আপনার অবশিষ্ট কী রইলো? অবশিষ্ট থাকলো তোমার খ্যাতি, উত্তরাধিকার ইত্যাদি। তারা মনে করতো এসব মৃত্যুর পর থেকে যায়। তাহলে আরবরা তখন থেকে “আকাশ থেকে পড়া” এই অভিব্যক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছে যখন কোরআন নাজিলও হয় নি।

তারা সব সময় এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করতো। আপনি কি জানেন যে তারা এটি দিয়ে কী বুঝাতে চাইতো?

এটির অর্থ হল – ২টি গোত্র যুদ্ধ করছে, একটি গোত্র পাহাড়ের চূড়ায়, আরেকটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত। কার সুবিধা বেশি? অবশ্যই যে উপরে আছে। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সত্ত্বেও যদি তারা যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে তাদের প্রতিপক্ষ তাদের শরীর নিয়ে কি করবে? পাহাড়ের চূড়া হতে ফেলে দিবে। তারা এটিকে কী বলে? “আকাশ থেকে পড়া”।

এখানে দুটো ব্যাপার রয়েছে। হয় তারা এতই বাজে যোদ্ধা যে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সত্ত্বেও তারা হেরে গিয়েছে অথবা তারা পালাচ্ছিল, শত্রুপক্ষ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তারপর কী হল?

তারা পাহাড়ের চূড়া হতে পড়ে গেলো এবং কাপুরুষের মত মৃত্যুবরণ করলো। তারা হয় অপদস্থ হয়ে নয়তো বা কাপুরুষ হয়ে মৃত্যুবরণ করলো। এগুলো হল আরব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা যা আরবরা পিছনে ফেলে আসতে চায়। “আকাশ থেকে পড়লো” এই বাক্য শুনে মারা যাওয়া হল সবচেয়ে খারাপ ধরণের মৃত্যু যা তারা কল্পনা করতে পারতো। আল্লাহ এইসব মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন- মুশরিক, আরব – যাদের পরকাল সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, শেষ বিচারের দিনের অপমান সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, তাই তিনি তাদেরকে এই বাক্যটি বললেন যেন তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিজেদের সাহায্য করতে পারে। সবচেয়ে নোংরা এমন কোন বিষয় আপনি কল্পনা করতে পারেন? শিরক হল এমন একটি বিষয়। শিরক হল “আকাশ থেকে পড়া” ধরণের বিষয়।

যখন কেউ যুদ্ধে মারা যায়, আপনি নিশ্চয় জানেন এটি প্রাচীন ঐতিহ্য, দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। মানুষ মারা যায়। সব জায়গায় লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তখন লাশগুলোর কী হয়? উভয়পক্ষ হতে লোক আসে মৃতদের নেয়ার জন্যে যেন তাদের সঠিকভাবে কবর দিয়ে সম্মানের সাথে বিদায় জানাতে পারে। এইটাই তো হয় নাকি? আবার যদি আপনি মনে করেন যে আপনার সৈন্য বিশ্বাসঘাতক অথবা আপনার জাতির জন্য অপমানস্বরূপ তাহলে তাকে কেউ নিতে আসবে না। যখন আপনার লাশ কেউ নিতে আসবে না, তখন আপনার জন্যে কী আসবে বলে মনে হয়? পাখি, “الطير”. “ذاهل الشعر” প্রাচীন কবিতায় একে শকুন বলে। গলিত মাংসখাদক পাখি যা মৃতের মাংস খায়। তাই এখন পাখিরা এই মর্যাদাহীন মৃতদেহকে চিবিয়ে খায় যে তার নিজ গোত্র হতে বিচ্ছিন্ন। তার গোত্রের লোকেরাও তার জন্য কিছু করতে চায় না। মৃত লোকটিকে যেসব নোংরা পাখি ভক্ষণ করে সেগুলোও তাকে আর খেতে চায় না। পাখি গুলোও তাকে চায় না। এরপর কী আসে? এরপর একটি জোরালো বাতাস আসে যা মৃত লোকটির দেহের অবশিষ্ট উড়িয়ে নিয়ে যায় এবং দূরবর্তী কোন স্থানে নিক্ষেপ করে। এই লোকটি এই পৃথিবীর একটি আবর্জনা। নোংরা পচে যাওয়া বস্তু।


এই হল সবচেয়ে মর্যাদাহীন বা নোংরা ধরণের মৃত্যু যা আরবরা কল্পনা করতে পারতো। এ ব্যাপারটি এত সুন্দর উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যেন আপনি একটা ধারণা পেতে পারেন। আপনি কি মনে কর শিরক সামান্য ব্যাপার? ওদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। আপনি কী দেখেছেন কোরআন তার উদাহরন এর দিক থেকে কি পরিমাণ শক্তিশালী?