নোমান আলী খান
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন-
وَإِذَآ أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنسٰنِ أَعْرَضَ وَنَـَٔا بِجَانِبِهِۦ ۖ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ يَـُٔوسًا
যখন আমরা মানুষকে নেয়ামত দান করি – (আ’রাদ) – মানুষ তা অগ্রাহ্য করে। ইচ্ছাকৃতভাবেই তা আমলে নেয় না। এখানে যা ইঙ্গিত করা হচ্ছে তা হল যখন মানুষকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অনেক নেয়ামত দান করা হয়, মানুষ তখন একটা মোহের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা ভাবতে শুরু করতে কোনভাবে তারা এসবের যোগ্য বা তারা এসবের সত্ত্বাধিকারী অথবা এসব তাদের নিজস্ব কর্মের ফল বা তাদের নিজস্ব অর্জন বা সক্ষমতা। এসব যে নেয়ামত এই বাস্তবতা তারা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। তারা ভাবতে শুরু করে যে তারা এসবের মালিক বা কোন না কোনভাবে তারা এসবের স্বত্তাধিকারী।
ওয়া নাআ বিজানিবিহি- এবং সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অন্যকথায় বলতে গেলে- আপনাদের একটি ইংরেজি অনুবাদ দিই। নাআ বিজানিবিহির একটি অনুবাদ দিই।
“হাহ্!”
এটাই নাআ বিজানিবিহি। যখন কেউ বলে আল্লাহ্ আপনাকে অনেক নেয়ামত দিয়েছেন তখন বলে- হাহ্! এই অর্থই আক্ষরিকভাবে ভাষার মধ্যে প্রকাশ পায়। তাই সে আল্লাহ্ যেসব নেয়ামত দিয়েছেন সেসবের ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করে এবং এসব যে খোদায়ী উপহার হতে পারে এই ধারণাটিকেই সে উড়িয়ে দেয়।
ওয়া ইজা মাসসাহুশশার- এবং যখন তাকে কোন অনিষ্ট স্পর্শ করে, কানা ইয়াউসা- তখন সে একদম হতাশ হয়ে পড়ে, দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ্ আমার প্রতি এমনটা করেছেন। কেন আমাকে এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে? আমি কি এমন করেছি যে আমাকে এসবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? যখন ভাল কিছু ঘটে তখন- আমি এসবের হকদার। এবং এটা আমারই অর্জন ছিল। যখন খারাপ কিছু ঘটে- এটা আমার কর্মের ফসল না। এটা আল্লাহর কাজ। তিনি আমার প্রতি এটা করেছেন। কানা ইয়াউসা। এমনই তার বক্র চিন্তা।
এই আয়াতের সবচেয়ে অসাধারণ বিষয়টি হচ্ছে এটি আদবের ব্যাপারে একটি ভাল শিক্ষা। আখলাকের ব্যাপারে একটি উত্তম শিক্ষা। কেবল আমরা আল্লাহ্র ব্যাপারে কিরকম চিন্তা করি তা না, আল্লাহ্র ব্যাপারে আমরা কিভাবে কথা বলি সেটাও।
একজন মানুষ কিভাবে কথা বলে তা সে কিভাবে চিন্তা করে তার প্রতিফলন ঘটায়। তাই যখন নেয়ামতের কথা বলা হচ্ছে আল্লাহ বলেন- (ওয়া ইযা আন’আমনা ‘আলাল ইনসান)। এটি অতীত কাল বুঝায়। আন’আমনা, এখানে কর্তা কে? নাহ্নু, এটা আল্লাহ্, আমরা দিয়ে থাকি। কিন্তু যখন তিনি বলেন- ওয়া ইজা মাসসাহুশশাররু – যখন নেয়ামতের কথা বলা হয় তখন কর্তা আল্লাহ্ – যখন আমরা তার উপর নেয়ামত বর্ষণ করি। যখন তাকে কোন অকল্যাণ স্পর্শ করে আল্লাহ বলেন মাসসা, হুআ মাসসা- এখানে কর্তা হচ্ছে আশ শাররু।
অন্য কথায় আল্লাহ অকল্যাণের সাথে নিজের নামকে জড়াননি। তাই আল্লাহ এটা বলেননি যে আমরা তাকে অকল্যাণের সম্মুখীন করেছি বা তাকে অনিষ্ট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ করেছি। তিনি তা করেননি। তিনি নিজেকে অকল্যাণের সাথে জড়াননি। এবং এটা আমাদেরকে একটা বিষয়ের ব্যাপারে শিক্ষা দিচ্ছে। এই দুনিয়াতে কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যাপারে আমাদের দ্বীনের খুবই গভীর একটি বিষয়। দিনশেষে আমাদের আকিদা বা বিশ্বাস কি? সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে। যখন কেউ অসুস্থ হয় তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। যখন কেউ সুস্থ হয় তাও আল্লাহর পক্ষ থেকে। এটাই আমাদের বিশ্বাস। কোন কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া হয় না।
কিন্তু তার মানে এই না আমরা এসবের ব্যাপারে এভাবে কথা বলব। যদিও এটিই বাস্তবতা তবুও একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় সম্মান রাখা উচিত। এটা কেন? যদি এটা সত্য হয়, তবে এটাই সত্য। আপনার এটা বলে ফেলা উচিত। কেন এত ভদ্রতার মুখোশ পরানো? এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের এমনভাবে শিক্ষা দেন যা সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত। একজন পরিপক্ক ছাত্র, পরিপক্ক ঈমানদার সে জানে যখন ভাল কিছু হয় সেখানে ভাল কিছু আছে এবং যখন মন্দ কিছু ঘটে সেখানেও ভাল কিছু আছে। সেই একজন পরিপক্ক ঈমানদার। কিন্তু যার পরিপক্কতার অভার রয়েছে, যার ঈমান ততটা পরিপক্ক নয়- যখন খারাপ কিছু ঘটে সে বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। তারা কিভাবে তা চিন্তা করে? যেন আক্ষরিক অর্থেই আল্লাহ খারাপ কিছু করেছেন এবং সে এটা দ্বারা খারাপ কিছু ইঙ্গিত করে। তারা এর চেয়ে পরিপক্ক কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না। ঠিক? তাই আল্লাহ এমন ভাষা নাযিল করলেন যা গভীরভাবে চিন্তা করে এমন মানুষ বুঝার পাশাপাশি যে কেবলমাত্র ভাসাভাসাভাবে দেখে সেও যাতে এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারে এবং ভুল উপসংহার না টানে। অকল্যাণ তাকে স্পর্শ করেছে। আল্লাহ যখন অকল্যাণের কথা বলেন এটা বলেননি- আল্লাহ্ তার ক্ষতি করেছেন। আল্লাহ তা সেভাবে বলেননি। কারণ যে অপরিপক্ক সে এটা শুনছে যে সে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এবং তিনি সেই অপরিপক্ক মানুষকে সংশোধন করে দিচ্ছেন এই বলে যে- ওয়া ইজা মাসসাহুশশার, কানা ইয়াউসা। যখন তাকে কোন অকল্যান স্পর্শ করে, তখন সে একদম হতাশ আর বিহ্বল হয়ে পড়ে। ইয়াউসা আসলে ফা’উল, এটা ইয়ায়িস থেকে এসেছে যা মুবালাগা বা আধিক্য বুঝায়। তার মানে দাঁড়ায় মারাত্মক হতাশাগ্রস্থ।
আপনারা জানেন কিছু মানুষ আছে যারা সফলতার সাথে অভ্যস্ত। যারা একশতে একশ পেতে অভ্যস্ত, প্রত্যেক প্রতিযোগিতায় জিততে অভ্যস্ত, যেকোন খেলায় জয়লাভ করতে অভ্যস্ত, তারা সবকিছুতেই এক নম্বর হতে অভ্যস্ত। তাদের বাবা-মা সবসময় তাদের কথাবার্তাকে গুরুত্ব দেয়। এরপর একবার তারা সহজে পার পায় না। এরকম মানুষের ক্ষেত্রে কি ঘটে? এরকম লোকেরাই জীবনের ব্যর্থতা, ক্ষয়ক্ষতি কিংবা চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে উঠতে পারে না। পরিবারের চার নম্বর কিংবা পাঁচ নম্বর সন্তান বা এরকম কেউ যারা সবসময় অন্যের জন্য সাফার করে সেটা তাদের জন্য ভাল। বা সবচেয়ে ছোটটা।
যেমন আপনারা জানেন আমি আমার ছোটটাকে নিয়ে চিন্তিত। কারণ সে বলতে গেলে যেকোন কিছু করে পার পেয়ে যায়। কারণ যে সময়টাতে আপনি সবচেয়ে ছোট থাকেন তখন কি এক কারণে বাবা-মায়ের শাসন আমি জানিনা কোথায় উধাও হয়ে যায়। যেমনটা আমি আমার বাবা-মাকে আমার সবচেয়ে ছোট বোনটার ব্যাপারে বলে থাকি- তারা আমার প্রতি কঠোর ছিল। কিন্তু আমার সবচেয়ে ছোট বোনটা যেকোন কিছু করে পার পেয়ে যায়। মা, কি ব্যাপার? আমাদের ব্যাপারে ত এই নীতি ছিল না। সে খুবই ছোট। সে ছোট নয়। এমন লোকের কি হয়? তারা নষ্ট হয়ে যায়। কাউকে বেশি অনুগ্রহ করলে তা তাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
তাই যখন একটু এদিক-ওদিক হয়, তারা একদম হতাশ হয়ে পড়ে। এখন এই যে শিক্ষা আল্লাহ আমাদের দিচ্ছেন- নেয়ামতে ব্যাপারে, আমাদের অনিষ্ট স্পর্শ করার ব্যাপারে, আমাদের সবাইকে দুনিয়াতে সীমিত সংখ্যক নেয়ামত ও সীমিত পরিমাণ অকল্যাণ দেওয়া হয়েছে। একদিকে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদের রিজিক কি হবে, আমাদের রিজিকের মধ্যে রয়েছে আমাদের অর্থ কিন্তু এর মধ্যে আমাদের বন্ধু-বান্ধবও রয়েছে। আমাদের পরিবারও আমাদের রিজিক। আমাদের জ্ঞানও আমাদের রিজিক। যারা আমাদের শিক্ষা দেন তারাও আমাদের রিজিক, যারা আমাদের থেকে শিখে তারাও আমাদের রিজিক। আপনার জীবনে ভাল যা কিছুই আছে তা-ই মূলত আপনার রিজিক। আপনার এসব জিনিস একটা সীমার মধ্যেই আছে। কোথায় আপনি সীমাহীন রিজিক পাবেন? আপনি সেটা পাবেন জান্নাতে। এখানে আপনি যা পাবেন তা একটি সীমিত অংশ। এটা আপনার জন্য লেখা আছে। উপরন্তু- আপনি জীবনে মোকাবিলা করবেন এমন চ্যালেঞ্জও সীমিত। যা লেখা আছে তার চেয়ে বেশি কিংবা কম আল্লাহ আপনাকে দিবেন না। এটাই। এটাই ঘোষিত, এটাই আপনার জীবনের ভাগ্য। আপনি যদি এটাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করতে পারেন, তাহলে আপনার আর সম্ভাবনা আমার চ্যালেঞ্জ আর সম্ভাবনার মতন নয়। এগুলো এক নয়। কখনো আল্লাহ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেন কিন্তু আপনি সেই পথ ধরে হাঁটতে অস্বীকৃতি জানান। আপনি এর থেকে অনেক সওয়াব নিতে পারতেন কিন্তু আপনি সে পথে হাঁটতে নারাজ ছিলেন। ফলস্বরূপ আপনি দুঃখদুর্দশায় নিমজ্জিত হন এবং আল্লাহকে দোষারোপ করেন।