স্ত্রী এবং শ্বশুর-শ্বাশুড়ি

-আসসালামু আলাইকুম। কেমন চলছে?
-আলহামদুলিল্লাহ।
– কেমন চলছে?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-পরিবার?
-পরিবারও ভালোই আছে।
-তোমার বাবা কেমন আছে? তাঁকে আমার সালাম পৌঁছে দিও দয়া করে। ইনশা আল্লাহ।
-শনিবারে সে আসবে।
-ও তাই! তাহলে তো দেখা হচ্ছে! ও দাঁড়াও! আমি তো শনিবার থাকবো না।
-আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি হিউস্টন যাচ্ছি ইনশা আল্লাহ।
– আপনার কি অনেক প্রোগ্রাম থাকছে আজকাল?
– হ্যাঁ। অনেক প্রোগ্রাম আছে।
-কেমন চলছে প্রোগ্রামগুলো?
– অনেক প্রোগ্রামই তো আছে। একটা ঘটনা আমার মাথায় এখনো গেঁথে আছে, প্রোগ্রাম শেষে এক মহিলা আমার কাছে এসে আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার স্বামী নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। আমার শোনা সবচেয়ে খারাপ ঘটনা এটি নয়, কিন্তু যথেষ্ট জগাখিচুড়ি পাকানো একটি ঘটনা। সে এসে বলেছিল, আমার স্বামী যথেষ্ট ধার্মিক। সে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়ে। সবসময় মসজিদে যায়। ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু একইসাথে, সে আমাকে আমার পরিবারের সাথে দেখা করতে নিষেধ করে। আমি যখন তাদের কল করি, যখন তাদের সাথে দেখা করতে যাই, সেটা সে পছন্দ করে না। আমাকে খুব কষ্ট করে, লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মাকে কল করতে হয়, দেখা করতে হয়। যদি আমি আমার স্বামীকে না বলি যে, আমি আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি, তাহলে কি আমি গোনাহগার হব? কারণ, আমাকে তো আমার স্বামীর কথা মেনে চলতে হবে। সে আমাকে বলে, স্ত্রীদের উপর পুরুষের কর্তৃত্ব রয়েছে। তাই সে যা বলে, আমাকে তো তাই করতে হবে। সে হচ্ছে ঘর-বাড়ির আমির। সে বলে- আল্লাহ এবং তার দ্বীন এর মতে, সুন্নাহ এবং শরীয়াহ এর মতে, তোমাকে আমার কথা মেনে চলতে হবে যেহেতু তুমি আমার ঘরে বাস কর। তুমি তোমার পরিবারের সাথে, ভাইবোনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। এবং এগুলোর সাথে সে তার উপর আরও শর্ত আরোপ করে, আমি চাই না তুমি ঘর থেকে বের হও। বাড়িতে থাক। এবং কোথাও যাবে না যতক্ষণ না আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাই। এরকমই ঘটনাটি ছিল। কাজেই মহিলাটি জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কি এই কারণে গোনাহগার হব? একবার সে বাড়ির পিছনে গিয়েছিল, তার জন্যেও নাকি তাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল! সে হতাশ হয়ে পড়েছে। তার স্বামী সেখানেই ছিল, সে ছিল বাথরুমে বা কোথাও ছিল। আর সে সুযোগে মহিলাটি আমাকে প্রশ্ন করতে পেরেছিল। সুবহানাল্লাহ!

অনেক সময় মানুষ অনেক কিছুই ইসলামের নামে করে থাকে এবং তারা কুর’আন, সুন্নাহ, শরীয়াহ এর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। কিন্তু আমলের দিক থেকে ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করে। আপনারা জানেন, স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে অংশীদারের মত। এবং যদিও স্বামীকে বাড়ির কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, কুর’আনের ভাষায় মহিলাদের উপরে পুরুষদের কর্তৃত্বের কথা বলা হয়নি, আর রিজালু কাওয়ামুনা আলান নিসা। মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী বলা হয়েছে। কওয়াম শব্দটির সাথে কর্তৃত্বের কোন সম্পর্ক নেই। এটি আসলেই অনেক চাঞ্চল্যকর যে, অনেক অনুবাদেই আপনি এর অর্থ দেখতে পাবেন কর্তৃত্ব। কিন্তু কওয়াম শব্দটির যত প্রকার অর্থ আছে, সেগুলোর কোনটিই আসলে কর্তৃত্ব বোঝায় না। আসলে এর থেকে আল্লাহর একটি নাম এসেছে। আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কইয়্যুম। একই উৎস থেকে এসেছে। কইয়্যুম – এর সাথে কর্তৃত্বের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি যদি এটি আল্লাহকে নিয়ে কথা বলে, তখনও। এর মানে হচ্ছে কোন কিছু যত্ন সহকারে দেখভাল করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা, সব কিছু ঠিকঠাক রাখা ইত্যাদি। তিনি সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আর এটিই হচ্ছে কইয়্যুম এর অর্থ। কাজেই, যদি আপনি এর অর্থটি জানেন এবং বলেন, তোমার (স্ত্রী) উপরে আমার কর্তৃত্ব রয়েছে। প্রথমত, এর আসলে কোন মানে হয় না।

দ্বিতীয়ত, আমার স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে, আমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে তার বাবা-মায়ের, ভাইবোনের, বন্ধুদের। একটা সম্পর্কের কোন অধিকার নেই, অন্য সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে দেয়ার। প্রত্যেকেরই তার নিজস্ব একটি দুনিয়া থাকে। আমরা কোন মানুষের দাস নই। কোন মানুষই আসলে অন্য কোন মানুষের দাস হতে পারে না। আমরা সবাই একমাত্র আল্লাহর দাস। ঠিক? উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার মায়ের কাছে কিছু জিনিসের জন্য ঋণী। আমার মা আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য বলতে পারেন না। অথবা আমার স্ত্রী আমার মায়ের বিরুদ্ধে! আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। আমি আমার স্ত্রীকে এমন কিছু করতে বলতে পারি না যেটি তার বাবা-মায়ের মৌলিক কিছু অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। সে কি আমার বাড়িঘর ছেড়ে তাদের সাথে চলে যাচ্ছে? সে শুধুই একটি কল দিয়েছে! আমি তাকে এটি না করতে বলতে পারি না। আর যদিও আমি এটি করি, তাহলে এটি কোন গণণার মধ্যে পড়ে না। কারণ, সে তার বাব-মায়ের প্রতি ঋণী। আর এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম। এটি এমন কিছু না যা সে নিজে থেকে করছে। এটি আল্লাহর হুকুম। “তোমাকে বাবা-মায়ের প্রতি ভালো আচরণ করতে হবে।” যখন আল্লাহ বলেন, ওয়াবিল ইয়াদাইনি ইহসানা। তিনি কিন্তু এটি বলেননি, “পুরুষরা! সবসময় পিতা-মাতার সাথে সর্বোত্তম আচরণ কর, ”মহিলারা” বিয়ে পর্যন্তই। জীবনের বাকি সময় পিতা/ মাতা শুধুই ইতিহাস!! মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নিলেই হবে, যেমন শুধু প্রতি ঈদে! আল্লাহ আমাদের এমনটি করতে বলেননি। তিনি আমাদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। এই ঘটনাটিতে আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রথমত, তারা এখানে ধর্মকে টেনে নিয়ে আসেন, যা এখানে খাপ খায় না। তারপর, তার স্বাধীনতা নিয়ে, সে কোথায় যাবে, সে কি বাইরে যাবে ইত্যাদি।

এটি কোন ধর্মের হুকুম নয়, যে সে বাইরে যেতে পারবে না। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামী স্ত্রীকে বাইরে যেতে নিষেধ করতে পারে না। কিন্তু স্বামী যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, অতিমাত্রায় প্রতিরক্ষামূলক হয় এবং সে বিকৃত আচরণ করে তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করে ইত্যাদি, তাহলে এটি হচ্ছে স্বামীর মানসিক সমস্যা। ধর্মের সমস্যা নয়। কাজেই আমি এটি বলছি না যে, যখন সে বাধ্য হবে কেবল তখনি স্বামীর অবাধ্য হয়ে বাইরে যাবে। যদিও সে বাধ্য নয়, তারপরেও সে যাচ্ছে! তার যাওয়ার স্বাধীনতা আছে। এতে তার অধিকার রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আপনি অন্যকে দায়দায়িত্ব পালনে নিষেধ করতে পারেন না এবং অন্যের অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করতে পারেন না। আমার বিশুদ্ধ বাতাসের অধিকার রয়েছে। আবার কোন মহিলারা এটিকে উগ্রভাবে গ্রহণ করতে পারে, ঠিক? কেউ বলতে পারে, দেখুন আমি একটা লেকচারে শুনেছি, উমর (রাঃ) এর একটা গল্প শুনেছি। তাই আমি রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে যাচ্ছি! আমি ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছি। স্বামীরা! পরে দেখা হবে! (হাসি) অনেকেই এটি করতে পারেন। তাহলে, এটি সম্পূর্ণই তাদের সমস্যা। এটি আরেক ধরনের মানসিক সমস্যা। যেমন কেউ বলল, আমি শুধুই বিদ্রোহী হব, কারণ আমি হতে পারি।

পরিবার মানে এটা নয় যে একে অন্যের কাঁধে শুধু নিয়ম-কানুন চাপাবেন এবং সব সময় একটি হাদিসের উদ্ধৃতি কিংবা আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে কোন কাজ করাবেন। তাহলে কুর’আন এবং সুন্নাহর বিষয়ের চাইতেও আপনার নিজের আরও গভীর সমস্যা আছে! আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো আর সুস্থ থাকে না! বিয়ে মানে হচ্ছে আলোচনা, একে অন্যকে ছাড়, আমার সঙ্গী সুখি কিনা সেটা সব সময় খেয়াল রাখা, ঠিক? আর যখন আপনার সঙ্গীকে দিয়ে কিছু করানোর জন্য রীতিমত ধর্মকে ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করতে হয়, তাহলে এটা চূড়ান্ত পর্যায়ের নোংরামি। আমি একটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর চাইতে বেশি জগাখিচুড়ি কিছু চিন্তা করতে পারি না। অন্যের উপরে জোর করে নিজের হুকুম চালানোর জন্য কুর’আন এবং হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়া, যদিও সেটা সেখানে খাপ খায় না। সুবহানাল্লাহ। আমি যতটুকু বলার ছিল তাকে বলেছিলাম। কিন্তু, দিনশেষে সে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে। আমি অথবা কেউই ঐ পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে পারব না। দিনশেষে তাকেই তার স্বামীর সাথে সরাসরি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। ঠিক? হতে পারে, আমার কথা কাজে লেগেছে। কমপক্ষে, আমি মনে করি, অনেক সম্পর্কে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা হওয়া জরুরী। এবং যখন মানুষ ধর্মের অপব্যবহার করে, তাহলে সেটা তুলে ধরা উচিত। আপনারা জানেন। এরকম ঘটনা দেখে আমার দুঃখ হয়। কিন্তু ইনশা আল্লাহ, দিন দিন ভালো হচ্ছে। কমপক্ষে মানুষ আমার কাছে আসার মত সাহস পাচ্ছে। আমি এই সাহসের তারিফ করছি। বাড়ির সমস্যা নিয়ে আসা এবং কথা বলা একটি অনেক বড় সাহসের ব্যাপার। কাজেই আমি দোয়া করি সবাই যেন এটা থেকে উপকৃত হয়। কারণ তার যথেষ্ট সাহস ছিল আমার কাছে আসার এবং প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার। পরবর্তীতে আবার দেখা হবে।