এই চমকপ্রদ আয়াত দিয়েই আমি শেষ করবো, কিন্তু তার পূর্বে আবার দাউদ (আ) সম্পর্কে কথা বলতে চাই। কারণ ঐ আয়াতের সমাপ্তিটা অসম্ভব সুন্দর। এটা করার আগে সূরাতুল কাসাস থেকে একটি আয়াত আলোচনা করতে চাই। আল্লাহ বলেন – تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا – “সেই আখিরাতের ঘর” মানে জান্নাত, আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, আল্লাহ বলেন। যারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না। তারা এই দুনিয়ায় অন্যদের কাছে বড়ত্ব দেখাতে চায় না। তাদের আচরণের কারণে অন্যরা নিজেদেরকে ছোট মনে করে না। তাদের জীবন এমন নয়। لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ –
প্রসঙ্গত, যখন আপনি এমন একটা সমাজ তৈরি করেন যেখানে কিছু মানুষ নিজেদের ছোট মনে করে, আবার কিছু মানুষ নিজেদের অন্যদের তুলনায় বড় মনে করে, আর এভাবে সমাজ চলতে থাকে। তখন কি হয় জানেন? সমাজের সবাই উঁচু শ্রেণীর মানুষদের মত হওয়ার জন্য জীবন পণ প্রচেষ্টা চালায়। সমাজে এমন মানুষ আছে, যারা গরিব, তেমন টাকা-পয়সা আয় করতে পারে না, কোনোরকম ঘরে বসবাস করে। তারাও বড় বড় ম্যানশনে বসবাস করার স্বপ্ন দেখে, বিলাসবহুল গাড়ি চালানোর স্বপ্ন দেখে। এটাই ফাসাদ। এই শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজ, যেখানে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর মর্যাদার জন্য প্রতিনিয়ত টেক্কা দিয়ে যায়। এটাই ফাসাদ। কারুনের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছিল। এই জন্যই কারুনের ঘটনা বর্ণনা করার পর পরই এই আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। কারুনের ছিল বিশাল সম্পত্তি, আর তার চারপাশে বনী-ইসরাইলের সবাই ছিল দরিদ্র। তারা বলতো – يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ – “হায়, কারুন যা প্রাপ্ত হয়েছে, আমাদেরকে যদি তা দেয়া হত!” আমরা কত ভালো থাকতাম! ইস! আমার যদি কারুনের মত সম্পত্তি থাকতো। কত মিষ্টি! আমার যদি তার মত সম্পত্তি থাকতো। এর মূলটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা অন্তরের বিকৃতি। এই আকাঙ্ক্ষা যে কোন উপায়ে মানুষকে টাকা পয়সা উপার্জন করতে বাধ্য করে। তখন তারা আর হালাল হারামের তোয়াক্কা করে না। যতক্ষণ এখান থেকে ভালো পয়সা আসে আমি করবো। যদি এখান থেকে ভালো কামানো যায় আমি করবো। আপনার হাত দিয়ে হালাল এবং বৈধ আয় করার যে বিধান রয়েছে, আপনার জীবনে তার আর কোন অস্তিত্ব থাকে না।
উপসংহারে এসে আমি আয়াতের শেষ অংশটি নিয়ে কথা বলতে চাই। যে আয়াতে আল্লাহ দাউদ (আ) কে লোহা নিয়ে কাজ করতে বলেছেন এবং বলেছেন, কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর”। এই আয়াতে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল এই কাজটার সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। এটা তিনি না বললেও পারতেন। আল্লাহ দাউদ (আ) কে শুধু লোহা নিয়ে কাজ করতে বলতে পারতেন। কিনুত তিনি আরও বললেন, وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ – কড়াসমূহ সঠিকভাবে সংযুক্ত কর। যখন কোন কাজ করবে তা নিখুঁতভাবে কর। এটাই তিনি তাকে বললেন। প্রসঙ্গত, এটা শুধু দাউদ (আ) সম্পর্কে নয়। আয়াতটি শেষ হয়েছে এই কথা বলে যে, وَاعْمَلُوا صَالِحًا ۖ إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ – আর ‘’আর তোমরা সবাই সৎকর্ম কর। তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয় আমি তার সম্যক দ্রষ্টা।’’ দাউদ (আ) সম্পর্কে আলোচনার মাঝখানে আল্লাহ রুপান্তর করেছেন, যাকে ‘ইলতিফাত’ বলা হয়। তিনি ‘ইলতিফাত’ করে সরাসরি আমাকে এবং আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন আমি তোমাদের শুধু দাউদ (আ) এর গল্প বলছি না, বরং তোমরাও তোমাদের কাজ ভালোভাবে কর। তোমরাও তোমাদের কাজ ভালোভাবে সম্পাদন কর। এটা কোন ব্যাপার নয়, আপনি যদি অনেক ক্ষমতাশালী কোন এক্সিকিউটিভ হন, বা একজন দারোয়ান হন, অথবা কোন কেরানী হয়ে থাকেন, এতে কিছু আসে যায় না। আপনি যে কাজই করেন না কেন সেই কাজে আপনার উত্তম কৃতিত্ব প্রদর্শন করা উচিত। আপনি যে বেতন পেয়ে থাকেন তা যেন আপনার কাজের কারণেই পান। আপনি যেন কাজের মাঝে ঘুমিয়ে না থাকেন। আপনার কাজের মাঝে ইহসান থাকা উচিত।
এমন অনেক মানুষ আছে যারা তাদের চাকরিকে পছন্দ করে না। তারা তাদের চাকরি ঘৃণা করে। একমাত্র বেতনের জন্য তারা চাকরি চালিয়ে যাচ্ছে। এটাই একমাত্র কারণ। পোস্ট অফিসের লোকদের তুচ্ছ করার জন্য নয়, কিন্তু অনেককে এমন দেখা যায়। যেমন – ‘Department of Motor Vehicle’ – এ গেলে দেখা যায়, লোকটি আরাম করে বসে আছে, আপনাকে কোন সাহায্য করতে চায় না। সে বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে কখন লাঞ্চের সময় হবে। বেশি মানুষ আসতে দেখলে, বিরক্ত হয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে। এভাবে ডাকে, ‘নাম্বার ৫৬। তারা আপনাকে দেখে খুবই হতাশ। আপনি যে চাকরিই করেন না কেন, যে চাকরিই করেন না কেন, আপনাকে অনুভব করতে হবে যে, এখানে আপনার ‘ইহসান’ প্রদর্শন করতে হবে, সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখাতে হবে। কারণ এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি একটি অনুগ্রহ। যদি এই চাকরি না থাকতো আপনাকে মানুষের কাছে হাত পাততে হত। আপনাকে মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হত। বিদ্যুৎ বিল দেয়ার জন্য, মুদি দোকানের বিল পরিশোধ করার জন্য, আপনার বাচ্চাদের খাবার কিনে দেয়ার জন্য। আমরা কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না যেখানে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। স্বনির্ভরতা মানুষকে মর্যাদা এনে দেয়। আমি যে স্বনির্ভর, নিজের গাড়ি চালাই, নিজের বাসায় থাকতে পারি, নিজের জামা-কাপড় কিনতে পারি, নিজের খাবার কিনতে পারি, এগুলো আমার আত্মসম্মানের অংশ। কারো কাছে চাওয়া, হাত পাতা অপমানকর, লজ্জাজনক।
তাই আপনার যে চাকরিই থাকুক না কেন – আমাদের চাকরি নিয়ে অভিযোগ থাকতে পারে, তাতে সমস্যা নেই – কিন্তু আমি আপনি যে চাকরিই করি না কেন তা আসলে আমাদের প্রতি আল্লাহর একটি অনুগ্রহ। এর মাধ্যমে তিনি আমাদের এবং আমাদের পরিবারকে রিজিক প্রদান করে থাকেন। যেহেতু এটি আল্লাহর একটি অনুগ্রহ, আমাদেরকে এর প্রতি যত্নবান হতে হবে। আমাদের কাজগুলো ঠিকভাবে করতে হবে। চাকরি করার সময় ঘুমাতে পারি না, ম্যানেজার সব সময় দেখছে না বলে ফাঁকি দিতে পারি না। কেউ চেক করছে না বলে আপনি মন মত যখন তখন কাজে আসলে হবে না। আল্লাহ আপনাকে দেখছেন। আপনি তাঁর নিকট এই কাজের জন্য ঋণী। তাই ‘ইহসান’ প্রদর্শন করুন। আল্লাহ আমাদের বলেন- أَوْفُوا بِالْعُقُودِ – ‘’তোমরা তোমাদের ও‘য়াদাগুলি পূর্ণ কর।’’ যখন আপনার সাথে কোন চুক্তি করা হয়, আপনার নিকট প্রত্যাশা করা হয়, আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী সেই প্রত্যাশা পূর্ণ করা উচিত। وَاعْمَلُوا صَالِحًا – আর তোমরা সৎকর্ম কর। এটা বলেই শেষ করবো।
আমাদের শুধু হালালভাবে কাজ করলেই হবে না, আমাদের কাজটাও যেন বৈধ কাজ হয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা যে চাকরি করি তার মাধ্যমে পৃথিবীতে যেন ভালো কিছুর আবাদ হয়। আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত কোন ইন্ডাস্ট্রির অংশ হতে পারি না। আমরা এমন কর্পোরেশনের অংশ হতে পারি না, যা পৃথিবীতে নোংরামি আর নষ্টামির বিকাশ ঘটায়। প্রতিষ্ঠানটি কিসের অংশ তার দিকে লক্ষ্যপাত না করে শুধু নিজের টাকা উপার্জন নিয়ে চিন্তিত থাকতে পারি না। এই জন্য আপনি কোন বিয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিতে পারেন না, অথবা অস্ত্র নির্মাণকারী কোন শিল্পে। এই মানুষগুলো পৃথিবীতে ভয়ংকর অনিষ্টের জন্ম দেয়। তারা ব্যাপক মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। আমাদেরকে নৈতিকভাবে সচেতন থাকতে হবে যে, আমরা যা করি তা যেন পৃথিবীতে ভালো কিছু আনয়ন করে, উত্তম কোন উদ্দেশ্য সাধন করে। তাই আমাদের চাকরীর জায়গা নিয়ে এবং যে ক্ষেত্রে আমরা অবদান রাখছি তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। তারপর আল্লাহ বলেন, إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ – তোমরা যা কর আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। আপনার বস হয়তো দেখছে না, কেউ দেখছে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবে আল্লাহ দেখছেন।
আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কাজের বিষয়ে সচেতন করে তুলুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হালাল উপার্জনের সামর্থ্য দান করুন। এবং আমাদের উপার্জন যেন আমরা সর্বোত্তম উপায়ে ব্যয় করতে পারি। আল্লাহ আমাদের প্রতি এবং আমাদের পরিবারের প্রতি তাঁর ‘ফাদল’ যেন অব্যাহত রাখেন। আল্লাহ আমাদেরকে এই দুনিয়া এবং পরকালে যেন সর্বোত্তম রিজিক দান করেন।