বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ] সত্য-মিথ্যার চিরকালীন দ্বন্দ্বে মিথ্যাবাদীরা কৌশল খাটিয়ে কিছুদিনের জন্য টিকতে পারে – তা নিয়ে এক খুৎবাতে উস্তাদ নুমান আলী খান কুর’আন হাদীস থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাদের ৫টি কৌশলের। লেখাটা একটু বড় হতে পারে, একটু ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো। মিথ্যাবাদীদের কৌশলগুলো বলার আগে দেখি আল্লাহ সুবহানাল্লাহি ও তাআলা সত্যকে কীভাবে চিত্রায়িত করেছেন কুরআনে। সত্য সবসময় আগ্রাসী আর মিথ্যাকে সামনে পেলেই চুরমার করে ফেলে: “আমরা সত্যের দ্বারা মিথ্যার উপর আঘাত হানি, ফলে তার মগজ চুরমার হয়ে যায়, তখন দেখো! তা অন্তর্হিত হয়। আর ধিক তোমাদের প্রতি! তোমরা যা আরোপ কর সেজন্য।“ [সূরা আম্বিয়া: ১৭] সত্যের নিজের কোন অস্ত্র লাগেনা। মিথ্যাকে মারার জন্য সত্য নিজেই এক অস্ত্র। কোন বিষয়ের সত্য মিথ্যা একসাথে রাখলে সত্য একদম নিঃশেষ করে দেয় মিথ্যা কে। সত্য খুবই আগ্রাসী এ ব্যাপারে। সত্যের আগমনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হয় যারা এতদিন মিথ্যা কিছু তথ্য আর বিশ্বাসের উপর ভর করে বিশাল বিশাল ইমারত তৈরি করে নিয়েছে আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্ধভাবে তা মেনে চলছে। এইসব অহংকারী মিথ্যাবাদীরা কিভাবে সত্যকে নিশ্চিতভাবে জানার পরও প্রথম যে কৌশল এর আশ্রয় নেয় তা হল By Force বা পেশী শক্তি আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে। যেমন: ছোট একটা ছেলে তার এক বড় ভাইকে বিরবির করে বলল: ২+২=৪ বড়ভাই বলে উঠল ভারী গলায় “না, ২+২ =৫” “কিন্তু দেখুন ২ হচ্ছে ১ যোগ ১ আর…” “থাম, আমি বলছি ৫ , তাই ৫ এখন অফ যাও” ইব্রাহীম (আঃ) যখন তার গোত্রদের বললেন তোমরা ভুল ইলাহদের প্রার্থনা করছো আর জবাবে ওরা বলল: তাই না? ওকে জীবন্ত পুড়াও। শুধু জোর খাটিয়ে পেশী শক্তি আর হুংকার দিয়ে সত্যকে দূরে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয় কৌশল হল চরিত্র হনন। আগের উদাহরণে আসি। – “জান ভাইয়া ২+২=৪”...
আমি আপনাদেরকে আরবি শব্দ “ইবাদাহ বা এর মাছদার উবুদিয়া” এর অর্থ বোঝাতে চাই। শব্দটি দ্বারা দুটি জিনিস বোঝায়, যদি আমি এর যেকোনো একটি অর্থ ব্যবহার করে অনুবাদ করি তাহলে অনুবাদটি হবে অসম্পূর্ণ। এটা ক্লাসিকাল আরবির বিপরীতে ইংরেজি বা বাংলার সীমাবদ্বতা। ক্লাসিকাল আরবির একটি শব্দ দিয়ে একই সময়ে অনেকগুলো অর্থ প্রকাশ করা হত। যদি আমরা এই ধারনাটি (ইবাদা শব্দটি) আংশিক বাংলা অর্থ দিয়ে অনুবাদ করি, তাহলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। যে দুটি পদ আরবি শব্দ ইবাদার পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে তাহলো – উপাসনা এবং দাসত্ব। অধিকাংশ সময় আমরা যেকোনো একটি অর্থ গ্রহণ করি। বাংলায় দুটি আলাদা বিষয়, কিন্তু আরবি একটি শব্দ ইবাদা দ্বারাই উভয়টি বোঝায়। সুতরাং যখন রাসুল (স) বলেন, ‘লা আ’বুদু মা তা’বুদুন’ – এর অর্থ শুধু এটা নয় যে, আমি উপাসনা করব না, বরং এর অর্থ এটাও যে, আমি গোলাম হব না , আমি দাস হব না। সংক্ষিপ্তভাবে আমি আপনাদেরকে উপাসনা এবং দাসত্বের পার্থক্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। যখন মাগরিবের নামাজের সময় হয়, আমরা আল্লাহর উপাসনা করি। আবার যখন এশার নামাজের সময় হবে, আমরা উপাসনা করব। কিন্তু এই দুই নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে আমরা কী? আল্লাহর দাস। যখন আপনি ঘুমাচ্ছেন আপনি উপাসনা করছেন না, কিন্তু তখনও আপনি আল্লাহর একজন দাস। যখন আপনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন, গাড়ি চালিয়ে কাজে যাচ্ছেন, দাঁত ব্রাশ করছেন, নাস্তা করছেন, গাড়ি পার্ক করছেন – যদিও এই সময় আপনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন না বা কোনো উপাসনার কাজ করছেন না – কিন্তু এই সময়েও আপনি আল্লাহর একজন দাস। অন্য কথায় উপাসনা হলো – কিছু সুনিদৃষ্ট কাজের নাম। রোজা রাখা, নামাজ পড়া, হজ্জ পালন করা, কুর’আন তিলাওয়াত করা, দান করা – এইসব কাজ হলো উপাসনা। কিন্তু একজন দাস সবসময়-ই একজন দাস। সে এই কাজগুলো পালন করুক আর...
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ] “আর যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, পুরোপুরি পালন করত, তবে তারা উপর থেকে এবং পায়ের নীচ থেকে (অর্থাৎ আসমানী বরকত এবং ভূ-গর্ভের নেয়ামত) ভক্ষণ করতো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং অবশিষ্ট বেশিরভাগ লোকই মন্দ কাজ করে যাচ্ছে।” আজকের আলোচনায় সূরা মায়িদাহ এর ৬৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “ওয়া লাও আন্নাহুম আক্বামুত তাওরাতা ওয়াল ইঞ্জিল” – যদি ঐ লোকেরা তাওরাত এবং ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করত (পুরোপুরি মেনে চলত)… আল্লাহ এখানে সেই সময়ের ইহুদি এবং খ্রীস্টানদের কথা বলছেন। তাদের উপর তাওরাত এবং ইঞ্জিল নাজিল হয়েছিলো… যদি তারা সেই কিতাব মেনে চলত, “ওয়া মা উনঝিলা ইলাইহিম মিন রাব্বিহিম” – এবং অন্যান্য যেসব কিতাব তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নাজিল করা হয়েছিলো সেগুলো মেনে চলত, “লাআকালু মিন ফাউক্বিহিম ওয়া মিন তাহতিহিম” – তাহলে তারা তাদের উপর থেকে আর তাদের নিচ থেকে আহার পেতো। আল্লাহ বলছেন, যদি তুমি কিতাব প্রতিষ্টা কর, তাহলে শুধু জান্নাতেই সুখী জীবন পাবে না…যে বিষয়ে আগের আয়াতে ৬৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে, বরং এখানেও সুখী জীবন পাবে। তুমি উপর থেকে আর নীচ থেকে আহার পাবে। বিষয়টা এমন না যে আল্লাহর কিতাব মেনে চললে সবকিছু হারাতে হবে। অনেক মানুষ মনে করে যদি তারা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী জীবন ধারণ করে তাহলে সে জীবন হবে দুর্বিষহ। জীবনে অনেক কিছু তাদের হারাতে হবে। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন, হায় যদি তোমরা জানতে! আমি আসমানের রিযিকের দরজা খুলে দিতাম, জমিনের রিযিকের দরজা খুলে দিতাম। তোমরা শুধু সেসব ভোগ করতে, তোমরা বিলাসী জীবন পেতে… শুধু কী করতে হবে? মাত্র একটা জিনিসই করতে হবে – আল্লাহ’র কিতাব মেনে চলতে হবে। সুবহানাল্লাহ! “মিনহুম উম্মাতুন মুক্বতাসিদাহ ওয়া কাছিরুন মিনহুম সাআ...
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ] ইসলামের পথে আমার যাত্রার গল্প হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একজন মুসলিম হিসেবেই। আমার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন আমার পরিবার ইউনাইটেড স্টেটসে চলে আসে। কয়েক বছরের মাঝেই সঙ্গ আর পরিবেশের প্রভাবে ধর্ম আমার জীবন থেকে পুরোপুরি হারিয়ে তো গেলই, সেই সাথে আমি ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম, বিশেষ করে কয়েকটা দর্শন (ফিলোসফি) ক্লাস করার পর। আমার মনে হয়, দীনের পথে আমার ফিরে আসার যাত্রাটা একটা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছিল। ১৯ বছর বয়সে যখন আমি ইসলামের প্রকৃত মানে কি সেটা জানা আবিস্কার করা শুরু করলাম, তখন আমি নিউ ইয়র্কে। নিউ ইয়র্ক একটা চমৎকার জায়গা। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ জায়গাগুলোর মাঝে একটা। সেখানে আমি অনেকগুলো গ্রুপের সাথে মিশেছিলাম, যারা সবাই নিজেদের সুন্নী ইসলামের প্রতিনিধি বলে দাবী করত। আমি যখন কোন একটা গ্রুপের স্টাডি সার্কেলে বসতাম, তখন আমি প্রায়ই “অন্য” গ্রুপগুলোর বিভ্রান্তি সম্পর্কে শুনতে পেতাম। হয়তো রাস্তার ঠিক ওপারে থাকা “অন্য গ্রুপটা” যে কতটুকু নষ্ট, বিভ্রান্ত, বিপথগামী, এমনকি তারা আমার নিজের পরিত্রাণের জন্য কতটা বিপজ্জনক, এসব প্রায়ই আমার কানে আসত। ভালর জন্য হোক কিংবা খারাপের জন্য হোক, আমি শেখার জন্য একটা নিয়ম দাঁড় করিয়ে ফেললাম যে আমি দুই গ্রুপের কথাই শুনে দেখব। এরকম কোন “বিচ্যুত” গ্রুপের (অন্যদের চোখে) কথা আমার কানে আসলেই আমি সেই “বিচ্যুত” লোকগুলোর সাথে দেখা করে তাদের সাথে কথা বলতাম, যাতে তারা আসলে কি বলেছে সেটা সরাসরি তাদের মুখ থেকেই শুনতে পারি। এখন আমি বুঝতে পারছি যে, সে বয়সে সেটা করা অনেক বিপদজনক কাজ ছিল, কিন্তু ইসলামের পথে ফিরে আসার জন্য সেটাই ছিল আমার প্রথম পদক্ষেপ। আমি ইসলামের পথে ফিরে আসার কথা চিন্তাই করতাম না যদি আমার মাঝে সামান্য হলেও খোলা মন না থাকত।...
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ] জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়সাধন… সূরাটি শুরু হয়েছে আল্লাহর পরিচিতি দিয়ে (প্রথম ৩ আয়াত)। তাই বলা যায় ‘আল্লাহ’ সম্পর্কে ‘জ্ঞান’ দিয়ে শুরু এই সূরার। এ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের যদি ‘জ্ঞান’ থাকে তবেই এই ‘জ্ঞান’ কর্মের পথপ্রদর্শন করতে পারে (কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো কীভাবে?!)। ‘আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান’ আমাদেরকে কর্মের দিকে ধাবিত করে আর সেই কর্ম হল আল্লাহর দাস হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রচেষ্টা করা (মাঝখানের আয়াত অর্থাৎ ৪ নং আয়াতঃ ই’ইয়াকানা’অবুদু ওয়া ই’ইয়াকানাসতা’ইন)। আমরা যদি এই জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিই আর কাজ করে এ’দুটোর মাঝে সমন্বয়সাধন করতে পারি তবেই আমরা সরলপথে থাকব – সিরাতাল মুসতাকিম, এমন একটি পথ যে পথে পূর্ববর্তীরাও সেসব মানুষেরা চলেছেন যারা জ্ঞানকে কর্মে রুপান্তরিত করেছিলেন (হেদায়েত – শেষ ৩ আয়াত)। সুতরাং হিদায়াত বা সৎপথ হল জ্ঞানকে কর্মের মাধ্যমে সমন্বয় করা। এভাবে সরলপথের বিরপীত ভ্রষ্টপথ এর দুটি অবস্থার যেকোন একটি হতে পারেঃ এক. যখন আমাদের জ্ঞান আছে কিন্তু আমল নেই এবং দুই. যখন আমাদের আমল আছে কিন্তু জ্ঞান নেই। এরপরেই সূরাটিতে বলা হচ্ছে, আমরা যেন তাদের মত না হই যাদের জ্ঞান ছিল কিন্তু আমল ছিল না (মাগজুব – অভিশপ্ত – সৎপথের আমলহীনলোকেরা তো মন্দই করে – তারা তো মানুষের প্রতি মন্দ করার কারণে অভিশাপে অভিশপ্ত হবেই) এবং এরপরে বলছে, তাদের মতও যেন না হই যাদের আমল ছিল কিন্তু জ্ঞান ছিল না (ওয়ালাজ্জাল্লিন – যারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছিল – জ্ঞান না থাকার কারণে)। সংক্ষেপে এভাবে দেখানো যায়… আল্লাহ সম্পর্কে ‘জ্ঞান’ – প্রথম ৩ আয়াত (এ জ্ঞান যখন পথপ্রদর্শনের দিকে নিয়ে যায় তখন) আমাল – মধ্যখানের ১টি আয়াত (এখন জ্ঞান আর আমাল-এর সমন্বয় হল…তাহলে এটা নিয়ে যাবে) হেদায়েত-এ – শেষের ৩টি আয়াতে (অর্থাৎ...