এ রিয়ালিটি চেক ফ্রম সূরা আল-ক্বিয়ামাহ – ১ম পর্ব

শেষ যে দুইটা আলোচনা আমরা শুনেছি তা ছিল অসাধারণ অনুপ্রেরণার। আজ আমি সেরকম কোনো বক্তব্য পেশ করতে যাচ্ছি না। শুরু করার পূর্বে আপনাদের কিছুটা মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিতে চাই। এখন আমি আপনাদের সাথে যা শেয়ার করতে যাচ্ছি….আমি মনে করি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বর্তমান সভ্যতার কিছুটা পটভূমি মুসলমানদের জানা থাকা উচিত।

আমি এমন কিছু নিয়ে কথা বলবো যা বুঝতে হলে অনেক মগজ খাটাতে হবে। আপনারা সারাদিন ধরে এখানে বসে আছেন, মানসিকভাবে অনেকটা ক্লান্ত … তাই দোয়া করুন যেন আমি পরিষ্কারভাবে ধারণাগুলো আপনাদের নিকট উপস্থাপন করতে পারি এবং আপনারাও যেন আমার চিন্তা পদ্ধতির সাথে একাত্ম হতে পারেন।

যে কারণে আমি এই ভূমিকাটা দিচ্ছি তা হলো, যখন আপনাদের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো …. এভাবেই আমি শিক্ষা দিয়ে থাকি, আমি শুধু প্রশ্ন করার নিমিত্তে কোনো প্রশ্ন করি না, যখন আমি কোনো কিছু জানতে চাইবো আশা করি আপনারা জোর আওয়াজে তার জবাব দিবেন। এর ফলে আমি বুঝতে পারবো, আপনারা জীবিত আছেন। একমাত্র এভাবেই আমি বুঝতে পারবো আপনারা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাই বক্তব্য চলা অবস্থায় আমি আপনাদের নিকট অনেকবার বিভিন্ন প্রশ্ন করবো…আপনারা জবাব দিলেই কেবল আমি আলোচনা সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে পারবো।

আমি আশা করছি, আধা ঘন্টার মধ্যে আলোচনা শেষ করতে পারবো। যদি না পারি ….তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। আজ আমরা ইসলামের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা শুনেছি, আমরা রাসূল (স) সিরাহ নিয়েও আলোচনা শুনেছি।

কিন্তু আমি আলোচনা শুরু করতে চাই ইউরোপের ইতিহাস নিয়ে, ইনশাল্লাহ। ইউরোপের কিছু ইতিহাস নিয়ে। আমাদের সময়ের সমস্যাগুলো উপলব্ধি করার জন্য এই প্রেক্ষাপট জানা জরুরি। আমি আপনাদের সে সময়ের ইউরোপে নিয়ে যাচ্ছি যখন চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিলো। আপনারা যদি এটা না জেনে থাকেন ….তার সারমর্ম হলো – তখনকার ইউরোপ ছিল একটি ধর্মীয় সমাজ, আর সমাজের উপর চার্চের ছিল ব্যাপক কর্তৃত্ব। সে সময়ের চার্চ নিষ্ঠুর নিপীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল। পোপের কথাকে সৃষ্টিকর্তার কথার সমমূল্য দেয়া হতো।

কেউ পোপের কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করলে, তাকে আমাদের ভাষায় মুরতাদ ঘোষণা করা হতো। ধর্ম থেকে তাকে বের করে দেয়া হতো এবং হত্যা করা হতো। তাদের মতে, চার্চের সাথে দ্বিমত পোষণের একমাত্র ক্ষতিপূরণ রক্তের মাধ্যমে দিতে হবে। তাকে প্রথমে নির্যাতন করা হতো তারপর হত্যা করা হতো। শুধু হত্যা নয়, প্রথমে নির্মম অত্যাচার এরপর হত্যা। তারা মনে করতো তার আত্মাকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র উপায়।

ইউপরোপ এই ধরণের ধর্মীয় মতবাদ দ্বারা দীর্ঘকাল শাসিত হয়ে আসছিলো। এর ফলে দুইটি মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। উভয়টি প্রায় একই সময় আত্মপ্রকাশ করে। তার একটি হলো – প্রোটেস্ট্যান্ট রেফরমেশন। চার্চের মতে, সাধারণ মানুষের বাইবেল পড়ার কোনো অধিকার নেই। তারা নিজে নিজে বাইবেল পড়তে পারবে না। চার্চের অথরিটি বা পোপের নিয়োগপ্রাপ্তরাই কেবল বাইবেল পড়তে পারবে এবং এর ব্যাখ্যাও তারাই করবে। তাদের ব্যাখ্যার বিপরীতে কোনো ভিন্নমত পোষণ করা যাবে না।

প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন এসে ঘোষণা দিলো – না, প্রত্যেক খ্রিস্টানের বাইবেল পড়ার অধিকার থাকতে হবে। নিজেদের জন্য পড়বে, নিজেরা নিজেদের জন্য এর থেকে অর্থ খুঁজে নিবে। এর জন্য আমাদের চার্চের দরকার নেই। এভাবে চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো। সংক্ষেপে এটাই প্রোটেস্ট্যান্ট মুভমেন্ট, এই ব্যাখ্যাকে বলা যেতে পারে ক্লাস সেভেন এইট এর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপযোগী ব্যাখ্যা।

সে সময় আরেকটি মুভমেন্টেরও আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই আন্দোলনটি ছিল আরো শক্তিশালী। আর দু’টি আন্দোলন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয় আন্দোলনকারীরা বলতে লাগলো – “চার্চ এতো দিন ধরে যে মতবাদ প্রচার করে আসছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তা যৌক্তিক নয়। চার্চের এই মানুষগুলো দর্শনের বই পুড়েছে, বিজ্ঞানের বই পুড়েছে, যা কিছুই তাদের মতবাদের সাথে মিল রাখে না ….যেমন, বাইবেলের মতে, পৃথিবী হলো মহাবিশ্বের কেন্দ্র…কিভাবে আমরা এটা মেনে নিবো? যেখানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এই মতের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা এই বিশ্বাস মেনে নিতে পারি না।”

এর ফলে চার্চ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে ‘কুফর’ বা ধর্মদ্রোহিতা হিসেবে ঘোষণা করলো। তাই তারা লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফেলেছিলো, বৈজ্ঞানিকদের হত্যা করেছিল, দার্শনিকদের মেরে ফেলেছিলো। যে বিষয়গুলো ফরাসি বিপ্লবে প্রেরণা জুগিয়েছিল….খ্রিস্টান মতবাদের দুইটি দিক প্রথমত: এটা নিপীড়নমূলক আর দ্বিতীয়ত: এটা অযৌক্তিক। আমাদের এমন মতবাদের নিকট আসতে হবে যা যৌক্তিক আর তা হলো – বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তি এবং বিচারবুদ্ধি। এভাবে দুই দিক থেকে চার্চ বিদ্রোহের স্বীকার হয়, ধর্মীয় দিক থেকে প্রোটেস্ট্যান মুভমেন্টের দ্বারা এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকে, সেকুলার আন্দোলন দ্বারা। যা চার্চের কর্তৃত্বকে দূর করে দেয়।

ইউরোপ জুড়ে যখন এই বৈপ্লবিক আন্দোলন চলছিল, আর এই আন্দোলন ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী এক আন্দোলন। যখন এই বিপ্লব ঘটে গেলো। হঠাৎ করেই ইউরোপ একটি মুক্ত চিন্তার সমাজে পরিণত হলো। তারা নতুন করে আবিষ্কর করতে লাগলো কোন কোন বিশ্বাস তাদের ধরে রাখা উচিত, আর কোন কোন ধারণা-চিন্তা সমাজের কেন্দ্রে থাকা উচিত। এটা নব চিন্তা-চেতনার একটি মুক্ত বাজারে পরিণত হয়ে গেলো।

এই সময় কয়েকটি দর্শনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মূলত, প্রথম দিকে সেরা সেরা বিজ্ঞানীদের অনেকেই ছিলেন নামকরা দার্শনিক। তাদের নিকট দর্শন এবং বিজ্ঞান একসাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। আর ধারণা-চিন্তার এই মুক্ত বাজারে শুধু একটি নয় অনেকগুলো দর্শন একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো।

কিন্তু, আমি চাই আপনারা এই বিষয়টা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন…একটি কমন চিন্তা অন্য সব চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, যদিও এই চিন্তার ছোট-খাটো ভিন্ন পাঠও পরিলক্ষিত হয়, তবু বলা চলে একটি চিন্তা শেষ পর্যন্ত বর্তমান থেকে যায়। আর এটি শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এই চিন্তাটি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

আজ আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি তা আসলে সেই মতবাদ বা সেই ধারণাগুলোর প্রতিক্রিয়ার ফল। তাই আমি প্রথমে সে ধারণাগুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই, তারপর সূরাতুল ক্বিয়ামাহ থেকে কিছু উপস্থাপন করবো। সূরা ক্বিয়ামার প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াত, কিন্তু তার পূর্বে দৃশ্যপট তৈরী করে নিতে চাই।

— উস্তাদ নোমান আলী খান