ই পৃথিবীতে আপনি কখনই পরিপূর্ণ সুখী হতে পারবেন না। আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা আপনাকে যত কিছুই দান করুক না কেন? আপনি কখনই সত্যিকার অর্থে পরিতৃপ্ত হবেন না। এই দুনিয়াকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে এটা আপনার হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে। এটাকে নকশা করা হয়েছে এভাবেই। আপনি যদি দুনিয়ায় সুখী হওয়ার প্রত্যাশায় থাকেন, আপনি আসলে ভুল জায়গায় আছেন। আমার প্রিয় ভাইয়েরা, কিভাবে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে পারেন? আমার প্রিয় বোনেরা, কিভাবে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে পারেন? আপনি তো লাত, ওজ্জার দাস নন। অথবা ঈসা (আঃ), কৃষ্ণ বা গণেশ এর দাস নন। আপনি তো ফ্যাশন বা অর্থের দাস নন। অথবা খ্যাতি, সৌন্দর্য, ক্ষমতা বা পদবির দাস নন। আপনি আল্লাহর দাস, আল্লাহর গোলাম। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মাঝে আল্লাহ আপনাকে পছন্দ করেছেন। আল্লাহ আপনাকে পছন্দ করেছেন আর ইসলামের মাধ্যমে মহিমান্বিত করেছেন।
দুঃখ-বেদনা একমাত্র তখনি নেতিবাচক হয়, যদি এটা আপনার এবং আল্লাহ সুব হা নাহু ওয়া তায়ালার মাঝে বাধার দেয়াল তৈরি করে। আর দুঃখ-বেদনা তখন ইতিবাচক হয়ে উঠে, একটি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে যখন এটি আপনাকে আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার নিকটবর্তী করে তোলে। ”ও আমার প্রিয় বান্দাহ! তোমার প্রভুর নিকট ফিরে আস।” ও আমার প্রিয় দাস! এটি তোমার জন্য একটি স্মরণিকা এজন্য যে আমি তোমাকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনতে চাই। ‘’তাদের উপর কোন ভয় নেই আর তারা দুঃখ ভারাক্রান্তও হবে না।” এখনো ঘটেনি এমন কিছুতে মানসিকভাবে আতঙ্ক গ্রস্ত হয়ে পড়বেন না, এটা হল ভয়। আবার ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পড়বেন না। সবকিছুই আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত। মুসলমানদের জন্য দ্বীনের যে বিষয়টি মেনে নেয়া সবচেয়ে কঠিন – আমাদের দ্বীনের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদ – তা হল ”আল্লাহর কদর”। আমরা এটা স্বীকার করতে চাই না। আমরা আল্লাহর ক্ষমতার কথা ভুলে যাই। আমরা আল্লাহর উপস্থিতির কথা ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই যে আমরা এক ফোটা নাপাক পানি থেকে এসেছি, আমাদের কোন মূল্যই ছিল না। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সঃ) কে সবকিছু পরিশুদ্ধ করতে হয়ছিল, কারণ আমরা কিছুই সঠিকভাবে করছিলাম না। আমরা ভীত হয়ে পড়ি, কারণ আমরা ভুলে যাই। আমরা ভয় পাই কারণ আমরা ভুলে যাই যে সবকিছু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে আছে।
নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের প্রত্যেককেই পরীক্ষা করব, ধন সম্পত্তির ক্ষতির দ্বারা, জীবনের ক্ষতির দ্বারা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির দ্বারা। সুতরাং ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দান করুন। আর তাদের পরীক্ষা করা হলে তারা বলে আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর নিকটই আমাদের প্রত্যাবর্তন। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। যদি আল্লাহ আপনার উপর সন্তুষ্ট থাকেন তবে আপনি যা চান সবই আপনার আছে। আর আল্লাহ যদি আপনার উপর সন্তুষ্ট না থাকেন, তবে কোন কিছুই আপনাকে সুখী করবে না। এটা সর্বদা আপনার জন্য দুঃখ-কষ্টই বয়ে নিয়ে আসবে। আল্লাহর কসম! এটাই সত্য। এটা মিথ্যা নয়।
আমার প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, আমি আমার এই আলোচনা এমন সব মানুষের জন্য উৎসর্গ করতে চাই, যাদেরকে তাদের পিতা পরিত্যাগ করেছেন। যিনি এই দুনিয়ার কাউকে ভালবেসেছিলেন, কিন্তু কোন এক কারণে সে ছেড়ে চলে গেছে। যার কোন প্রিয়জন চিরদিনের জন্য দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আর তিনি বুঝতে পারছেন না, কেন এমন হল? পৃথিবীর বহু জায়গায় বহু মানুষ আজ চরম দুঃখ- কষ্টে নিমজ্জিত, বিভিন্ন রকম ব্যথা, বিভিন্ন রকম কষ্ট। কিন্তু সব সময় এর শেষ কথা হল শয়তান কোন না কোন উপায়ে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সমর্থ হয়। এবং তাদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আজকের এই আলোচনা এমন সব মানুষদের জন্যই।
আমাদের সবার জীবনেই দুঃখ-কষ্ট আছে। এটাই বাস্তবতা। জীবন হলো একটা পরীক্ষা। আমাদের পরীক্ষা করা হবেই। আর তাইতো আল্লাহ বলেন- তুমি কি মনে করেছ তুমি বিশ্বাস কর এ কথা বললেই তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে? কোন রকম পরীক্ষা করা ছাড়াই? তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের পরীক্ষা করা হয়েছে। এমনকি নবীরা এবং যারা তাদের সাথে ছিলেন বলে উঠেন কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ? তারপর আল্লাহ বলেন- নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য সবসময় অতি নিকটে। সুবহানাল্লাহ! সুতরাং হ্যাঁ, আমাদের পরীক্ষা করা হবেই। কঠোরতা আসবেই, বাধাবিপত্তি আসবেই। এটাই জীবনের বাস্তবতা।
আমাদের বুঝতে হবে যে, যা কিছুই ঘটছে সবি আল্লাহর পক্ষ থেকে। আপনার হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আপনি যদি আল্লাহকে ভুলে যান, আপনি হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। আপনি ভাবেন, চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন আর কুয়াশাচ্চন্ন। কিন্তু না। আমরা এটা বিশ্বাস করি না। আমরা সুখী সমাপ্তিতে বিশ্বাসী, বাহিরটা যতই নিরস হউক না কেন। এটা তো দুনিয়া। আপনি নিম্নতম স্থানে আছেন। দুনিয়া মানেই হল – নিম্নতম স্থান। আমরা একদম তলায় আছি, এখান থেকে শুধু ঊর্ধ্বেই যাওয়া যায়। সত্যিই। এখান থেকে শুধু ঊর্ধ্বেই যাওয়া যায়। এই স্থান… আল্লাহর কসম! আমি আপনাদের এবং আমার নিজেকে আন্তরিক উপদেশ দিচ্ছি… এই জায়গাকে সাজানোই হয়েছে আপনার অন্তর ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার জন্য। এটাকে এভাবেই নকশা করা হয়েছে। যদি আপনি এই দুনিয়ায় সুখী হওয়ার খোঁজে থাকেন, আপনি ভুল জায়গায় আছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের যেসব পরীক্ষা করা হয় তা শুধু দুঃখ-দুর্যোগের মাধ্যমে করা হয় না; যেমন মৃত্যু, সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে। অনেক সময় নিয়ামতের মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হয়। আল্লাহ আমাদের অনেক নিয়ামত দিয়েছেন, কিন্তু তার জন্য আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ধন্যবাদ দেই না। এবং সে নেয়ামাতগুলোকে আমরা সঠিক কাজে ব্যবহারও করি না। আপনি যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দ্বারা পরীক্ষিত হয়ে না থাকেন, আপনি যদি সে পরীক্ষাটা দেখতে না পান; তাহলে এখন অনুধাবন করুন যে, হয় আপনাকে দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হচ্ছে, অথবা আপনাকে আনন্দ-ফুর্তির মাধ্যমে পরীক্ষা করা হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রে একই ফলাফলের দরকার হয়; আপনি আল্লাহর দিকে ফিরে আসেন।
যাকে দুঃখ-দুর্দশার মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়; সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করে এবং এই কষ্ট থেকে বাঁচার একটা উপায় পেয়ে যায়। আর যাকে বিভিন্ন নিয়ামতের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হচ্ছে; সে আল্লাহর এই সব নিয়ামতরাজির জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। আর তাকে প্রদত্ত সব নিয়ামতরাজি ব্যবহার করে আল্লাহর আরও অধিক নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
কতজন ধনী মানুষকে আপনি চিনেন যাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে? তাদের মাঝে এমন অনেককেই পাবেন যারা সন্তানদের কারণে কঠোর যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করছেন। তার ছেলে হয়তো সম্পূর্ণরূপে উচ্ছৃঙ্খল, সত্যিই। চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, মানুষ কঠোর যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করছে। আপনি তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন কারণ তার রয়েছে বিশাল বাড়ি, সুন্দর মার্সিডিজ গাড়ি। আপনি যদি তার জুতা পরে থাকতেন (তার জায়গায় থাকতেন) হয়তো বলতেন “আমার পুরান জুতাই ভালো, যদিও তাতে ছিদ্র রয়েছে; কারণ অন্তত আমি রাতে ঘুমাতে পারি। তার জুতা পরে থাকলে (তার জায়গায় থাকলে) আমাকে যতসব ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাতে হয়।”
যখন আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে আপনাকে পরীক্ষা করা হয়, আপনাকে দুটি পথের যে কোন একটি বেছে নিতে হয়। হয় আপনি এখনই এই কষ্টের মোকাবেলা করবেন এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হবেন, অথবা এই কষ্টের মোকাবেলায় আপনি দেরি করবেন; অন্যদের করুণা ভিক্ষা করবেন, সাহায্য ভিক্ষা করবেন এবং কোন উপায় অবলম্বন না করে কষ্টটাকে দীর্ঘায়িত করবেন।
মানুষ যখন কোনো কষ্টের মধ্য দিয়ে গত হয় তারা একটি চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। এই চক্রটি বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। যখন তারা প্রিয় কাউকে হারায়, যখন তারা অন্য কারো দ্বারা প্রতারিত হয়, সর্বপ্রথম যে কাজটি তারা করে তা হলো – নিজের জন্য একাকিত্বকে পছন্দ করে। তারা একা থাকতে চায়। পুরুষের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা বেশি গভীরভাবে দেখা যায়। কারণ পুরুষরা প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো একা একা মোকাবেলা করতে চায়। তারা এটা নিয়ে কথা বলতে চায় না।
কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। মহিলারা বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায়। তাদের ব্যথা এবং বেদনার কথা অন্য কারো কাছে শেয়ার করতে চায়। তাই তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো – সাথে সাথে ফোনে কারো সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করা বা মায়ের বাড়ি চলে যাওয়া অথবা কোনো বান্ধবীর বাসায়।
কিন্তু যাই হউক কষ্টটা যদি অনেক গভীর হয়ে থাকে, একটা সময় পরে আপনি নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইবেন। তাই সবার আগে আপনাকে এই একাকিত্বে চলে যাওয়ার সমস্যাটা শনাক্ত করতে হবে। আপনি এটা করবেন না। এটা প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া নয়। বরং শয়তান আপনাকে বলছে – ‘’তুমি ভালো ফিল করবে যখন তুমি একা থাকবে। কারণ তোমার সমস্যাটা তুমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।’’ এটা শয়তানের একটি প্রতারণা। যদিও কিছু সময়ের জন্য আপনার একাকিত্বের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু এই একাকিত্বকে দীর্ঘায়িত করা মারাত্মক ক্ষতিকর। এই একাকিত্ব আপনার পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলবে। ব্যাথা বা কষ্ট পাওয়ার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আপনাকে আবার ঈমানদারদের সাথে মিশতে হবে। আপনাকে মানুষের সাথে মিশতে হবে যারা আপনাকে আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।
— শায়েখ নাভায়েদ আজিজ ও শায়েখ হামজা ইউসুফ