বিয়ের পথ সহজ করে দিন

আল্লাহ যখন বলেন – তোমাদের মাঝে অবিবাহিতদের বিয়ে দিয়ে দাও, তাদেরকে বিয়ে করার সুযোগ করে দাও; এই নির্দেশনাটি ব্যাপকতা বুঝায়। এই নির্দেশনাটি কাদের জন্য প্রযোজ্য?

আপনি হয়তো চিন্তা করবেন ছেলেটা যখন লেখাপড়া শেষ করবে, তারপর যখন ভাল একটা চাকরি পাবে, যখন সে অনেক টাকা জমাবে, যখন সে তার পিতামাতাকেও তাদের খরচের কিছু টাকা ফেরত দিতে পারবে, যখন সে এটা করবে সেটা করবে ইত্যাদি… এবং পরিবারের অন্য সবার যত্ন নেয়া হবে – তারপর আমরা তার বিয়ের কথা চিন্তা করবো। কারণ এখন যদি আমরা তাকে বিয়ে করাই তাহলে তার সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবে তার স্ত্রী। আমরা কিছুই পাবো না। এটা আমাদের সন্তান, আমাদের বিনিয়োগ, তাকে বিয়ে করানোর আগে আমরা আমাদের টাকার মূল্য চাই।

আর এমনকি যখন আমরা তাকে বিয়ে করাবো তখন ব্যাপারটা শুধু আমাদের পার্থিব অর্জনের বিষয় না, এটা আমাদের পারিবারিক গৌরব এবং প্রদর্শনের বিষয়ও। এমন একজনকে বিয়ে করাতে হবে যাকে আমরা প্রদর্শন করতে পারবো। যাকে নিয়ে আমরা গর্বিত হব, অনেক ছবি তুলতে পারবো। তাই বিশাল এক অনুষ্ঠানের আয়োজন কর এবং মানুষকে দেখাও যে আমরা একটা উচ্চ শ্রেণীর পরিবারে আত্মীয়তা করেছি…ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই কাউকে বিয়ে করানোর ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো আপনি বিবেচনা করেন তা হল – নারী পুরুষ উভয়ের জন্য আপনি বয়সের একটা মাত্রা ঠিক করে দেন।

নারীদের ক্ষেত্রে একদম বিপরীত কাণ্ডটাই ঘটে, কোন কোন পরিবারে সে টিনএজ বয়সে পৌঁছার সাথে সাথে এমন ভাবা হয়- আমাকে দ্রুত এর দায়দায়িত্ব পালন থেকে বাঁচতে হবে। মনে হয় যেন এটা আপনার ঘরের একটা ব্যাধি, যত দ্রুত এর থেকে বাঁচা যায় ততই মঙ্গল। আপনি মেয়েটাকে যেন তেন কোন পাত্রের কাছে তুলে দিতে পারলেই বাঁচেন।

বহু মেয়েরা হতাশায় ভোগেন, কারণ তাদের বাবা মা সবসময় বলতে থাকেন; তুমি এখনো এখানে পড়ে আছ, তুমি বিয়ে করছ না, তুমি বাসায় বসে আছ। আর পক্ষান্তরে, যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে চায়; আর তাদের বাবা মা বলতে থাকে ”তুমি এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত নও, তুমি এখনো তৈরি নও।”

লক্ষ্য করুন, কুরআনের আয়াত আমাদের কি বলে? وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ – “এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও (বিয়ে দিয়ে দাও)।” তখনকার সমাজে দাস দাসীরাও ছিল। এদের বলতে গেলে কোন টাকা-পয়সাই ছিল না। আল্লাহ বলেন – তাদেরকেও বিয়ে দিয়ে দাও। তাই এই যুক্তি যে, বিয়ে সম্পর্কে চিন্তা করার আগে কাউকে স্বাবলম্বী হতে হবে- তা এই একটি বক্তব্যের মাধ্যমে তছনছ করে দেয়া হল, সমীকরণ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হল। যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে তা হল, প্রথমতঃ তারা কি বিয়ের বয়সে পৌঁছেছে? আর দ্বিতীয়তঃ ‘সলিহিন’ ভাল মানুষ। ভাল মানে তাদের আল্লাহর সাথে ভাল সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা পরিণত, তারা প্রস্তুত। এই হল وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ ۚএর ব্যখ্যা।

তারপর আল্লাহ এর সাথে যোগ করে আরও বলেন – কারণ এখনও বহু মানুষ এই বিষয়টাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে- إِن يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন।

কারণ টাকা পয়সার বিষয়টা আল্লাহর নিকট ক্ষুদ্র সমস্যা। কিন্তু ‘আইমা’ … আইমা মানে সমাজের বহু মানুষ যারা অবিবাহিত রয়ে গেছে, সেটা তুলনামূলক বড় সমস্যা। অর্থ কড়ি না থাকা ছোট সমস্যা। কিন্তু মানুষের মাঝে সম্পর্ক জুড়ে না দেয়া আল্লাহর নিকট অনেক অনেক বড় সমস্যা। এই আয়াতটি পড়ার সময় আমি একটি বর্ণনার সন্ধান পাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সমাজ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন যেখানে প্রচুর অবিবাহিত মানুষ রয়েছে। তিনি উম্মাহর এমন অবস্থা হওয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন যেখানে প্রচুর অবিবাহিত মানুষ থাকবে; আর তারা এটা নিয়ে সুখী থাকবে। আসলে এ অবস্থায় তারা সুখী নয় বরং তাদের পরিবার একজনকে ক্রমাগত অপছন্দনীয় পাত্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আর অন্যজনের বেলায়, যে বিয়ে করতে চাচ্ছে তাকে বিয়ে করতে দিচ্ছে না। তখন সেই ছেলে বা মেয়ে বলে- যাহ! যাই ঘটুক আমি একা থাকবো।

যখন কেউ বলে আমি একা (single) থাকবো, তার অর্থ এই নয় যে আমি ফেরেশতার (angel) মত থাকবো। নিঃসঙ্কোচে বলতে গেলে আমরা জানি এর মানে কি? একজন ত্রিশ বছরের যুবক যে কিনা একজন প্রফেশনাল, ভাল টাকা উপার্জন করেন, অন্যদিকে আটাশ বছরের এক মেয়ে যে লেখাপড়া শেষ করেছে এখনো অবিবাহিত – তার মানে এই না যে তাদের কোন আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়নি, পাপ করার সুযোগ তৈরি হয়নি বা তারা আগের দিনের মদিনার মানুষের মত ধার্মিক জীবন অতিবাহিত করে।

প্রসঙ্গতঃ মদিনারও তার নিজস্ব ধরনের সমস্যা ছিল। মদিনাতেও তার নিজস্ব ধরনের পরিস্থিতি ছিল। আপনি যদি মনোযোগ দিয়ে রাসূল (স) এর জীবনী পড়েন তাহলে দেখবেন সাহাবীদের জীবনে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। মাত্র আজ সকালে আমি এক সাহাবীর একটি বর্ণনা পড়ছিলাম যিনি কোন এক কারণে মক্কায় গিয়েছিলেন। আর সেখানে তার জাহেলী যুগের এক মেয়ে বন্ধু ছিল। সত্যিই ‘মেয়ে বন্ধু’! আরবি বর্ণনায় যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ‘খালিলাহ’ মেয়ে বন্ধু; তাঁর মুসলিম হওয়ার আগের জীবনের। তো, মেয়েটি তাকে দেখতে পেল। আর বলল- কি খবর তোমার? তুমি কি আবার আমার সাথে নির্জনে থাকতে চাও না? আক্ষরিক অর্থে সে মেয়েটি এটাই বলল। তখন সেই সাহাবী (রা) বললেন- “সম্ভব না। তোমার আর আমার মাঝে এখন ইসলাম এসে গেছে।” তিনি এটাই বললেন। তখন মেয়েটি রেগে গেল। সে তার ভাই বন্ধুদের ডাকল তাঁকে মারার জন্য। তিনি বললেন- ঠিকাছে, আমাদের জন্য একটাই পথ আছে তা হল- আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে। মেয়েটি বলল- ঠিকাছে, আমাকে বিয়ে কর। তিনি বললেন- আমাকে আগে রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করতে হবে। কারণ তিনি জানতেন না যে অমুসলিম কাউকে বিয়ে করা যাবে কিনা। তারপর তিনি রাসূল (স) এর কাছে ফেরত গেলেন এবং তাঁকে (স) জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর এই আয়াত অবতীর্ণ হয় – ” মুশরিক নারীদের বিয়ে কর না যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে ঠিকাছে, আর যদি না করে তাহলে না, বিয়ে করা যাবে না। সে যদি মূর্তি পূজা ত্যাগ করে মুসলিম হয় তাহলে ঠিকাছে।

আমি আমার যুক্তি থেকে সরে গিয়েছি। আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হল – কিভাবে আমরা বিয়েকে সহজ করে দিব? কারণ এটা (বিয়েকে কঠিন করা) শয়তানের কাজ। শাহ ওয়ালি উল্লাহ (র) বুদ্ধিদীপ্তভাবে বিষয়টা তুলে ধরেছেন। একটি সমাজে শয়তানের রাস্তা হল হারামকে সহজ করে দেয়া আর হালালকে কঠিন করে দেয়া। যখন সমাজে এটা ঘটে তখন শয়তানের জয় হয়। কারণ লোকজন সহজের দিকে আকৃষ্ট হবে। তাই আজকের সমাজে আপনি যদি চোখ দিয়ে আনন্দ পেতে চান আপনার সামনে আছে স্ক্রিন, বিভিন্ন নিষিদ্ধ জায়গায় আপনি যেতে পারেন, আপনার অফিস বা ক্যাম্পাসে, আপনার মোবাইল ডিভাইসে, সোশাল মিডিয়ায়, ডেটিং অ্যাপ্স আরও কত রকম উপকরণ আপনার হাতের মুঠোয়।

কারণ পুরুষের মহিলাদের প্রতি আকর্ষণ থাকবেই; আল্লাহ এটা মানুষের ভেতরে দিয়ে দিয়েছেন আর এটা কোথাও চলে যাবে না। নারীরাও নিজেদের জন্য সাথীর খোঁজ করবেই, এটাও আল্লাহ তাদের ভেতরে দিয়ে দিয়েছেন, এটা তাদের প্রকৃতিতেই রয়েছে। এ কারণেই পরিবার তৈরি হয়। আজ যখন অসুস্থ, নোংরা আর অবৈধ কার্যক্রমের দরজাকে বিস্তীর্ণরূপে খুলে দেয়া হয়েছে- এরকম পরিস্থিতিতে একজন যুবক এসে যখন বিয়ের কথা বলে…”আমি জানি আমি মাত্র ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে পড়ি, কিন্তু আমি আর পারছি না মা, আমি আর পারছি না বাবা।” সে হয়তো এভাবে বলে না- আব্বা আমার হরমোন আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে, ক্যাম্পাসে মেয়েদের যা অবস্থা! আমি জানি না আপনাকে কি বলবো। সত্যিই, একটা মেয়ে আমাকে শুধু মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। সে তো আর এভাবে তাঁর বাবা মাকে বলবে না। সে হয়তো বলবে- মা আমি মনে করি আমার বিয়ে করা উচিত। সে ইঙ্গিতে ভালভাবে বলার চেষ্টা করবে। আর তখন কোন কোন পিতামাতা এই যুবক ছেলেটাকে অপমানিত করা শুরু করে। ” ওহ, ধৈর্য ধরতে পার না? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পার না? আমি চল্লিশ বছর বয়সে…” পিতা এভাবে তাকে লেকচার দেয়া শুরু করেন। কিভাবে আপনার তখন ৪০ বছর বয়স ছিল…এখন আপনার বয়স ৫০! হা হা।

তো, আমরা পিতামাতারা অনেক সময় এ ব্যাপারটাকে অত্যাচার এবং দমন করার চেষ্টা করি যা আল্লাহ প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ভেতরে দিয়ে দিয়েছেন। বিশেষতঃ আজকের দিনে – যখন হারামকে অত্যন্ত সহজ করে দেয়া হয়েছে- আপনাকে স্বাভাবিক নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে হালালকে সহজ করে দিতে হবে। সাধারণ নিয়ম কানুনের বাইরে যেতে হবে। হালালের পথ উন্মুক্ত করার মাধ্যমেই কেবল আপনি হারামকে মোকাবেলা করতে পারবেন। ফলে আমরা আমাদের তরুণ তরুণীদেরদের বলতে পারব হালাল পথ তোমাদের জন্য উন্মুক্ত। কোন ভুল করার চিন্তা করারও আগে আমাদের সাথে কথা বল। আমাদের জানতে দাও।