অপচয় কী আর শয়তানের ভাই কারা?

কুরআনে আল্লাহ তাআলা অসংযতভাবে ব্যয়কারীদের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এর জন্য দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।একটি হল ‘ইসরাফ।ইসরাফ মানে হল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খরচ করা।আপনি যদি শপিং এ যান কারণ আপনার একটি শার্টের প্রয়োজন আর আপনি একটি শার্টের পরিবর্তে ২০ টি শার্ট কিনলেন কেবলমাত্র আপনার সামর্থ্য আছে বলে।এ কাজটি এক ধরনের ইসরাফ।

অবশ্যই শার্ট আপনার কাজে লাগবে আপনি সেগুলো পরতে পারবেন ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু করে ফেলেন সেটাই হল ইসরাফ।কুরআনে ইসরাফ ব্যাপারটিকে নিচু চোখে দেখা হয়েছে। কিন্তু আরেক ধরনের খরচের বাতিক আছে। মানুষের মাঝে যা এর থেকেও অনেক খারাপ।যেটাকে আল্লাহ বলেছেন ‘তাবযীর। তাবযীর মানে হল আপনি এমন জিনিসে খরচ করছেন যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এটা কোন মৌলিক চাহিদা নয়।আপনি জিনিসটি একেবারেই অর্থহীন কারণে কিনছেন।কোন উল্লেখযোগ্য চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না আপনি যা কিনেছেন এই তাবযীর দ্বারা।তাবযীর শব্দটির মানে আপনি বলতে পারেন অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা অপব্যয় করা, ফালতু জিনিসে খরচ করা। কিন্তু আল্লাহ যেভাবে তাবযীর শব্দটি বর্নণা করেছেন তা হল…”ইন্নাল মুবাযযিরীনা কানু ইখওয়ানাশ শায়াতীন” যারা অপ্রয়োজনীয় খরচ করে তারা শয়তানের ভাই।এই ঘোষণাটি খুব নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। আমি শুধু খরচ করছি বলে ধরুন খরচ করছি ভিডিও গেমস এর উপর কিংবা Las Vegas এ একটি ট্রিপে যেতে অনেক টাকা খরচ করছি ইত্যাদি ইত্যাদি।এগুলোর জন্যে আমাকে শয়তানের ভাই হিসেবে কেন আখ্যা দেওয়া হল!আল্লাহ বলেননি এটা হারাম কিংবা এটা করো না কিংবা এ থেকে দূরে থাক।সরাসরি আমাকে শয়তানের অনুগত হিসেবে বিবেচিত করলেন!আল্লাহ এমনটা কেন বললেন! এর পিছনে অনেক কারণ আছে।চলুন ধীরে ধীরে আয়াতগুলো বুঝার চেষ্টা করি।

প্রথমেই আল্লাহ বলছেন “রব্বুকুম আ’লামু বিমা ফী নুফূসিকুম ইন তা কুনু সলিহীন”। “তোমাদের রব জানেন তোমাদের অন্তরের গভীরে কী আছে যদি তোমরা প্রকৃত নেককার হয়ে থাক” ।”ফা ইন্নাহু কানা লিল আওওয়া বি না গফূরান”“যারা আল্লাহর কাছে বারবার ফিরে আসে আল্লাহ তাদের ব্যাপারে অত্যন্ত ক্ষমাশীল।“ অন্য কথায় আল্লাহ বলতে চাইছেন, “দেখ আমি জানি তুমি ভুল করবে এবং আবার আমার কাছেই ফিরে আসবে; আবার ভুল করবে, আবার ফিরে আসবে”আর আল্লাহ এটাই চান…আপনি সব কাজে নিখুঁত হবেন আল্লাহ সে আশা করেননি এবং আপনার মনের অবস্থা তিনি জানেন…এটা হল প্রথম কথা। ঠিক এর পরেই দ্বিতীয়ত আল্লাহ সূরা ইসরা তে যা বলেছেন, “ওয়া আতি যাল ক্বুরবা হাকক্বহু ওয়াল মিসকীন, ওয়াব নাস সাবিল, ওয়ালা তুবাযযির তাবযীরা”। “দান কর তাদের যারা তোমার ঘনিষ্ঠজন হতে পারে আপনার আত্মীয় কিংবা আপনার পরিবারের সদস্য তাদেরকে তাদের অধিকার দিয়ে দাও। আতি যাল ক্বুরবা হাকক্বহু এটা একবচনে বলা হয়েছে…বলা হয়নি “যাল ক্বুরবা হুকুকাহুম” বরং আল্লাহ বলছেন “যাল ক্বুরবা হাকক্বহু”।

যার মানে হল আপনাকে প্রত্যেক আত্মীয় স্বজনের কথা চিন্তা করতে হবে এবং তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।আপনাকে আলাদাভাবে প্রত্যেকের কথা ভাবতে হবে…এই আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী ।”ওয়াল মিসকিন”…তার কথাও ভাবতে হবে যে অসহায় অবস্থায় রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে যে অচল তার পরিস্থিতির কারণে। হয়ত তারা অসুস্থ তাই কাজ করতে পারছেনা।এরাই হল মিসকিন ।”ওয়াব নাস সাবিল” এবং তাদের কথা যারা পথে রয়েছে…হতে পারে তারা গৃহহীন কিংবা তারা ভ্রমণে রয়েছে কিংবা স্থানান্তর ঘটেছে-এধরনের মানুষদের বলা হয়েছে ওয়াব নাস সাবিল।

এই মানুষগুলোকে তাদের অধিকার দিয়ে দাও।অন্য কথায় তাদের সাহায্য করে আপনি তাদের অনুদান করছেন না…তাদের অনুগ্রহ করছেন না বরং তাদেরকে তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই একই আয়াতে আল্লাহ বলছেন “ওয়ালা তুবাযযির তাবযীরা” ফালতু জিনিসে খরচ করো না, মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় কর না।এর মানে কি জানেন? এই কথাটি একই আয়াতে রেখে আল্লাহ প্রথমত বুঝাতে চাচ্ছেন যেই টাকা আপনি অযথা কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে খরচ করেছেন, আসলে কিছু মানুষের সেই টাকার উপর অধিকার ছিল।

আপনি প্রথমত যেই অন্যায় করলেন তা হল সাহায্যপ্রার্থী মানুষের অধিকার খর্ব করলেন, তার উপর আপনি সেই টাকা অযথা নষ্ট করলেন।যখন মানুষের টাকার প্রয়োজন হয় আর টাকার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠে তখন আপনি তাদের সাহায্য করতে পারতেন কিন্তু করেননি। আমাদের মাঝে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন…কিন্তু এই লক্ষ মানুষেরা টাকা নষ্ট করে চলেছেন সাহায্য করার বদলে।এই যে কালচারটা গড়ে উঠেছে এতে করে একদিকে যারা প্রচণ্ড অর্থকষ্টে আছেন তারা বেপরোয়া হয়ে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করবেন তাদের চাহিদা পূরণের জন্যে। এভাবে আপনি সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারেন কারণ আপনি খেয়াল করে দেখবেন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের নিম্ম আয়গোষ্ঠীর মাঝে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি, তাই না? যখন তাদের চাহিদাগুলো পূরণ হবে না আরও বেশি মানুষ অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়বে।আরও বেশি তরুণেরা মরিয়া হয়ে উঠবে।তারা এমন কাজ করে বসবে পরে যা নিয়ে আফসোস করতে হবে তরুণীদের বেলায়ও তাই হতে পারে।আর শয়তান তো এটাই চায়!

একভাবে চিন্তা করলে আপনি না বুঝেই শয়তানকে সাহায্য করলেন এরকম একটা অসৎ সমাজ তৈরি করতে…তাদের চাহিদাগুলোকে মূল্যায়ন না করে। আর একটি ব্যাপার…যেটা আমি আগেই বলে নিতে চাই সেটা হল ভারসাম্য আল্লাহ বলছেন,”ওয়ালা তুবাযযির তাবযীরান”…বাড়াবাড়ি রকমের ফালতু খরচ কর না। আল্লাহ আমাদের চরমপন্থী হতেও নিষেধ করেছেন।অন্য কথায় আল্লাহ বলছেন না যে “দেখ, তুমি কক্ষনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারবে না, কক্ষনো না!” উদাহরণস্বরূপ, আপনি দোকানে গিয়ে কিছু ফুল দেখে ভাবলেন “ওয়াও! আমি কিছু ফুল কিনতে চাই” যদিও আপনার ফুলের কোন দরকার নেই ফুল ছাড়াও আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন! কিন্তু ফুল কিনতে অসুবিধা নেই।

আল্লাহ বলছেন,”লা তুবাযযির তাবযীরান” অর্থাৎ আপনি হয়ত এমন কিছুতে টাকা খরচ করে ফেলবেন যা আপনার দরকার নেই এতে সমস্যা নেই। কিন্তু এটা যেন আপনার অভ্যাসে পরিণত না হয়।এটা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়।এটা এতটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেন চলে না যায় যে আপনি শত-সহস্র টাকা খরচ করে ফেলছেন।অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একেবারে ফালতু কাজে। সেসব মানুষের একজন হবেন না কারণ এটাই শয়তানের কাজ।এরপরের আয়াতে বলা হয়েছে “ইন্নাল মুবাযযিরীনা কানু- ইখয়ানাশ শায়াতীন”…নিশ্চয়ই যারা বেহুদা খরচ ‘করে’ ( তারা শয়তানের ভাই) এখানে অসাধারণ ভাষাশৈলীর দিকে লক্ষ্য করুন আল্লাহ বলছেন না “ইন্নাল্লাযিনা বাযযারুঃ যারা অযথা খরচ ‘করেছে’.. (তারা শয়তানের ভাই)”, আল-মুবাযযিরীন হল বিশেষ্য, ইস্‌ম ফা’য়িল…আর আরবিতে বিশেষ্য হল স্থায়ী অবস্থা।অর্থাৎ অযথা খরচ করা যাদের অভ্যাস, এটা যাদের স্থায়ী অবস্থা, যারা সব সময়ই অপব্যয় করে তাদেরকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।এ বিষয়টা বেশ চমকপ্রদ।কারন মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে আপনাকে ভোগবাদী সমাজের ব্যাপারে জানতে হবে এবং বিভিন্ন রকমের ভোক্তাদের প্রোফাইল তৈরি করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষ আছে যাদের খরচ করার জন্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আছে। কিন্তু আলিশান গাড়ি, বড় স্ক্রিনের টিভি ইত্যাদি জিনিসে খরচ করতে করতে ব্যাপারটা তাদের জন্যে একঘেয়ে হয়ে যায়।তখন তারা ভাবতে থাকে নতুন আর কোন জিনিসে ব্যয় করা যায়! খরচ করার ব্যাপারে তারা সৃজনশীল হয়ে উঠে!আপনি তখন তাদের দেখবেন তারা ব্যয় করছে জুয়া খেলাতে, দামি মদ কিনতে।কেউ কেউ হয়ত নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের ক্লাব খুলে বসে এধরনের কাজ কারবার!তো তারা এভাবে একটা অভিজাত বিনোদন শিল্প সৃষ্টি করে যেটা মূলত অত্যন্ত ধনী মানুষদের চাহিদা পূরণ করে।কারণ তাদের কাছে ব্যয় করার মত টাকা থাকে..এজন্য তারা খরচ করতে পারে অ্যালকোহলে, জুয়া খেলাতে, পতিতাবৃত্তি আরও যত ধরনের অসভ্য কাজ রয়েছে তাতে এই শিল্প কখনোই টিকতে পারত না যদি ধনী সমাজের মানুষরা এখানে ব্যয় করা বন্ধ করত। কিন্তু এই মাধ্যম গুলো বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মিতভাবে এখানে টাকা খরচ করতে হবে তাদেরকে মুবাযযিরীন হতে হবে ব্যাপারটা এমন না তারা জীবনে একবারই এই কাজ করেছে। কারণ যারা ধনী তারা অবশ্যই সংখ্যায় সমাজের নগন্য একটা অংশ তারা যদি কেবল একবারই এসব কাজে খরচ করে, ব্যবসার দিক থেকে ভাবতে গেলে যে মানুষগুলো এধরনের সেবা দিয়ে থাকে সে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না যদি তার কাস্টমার কেবল একবার কি দুইবার দেখা দেয়।তার প্রয়োজন একজন নিয়মিত কাস্টমার।তো তারা আসলেই মুবাযযিরীন- এ পরিণত হয় আর নিয়মিতভাবেই অযথা টাকা নষ্ট করে।আর এভাবেই তারা সৃষ্টি করে সমৃদ্ধ করে জুয়ার কারখানা, মদের কারখানা, পতিতাবৃত্তি আপনি যা যা ভাবতে পারেন! তারা সেরকম একটা পরিবেশ গড়ে তুলে শুধুমাত্র বেহুদা খরচের মধ্য দিয়ে। আমরা এখানে লাখপতি আর কোটিপতি দের নিয়ে কথা বলছি কিন্তু একটু নিচের লেভেলেও এটা লক্ষ্য করা যায়।কিছু তরুণ-তরুণীরা আছে যারা দেখছে এবং ডাউনলোড করছে কিছু নোংরা ভিডিও অথবা মুভি… তারা হয়ত বলতে পারে আরে! আমি তো শুধু নিজের ক্ষতি করছি আমি তো আর কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না!

তবে সত্যিকার অর্থে আপনি এই ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের সমর্থন জানাচ্ছেন। তারা এত টাকা করতে পারত না যদি আপনি সেসব ডাউনলোড না করতেন আমাদের এই সময়ের ট্র্যাজেডি হল এই আবর্জনার একটা বিশাল অংশ ডাউনলোড হয় মুসলিম দেশগুলো থেকে এটাই বাস্তবতা। তো আল্লাহ বলছেন “ইন্নাল মুবাযযিরীনা কানু- ইখওয়ানাশ শায়াতীন” বোধ হয় এজন্য যে আমাদের সময়ের এবং সর্বকালের সবচেয়ে ক্ষতিকারক উদ্যোগগুলো সেসব মানুষের সমর্থনে চলছে যাদের যথেষ্ট আয় আছে এবং তারা সেটা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে খরচ করে।এই বিষয়টার প্রতিই এখানে নির্দেশ করা হয়েছে।এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। আমরা দায়িত্বশীল ভোগবাদ নিয়ে কথা বলি। আমাদের সেসব জায়গায় খরচ করতে হবে যেগুলো দুর্নীতিমুক্ত যেখানে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হয় না কিংবা শিশুশ্রম কাজে লাগানো হয় না।আমরা ‘অর্গানিক ফুড’ এর প্রতি ঝুঁকে পড়ি।

ঠিক একই ভাবে আমাদের শুধু এটা জানলেই চলবে না কোথায় পণ্যটি তৈরি হয়েছে আমাদের এটাও জানতে হবে পণ্যটি কিসের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। যেই জিনিসটা আপনি কিনছেন আপনার নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে কেন আপনি এই পণ্যটি কিনছেন? কেন আপনি এই পণ্যের একজন ভোক্তা? আপনি কি এর থেকে ভাল কিছুতে ব্যয় করতে পারেন না? তো এখানে একটা চমৎকার ভারসাম্য কাজ করে…এটা বলেই আমি আমার কথা শেষ করতে চাই যে, দেখুন আপনি মাঝে মাঝে এমন জিনিসে খরচ করবেন যা ঠিক আপনার প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না…আর এতে কোন সমস্যা নেই।অপরদিকে আপনি যদি মুবাযযিরীন হন…আপনি শয়তানের ভাই এ পরিণত হবেন।কারণ ব্যাপারটি যদি এভাবে ভাবেন আপনি শয়তানকে শয়তানির ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন আর শয়তান আপনাকে বিনোদন দিচ্ছে… এভাবে একজন আরেকজনের ভাই…একজন আরেকজনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন।অর্থাৎ আপনারা দুজন দুজনকে সমর্থন করছেন।আর এটাই তো শয়তান চাইছে! আমি দুআ করি আল্লাহ আযযা ওয়াজাল যেন আমাদের শয়তানের ভাই হওয়া থেকে রক্ষা করেন এবং আমরা যেন মুবাযযিরীন কিংবা ইসরাফকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হই।