আল্লাহর কাছে কী চাইবো? (২য় পর্ব)

এটা শুনার পর আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, ক্ষমা চাওয়ার জন্য কোন দোয়া পড়তে হবে বা ক্ষমা চাওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ দোআ কোনটি? মানুষ বিভিন্ন অকেশনে বিভিন্ন রকম দোআ পড়ে। যেমন – কোন সন্তানসম্ভাব্য মা এসে জিজ্ঞেস করে, কিছুদিনের মধ্যে আমার বাচ্চা হবে, এখন আমার বাচ্চার জন্য কোন দোয়াটি আমি পড়তে পারি? অথবা কেউ একজন এসে বলতে পারে – আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি, কোন দোয়াটি আমি এখন পড়তে পারি? ঠিক কিনা? আমাকে বিশেষ বিশেষ সময় উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ দোআ প্রদান করুন।

আমি আপনাদের বলছি – বিশেষ সময়ের ঐ দোয়াগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো পবিত্র এবং আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ। কিন্তু সকল সমস্যার ক্ষেত্রে কমন দোআ হলো – “আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করা।” আপনার সকল সমস্যা দূর করার দোআ, যে একটি দোআ আপনার সকল সমস্যা দূর করবে তা হলো – সত্যিকারার্থে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর জাতিকে আল্লাহর দিকে ডেকেছিলেন নয় শত বছরেরও বেশি সময় ধরে। তিনি তাদের নিকট অবিরাম দাওয়াত দিয়ে গেছেন।

তাঁর নবুয়তি জিন্দেগির শেষ দিকে এসে তিনি পেছনে ফিরে দেখেন এবং তিনি তাদের নিকট যে বার্তাটি দিতে চেয়েছিলেন তার একটি সারাংশ দাঁড় করিয়েছেন। অবশ্যই তিনি তাদের নিকট শুধু একটি বার্তা দেন নি, তিনি তাদের উদ্দেশ্যে শুধু একবার বা দুইবার কথা বলেন নি,…قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا – “তিনি বললেন: হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি দাওয়াত দিয়েছি;” তিনি রাতেও কোন বিরতি নেন নি, প্রতিনিয়ত, সারাক্ষণ তাদের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। কুরআনের একটি সূরা তার নামে নামকরণ করা হয়েছে, সূরাতুন নূহ। সেখানে তিনি এই গোটা সময় ধরে যে তার সম্প্রদায়কে দাওয়াত দিয়ে গেছেন তার একটি সারমর্ম তুলে ধরেছেন। আমি তোমাদের কাছ থেকে কী আশা করেছিলাম। وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ – আর এই গোটা সময় ধরে আমি তাদেরকে এই ধর্মের দিকে আহবান করেছি ‘যেন আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন ইয়া রব’। আমি ঠিক এই কথাগুলো তাদের বার বার বলেছি, বার বার বলেছি। فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ – অতঃপর বলেছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا – “তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।” إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا এ অংশটুকু আমি পরে ব্যাখ্যা করবো। নিশ্চয় আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যিনি বার বার ক্ষমা করতে থাকেন, বার বার ক্ষমা করতে থাকেন।

এরপর তিনি যা বলেছেন তা খুবই অসাধারণ। আমি চাই আপনারা এই বিষয়টা উপলব্ধি করুন যে তিনি কোন ধরণের মানুষগুলোর উদ্দেশ্য কথা বলছিলেন। তিনি ইতিহাসের অন্যতম খারাপ একটি সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন। নূহ (আ) এর সম্প্রদায়কে পৃথিবীর অন্যতম চরম অবাধ্য জাতিগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

সূরাতুজ যারিয়াতে আল্লাহ বিভিন্ন জাতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে অর্থাৎ তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, ফলে তাদের ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। এর পর সূরা আন নাজমে যখন নূহ (আ) এর জাতির কথা আসলো তিনি বললেন – وَقَوْمَ نُوحٍ مِّن قَبْلُ ۖ إِنَّهُمْ كَانُوا هُمْ أَظْلَمَ وَأَطْغَىٰ – “আর পূর্বে নূহের কওমকেও। নিশ্চয় তারা ছিল অতিশয় যালিম ও চরম অবাধ্য।” 

বিষয়টা যৌক্তিক মনে হয়। অন্য সকল নবীর মত শুধু এক প্রজন্মের জন্য তাদের নবী ছিল না, প্রতি শতাব্দীতে তিন চার প্রজন্ম মানুষের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের একজন নবী ছিল। প্রতি বিশ বছর পর পর নতুন নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে, আর নূহ (আ) এটা দেখেছিলেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তিনি ৪০-৫০ প্রজন্মের মানুষদের দেখেছিলেন আর তারা সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর তিনি সকল প্রজন্মকে একই দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন।

একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমি এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করছি। তিনি চরম অবাধ্য এক জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন। তাদের নিকট তিনি কী প্রস্তাব তুলে ধরেন? তিনি বলেন – اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ- তোমাদের রবের ক্ষমা প্রার্থনা করো।إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا—-তিনি বার বার ক্ষমা করতে থাকেন।

তোমরা বার বার আল্লাহর অবাধ্যতা করছিলে, আল্লাহ বার বার ক্ষমা করতে থাকেন। কিন্ত তাঁর প্রস্তাব এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি বলেন – يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا – এখানে يُرْسِلِ হলো জওয়াবে আমর। এর মানে হলো – যদি তোমরা তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য আসমানের দরজা খুলে দিবেন আর এটা তোমাদের উপর অজস্র ধারায় করুণা বর্ষণ করবে। এর দ্বারা বৃষ্টিও বোঝানো হতে পারে।

পরিহাসের বিষয় হলো, এখানে বৃষ্টি দ্বারা বন্যার ইঙ্গিত করা হয়নি, যদিও পরিশেষে তারা বন্যা কবলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই আয়াতে আল্লাহ ভিন্ন ধরণের বৃষ্টির কথা বলছেন। যদি তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো…. যে বৃষ্টি তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলো, সে বৃষ্টিই হতে পারতো তাদের জন্য জীবন আহরণকারী। তারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেনি। আর আল্লাহ তাদের বলেছেন, ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তোমরা যদি ক্ষমা প্রার্থনা করো, আকাশের দরজা তোমাদের জন্য খুলে যাবে আর তা বৃষ্টি বর্ষণ করতে থাকবে।

আল্লাহ বলেননি যে, পানি বর্ষিত হবে। তিনি বলেছেন, আকাশ বর্ষণ করবে। কারণ আকাশ শুধু বৃষ্টি নয় আরো রহমত বর্ষণ করতে পারে। আকাশ থেকে ক্ষমা আসে, আকাশ থেকে প্রশান্তি আসে, বিশ্বাস আসে, রিয্ক আসে, সমস্যার সমাধান আসে আসমান থেকে।

তিনি তোমাদের জন্য আকাশ খুলে দিবেন আর আকাশের সকল সম্পদ তোমাদের উপর অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে থাকবে। আর তোমরা এতদিন এই রহমতের ভাগিদার হতে পারছিল না, কারণ তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো নি। তাই এখন ক্ষমা চাইলে এটা খুলে যাবে। আপনি সাধারণত একটা একটা করে আপনার সমস্যাগুলোর কথা আল্লাহকে বলেন। আপনার এমন সমস্যাও থাকতে পারে যার বর্তমান থাকার কথা আপনি নিজেও জানেন না। কিন্তু আল্লাহ জানেন। আমি আর আপনি যদি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে পারি, তাহলে ঐ অজানা সমস্যাগুলোও স্বর্গীয় হস্তক্ষেপে সমাধান হয়ে যাবে। يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا – “তিনি আকাশকে তোমাদের উপর অঝোর ধারায় বর্ষণ করাবেন।” 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এখানেই থেমে যান নি। আপনি কার জন্য ক্ষমা চাচ্ছেন? আপনার নিজের জন্য। اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ – তোমাদের নিজেদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। আল্লাহ বলেন – وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ – “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন।” তিনি ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি দিয়ে তোমাদের ঐতিহ্য কে সমৃদ্ধ করে দিবেন। এমন সম্পদ নয় যা আপনাকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। কারণ এই টাকা দেয়ার কথা এসেছে আপনার ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষাপটে। তিনি আপনাকে ভালো অর্থ দিবেন, যা আপনার জন্য দুনিয়াতে এবং পরকালে কল্যাণ নিয়ে আসবে।

তিনি আপনাদের ভালো সন্তান দান করবেন, যারা আপনাদের জীবিত থাকাবস্থায় ভালো কাজ করবে। তারা আপনাদের সম্মান করবে, ভালোবাসা দেখাবে, আনুগত্য করবে, আপনি তাদের দেখে গর্বিত হবেন, তারা জীবিত থাকাবস্থায় আপনাকে সুখী করবে।

এমনকি আপনি এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেও তারা ভালো কাজ করতে থাকবে, যা সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আপনার আমলনামায় এসে যোগ হবে। আল্লাহ আপনাকে এই সব কিছু দান করবেন। প্রসঙ্গত, এই দুই শব্দ “অর্থ এবং সন্তান-সন্ততি” এই সূরার শেষের দিকের একটি আয়াতেও এসেছে। إِنَّهُمْ عَصَوْنِي وَاتَّبَعُوا مَن لَّمْ يَزِدْهُ مَالُهُ وَوَلَدُهُ إِلَّا خَسَارًا – “আমার সম্প্রদায় আমাকে অমান্য করেছে আর অনুসরণ করছে এমন লোককে, যার অর্থ ও সন্তান-সন্ততি কেবল তার ক্ষতিই বৃদ্ধি করছে।” 

ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি ক্ষতির উপকরণ। কিন্তু আপনার ক্ষমা চাওয়ার পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি আসে তা আপনার জন্য শুধু কল্যাণ নিয়ে আসে। একই ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি! পার্থক্য হলো এখন তাদের উপর আল্লাহর ক্ষমা এবং রহমতও রয়েছে। বিষয়টা এমন যেন তারা দূষিত হয়ে গিয়েছে, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর ক্ষমার মাধ্যমে তাদের পরিশুদ্ধ করেন।