এই উম্মতের জন্য রাসূল (স) এর ছিল অগাধ ভালবাসা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন ঃ لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল।” عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ “তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ।” حَرِيصٌ عَلَيْكُم তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী। হারিস শব্দটি সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ভালবাসা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। তিনি তোমাদের ভালোর জন্য বেশ আগ্রহী। بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। আল্লাহ রাসূল (স) এর জন্য এমন দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন যার শুরুতে আলিফ লাম যুক্ত করে আল্লাহর দুটি নাম প্রকাশ করা হয়। আর রাউফ , আর রাহিম। আলিফ লাম কেটে দিয়ে মানুষের জন্য শব্দ দুটি ব্যবহার করা যাবে। সুতরাং আর রাউফ এবং আর রাহিম রাসুল (স) কে রাউফ এবং রাহিম বলে বর্ণনা করেছেন। কাদের প্রতি তিনি রাউফ এবং রাহিম ? মুমিনদের প্রতি। বিশ্বাসীদের প্রতি তিনি রাউফ। রাউফ শব্দের অর্থ হলো চরম স্নেহশীল, রাহিম হলো সাধারণ দয়া। রাউফ হলো বিশেষ ধরণের দয়া। মাতা পিতার সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা তাকে রা’ফা বলে। সুতরাং আল্লাহ যিনি আর রাউফ তিনি রাসুল (স) কে মুমিনদের জন্য রাউফ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
রাসূল (স) একবার কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন আর তিনি কিছু বিশেষ আয়তের সংস্পর্শে এলেন … তার একটা হলো বিখ্যাত এই আয়াতটি, যখন ইব্রাহীম (আঃ) বলেন – رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ ۖ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (সূরা ইব্রাহীম ৩৬)। ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য দোয়া করছেন – “ও আল্লাহ! যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার। এবং কেউ আমার অবাধ্যতা করলে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” ও আল্লাহ! এমনকি তাঁকেও ক্ষমা করে দিন। এটাই ইব্রাহীম (আঃ) বলছিলেন- যে আমার অনুসরণ করে সে আমার সাথে আছে, তাকে রক্ষা করুন। কিন্তু যারা আমার অবাধ্য হয় তাদেরকেও ক্ষমা করে দিন।
তারপর তিনি ঈসা (আঃ) এর দোয়া সংক্রান্ত একটি আয়াত পড়লেন। এই আয়াতটি সূরা মায়েদার- إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ — যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ। অন্য কথায়, আমি চাই আপনি তাদের ক্ষমা করে দেন।
তো, তিনি দুইটি আয়াত তিলাওয়াত করেন। উভয় আয়াতে নবীরা তাদের স্ব স্ব উম্মার জন্য দোয়া করছেন। তারপর তিনি তাঁর নিজের উম্মার জন্য চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাত উত্তোলন করে বলতে শুরু করলেন – ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মাহর কথা চিন্তা করে কাঁদতে শুরু করেন। আর আমরা তাঁর সেই উম্মাহর সদস্য। স্ব স্ব উম্মাহর জন্য ইব্রাহীম এবং ঈসা আলাইহিস সালামের দোয়া পড়ার পর রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর নিজ উম্মাহ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোআ করলে লাগলেন – “ও আল্লাহ! আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ।”
তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জিব্রিল আলাইহিস সালামকে বললেন – “মুহাম্মদ (স) এর নিকট যাও, এবং তাকে জিজ্ঞেস করো কেন সে কাঁদছে। ” এই হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, খুবই সুন্দর হাদিস। অতঃপর, জিব্রিল (আ) আসলেন এবং রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি কাঁদছেন? [ আর অবশ্যই আল্লাহ জানেন কেন তিনি কাঁদছেন। আল্লাহ যখন জিব্রিল (আ) কে পাঠান তখন তিনি জানতেন কেন রাসূল (স) কাঁদছেন।] রাসূল (স) বললেন – “আমি আমার উম্মাহর কথা চিন্তা করে কাঁদছি।” তাদের ভাগ্য কী হবে তা চিন্তা করে আমি কাঁদছি।
অতঃপর, জিব্রিল (আঃ) আল্লাহর নিকট ফেরত গেলেন। আল্লাহ বললেন – “হে জিব্রিল! মুহাম্মাদের নিকট ফেরত যাও, এবং তাকে বলো – আমি আপনার উম্মাহর জন্য আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিবো।” কারণ আমরা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চাই, আর তাই তাঁর উম্মাহকে পবিত্র করবো। আর আমরা আপনাকে কোনো কষ্ট দিবো না। অন্য কথায়, আপনার জন্য ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার উম্মাহর বিষয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিবো। আর আমরা আপনাকে কোনো কষ্ট দিবো না।
আমাদের জন্য রাসূল (স) এর কেমন তীব্র ভালোবাসা ছিল তার একটি ইঙ্গিত হলো — আমি চাই আপনারা এটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন, শুধু আজ নয়, আপনাদের অবশিষ্ট জীবন ধরে সব সময় ভাবুন যে, এই ইস্যুতে রাসূল (স) কেমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আর তা হলো- আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা প্রত্যেক নবীকে একটি বিশেষ ইচ্ছা করার সুযোগ দান করেছিলেন। প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ এই সুযোগ দান করেছিলেন।প্রত্যেক নবীকে বলা হয় যে, তাদের একটি বিশেষ দোয়া কবুল করা হবে। কোনো কোনো নবী তাদের এই বিশেষ দোয়াটি তাদের বিদ্রোহী উম্মাহর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ তারা তাদের উম্মাহর প্রতি হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।
যেমন, নূহ (আ) দীর্ঘ ৯৫০ বছর ধরে তার উম্মাহকে দাওয়াত দেয়ার পর অবশেষে আল্লাহর নিকট দোআ করলেন – وَقَالَ نُوحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا – “নূহ আরও বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আপনি পৃথিবীতে কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না।” আর তাই আল্লাহ সেই সময়ের গোটা মানব জাতিকে ধবংস করে দেন। আর সেটা ছিল একটি শহর। গোটা শহর ধ্বংস করে দেয়া হয়। শুধু যারা তাঁর নৌকায় আরোহন করেছিল তাদের ছাড়া বাকি সবাইকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
ইব্রাহীম (আ) আমাদের রাসূল (স) এর জন্য দোআ করেন। তিনি বলেন – رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا – “ও আল্লাহ! তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন।” আর রাসূল (স) বলেছেন – ” আমি আমার পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়ার ফসল।” তো, ইব্রাহিম (আ) তার জন্য বরাদ্ধকৃত বিশেষ দোয়াটি আমাদের রাসূল (স) এর জন্য ব্যবহার করেন। আর মূসা (আ) তার বিশেষ দোয়াটি ফেরাউনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। কারণ ফেরাউন ছিল একজন গণহত্যাকারী মানবতার দুশমন।
আপনারা সবাই জানেন সে কত শত সহস্র বাচ্চাদের হত্যা করে, সে ছিল তার সময়ের হিটলার। তাই মূসা (আ) আল্লাহর নিকট দোআ করেন – “আল্লাহ ফেরাউনকে হেদায়েত দিবেন না। যাই ঘটুক না কেন ফেরাউনকে হেদায়েত দিবেন না।” অবশেষে এটাই ঘটে। তাকে হেদায়েত দেয়া হয়নি। শেষ মুহূর্তে সে ইসলাম গ্রহণ করার চেষ্টা করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। আরো কত উদাহরণ রয়েছে।
সুলাইমান (আ) আল্লাহর নিকট দোয়া করেন – قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَّا يَنبَغِي لِأَحَدٍ مِّن بَعْدِي – “সোলায়মান বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না।” এখানে مُلْكًا মানে শুধু রাজত্ব নয়, مُلْكًا অর্থ নিয়ন্ত্রণ। আমাকে এমন নিয়ন্ত্রণ, সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পর আর কাউকে দান করবেন না। আমাকে এমন শক্তি দান করুন, যা আমার পর আর কেউ পাবে না। فَسَخَّرْنَا لَهُ الرِّيحَ تَجْرِي بِأَمْرِهِ رُخَاءً حَيْثُ أَصَابَ – “তখন আমি বাতাসকে তার অনুগত করে দিলাম, যা তার হুকুমে অবাধে প্রবাহিত হত যেখানে সে পৌছাতে চাইত।”
উড়ন্ত কার্পেটের ধারণাটা সুলাইমান (আ) থেকে আসে। সুলাইমান (আ) কার্পেটের উপর বসতেন আর সে কার্পেট তাকে এক রাতের মধ্যে একমাসের দূরত্বে নিয়ে যেত আবার ফেরত নিয়ে আসতো। এখন থেকেই এই কার্পেটের ধারণাটা আসে। জিনদেরকে বোতলে ঢুকিয়ে রাখার ব্যাপারটাও সুলাইমান (আ) থেকে আসে। وَالشَّيَاطِينَ كُلَّ بَنَّاءٍ وَغَوَّاصٍ – “আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম অর্থৎ, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী।” আল্লাহ সুলাইমান (আ) কে পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য দান করেন। আবার তিনি সকল প্রাণীদের সাথেও কথা বলতে পারতেন। এখন বুঝতে পারছেন তো এই দোয়াটি একজনকে কেমন অচিন্তনীয় নিয়ামত দান করতে পারে।
আমাদের রাসূল (স) এর ও এরকম বিশেষ দোয়া করার সুযোগ ছিল। অন্যান্য নবীদের মতো তাঁরও একটি বিশেষ দোয়া করার অধিকার ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর এই বিশেষ দোয়াটি কোন কাজে ব্যবহার করেন? রাসূল (স) বলেন – “প্রত্যেক নবী এবং রাসূল কে আল্লাহ একটি বিশেষ দোআ দান করেন, যে দোয়াটি আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই কবুল করবেন। প্রত্যেক নবীই তাঁর এই দোয়াটি এই দুনিয়াতে ব্যবহার করেছেন, একমাত্র আমি ছাড়া। আমি এখনো এটা ব্যবহার করিনি। আর আমি এই দুনিয়ায় এটি ব্যবহার করবো না। আমি আমার উম্মতের জন্য এটা রেখে দিয়েছি। আমি কিয়ামতের দিন তাদের জন্য এটা ব্যবহার করবো। আর দোয়াটি হবে – ‘হে আল্লাহ! আমার গোটা উম্মাহকে ক্ষমা করে দিন।’
বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের জন্য। ও আল্লাহ যারাই আমাকে বিশ্বাস করবে তাদের ক্ষমা করে দিন। আর আল্লাহ দোয়াটি কবুল করবেন। আমরা সবাই জানি, সকল মুসলিম অবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই ধারণাটি কোথা থেকে আসে। এটা আসে আমাদের রাসূল (স) এর দোয়া থেকে। প্রত্যেক মুসলিম যারাই রাসূল (স) কে বিশ্বাস করবে, এবং যারা তাঁর শিক্ষার উপর আমল করবে, যদি তারা সামান্য আমল ও করে, যত বড় পাপীই হউক না কেন, অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ সে তার পাপের কারণে হয়তো জাহান্নামে অনেক দিন অবস্থান করবে, কিন্তু অবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
আর এই ধারণাটি কোথা থেকে আসে? কারণ রাসূল (স) তাঁর এই বিশেষ একটি দোআ কিয়ামতের দিনের জন্য রেখে দিয়েছেন। তিনি নিজের জন্য এটা ব্যবহার না করে আমাদের জন্য সেক্রিফাইস করেছেন। এর চেয়ে বড় কোনো সেক্রিফাইস হতে পারে না। আমাদের জন্য রাসূল (স) এর এমনই গভীর ভালোবাসা ছিল।
— শায়েখ ডঃ ইয়াসির কাদি