আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, একদা হারিসা নামক এক যুবক আনসার সাহাবি রাসূল (স) এর নিকট আগমন করেন। রাসূল (স) তাকে দেখে বললেন, আজ সকালটা তোমার কেমন যাচ্ছে, হে হারেসা? হারেসা (রা) জবাবে বললেন, আজ সকালে আমি একজন দৃঢ় প্রত্যয়ী মুসলিম, হে আল্লাহর রাসূল (স)। রাসূল (স) বললেন, সবকিছুর একটা প্রমান রয়েছে; তোমার বক্তব্যের প্রমান কী? হারেসা (রা) বললেন – দুনিয়া আমার মনকে আর আচ্ছন্ন করে রাখে না। আমি রাতে নামাজ আদায় করি, আর দিন কাটাই রোজা রেখে। আমার মনে হচ্ছে যেন আমি আমার মহান রবের সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় যেন আমি দেখতে পাচ্ছি যে, জান্নাতবাসীরা মহা আনন্দ উৎসবে মেতে আছেন; আর জাহান্নামবাসীরা আগুনে পোড়ার আজাব উপভোগ করছে।
অতঃপর রাসূল (স) তাকে বললেন – “তুমি ঈমানের বাস্তব অবস্থা চিনতে পেরেছো। এখন এর উপর সব সময় অটুট থেকো।”
আর এ বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঈমান এমন নয় যে আপনি একটা লেভেল অর্জন করে ফেলেছেন। যেমন, আপনি যদি পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন কেউ আপনার কাছ থেকে এটা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এটা আপনার অর্জন। ঈমানের ব্যাপারটা এমন নয়। ঈমানের জন্য নিয়মিত পরিশ্রম করতে হয়।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (স) বললেন – “কেউ যদি এমন কাউকে দেখতে চায় যার অন্তর থেকে ঈমানের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে সে যেন হারেসার দিকে তাকায়।”
আমার অত্যন্ত প্রিয় আরেকটি বর্ণনা দিয়ে আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানবো। এটাও দৃঢ় প্রত্যয়ী ঈমানের উদাহরণ নিয়ে। দৃঢ় ঈমান বলতে আসলে কী বুঝায়? অধ্যাত্বিকতা বলতে আসলে কী বুঝায়।
তাবারানী শরীফের একটি অসাধারণ বর্ণনা… “রাসূল (স) একদিন এক বেদুঈনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যখন সে আল্লাহর নিকট দোয়া করছিল…” এখন বেদুইন বলতে আসলে কারা? সহজভাবে বললে আমাদের সময়কার গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল মানুষদের মত। যারা খুবই সিম্পল জীবন যাপন করতেন।
তো, রাসূল (স) থামলেন এবং সে কী বলছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। তিনি শুনতে পেলেন লোকটি বলছে–
“হে একক সত্তা! এই পৃথিবীর চোখ দিয়ে যাকে দেখা সম্ভব নয়, যার মহানুভবতা মানুষের ক্ষুদ্র মস্তিস্কের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, তিনি যেমন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য মানুষের পক্ষে সেরূপ প্রশংসা করা সম্ভব নয়, কোন ঘটনা তাঁকে পরিবর্তন করতে পারে না, তিনি সময় শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় করেন না, তিনি পৃথিবীর সকল পাহাড় পর্বতের একেবারে সঠিক ওজন জানেন, তিনি পৃথিবীর সকল মহাসাগরের একেবারে সঠিক আয়াতন জানেন, বৃষ্টির ফোটার একেবারে সঠিক সংখ্যা তিনি অবগত আছেন, তিনি পৃথিবীর সকল গাছের সর্বমোট পাতার একেবারে সঠিক সংখ্যা জানেন, রাত তার অন্ধকারে যা কিছু লুকিয়ে রাখে এবং দিন তার আলোতে যা প্রকাশ করে তার সবই তিনি জানেন, আল্লাহর কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক আকাশ অন্য আকাশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না, আল্লাহর কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাটির একটি স্তর অন্য স্তরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না, পাহাড়ের গভীর অন্ধকারের কোন গর্তও তাঁর কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না এবং গভীর সমুদ্রের গহীন অন্ধকারও আল্লাহর কাছ থেকে কিছু গোপন রাখতে পারে না।”
এমন অসাধারণ ছিল তাঁর বিশ্বাস, তাঁর ঈমান। এভাবে আল্লাহর প্রশংসা করার পর সে দোয়া করতে লাগলো। তাঁর দোয়াও ছিল অসম্ভব সুন্দর।
“ ও আল্লাহ! আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় যেন আমার জীবনের সর্বশেষ সময় হয়, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ যেন আমার জীবনের সর্বশেষ কাজ হয়, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনে যেন আমি আপনার সাক্ষাত লাভ করি।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ডেকে আনলেন। তিনি বললেন এই লোকের নামাজ শেষ হলে আমার কাছে আসতে বলো। সে আসলে রাসূল (স) তাঁকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে কোন গোত্রের তাও জানতে চাইলেন। সে বলল- আমি বনু আমর ইবনে সা’সা’ থেকে এসেছি। তারা রাসূল (স) এর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। তারপর রাসূল (স) তাঁকে একটি উপহার দিলেন। লোকটি কেমন সরল মনের ছিল অথচ তাঁর বিশ্বাস এতো দৃঢ় ছিল তা আমাদের দেখানোর জন্য রাসূল (স) তাঁকে বললেন, জানো কেন আমি তোমাকে এই উপহার দিয়েছি? সে বলল- কারণ আমি আপনার আত্মীয়। রাসূল (স) বললেন – না, না এই কারণে না। আত্মীয়তার সম্পর্কের নিজস্ব অধিকার রয়েছে। আমি তোমাকে এই উপহার দিয়েছি কারণ তুমি কেমন অসম্ভব সুন্দর করে আল্লাহর প্রশংসা করেছো, আর কেমন অনন্যসুলভ তোমার ঈমান।”
[শায়েখ আব্দুন নাসের জাংদার Strengthening Belief in Times of Uncertainty লেকচার থেকে]