বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ — اللَّهُ الصَّمَدُ — لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ — وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
আবারো সবাইকে জানাচ্ছি, আসসালামুওয়ালাইকুম ওয়া রাহ মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। আমি আপনাদের কাছে সুরা ইখলাসের একটি পরিচিত তুলে ধরতে চাই। কিন্তু তার আগে বলতে চাই, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর এই সুরার প্রতি একটি বিশেষ ভালবাসা ছিল। কুরআনে দেখা যায়, সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হিসেবে যে নামাযকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো ফজরের নামাজ। আল্লাহ এই সালাতকে ‘কুরআনাল ফাজর’ বলেছেন। আর কোন সালাতের সাথে কুরআন শব্দটি এইভাবে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়নি, যেভাবে ফজরের নামাজের সাথে হয়েছে। এ জন্য এটাকে বলা হয় ‘কুরআনাল ফাজর।’ যার মানে ফজরের সময়কার কুরআন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ফজরের সুন্নাহ সালাতের সময় নিয়মিত সুরা কাফিরুন এবং সুরা ইখলাস পড়তেন। তার মানে এই দুটো সুরা উনি নিয়মিত ভাবে ফজরে পড়তেন। তার উপর, শুধু একটি নয় অনেক অনেক বার রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই সুরাকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ বলে উলেখ করেছেন। এটা শুধু এই কারণে গুরুত্বপূর্ন নয় যে এটি এই সুরা পড়ার গুরুত্বকে আরো জোরদার করে এইভাবে যে এটি একবার পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমতুল্য হয়, ব্যাপারটি আরো গুরুত্ববহ এই কারণে যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ব্যাপারটি বার বার জোর দিয়েছেন। এটা একটি ভাবার মত বিষয়। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অন্য কোন সুরার ক্ষেত্রে এমনটি করেননি। এমন অসংখ্য হাদিস পাওয়া যাবে না যেখানে একটি বিশেষ সুরার গুরুত্ব বলা হয়েছে, বারবার। কিন্তু এই সুরার জন্য এরকম পাওয়া যায়।
এই ব্যাপারে বেশ উল্লেখ্যযোগ্য একটি হাদীস না উল্লেখ করলেই নয়, তা হল, আপনাদেরকে পড়ে শুনাচ্ছি, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে উনি একজন সাহাবীর কথা জানতে পারলেন, যে ইমামতি করার সময় প্রত্যেক রাকাত শেষ করতেন এই সুরা পড়ে। তার মানে উনি প্রত্যেক রাকাতেই ‘কুল হু ওয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লোক পাঠালেন যে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে যে কেন সে এমনটি করে? কি কারণে সে প্রত্যকে সময় ইখলাস পাঠ করে? সে জবাব দিল এই সুরা ‘রাহমান’ কে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও আর রাহমান শব্দটি এই সুরার মাঝে নেই, কিন্তু ওই ব্যক্তির মনে হয়েছে যে আল্লাহর দয়া এই সুরাটির মাঝে একীভূত রয়েছে। এই কারণেই আমি বারবার এই সূরাটি নামাজের ইমামতিতে পড়তে ভালবাসি। যাতে লোকেদেরকে রাহমানের ভালবাসার, গুণের কথা মনে করিয়ে দিতে পারি। ‘ফাক্বালা রাসুলুল্লাহি (সাঃ) আখবিরুহু আন্নাল্লাহা ইয়ুহিব্বুহু’ ‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন – তাকে গিয়ে জানাও, আল্লাহও তাকে ভালবাসেন’। তার মানে ওই ব্যক্তির ইখলাসের প্রতি ভালবাসার কারণে সে আল্লাহর ভালবাসার পাত্র ছিল। আমাদেরও সুরা ইখালাসের প্রতি বিশেষ ভালাবসা থাকা দরকার। তাহলে এখন প্রশ্ন আসে, এই সুরার বিশেষত্বটা কি? দেখে মনে হয় যে এতে তো একদম ইসলামের মূল যে ধারনাটি সেটা শিখানো হচ্ছে।‘ আল্লাহ এক, উনি কাউকে জন্ম দেননি , উনিও কারো থেকে জন্ম নেননি, আর কোন কিছুই উনার সমতুল্য নয়’ শেষ। দেখে মনে হচ্ছে এটা তৌহিদের একদম প্রাথমিক ধারনাটি। তাহলে কি কারণে এই সুরা এত তাৎপর্যপূর্ণ? এখানে আমাদেরকে একটি জিনিস বুঝতে হবে, কুরআন আমাদের তিনটি মৌলিক জিনিস শেখায়, তা হলঃ আল্লাহ,পরকাল এবং ওহী। মূলত অন্য যেই বিশ্বাসগুলো সেগুলো কোন না কোন ভাবে এই তিনটার মাঝেই পড়ে যায়। ঈমান বিল্লাহ, ঈমান বিল আখিরাহ, ঈমান বির রিসালাহ। আল্লাহয় বিশ্বাস, আখিরাতে বিশ্বাস, আল্লাহ প্রেরিত অহিতে বিশ্বাস। আপনি যদি বলেন ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস? ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসতো। তাই এটা ওহীর প্রতি বিশ্বাসের মাঝে পড়ে যায়। যখন আমরা বলি আল্লাহতে বিশ্বাস করি, তখন আর মাঝে আল্লাহর সব নাম, উনার সব গুণ উনার সব কাজ। আবার যখন বলি আখিরাতে বিশ্বাস, তার মাঝে কবরের জীবন, বিচার দিবস, জান্নাত জাহান্নাম সব এসে যায়। তো এইভাবে যদি চিন্তা করা যায় তাহলে বুঝা যায় বিশ্বাসের এক তৃতীয়াংশ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পুরো ব্যাপারটি এই একটি সুরাতেই সর্বোত্তম উপায়ে বর্ণিত হয়েছে।
আপনি যদি শুধু বুঝেন যে এই সুরাতে কি বলা হয়েছে তাহলে দ্বীনের পথ চলা শুরু করার মূলটা আপনি ধরতে পেরেছেন। আপনি বিশ্বাসের এক তৃতীয়াংশ অনুধাবন করতে পেরেছেন, আর অন্য দুইটা কিন্তু এর পথ ধরেই আসবে। আখিরাতে বিশ্বাস তখুনি আসবে যদি আপনি আল্লাহয় বিশ্বাস করেন, আপনি তখুনি অহিতেও বিশ্বাস করবেন যদি আপনি আল্লাহর উপর বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ অন্য দুইটাও আসলে এই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ফলেই প্রস্ফুটিত হয়। আরেকটি জিনিস যেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটা হল এর অবস্থান, যখন মানুষ কোন কাজ শুরু করে, এবং তারা বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করতে থাকে লম্বা সময় ধরে, যত সময় যেতে থাকে, সেটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে মানুষ ভুলেই যায় যে সে কেন এই সংগ্রামটা শুরু করেছিল, কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের অনেক যুদ্ধ হয়েছিল, বার বার এসব সংগ্রামের পর, একসময় ইসলাম জয়ী হবে, এবং যেদিন ইসলামের বিজয় হবে তখন তারা চিন্তা করবে, যে আমরা আসলে কেন যুদ্ধ করছিলাম? এটা কি রাজ্য জয়ের জন্য? মূর্তি ভাঙ্গার জন্য? আমরা বনাম তারা যে হলাম, কেন সেটা? ব্যাপারটি আসলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে না, আমাদের লক্ষ্যটা আসলে সবসময় এটাই যে একমাত্র, অনন্য আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। আল্লাহর একত্ববাদ। কেন আমরা কাবাকে মুশরিক মুক্ত করতে চাই?যেন আল্লাহর ইখলাস প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ যেন শুধু এবং শুধু মাত্র আল্লাহর ইবাদত করে। তাই দেখা যাচ্ছে ‘ইযা জা আ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহ’(সুরা নসর), আবু লাহাবের ধংসের মধ্য দিয়ে জয়ের দরজা খোলার পর(সুরা লাহাব) আল্লাহ এই সুরা দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে তোমাদের আসল উদ্দেশ্য কি সেটা কক্ষনো ভুলে যেও না। যে কেন তোমরা বিশ্বাসী, কেন তোমরা এত যুদ্ধ করলে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের মিশন কি ছিল?
উনার মিশন ছিল, প্রতিটি মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি আন্তরিক ভালবাসার, আনুগত্য এবং ইবাদতের বীজ বপন করা। এই কারণেই কাবা মুশরিকমুক্ত হয়েছে, এবং সেই কারণেই সুরা ইখলাস এত গুরুত্বপূর্ন। আর এই কারণেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমদের কে বারবার এই সূরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কারণ এটা তাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে কেন তারা মুসলিম? দ্বীনের মূল শেকড়টা কোথায়? এটা আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্কের বীজ। যদি আমি আপনাদেরকে এই সুরার উপর একটি লেকচার দিতে পারতাম তাহলে আমি এর অসাধারণ ভাষা আপনাদের কাছে ব্যাখা করতে পারতাম। ব্যাকরণগত দিক থেকে এটা অসাধারন যে আল্লাহ শব্দটির পরে ‘আহাদুন’ শব্দটি এসেছে। এরপর আবার আল্লাহ শব্দটি আসছে, ’ আল্লাহুসসামাদ’ এরপর কোন ইসম মওসুল, মানে আল্লাজি ব্যবহার না করে থেমেছে, (বাংলায় বললে, আল্লাহ, যে, এই যেটা ব্যবহার হয়নি, সরাসরি পরের বাক্য) এরপর বলছে ‘লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম উয়ু লাদ’ এটা অন্য সময়ের জন্য থাক। এখন আরেকটা জিনিস শেয়ার করতে চাই, যে কেন এটিকে ইখলাস বলা হচ্ছে? এই শব্দটা সুরার মাঝে নেই, এই সুরাটি আপনার আমার বিশ্বাসকে পোক্ত করার জন্য, যেটা আমরা বুঝতে পারছি আমাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ধারনাটি যত পোক্ত হবে তত আমরা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনুগত হব, আল্লাহ আমাদের সকল কাজে আন্তরিকতা ও আনুগত্য দান করুন।