মন্দ সামাজিক প্রথা উদ্ভাবনকারীদের থেকে সাবধান

আমি আমার আজকের খুতবা একটা সাধারণ বিষয়ের মাধ্যমে শুরু করতে যাচ্ছি, আমি মনে করি আজকে এখানে যারা রয়েছি তারা সকলেই এই বিষয়টি বুঝি যে আমরা কম বেশি সামাজিক চাপ (সোসাইটাল প্রেশার) অনুভব করি। যখন আমরা সামাজিক চাপের কথা শুনি তখন আমরা সাধারণত মনে করি এটি অত্যন্ত বিরাট একটি বিষয়, কিন্তু এটি আমাদের জীবনের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ঘটনার মধ্যেও রয়েছে। আপনাদের যাদের বাচ্চা রয়েছে তারা হয়তো অনেক সময় খেয়াল করেছেন যে আপনাদের বাচ্চাটি একটু বিশেষ রকমের পুতুল চাচ্ছে। অনেক সময় তারা এই পুতুল চায় কারণ হয়তো স্কুলের অন্য কোন বাচ্চার এইরকম একটি পুতুল রয়েছে। তারা ঐ জিনিসটিই কিনতে চায় যা অন্য লোকেদের রয়েছে। এটা হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক চাপ। যখন আপনার বাচ্চা একটু বড় হয় তখন তারা বিশেষভাবে (সার্টেইন ওয়েতে) কাপড় পরতে চায় এবং এই বিশেষভাবে কাপড় পরার চিন্তাটা তার নিজস্ব মস্তিষ্ক থেকে আসেনি, এটা এসেছে হয়তো এমন কোন অনুষ্ঠান থেকে যা সে টিভিতে দেখেছে এবং এখান থেকে সে শিখেছে “এভাবেই কাপড় পরতে হবে”। তার মাথায় হয়তো এই জিনিসটি এসেছে এমন কারো কাছ থেকে যাকে সে স্কুলে দেখেছে বিশেষভাবে কাপড় পরে আসতে অথবা এই ধরনের অন্য কোন মাধ্যম হতে যেখান থেকে সে শিখে নিয়েছে এভাবেই কাপড় পরতে হবে। এই ধরণের জিনিসগুলোকে তখন সে নির্দিষ্ট ধরে নেয় (Defined)। তখন সে নির্দিষ্ট সেই পন্থায়ই কাপড় পরতে চায় বা নিজেকে সেইভাবেই উপস্থাপন করতে চায় অথবা সেই সুনির্দিষ্ট খেলনাটিই কিনতে চায়।

ছোট ছোট বাচ্চারা মোবাইল ফোন কিনতে চায়, তাই না? “তোমার ফোনের কি প্রয়োজন?’’ আমি জানি না, আমার বন্ধুর একটি ফোন রয়েছে, আমার কেন থাকবেনা?” পিতা-মাতারা হয়তো এই ধরনের কিছু যুক্তি শুনে থাকবেন, ‘’তার এই জিনিসটি রয়েছে, আমার কেন থাকবেনা?” যখন সে আরো কিছু বড় হয় তখন সেই সামাজিক চাপই ভিন্ন রূপে তার সামনে হাজির হয়। আপনি হয়তো আপনার গাড়ি আপনার অফিস কর্তৃক নির্ধারিত পার্কিং এর জায়গায় রেখেছেন সেই সময় দেখলেন যে আপনার অফিসের আরেক সহকর্মী আরো সুন্দর একটি গাড়ি সেই জায়গায় রাখলেন তখন আপনার মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো “ওহ! আমিতো পিছনে পড়ে গেলাম, এই লোকটির গাড়ি কত সুন্দর! আপনি হয়তো আপনার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেলেন, গিয়ে দেখলেন যে তার এলাকার পরিবেশ আপনার এলাকা থেকে উন্নত তখন আপনার মাথায় চিন্তা আসলো “আমি কখন এইরকম পরিবেশে থাকতে পারব?’’ আমাকে এইরকম পরিবেশে অথবা এর চেয়ে ভালো পরিবেশে থাকতে হবে। আমাকে ওর মত অবস্থানে পৌঁছাতে হবে’’।

আমরা সর্বদাই অন্যদের কি রয়েছে তার সাথে আমাদেরটার তুলনা করে চলেছি এবং সচেতনভাবে অথবা অবচেতনভাবে অন্যদের সাথে নিজেদের পাল্লা দেওয়ার চিন্তায় মগ্ন রয়েছি। এই জিনিসগুলোকেই আমি সামাজিক চাপ (সোসাইটাল প্রেশার) বলতে চেয়েছি; হোক সেটা আপনার পোশাক, অথবা আপনি যা কিনছেন তা, অথবা আপনি আপনার টাকা কোথায় ব্যয় করছেন তা অথবা আপনি কোন ধরনের ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছেন সেটি। অনেক সময় আমাদের পিতামাতাই তাদের সন্তানদের সামাজিক চাপের মধ্যে ফেলে দেন। তার ছেলেমেয়ের সেই যোগ্যতা, মেধা আছে কিনা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই অনেক পিতা-মাতা বলে উঠেন, “তুমাকে অবশ্যই একজন ডাক্তার হতে হবে। কারণ ডাক্তার না হতে পারলে তুমি জীবনে ব্যর্থ হিসেবে গণ্য হবে’’। তাদের কথায় মনে হবে যে আমাদের চারপাশের যারা সফল মানুষ তারা সকলেই ডাক্তার আর এর পেছনে ছুটাই হল জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি বলছি না যে ডাক্তার হওয়া কোন খারাপ জিনিস, কিন্তু আপনার ছেলে-মেয়ে যদি ডাক্তার হয় নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমি কখনই তাদের পেশেন্ট(রোগী) হতে চাইব না। তাদের ডাক্তার হওয়ার পেছনের কারণ যদি শুধু থাকে তাদের মা-বাবার ইচ্ছা বা চাপ অথবা অন্য কোন সামাজিক চাপ আমি কখনই তাদের কাছে যেতে চাইবো না। এই ধরনের চাপ, এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব আমাদের চারপাশে সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে। এই চাপগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে একজন মানুষ নিজেকে একজন দাস ব্যতীত ভিন্ন কিছু রূপে কল্পনা করতে পারে না। তারা আসলেই তখন আর স্বাধীন থাকে না।

এটা আসলেই হাস্যকর যে আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেটি নিজেকে লিবারেল (স্বাধীন) ভেবে গর্ববোধ করে! তাই না? এটা ব্যক্তি-স্বাধীনতার জন্য গর্ববোধ করে, “আমি আমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারব’’, “আমার যেরকম ইচ্ছা পোশাক পরতে পারব’’, “যেভাবে ইচ্ছা কথা বলতে পারব’’, “যেভাবে ইচ্ছা নিজেকে উপস্থাপন করতে পারব’’, “আমার টাকাকে যেখানে ইচ্ছা ব্যয় করতে পারব’’। এই সমাজের মানুষগুলো এবং এই সমাজ এই ধরনের জিনিসগুলো নিয়ে গর্ববোধ করে কিন্তু আপনি যদি একটি স্কুলে যান দেখবেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রায় একইরকম ড্রেস পরে আছে (স্কুল ড্রেসের কথা বুঝানো হয়নি)। তারা সবাই প্রায় একইরকম ড্রেস পরে আছে। বিভিন্নরুচির শিশুদের সবার পোশাকও দেখবেন একইরকম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা সবাই একই ইউনিফর্ম পরে আছে। এমনকি তাদের সবার আচার-আচরণও একটি সুনির্দিষ্ট পন্থায় হতে হয় যা কিনা বেশিরভাগ মানুষের সাথেই খাপ খায়। আপনার আচরণ যদি বেশিরভাগ মানুষের সাথে না মিলে তাহলে আপনি হলেন একজন অচ্ছুৎ। তাই আমি যখন এই জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা করি আমি এর মাঝে কোন মুক্তি বা স্বাধীনতা খুঁজে পাই না। বরং আমি যা পাই তা হল সাংস্কৃতিক দাসত্ব বা দেউলিয়াপনা ( কালচারাল স্লেইভারি)। এই তরুণ অথবা তরুণীগুলো নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে অথবা কিভাবে কথা বলবে অথবা কীভাবে চলাফেরা করবে সেই সিদ্ধান্তটাও নিজে থেকে নিতে পারছে না। তাদের চারপাশে কি ঘটছে তার সাথে মিল রেখেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। অনেক সময় এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই হচ্ছে , অনেক সময় তারা মেনেই নিচ্ছে যে এটাই হচ্ছে জীবন পরিচালনার শ্রেষ্ঠ উপায়, এটাই হল কাপড় পরার অথবা কথা বলার অথবা সময়কে কাজে লাগানোর উত্তম পন্থা, এই ধরনের গান-বাজনাতেই আমাকে আসক্ত হতে হবে অথবা এই ধরনের কাজগুলোই আমি করব।

আমি অনেক মুসলিম টিনেজারদের দেখেছি তারা যখন আমার সাথে দলবেঁধে দেখা করতে আসে তখন তাদেরকে দেখে এক দুর্ধর্ষ দল মনে হয়। কিন্তু তারা যখন আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে তখন অনেকেই কেঁদে ফেলে। অনেকেই বলে “আমি এভাবে কাপড় পরতে চাইনি’’, “আমি এভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে চাইনি, কিন্তু আমি যদি তা না করি আমাকে স্কুলে মার খেতে হবে’’। এটাই হল সাংস্কৃতিক দাসত্ব। এটা হল দাসত্বের একটা রূপ। এই সাংস্কৃতিক দাসত্বপনা শুধুমাত্র তরুণদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, যেমন তারা কোন ধরনের সংগীত পছন্দ করছে, কোন ধরণের বিনোদনকে পছন্দ করছে, অথবা তারা কোন সুপরিচিত এথলেট বা সংগীতশিল্পীর মত হতে চায়; দাসত্বের এই রূপটা অধিক বয়সীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অধিক বয়সীদের জন্য এই সাংস্কৃতিক দাসত্বপনাটা অন্যভাবে হাজির হয়। আপনি দীর্ঘদিন ধরে আপনার সমাজে অথবা দেশে যে জিনিসগুলো দেখে আসছেন সে অনুসারেই একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে আপনার কাজগুলো করেন। আপনি সবসময় চান যে আপনার পরিবার ও বাচ্চারা ঐ একই উপায়ে কাজটি করুক, যদিও কাজটি খারাপ না ভালো তা আপনি কখনই ভেবে দেখেননি। এভাবেই আমরা কাজগুলো করি এবং ভাবি যে কাজটি এভাবেই করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন মাত্রায় দাসত্বপনায় ভোগা শুরু করি।

এই বিষয়কে সামনে রেখে আমি আপনাদের সম্মুখে সুরা আল-আ’রাফ এর একটি শক্তিশালী আয়াত তুলে ধরতে চাই যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু) ওয়া সাল্লাম এর ভূমিকা ও একটি দায়িত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে আমার বক্তব্য এই আয়াতকে কেন্দ্র করে নয়। আমি আমার বক্তব্যকে সুরা বাকারার দুটি আয়াতকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছি। তারপরও আমি সুরা আরাফের একটি আয়াতের মাধ্যমে এটি শুরু করতে যাচ্ছি। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল আহলে কিতাবদের (ইহুদি, খ্রিস্টান) বিষয়ে আলোচনা করছেন যারা জানত যে তাদের কিতাবগুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর আগমনের ভবিষ্যতবাণী তাদের কিতাবগুলোতে রয়েছে এবং আল্লাহ এই আয়াতে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। আমি আয়াতের এই অংশটি এড়িয়ে যাব তবে আয়াতের যে অংশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে সে অংশ সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলব।

আল্লাহ বলেন,

يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ

“তিনি তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ দেন, তিনি তাদেরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি তাদের জন্য ভালো ও পবিত্র কাজগুলোকে অনুমোদন করেন এবং নোংরা কাজকে তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেন।”

এটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি প্রধানতম দায়িত্ব যে তিনি আমাদেরকে ভালো কাজের আদেশ দেবেন, খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতে বলবেন, ভালো কাজগুলোর দ্বার(পথ) আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন এবং খারাপ কাজগুলোর দ্বার আমাদের জন্য বন্ধ করে দেবেন।

এরপর পরই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু কথা বলেছেন,

وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالأَغْلالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِم

“এবং তাদের থেকে বোঝা সরিয়ে নেবেন”, এই অংশটা ভালো করে শুনুন। “এবং তাদের কাছ থেকে বোঝা সরিয়ে নেবেন।”

إصْر” অর্থ হল ভারী বোঝা। এর আরেকটি অর্থ হল চুক্তি । তাই এই দুই অর্থকে যদি আমরা সমন্বয় করি তবে এই শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “একটি ভারী বা বৃহৎ চুক্তি” এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন তাদের নিকট থেকে এই বোঝা সরিয়ে নিতে এবং সরিয়ে নিতে “الأَغْلال”কে, যার অর্থ হল শিকল যে শিকল দ্বারা হাত অথবা গলা পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। আপনার নিশ্চয়ই জানেন কোন ধরনের মানুষদের এভাবে শিকল দিয়ে পেঁচানো হয়। ঠিক? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন কয়েদী বা কারাবন্দীদেকে এভাবে শিকল দিয়ে পেঁচানো হয়। একজন কারাবন্দীর হাতে ও গলায় শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন মানুষের বোঝা ও হাত ও গলার শিকল সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে শিকল ও বোঝা কারণে সে দাস হয়ে রয়েছে। কি ধরনের শিকল তাহলে এগুলো? আসুন জেনে নিই।

ইসলামের প্রথম যুগের মানুষদের উদ্বেগের বিষয় সীমাবদ্ধ ছিল কোন জিনিস হালাল, কোনটি হারাম, কোন জিনিসটি আমাদের করতে হবে, আর কোন জিনিস থেকে বিরত থাকতে হবে এদের মধ্যে। এইগুলো ছিল তাদের কাছে মুখ্য বিষয়, অন্য সবকিছুই ছিল গৌণ বা অপ্রধান। কিন্তু যতই সময় সামনের দিকে এগুলো এই উম্মাহ, এই সমাজ এবং এতে বিদ্যমান চাপগুলো পরস্পরের সাথে মিশ্রিত হওয়া শুরু হল। এখন আপনাকে শুধু আল্লাহ কি বলছেন তা মেনে চললেই হচ্ছে না, আপনার সমাজ কি বলছে তাও মানতে হচ্ছে। আপনার উপর আরোপিত হচ্ছে অধিক শিকল, আরোপিত হচ্ছে অধিক বোঝা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেনই এই সকল বোঝা ও সকল শিকল সরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা মনে করি সামাজিক চাপকে মেনে নিলে আমাদের জীবনযাত্রা সহজ হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা আমাদের জীবনকে আরো কঠিন করে তুলে। মানুষ কোন সুনির্দিষ্ট প্রথা অনুসারে চললে তার জীবন কীভাবে কঠিন হয়ে তার একটি উদাহরণ এখন আমি আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করব।

আমি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমি জানি এটা পাকিস্তানের অনেক বড় একটা সমস্যা। আমাদের দেশে বিবাহ অনুষ্ঠানে অনেক বেশি টাকা খরচ করানো হয়। বিবাহগুলো হয় অত্যধিক ব্যয়বহুল যদিও অনেক পরিবারের পক্ষে এতো খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। পরিবারগুলো এইরকম বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে সক্ষম না সত্ত্বেও শুধুমাত্র সামাজিক চাপের কাছে মাথা নত করে এই ধরনের বিবাহের আয়োজন করে। আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন আপনারা এগুলো কেন করছেন?, আপনারা কেনো এতো টাকা ঋণ করে এমন ব্যয়বহুল বিবাহের আয়োজন করছেন? তখন তারা কি বলে জানেন? তারা বলবে আমার কাজিন তার বিয়েতে এতো টাকা খরচ করেছে, তার বিয়েতে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে; আমি যদি না করি তাহলে আমি ওর কাছে মুখ দেখাবো কি করে। আমি আমার আত্মীয়, প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখাবো কি করে? আপনি কি আমাকে শুধু মাসজিদে গিয়েই বিয়ে করতে বলেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজের কাছে মুখ দেখাতে হবে! এটা এ জন্য নয় যে আপনাকে আপনার দ্বীন এই ধরনের কাজ করার কথা বলছে। তাহলে কে বলেছে? সমাজ, সমাজের মানুষ। চিন্তা করুন একটি তরুণ দম্পতি নতুন বিয়ে করেছে এবং তাদের বিবাহ-উত্তর জীবন শুরু করতে হচ্ছে বিরাট ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। আসলে তরুণ হলে তারা ভাগ্যবানই, কারণ আমি যে জায়গা থেকে এসেছি সেখানে সাধারণত তাদেরকে ত্রিশের আগে বিবাহ দেওয়া হয় না। তারা এমন একটা অনুষ্ঠানের জন্য এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছে যে অনুষ্ঠান তিনদিন পর কেউ মনে রাখবে না। সমাজের মানুষের অযৌক্তিক কিছু চাহিদা মেটানো ছাড়া তারা এই ধরনের কর্মকাণ্ড আর কিছুর জন্যই হচ্ছে না। “মানুষ কি বলবে। উর্দুতে “লোক কেয়া কাহেঙ্গে’’। “মানুষ কি বলবে যদি আমরা এটা না করি’’। কত উদ্বেগ মানুষ বলবে এই সম্পর্কে! এই ধরনের প্রবণতা আপনাকে শুধু সমস্যাতেই নিমজ্জিত করবে।

অপরদিকে দেখুন আল্লাহ কী বলছেন,

“يُريْد اللهُ اَنْ يُخَفِّفَ عَنْكُمْ,

আল্লাহ আপনার বোঝা হালকা করতে চান” দীনের উদ্দেশ্যও তাই।

আপনি আপনার চারপাশে এমন লোকদের পাবেন যারা তাদের সামাজিক প্রথার দাস হয়ে রয়েছে, দাস হয়ে রয়েছে সামাজিক চাপের। এই ধরনের লোকজনই ইসলাম সম্পর্কে বলে যে ইসলাম হল খুবই কঠিন, কঠোর। কিন্তু মজার কথা এই যে তারা যদি ইসলামের একটি ছোট মূলনীতিও মেনে চলত তাদের জীবন হত অনেক সহজ। দ্বীন তাদের জীবনকে কঠিন তো করতই না, বরং অনেক সহজ করে দিত। তারা যে জিনিসগুলোকে অনুসরণ করছে সেগুলো তাদের জীবনকে একটার পর একটা সমস্যায়ই নিমজ্জিত করছে কেবল। এগুলো তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে, যদিও তারা তা বুঝতে পারছে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন তাদের কাছ থেকে এই বোঝাগুলো তুলে নেবার জন্যই।

এই বোঝা এবং শিকলের আরো একটি অর্থ রয়েছে এই আয়াতে। আমরা যখন একটা নির্দিষ্ট সামাজিক প্রথা অনুসরণ করি তখন আমাদের শিশুরাও কিন্ত আমাদের কাছ থেকে এই জিনিসগুলো শিখে যেমন করে আমরা আমাদের পিতামাতার কাছ থেকে এগুলো শিখেছিলাম। এভাবে যখন আমরা বিচার দিবসে মহান আল্লাহ তা’লার সামনে দাঁড়াবো তখন আমাদের সামনে থাকবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা যারা শুধুমাত্র সামাজিক চাপের ফলে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে এবং তাদের সাথে আমাদেরকেও শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হবে। আমাদেরকেও তাদের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হবে, তাদের বোঝা হবে আমাদের বোঝা কারণ আমরাই সেই প্রথা বা ট্রেন্ডটি প্রতিষ্ঠা করেছি, আমরাই তাদের সেই পথে পরিচালিত করেছি। তারা পৃথিবীতে যা করেছে তার জন্য আমাদেরকেও জবাব দিতে হবে। তাদেরকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু আমাদের জবাবদিহি করতে আমাদের নিজেদের কাজের জন্য ও তাদের সবার কাজের জন্য। সুবহানাল্লাহ! আসলেই এটা অনেক বড় সমস্যা!

এই কারণে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম একজন সচেতন পিতা হিসেবে দোয়া করেছিলেন এবং আমাদেরকেও তা শিখিয়ে দিয়েছেন,

وَجَعَلْنا لِلْمُتَّقينَ اِماما

“মুত্তাকিদের মধ্যে থেকে আমাদের জন্য ইমাম বানিয়ে দাও।”

কারণ বিচার দিবসে আমরা এমন মানুষের সাথে শিকলবদ্ধ হতে চাই না যারা বিপথগামী হয়ে গেছে, যারা আমাদের দুর্ভাগ্যের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করবে।