আমি যদি পরবর্তী বিশ মিনিট বা তার কম সময়ের মধ্যে আপনাদের সাথে কুরআন শরিফের একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে পারি, আমি মনে করবো আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। এই আয়াতটি সূরা হাদিদের অন্তর্ভুক্ত। আচ্ছা আমি যেন কী সম্পর্কে কথা বলছিলাম? কত আয়াত নিয়ে আমি কথা বলবো? একটি আয়াত নিয়ে, যেটি সূরা আল হাদিদের অন্তর্গত। কুরআন মাজিদের ৫৭ তম সূরা, যেটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। যার মানে এই সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মুসলিম সমাজকে কেন্দ্র করে। এমন অনেক মাদানী সূরা রয়েছে যার মূল আলোচ্য বিষয়টিতে সমগ্র মানব জাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ এই ধর্মের আহবান সমগ্র মানব জাতির প্রতি।
কিন্তু কুরআনে আবার এমন জায়গা রয়েছে বিশেষ করে মদিনায় অবতীর্ণ কোন কোন সুরাতে যেখানে আলোচ্য বিষয়ের মূল উদ্দেশ্য মুসলিম সমাজ। তারাই এই সুরাগুলো শুনছে। আপনারা আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন না? ……। জীবনে আমরা যে সমস্ত বিষয়ের পেছনে ছুটি তার একটা সারাংশ আল্লাহ এই মাদানী সূরায় আমাদের দান করেছেন। তিনি শুরু করেন এভাবে, اعْلَمُوا – ‘’তোমরা ভালোভাবে জেনে রাখ,’’ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি আদেশ ভালোভাবে কোন কিছু উপলব্ধি করার জন্য। কিন্তু যে বিষয়গুলো তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলো আমাদের নিকট সুস্পষ্ট। সম্ভবত, আমরা আমাদের জীবন পরিচালনা করার সময় এই বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্যপাত করি না। তিনি বলেছেন, اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ – ‘’পার্থিব জীবন ক্রীড়া ছাড়া আর কিছু নয়….।’’ আমি নিজে পিতা হওয়ার পূর্বে এই আয়াতটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি। বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের কিছু প্রয়োজন এবং চাহিদা দেখা দেয়। আমরা সবাই এটা জানি। বাচ্চারা যখন জন্ম গ্রহন করে তখন তাদের কোন চাহিদা থাকে না, থাকে প্রয়োজন। তাদের দুধ পান করতে হয়, পেশাব-পায়খানা করতে হয়, ঘুমাতে হয়…এভাবে এই চক্র চলতে থাকে।
কিন্তু যখন তারা একটু বড় হতে শুরু করে তখন বিভিন্ন জিনিস চাওয়া শুরু করে। আমাদের বাচ্চারা যাদের বয়স ছয়, নয় মাস বা এক বছর তারা খেলা করতে চায়। তারা চায় কেউ তাদের কোলে নিক, খেলাচ্ছলে উপর নিচ করুক, কাতুকুতু দিক…। তারা শুধু খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে চায় না। তারা বেয়াও…খেলতে চায়। তারা খেলতে চায়। এই চাহিদাটা প্রকৃতিগতভাবেই বাচ্চার মধ্যে চলে আসে।
একবার একটি চমৎকার ঘটনা আমাকে এই আয়াতটির কথা মনে করিয়ে দেয়। আমেরিকায় এমন একটি জায়গা রয়েছে, এখানে উপস্থিত সকল বোন এই জায়গাটি সম্পর্কে জানেন। মনে হয় যেন মুসলিম বোনদের জন্য সপ্তাহে একবার সেখানে যাওয়া ফরজ কাজ। সেটা হলো – ‘টার্গেট’। তো, আমিও আমার ফরজ কাজ সম্পাদনকল্পে আমার বাচ্চাদের নিয়ে টার্গেটে গেলাম। সে সময় আমি আমাদের প্রথম বাচ্চা অলীদের দায়িত্বে ছিলাম। না, না ইমাদ। যাইহোক, আমি এখন প্রায়ই বাচ্চাদের নাম বলার ক্ষেত্রে ভুল করি। তাই আমি এভাবে ডাকি – তিন নাম্বার, না, না চার নাম্বার, সরি। এদিকে আসো। সে যাইহোক, ইমাদের বয়স সে সময় দুই বছর ছিল। আপনি যখন এরকম দুই তিন বছরের কোন বাচ্চাকে নিয়ে দোকানে যান, সে তখন তাক থেকে সব কিছু ফেলে দিতে চায়। কারণ আপনাকে আবার এটা তুলে রাখতে দেখলে সে একধরণের মজা পায়। তাই আমি চেয়েছিলাম তাকে ব্যস্ত রাখতে। তো, আমি খেলনার সেকশনে গেলাম। সেখানে বড় একটা বল ছিল। বলটা তার থেকেও বড় ছিল। তো আমি এটা নিলাম আর তাকে বললাম তুমি এটা দিয়ে খেলো। সে বলটা নিলো, কিক দিলো, বলটা একটু সামনে গেলো, সেও এগিয়ে গিয়ে বলটাকে আবার কিক দিলো…. এভাবে বিশাল এই দোকানটি বলটি নিয়ে চক্কর দিলো। আমার জন্য বিষয়টা ছিল দারুন, আমাকে আর কিছু করতে হয়নি, আমি শুধু তাকে ফলো করলাম। সে খেলতে খেলতে পুরো ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলো, ঘর্মাক্ত হয়ে গেলো, তার ডায়পার থেকেও সন্দেহজনক গন্ধ ছড়াচ্ছিল। এভাবে খেলতে খেলতে একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে গেলো, বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। তারপরও বলটির দিকে তাকিয়ে রইলো, বলটিকে বলছে – আমি আসছি, আমি আসছি। তারপর সে আবার উঠে দাঁড়ালো এবং বলটিকে কিক দিলো। এমন সময় আমার স্ত্রী এসে সেখানে হাজির হলো এবং তাকে কোলে তুলে নিলো। আমাকে বললো – “কি করছো তুমি”।
সে তার মায়ের কোলে যাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। কারণ সে সময়ে তার নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল খেলাধুলা করা।
তারপর আমাদের জীবন পরিক্রমায় অন্য একটি বিষয় এসে যুক্ত হয়। আল্লাহ বলেছেন – اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ – তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন হলো ক্রীড়া, কৌতুক… এখানে লাহু বলতে এমন জিনিস বোঝায় যা নিয়ে অবসর সময় কাটানো হয়। লাহু বলতে এমন জিনিস বোঝায় যা উপকারী নয়, কিন্তু বিনোদন পাওয়া যায়, যা আপনাকে কাজের কথা ভুলিয়ে দিবে, এটাকে লাহু বলা হয়।
আমাদের বাচ্চারা যখন আরেকটু বড় হতে শুরু করে তখন তারা শুধু, বেয়াও বা লুকোচুরি খেলার মাঝে সন্তুষ্ট থাকে না। আপনাকে আরো কিছু যুক্ত করতে হয়, আমরা তাকে বলি বিনোদন।
“আব্বা আমাকে একটি গল্প বলুন, আমি কি এই নাটকটি দেখতে পারি? এই অনুষ্ঠানটি দেখতে পারি? আমি কি এটা দেখতে পারি? আমি কি ঐটা দেখতে পারি? আপনি কি আমাকে একটি গল্প শোনাতে পারবেন?” এর নাম তো খেলাধুলা নয়, এর নাম কী? বিনোদন। সুতরাং জীবনের পরবর্তী পর্যায়টি হলো বিনোদন। বর্তমানে খেলাধুলা আর বিনোদনের সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছে ভিডিও গেইম ইন্ডাস্ট্রি। গল্প এবং খেলাধুলা দুইটাকে এখানে এক করে দেয়া হয়েছে। এই ভিডিও গেইমগুলোর সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলো শিশুরা।
আমাদের মুসলিম শিশুদের বড় একটা অংশও এগুলোর ব্যবহারকারী। আর এই গেইমগুলো তাদের বয়স সীমার অনেক বাইরে। যেমন আপনার আট বছরের বাচ্চা এসে আপনাকে বলে – ‘আম্মু এই ঈদে আমাকে গ্রান্ড থেফট অটো কিনে দিতে হবে। যদি আমাকে এই গেইমটি কিনে দেন তবে আমি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো। যদি এটা কিনে দেন তবে আমি প্রতিদিন ফার্স্ট হবো, ইত্যাদি, ইত্যাদি।’
তাহলে প্রথমে ছিল খেলা, দ্বিতীয়ত ছিল বিনোদন। তারপর আল্লাহ তৃতীয় পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেন। وَزِينَةٌ – শোভা-সৌন্দর্য। সৌন্দর্য নিজেই চরম আকাঙ্খার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এর মানে কি জানেন? এর মানে হলো – আপনি সাবালক হয়েছেন। এর মানে হলো – আপনি টিনেজার হয়ে গেছেন। আপনি এখন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন নিজের সৌন্দর্য নিয়ে। আপনার বয়স যখন ৯ বা ১০ বছর ছিল, আপনার জুতা ম্যাচিং করছে কিনা এটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আপনার পোশাক কেমন ছিল সেটা নিয়েও কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না বা অন্য কারো পোশাকের দিকেও আপনি ভ্রূক্ষেপ করতেন না।
এখন আপনি যদি ১৩ বছর বয়সের কোনো বোন হয়ে থাকেন, আপনি ৩০ মিনিট ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হিজাব ঠিক করেন। যদি এক পাশ অন্য পাশ থেকে কিছুটা উঁচু হয়, জোরে জোরে মাথায় থাপ্পড় দিতে থাকেন এটাকে নিচে নামানোর জন্য। কিন্তু এটা নিচে নামছে না, এমন সময় আপনার আম্মু দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করেন, সবকিছু ঠিকাছে তো? – হ্যাঁ, সব ঠিকাছে।
অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে, এখনো তাদের কোনো দাঁড়ি গজায়নি, কিন্তু তারা মনে করে যে একটা দুইটা গজিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার বার দেখতে থাকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার দাঁড়ি গজাচ্ছে, ওহ, আমি একটা দেখতে পেয়েছি। আবার যাদের মুখভর্তি দাঁড়ি উঠেছে, তারা পেন্সিলের মতো করে এটাকে সাজিয়ে রাখে। আপনার খেয়াল করেছেন? মনে হয়ে যেন একটা শৈল্পিক রূপ দিয়ে এটাকে ছাটা হয়েছে, কোনো এক ইঞ্জিনিয়ারের মহৎ কর্ম!!
এমনকি টাক মাথার ছেলেটাকে ও দেখা যায়, আয়নায় দাঁড়িয়ে এমন করছে। আমি দেখেছি তরুণ ছেলেরা যখন জুমুয়ার নামাজ পড়তে মসজিদে আসে, তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি গাড়ির আয়নায় নিজের চেহারা দেখে, চুল ঠিক করে। দৃশ্যটা বেশ মজার। বিশেষ করে যদি আপনি গাড়ির ভেতরে থাকেন, কিন্তু তারা জানে না। সত্যি বেশ মজার। যাইহোক।
সৌন্দর্য্য একটি চরম আকাঙ্খার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আপনি চান আপনাকে যেন সুন্দর দেখায়, আবার আপনি সুন্দর কারো প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আপনি সুন্দর গাড়িতে চড়তে ভালোবাসেন, যদি আপনার বাসা সুন্দর না হয়, আপনি মানুষকে দাওয়াত করতে চান না। আপনার বাবা যদি বেশ পুরাতন মডেলের কোনো গাড়ি চালায় আপনি তাকে স্কুল থেকে বেশ দূরে কোথাও নামিয়ে দিতে বলেন। আপনার বন্ধুদের এমন গাড়ি দেখানোর চেয়ে আপনি হেঁটে স্কুলে যাওয়াকে অধিক পছন্দ করেন। কারণ এ বয়সে সৌন্দর্য আপনার মনকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফ্যাশন, সুন্দর পোশাক, বাসার ভেতরের ডিজাইন ইত্যাদি। এ বয়সে আপনি আপনার রুম সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। আপনি গাড়ি চান। দেখতে সুন্দর এমন একটি ফোন চান, ভালো ভাবে কাজ করুক বা না করুক সেটা কোনো ব্যাপার না, আবার এটার জন্য সুন্দর একটা কাভার ও কিনে আনেন। এটাকেই বলা হয় ‘জিইনা।’ এমন একটি বয়স আপনি অতিক্রম করেন। সৌন্দর্য্যের প্রতি এই চরম আকাঙ্খাও এক সময় হ্রাস পেতে শুরু করে।
ইনশাআল্লাহ চলবে ….
[যে আয়াতটি এখানে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তার বঙ্গানুবাদ: “তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া, কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।” (৫৭-২০)]