এই কয়েক মিনিটে আমি আপনাদের সাথে সুরা নুর থেকে দু’টি উপমা শেয়ার করতে চাই। সুরা নুর হলো কুরআন শরিফের ২৪ তম সুরা। অনেক সময় কুরআন শরিফের অন্যতম কিছু কঠিন শিক্ষা আল্লাহ তায়ালা উপমা দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ সময় শুধু অনুবাদ পড়ে উদাহরণটা উপলব্ধি করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
তো, আমি যা করবো, আপনাদের প্রথমে পেছনের ঘটনা বলবো। যা এই সুন্দর উপমাটি বুঝতে সাহায্য করবে। এই উদাহরণ দুটি শুধু সুন্দর নয়, ভয়ংকরও বটে। কুরাআনের এই স্থানে আসলে দুইটি বিষয় আলো এবং অন্ধকারের মাঝে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং আমি প্রথমে কুরআনে কিভাবে ‘আলো’ সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে সে বিষয়টা তুলে ধরবো। প্রথম যে বিষয়টা আমরা জানি তা হলো আল্লাহ নিজেকে ‘নুর’ বা আলো বলেছেন।اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ আল্লাহ আকাশ এবংপৃথিবীর আলো। (২৪ঃ ৩৫)
কুরআনের অন্য এক জায়গায় ‘আলোর’ যে ব্যবহার আপনি পাবেন তা হলো, হেদায়েত তথা পথনির্দেশনার বিকল্প শব্দ হিসেবে নূর ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আলো’ এবং হেদায়াতকে একই বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন, বলা হয় যে সে অন্ধকারে আছে, এর মানে হলো সে পথভ্রষ্ট। এর বিপরীতটাও সত্য। কারো আলো আছে মানে সে সঠিক পথে আছে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহ যে নূর বা আলোর কথা বর্ণনা করছেন তার অবস্থান মানুষের অন্তরে।
কুরআনে আলোকে রাত্রিবেলা কোনো ঘরে দেয়ালের খোপে যে চেরাগ বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয় তার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আগের দিনে এই খোপটাকে ধনুকের মত মনে হত। এটা আমাদের বুকের খাঁচার আকৃতির ছিল। আর এই উপমায় বাতিটিকে অন্তরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং বাতি জ্বালানো মানে অন্তর আলোকিত করা। যাইহোক, যে পয়েন্টটা আমি বলতে চাচ্ছি তা হলো, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোর বসবাস হলো আমাদের অন্তরে। যে কারণে এই উপমাটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আলো শুধু ভেতরেই পড়ে থাকে না এর বিচ্ছুরণ বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
তাই কোন বাতি শুধু বাতিটিরই উপকার করে না এটা এর চারিপাশও আলোকিত করে তোলে। সুতরাং কারো অন্তরে যদি সত্যিকারের হেদায়েত থাকে, সত্যিকারের বিশ্বাস থাকে এতে শুধু তারা নিজেরাই উপকৃত হবে না বরং তাদের আশেপাশের সবাই এর ফলে উপকৃত হবে। প্রকৃতপক্ষে আলোর মূল্য তখনই বুঝা যায় যখন চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অন্য কথায় আমাদের ঈমানের প্রকৃত মূল্য তখনই বুঝা যায় যখন আমরা জীবনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। যখন আমরা পথভ্রষ্টতা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ি।
‘আমরা তখন ভাবি, ইস! আমরা যদি আগের দিনের ভাল সময়ে বসবাস করতাম! আমরা যদি রাসূল (স) এর সময়ে বসবাস করতাম! আমরা কী এক অন্ধকার সময়ে বসবাস করছি!’ এই ধরনের ভাবনা আসলে অর্থহীন। সকল নবীরাই (আ) ছিলেন সংখ্যালঘু। বিশ্বাসীরা সবসময় সংখ্যালঘুই ছিলেন। তাদের সময়কার অধিকাংশ মানুষ ছিলেন অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাই যখন আপনি বলেন, ‘ইস! আমি যদি সেই সময়ে বসবাস করতাম!’ আপনি আসলে আলাদা কোন পরিস্থিতির জন্য ইচ্ছা পোষণ করছেন না। হতে পারে আপনি আসলে আরও কঠিনতর কোন পরিস্থিতি কামনা করছেন। তো, প্রথমে আমি এই ধারনাটির অপনোদন করতে চেয়েছি।
নূর সম্পর্কে দ্বিতীয় যে কথাটা বলতে চাই, তা হলো আলোর রূপক অর্থ। স্পষ্টত আপনি কারো বক্ষ খুলে দেখলে সেখানে আলো খুঁজে পাবেন না। কিন্তু আসলে এমন একদিন আসবে যেদিন আপনি এই আলোর দেখা পাবেন। আল্লাহ আমাদের বিশ্বাসকে সেদিন আলোতে রুপান্তরিত করবেন। বিচার দিবসে বিচার শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদেরকে হেঁটে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছতে হবে। হয় জান্নাতে না হয় জাহান্নামে। মানুষের মধ্যে যাদের ঈমান থাকবে, যেটাকে কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে يَسْعَىٰ نُورُهُم بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِم – সেইদিনের গহীন অন্ধকারে দুই ধরনের আলো আমাদের সাহায্য করবে… একটা আলো আসবে আমাদের বক্ষ থেকে আরেকটা আসবে আমাদের ডান হাত থেকে। কুরআন কয়েক জায়গায় এটাই বর্ণনা করেছে। সেইদিনের সেই কঠিন পথে ঈমানের আলোর মাধ্যমে আপনাকে রাস্তা চিনতে হবে। যেন আমি আপনি জান্নাতে পৌঁছতে পারি এ জন্যই আলোর প্রয়োজন হবে।
এখন প্রশ্ন হলো কেন দুই ধরণের আলো থাকবে? এক ধরণের আলোর সম্পর্ক হলো আপনার আন্তরিক ঈমানের সাথে। এর অবস্থান আপনার অন্তরে। এ সম্পর্কে শুধু আপনি জানেন এবং আল্লাহ জানেন। আর কারো পক্ষে এর সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। আর অন্য আলোটি আসবে আপনার ডান হাত থেকে। এই দুনিয়ায় আমার আপনার কাজের প্রমাণ হিসেবে এই আলোটি পাওয়া যাবে। যদি আপনি দুনিয়ায় ভাল কাজ করে থাকেন, সেই ভাল কাজগুলোই সেদিন আলোতে রুপান্তরিত হবে। সুতরাং বিচার দিবসে আপনার নিকট এই দুই ধরণের টর্চ থাকবে যা আপনাকে রাস্তা চিনতে সাহায্য করবে, সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
দিনশেষে, এই সব আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো বিচার দিবসে যখন আমরা দাঁড়াবো আমাদের হাতে যেন কিছু আলো থাকে। আমাদের যেন কিছু আলো থাকে যেটা দিয়ে আমরা জান্নাতের পথ পাড়ি দিতে পারবো। আমাদের রাসূল (স) বর্ণনা করেন বিচার দিবসে যে আলো সহকারে আমরা উঠবো তা সবার জন্য সমান হবে না। অনেক মানুষের এত অল্প আলো থাকবে যে তারা কোনো মতে নিজেদের পা দেখতে পাবে। এত অল্প আলো তাদের থাকবে। আবার কারো আলোর পরিমাণ এত বেশি হবে যে, দুনিয়ার হিসেবে মনে হবে যেন সেই আলোতে এক শহর থেকে অন্য শহর দেখা যাবে। তাদের এতো বেশি পরিমাণ আলো থাকবে। আর সেটা নির্ভর করে আমাদের ঈমানের এবং ভালো কাজের লেভেলের উপর। তাই আলোর উপমাটি গুরুত্বপূর্ণ। আজকের খুতবার বিষয় এটা নয়। আলোর ধারণাটি বুঝার জন্য আমি শুধু পেছনের কিছু তথ্য দিতে চেয়েছি। আল্লাহ চান আমরা যেন আলোর ধারণাটি বুঝতে পারি। এবং কীভাবে আমরা সেই আলো নিজেদের বুকে ধারণ করতে পারি।
আর তাই আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে আমরা যেন সেই আলোর জন্য বিনিয়োগ করি এবং তা যেন হারিয়ে না যায়। কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে। বর্তমানে হয়তো আপনি আমি সেই আলোর অবস্থান বুঝতে পারছি না। কিন্তু সেই দিন সবাই এর আকাঙ্ক্ষা করবে। এখন যে দুইটি উপমা আমি আপানাদের সাথে শেয়ার করতে চাই সেগুলো আসলে আলো সম্পর্কে নয়। সেগুলো অন্ধকার সম্পর্কে।