আমি শুরু করেছিলাম, لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ দিয়ে। আপনার আচরণ দ্বারা কাউকে ছোট করবেন না। এক গ্রুপকে অন্য গ্রুপের তুলনায় ছোট করবেন না। ধরুন, আপনারা কয়েকজন বন্ধু একত্রে থাকেন, সবাই কলেজ পাশ করেছেন, কিন্তু একজন পাশ করতে পারেন নি। তার অর্থনৈতিক সমস্যা আছে, তার বাবা ব্যবসায় লস করেছে বা যাইহোক, তাই তাকে স্কুল ত্যাগ করে একটি গ্যাস স্টেশনে চাকরি নিতে হয়েছে। আপনারা সবাই পাশ করেছেন কিন্তু সে পাশ করতে পারেনি। এখন আপনারা সবাই চাকরি করেন, একত্রে ঘুরেন, আর সে বন্ধুর দিকে নিচু দৃষ্টিতে তাকান, তাকে মনে করিয়ে দেন যে সে কীভাবে স্কুল পরিত্যাগ করলো।
এটাই لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ (কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে।) তার গ্যাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা, গ্যাস পাম্প করা আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান এবং সম্মানিত। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহর এই আয়াতটি মনে রেখে উপার্জন বিষয়ে আমরা একে অন্যকে যেন ছোট চোখে না দেখি। জানেন, আল্লাহ কীভাবে অর্থ উপার্জনের বিষয়টা কুরআনে উল্লেখ করেছেন? যে কাজই আপনি করেন না কেন, সেটা ব্যবসা হউক, অফিসে কাজ করেন, হাসপাতালে চাকরি করেন বা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ যেটাই হউক – সব ধরণের হালাল কাজের একটাই নাম আছে। বিশেষত, শুক্রবারে জুমুয়ার পর তিনি কী করতে বলেন- فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ – নামাজ সমাপ্ত হওয়ার পর জমিনে ছড়িয়ে পড়, যেখানে যাওয়ার সেখানে যাও এবং ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ অনুসন্ধান কর। সেই উপার্জন, সেটা যে কাজই হউক না কেন আল্লাহ সেটাকে আপনার প্রতি ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেটা আপনার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ। আর যখন আল্লাহ কারো প্রতি অনুগ্রহ করেন, তার মানে তাকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন।
কারো উপর আল্লাহর অনুগ্রহ থাকলে সেখানে অসম্মানের কোন বিষয় নেই। এই দুইটা একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়।
চলুন এই ধারনাটি বাড়ির পাশে নিয়ে আসি। এই ধারনা যে অন্যের চেয়ে আপনি ভালো চাকরি করেন… প্রসঙ্গত, এই আচরণ আমরা শুধু অপরিচিত মানুষদের সাথেই করি না। আমরা পরিবারের সদস্যদের সাথেও একই আচরণ করি। কোন যুবক হয়তো বলে ‘আমি ডাক্তার হতে চাই না, আমি ফার্মাসিস্ট হতে চাই।’
তখন পরিবার তাকে বলে-‘ তুমি এমন একটা ব্যর্থ ছেলে। তুমি কিছু একটা হতে পারতে, আর এখন তুমি ফার্মাসিস্ট হতে চাও?’
– ‘হ্যাঁ, এই কাজে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় না, আমি এর পাশাপাশি জীবনে ভিন্ন ধরণের আরও কিছু কাজ করতে পারবো। আমি জানি না, আমি আরও পাঁচ ছয় বছর এই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবো কিনা’, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি ফার্মাসিস্ট হতে চাই।
এর চেয়েও আরও খারাপ ব্যাপার হলো – কোন কোন বাবা মায়ের জন্য এটা আত্মহত্যা করার মত যে, তার কোন সন্তান নার্স হতে চায়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
– ‘এ জন্যই তুমি বায়োলজি পড়েছ? নার্স হতে?
এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার হলো, কোন যুবক যদি ইতিহাস পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।
বাবা মা তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ইতিহাস পড়ে তুমি কী চাকরি করবে?
– ‘ওয়েল, আমি ইতিহাস ভালোবাসি। আর আমি মনে করি এটা শিক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। আর ভাবছি, পাশ করার পর শিক্ষকতা করবো।’
– ‘তুমি শিক্ষক হতে চাও!! আসল চাকরি করো। শিক্ষক? যারা কিছু করতে পারে না, তারাই শিক্ষকতা করে। অন্তত পারলে ল’ স্কুলে ভর্তি হও। ল’ইয়ার হও। কেন তুমি সত্যিকারের চাকরি করতে চাও না।’
আমরা আমাদের পরিবারের ভেতরেই কিছু কিছু কাজকে, কিছু কিছু পেশাকে নিচু মনে করি।
আরও খারাপ মনে করা হয়, যদি কোন তরুণ তরুণী সাইকোলজি পড়তে চায় বা কাউন্সেলিং করতে চায়… কারণ তারা অনুভব করে যে, মুসলিম কমিউনিটির প্রচুর কাউন্সেলর দরকার। আমাদের মেয়েদের কাউন্সেলর দরকার, আমাদের পিতামাতাদের কাউন্সেলর দরকার, আমাদের কিশোর-কিশোরীদের কাউন্সেলর দরকার। কিন্তু আমাদের এমন প্রফেশনাল কেউ নেই যার কাছ থেকে আমরা উপদেশ নিতে পারি। আমাদেরকে অমুসলিম কাউন্সেলরদের কাছে যেতে হয়। কারণ এই পেশায় আমাদের যথেষ্ট প্রফেশনাল নেই। তাই কেউ যদি কাউন্সেলিং পেশায় যেতে চায়, তখন সবাই তাকে নিয়ে মজা করে, যে সাইকোলজি নিয়ে পড়তে চায়। কারণ তারা বলে – ‘তুমি এটা পড়ে কী করবে?’ এটা পড়ে কীভাবে তুমি ক্যারিয়ার গড়বে?
আল্লাহ যে কাজে কাউকে দক্ষতা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে ব্যঙ্গ করা…যে কাজ করার জন্য আল্লাহ তাদেরকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন… আমি বলছি না যে আপনারা উন্নত মানের ক্যারিয়ারের জন্য প্রচেষ্টা করবেন না। কিন্তু মানুষকে তাদের কাজের/চাকরির জন্য ছোট মনে করবেন না।
আজকের দর্শকদের মধ্যে অনেক যুবক আছে, যারা কলেজের পড়ালেখায় খুবই দুর্বল। তারা পারে না। আপনি যতই তাদের পড়ালেখা করতে বলেন তারা পারে না। কিন্তু তারা হয়তো গাড়ি ঠিক করার কাজে খুবই দক্ষ। তারা মনে হয় যেন প্রকৃতিগতভাবে জন্মসূত্রে ম্যাকানিক। সে হয়তো গোটা জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ম্যাকানিক হতে পারে। আমি তার সাথে এমন আচরণ করি না, যার ফলে সে নিজের সম্পর্কে খুবই মন্দ ধারনা পোষণ করে। কারণ সে তার পড়ালেখা শেষ করতে পারেনি। সে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। কিন্তু যখন সে ঐ কাজে মনোনিবেশ করলো, খুবই দক্ষতা দেখাতে পারলো। এখন সে নিজের নামে তিন চারটা গ্যারেজ চালায়। তারপর সে হয়তো তার ভার্সিটি থেকে পাশ করা কাউকে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে চাকরি দেয়। এটাই ঘটতে যাচ্ছে। এইরকম প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
সবাইকে একই পথে চলতে হবে না। আমরা মনে করি, সমাজ আমাদের জন্য যে পথগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছে, সম্মান পাওয়ার জন্য সেগুলোই একমাত্র পথ। আপনি যদি ভার্সিটি থেকে একটি ডিগ্রী অর্জন করতে পারেন, তবেই আপনি সম্মান পাবেন। যদি আপনার কোন অফিসে চাকরি থাকে, তবেই আপনি সম্মান পাবেন। যদি অমুক অমুক কাজ করেন তবেই মর্যাদা পাবেন। কিন্তু যদি আপনি কৃষক হন তবে আপনার কোন সম্মান নেই। যদি আপনি ট্যাক্সি ড্রাইভার হন তবে আপনার কোন সম্মান নেই। যদি আপনি ম্যাকানিক হন আপনার কোন সম্মান নেই। আপনি যদি দোকানে চাকরি করেন আপনার কোন সম্মান নেই। কে এটা ঠিক করেছে? আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) কি এই মান ঠিক করে দিয়েছেন??? না।
আমরা যে ভেদাভেদ ভুলে নামাজে এক কাতারে দাঁড়াই তার কারণ আছে। নামাজের কোন কাতারে দাঁড়ানোর আগে আমরা চেক করি না যে আপনি কী চাকরি করেন। আমরা চেক করি না যে আপনি কত আয় করেন। إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ – “নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার।” (সূরা হুজুরাত-১৩)