আজ আমরা কী উদযাপন করছি? প্রতি বছর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল আমাদেরকে এভাবে একত্রিত করেন, দুই ঈদে- একটি হলো ঈদুল ফিতর আর এটি হলো ঈদুল আযহা। আর এই উভয় অনুষ্ঠানেই প্রতি বছর আমাদের একই বিষয় মনে করার কথা এবং একই বিষয়ের উপর চিন্তা-ভাবনা করার কথা। এটা নিশ্চয় এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের গোটা উম্মাহ তথা পৃথিবীর জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের প্রতি বছর এই ঐতিহ্য – আমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ) এর ঐটিহ্য – নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। আর এটি আসলেই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই পৃথিবীর সকল সভ্যতারই কোন না কোন উৎসব রয়েছে। যেমন, বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতা দিবস, সাংস্কৃতিক দিবস বা অন্য কোন উৎসবের দিবস। বাস্তবিকপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের অতিরিক্ত বেশী উৎসবের দিন রয়েছে। এক সপ্তাহ পর পরই কোন না কোন ছুটির দিন এসে উপস্থিত হয়, যেমন শ্রমিক দিবস, মেমোরিয়াল দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা অন্য কোন ধরণের দিবস।
এমনকি প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও আমরা বিভিন্ন উৎসব বা ধর্মানুষ্ঠানের সন্ধান পাই। যেখানে পুরো জাতি একত্রিত হয়ে বিভিন্ন উৎসব উদযাপন করে। সকল সভ্যতাতেই এই ধর্মানুষ্ঠানগুলোতে মানুষ একত্রিত হয়, সুখী সময় কাটায়। সাধারণত এই অনুষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকটিই কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ইতিহাস জুড়ে এটাই জাতিগুলোর প্রকৃতি। মানুষের উদযাপিত এই উৎসবগুলো বড় কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট যা সেই জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ।
আর সেই হিসেবে আমাদের দীনের ক্ষেত্রে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল আমাদেরকে বিক্ষিপ্ত কোন দিবস দেয়ার পরিবর্তে এই দুইটি ঈদ দান করেছেন। আর এই দুই দিন মুহাম্মাদ (স) এর গোটা উম্মাহ একসাথে উদযাপন করে। সারা পৃথিবীজুড়ে, সকল ভাষাভাষী মানুষ, সকল সংস্কৃতির মানুষ…আমরা একত্রিত হই এবং একসাথে উদযাপন করি। আর অবশ্যই এই সময়ে আমরা উত্তম পোশাক পরিধান করি, ভালো খাবার খাই, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাই এবং এই ধরণের আরও সুন্দর সুন্দর কাজ করি।
কিন্তু ঠিক একই সময়ে আমাদের এটা স্মরণ করা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে, কেন আমরা এই উৎসব উদযাপন করছি? এই দিবসটি আসলে আমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ) এর গ্রাডুয়েশন উৎসবের দিন। আল্লাহ বলেন – وَإِذِ ابْتَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ “যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি খুব কঠিন বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন।” ২ঃ১২৪ আল্লাহ যেভাবে ইব্রাহিম (আ) সম্পর্কে কুরআনে কথা বলেন সেভাবে অন্য করো সম্পর্কে বলেন না। অন্য কথায়, তিনি ইব্রাহিম (আ) কে এমনভাবে পরীক্ষা করেন যেভাবে অন্য কাউকে পরীক্ষা করা হয়নি, ইব্রাহিম (আ) এমনসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন অন্য কেউ যার সম্মুখীন কখনো হয়নি। আর তিনি সবগুলো চ্যালেঞ্জই সফলতার সাথে সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন। আপনাদের অনেকেই এই বিষয়টা জানেন।
আজকের খুতবা প্রধানত আপনার আমার জন্য সেই চ্যালেঞ্জগুলোর অর্থ কী? কারণ আমাদের সেই চ্যালেঞ্জগুলো স্মরণ করার কথা, শুধু এটা মনে করার জন্য নয় যে ইব্রাহিম (আ) কেমন অসাধারণ ছিলেন! বরং প্রকৃতপক্ষে এটা উপলব্ধি করার জন্য যে, আজকের দিনে সে চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের জন্য কী অর্থ বহন করে? এই বছর সেগুলো আমাদের জন্য কী মানে বহন করে? এভাবেই কুরবানীকে নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কথা।
আজ আমি ইব্রাহিম (আ) এর সামান্য কয়েকটি পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে চাই এবং বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনের সাথে তার সম্পর্ক তুলে ধরতে চাই। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল ইব্রাহিম (আ) কে এমন একজন যুবক হিসেবে উল্লেখ করেন যিনি ঐ সমাজের গৃহীত সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন। তিনি এমনসব কথা বলেন যেগুলো তৎকালীন রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল ভয়ংকর, সামাজিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং চরম অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু তিনি (আ) এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেন, চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন অন্য কেউ যেগুলো নিয়ে মুখ খুলতে প্রস্তুত ছিল না। আর তিনি এটা করেন খুবই তরুণ বয়সে। তাঁর পরিবার বা সমাজ কেউ এগুলো নিয়ে কথা বলতো না।
তরুণ তরুণীদের মাঝে একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো – তারা চায় সবাই তাদেরকে গ্রহণ করে নিক। আপনি আপনার চারপাশের অন্য সবার মত পোশাক পরতে চান, আপনি চান না যে আপনাকে অদ্ভুত দেখাক। আপনি সবার সাথে মিশে যেতে চান। আপনি এমনভাবে কথা বলতে চান যেন সবাই মনে করে যে আপনি এই গ্রুপের মাঝে গ্রহণযোগ্য। অথবা আপনি এই গ্রুপের সদস্য হওয়ার মত যথেষ্ট মজা করতে পারেন। কিন্তু যদি এমন হয় সবাই শুধু আপনাকে নিয়েই মজা করে, সবাই যদি বলে “তোমার কি মাথা খারাপ? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?” তখন আপনার মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকবে যে- না, আমার এটা করা উচিত না; আমার সবার সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
এটা এমন তরুণ-তরুণীদের ভঙ্গুর আত্ম-সম্মানবোধের অংশ, যারা নিজেদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর পরিবর্তে জনসমাগমের পিছনে গিয়ে লুকায়। আজকের দিনের স্কুল, কলেজগুলোতে এই চিত্র সহজেই চোখে পড়ে। স্কুল-কলেজেগুলোতে দেখা যায় তরুণরা তাদের বন্ধুদের মত পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করে। নিজেরদের জন্য পোশাক পছন্দের সিদ্ধান্তটা নিজের মত করে নেয় না। কাদের সাথে তাদের ঘোরা উচিত, কোন ধরণের ভাষা ব্যবহার করা উচিত, কোন ধরণের মিউজিক শোনা উচিত, কীভাবে ফ্রি সময় ব্যয় করা উচিত…… এই সব সিদ্ধান্তগুলো ‘পিয়ার প্রেসার’ (বন্ধু-বান্ধবদের চাপ) দ্বারা নির্ধারিত হয়। তারা মনে করে আমদেরকে মিশে যেতে হবে। বাচ্চাদের স্কুলের কেনাকাটা করতে নিয়ে গেলে তাদের সাথে পছন্দের ব্যাগ নিয়ে তর্ক করতে হয়। আমাকে এই ব্যাগটি কিনে দাও। কারণ আমাদের বন্ধুদেরও এই ব্যাগ আছে। এই ব্রান্ডের ব্যাগ পরলে তারা আর আমাকে নিয়ে টিটকারি করবে না।
এই প্রেক্ষাপটটি সামনে রেখে এবার ইব্রাহিম (আ) সম্পর্কে চিন্তা করুন। তিনি এই রকম একটি তরুণ বয়সে সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হওয়ার সম্ভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কারণ তাঁর আনুগত্য আল্লাহর জন্য, সত্যের জন্য। আরও বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হলো তিনি তাঁর পিতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। আমরা এই অসাধারণ কাহিনী থেকে জানতে পারবো যে, তিনি সঠিক ছিলেন। আর তাঁর পিতা যদিও বয়স্ক, তিনি তাকে বড় করেছেন, আর ইব্রাহিম (আ) তাঁর পিতাকে ভালোবাসতেন। এমনকি কুরআনে আল্লাহ এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ) বলেন – ‘ইয়া আবাতি…(হে আমার পিতা) ‘। আবাতি দ্বারা ভালোবাসা ইঙ্গিত করে। আমার পিতা যাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি, আমার প্রিয় বাবা। এমন নয় যে, তাঁর পিতা মুশরিক হওয়ার দরুন তিনি তাকে ঘৃণা করতেন। তিনি তাঁর পিতাকে আসলেই ভালবাসতেন, তাঁর পিতাই তাকে লালন-পালন করেছেন। তথাপি তিনি তাঁর পিতাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। কারণ তাঁর পিতা ভুলের উপর রয়েছেন। তিনি মূর্তি বানাচ্ছেন।
আজকের দিনে আপনি পাবেন যে, আপনার জীবনের অনেক অংশে…পরিবারের বয়স্ক সদস্যরাই ভুল কাজ করছেন। তারা সঠিক কাজ করছে না। অনেক সময় যদিও আমরা মুসলিম… আর আমাদের আনুগত্য হলো সত্যের প্রতি, সঠিক কাজের প্রতি, সত্য-ন্যায়ের প্রতি। আমরা এই আচরণ আঁকড়ে ধরে থাকি যে,
“তিনি আমার পিতা আমি তাকে কিছু বলতে পারবো না। এটা আমার মা, আমি তাকে কিছু বলতে পারবো না, এরা আমাদের বড়রা আমি কিছু বলতে পারি না। আমি শুধু স্রোতের অনুকূলে চলতে চাই। সবার আগে পরিবার।”
এই ক্ষেত্রে কীভাবে পরিবার সবার আগে? যদি আমি আপনি ইব্রাহিম (আ) এর ঐতিহ্য ধারণ করে থাকি। আমাদের আনুগত্য হলো ন্যায় এবং সত্যের প্রতি। তো, তিনি এমনকি তাঁর পরিবারকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত হয়ে যান। يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ “আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও।” ৪ঃ১৩৫। এটাই ইব্রাহিম (আ) এর ঐতিহ্য…এরকম একটি তরুণ বয়সেও। বাবা আমি আপনাকে ভালোবাসি, কিন্তু এটা ন্যায়সঙ্গত নয়, আমি এটা করতে পারবো না। সম্পর্ক এমন খারাপ হয়ে যায় যে, এটা শুধু আর মতানৈক্যের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি; তাঁর পিতা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তিনি এমনকি সেটাও মেনে নিলেন।