আপনি কি সত্যিই কুর’আনকে ভালোবাসেন

কিয়ামতের দিন স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহকে সরাসরি বলবেন,

وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا

(রাসূল (সাঃ) বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জাতির লোকেরা এ কুরআনকে পরিত্যক্ত গণ্য করেছিল।’)

এই আমার জাতি, নিঃসন্দেহে তারা এই কোরআনকে –এমনকি ‘হাজা’ শব্দটির ব‍্যবহারেও সৌন্দর্য‍্য লক্ষ‍্য করা যায়, যেটা ‘‘জালিকা’’ শব্দটির বিপরীত। (হাজা অর্থ এই, আর জালিকা অর্থ ঐ)। যেমনটি আপনি কোরআনের শুরুতে পড়ে থাকেন, (জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিইহি)। এখানে আল্লাহ বলেন নি ‘‘জালিকাল কোরআন’’ আল্লাহ বলেন, ‘‘হাজাল কোরআন’’– এই কোরআনটা এখানেই ছিল, তোমার সামনেই ছিল, তবুও তুমি তার প্রতি মনযোগ প্রদর্শন কর নি। এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেয়ামতের দিন অভিযোগ করে বলেন, আমার এই জাতি ‘‘এই’’ কোরআনকে, ‘‘ঐ’’ কোরআনকে নয়, এই কোরআনকে…। এই আয়াতে ‘‘হাজা’’ শব্দটির একটি অন‍্যতম পারিভাষিক বৈশিষ্ট‍্য হচ্ছে এরকম যে, যেন শেষ বিচারের দিন কোরআনকে সাক্ষী হিসেবে আনা হবে।

জানেন, আদালতে কিভাবে সাক্ষীদের হাজির করা হয়, তারপর সাক্ষী বা প্রামাণিক বস্তুকে সামনে রাখা হয় এবং প্রমানটিকে চিহ্নিত করে বলা হয় এই হচ্ছে তার প্রমান যে, ওই লোকটি আসামী। তাই শেষ বিচারের দিন স্বয়ং কোরআনই হবে প্রমান স্বরূপ। আপনার মামলার অবস্থা এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ ছিল এবং তার উপর কোরআনকে আনা হল সাক্ষী হিসাবে এবং সে সাক্ষী আনার ব‍্যাপারে উকিল হচ্ছেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)। এবং তিনি কোরআনকে চিহ্নিত করছেন এবং বলছেন এই লোকগুলো…আমার এই জাতিগুলো তারা এই কোরআনকে নিয়েছে ‘‘মাহজুরা’’ হিসাবে। আরবীতে মাহজুরা বলতে বুঝায়, আপনি কোনকিছু পুরোপুরি ভুলে গেছেন, আপনি কোনকিছুকে সম্পুর্ণরূপে অবহেলা করেছেন, আপনি তা অনেক পিছনে ফেলে রেখে এসেছেন। এখানে উর্দুভাষীরা হয়ত ‘‘হিজরা’’ শব্দটি চেনেন। সবাই চেনেন ‘‘হিজরা’’ শব্দটি কোনকিছুকে স্থানান্তর করা। আয়াতটি এমনকি ‘‘মাতরুকান’’ও বলে নি, ‘‘মাতরুকান’’ মানে পেছনে ফেলে রেখে আসা। আর ‘‘মাহজুরা’’ মানে বহুদূর পর্যন্ত পেছনে ফেলে রেখে আসা। তারা শুধুমাত্র কোরআনকে ছেড়েই দেয় নি, বরং তাকে অনেক দূরে পেছনে ফেলে রেখে এসেছে তারা তার ধারে কাছেও ছিল না। তারা শুধু তার কাছ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরেই সরে গিয়েছিল।

আমি নিজেকে ও আপনাদের সবাইকে আজকে একটি কথা স্মরণ করে দিতে চাই যে, কোরআন আমাদের কাছ থেকে যে ধরনের চরিত্র আশা করে আমরা যদি তা থেকে দূরে থাকি। তবে কোরআন তেলাওয়াত করা সত্ত্বেও আমরা কোরআন থেকে অনেক দূরে থাকবো। আমরা কোরআন থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা যদি তা পড়ার পর আমাদের চরিত্রের মধ‍্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ‍্য না করি, এটাই হচ্ছে বনী ঈসলাইলদের বৈশিষ্ট‍্য। (তারা তাওরাত বিষয়ে অনেক জ্ঞানী ছিল কিন্তু সেটা অনুযায়ী চলতো না।)

প্রসঙ্গত এটি হচ্ছে সূরা ফোরকান, কোরআনের ২৫তম সূরা, সূরাটি তেমন লম্বা নয়। তাই আপনারা বাসায় গিয়ে এর অনুবাদ পড়তে পারেন। এই সূরার চমকপ্রদ দিক হচ্ছে… এই আয়াতটি এর মধ‍্যবর্তী অংশ, কিন্তু যখন আপনি এর শেষে পৌঁছবেন শেষাংশের পুরোটাই হচ্ছে একজন মুসলিম হতে কী ধরণেরর চরিত্র আশা করা হয় সে সম্পর্কে, একজন মুসলিমের ব‍্যক্তিত্ব কিরূপ হওয়া উচিত। এটা কেন উল্লেখ করা হয়েছে? যখন রাসুল (সাঃ) অভিযোগ করেন যে, ওরা কোরআনকে পরিত‍্যাগ করেছে, কারণ যে ব‍্যক্তি কোরআনকে পরিত‍্যাগ করেন নি, তারঁ ব‍্যক্তিত্ত্ব ভিন্ন প্রকারের। তাঁদের ব‍্যক্তিত্ত্ব ভিন্ন ধরনের, তাঁদের চরিত্র ভিন্ন ধরনের, তাঁদের কার্যকলাপ ভিন্ন প্রকৃতির। এমনকি যাদের সাথে তাঁরা মেলামেশা করেন তারাও ভিন্ন। একই সূরায় রয়েছে যে যখন তাঁরা কোন বেহুদা কথোপকথনের সম্মুখীন হন, তখন তাঁরা ভদ্রভাবে তা পাশ কাটিয়ে চলে যান তাঁরা এর মধ‍্যে জড়াতে চান না। এমন কি তাঁরা বেহুদা সঙ্গ থেকেও দূরে থাকেন। এটা তাঁদের ব‍্যক্তিত্ত্বের প্রতিটি অংশকে প্রভাবিত করে। (আর আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করি) এটাই হচ্ছে কোরআনের বিসর্জন। আমি মনে করি যে এই উম্মাহ্ আমি আর আপনি নিজেদের ক্রমান্বয়ে দোষী করে ফেলছি এবং আমাদের এ ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত।

আমি এই আয়াতটি পড়ছিলাম… আমার মেয়ে বাসায় আমাকে কোরআন পড়ে শোনায়।
সে আয়াতটি পড়ছিল এবং তার উচ্চারণ দেখে দিচ্ছিলাম এবং সে তেলাওয়াত করছিল আমি পাশে বসেছিলাম এবং আমি কাঁদতে শুরু করলাম।
– সে বলল, ‘‘আব্বা তুমি কাঁদছ কেন ?’’
– আমি বললাম, ‘‘আল্লাহ যা বলেছেন তার কারণে।’’
– সে বলল, ‘‘তিনি কী বলেছেন?’’
– জানো, তিনি বলেছেন, ‘‘নবী করিম (সাঃ) কেয়ামতের দিন একটি দলের কোরআনকে ত‍্যাগ করার ব‍্যাপারে অভিযোগ করবেন।’’
তখন সে বলল, ‘‘কিন্তু আমরা তো কোরআনকে ত‍্যাগ করি নি, আমরা তো এটা পড়ছি।’’
এবং আমি বললাম, ‘‘মেয়ে আমার, এটা যদি শুধু পড়া সম্পর্কিত হত তাহলে অনেকটা সহজ হত।’’
এটা শুধু পড়াই নয়, এই কিতাবটিকে ভালবাসতে হবে। আমরা কি এটা প্রমান করতে পারব যে আমরা এই কিতাবটিকে নতুন কোন সিনেমার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসি? কোন ভিডিও গেইমের চেয়ে বেশী? আমরা কি এই কিতাবটির সাথে অন‍্য সবকিছুর চাইতে বেশী সময় অতিবাহিত করতে চাই? এই কিতাবটি আমাদের যে রকম হতে বলে আমরা কি সে রকম হতে চাই। অন‍্য কারো বা অন‍্য কিছুর মত হওয়া থেকেও বেশী? যুবক ছেলেরা নিজেদের শরীর বানাতে চায়, কারণ তারা পেশীসম্পন্ন একজনের ছবি দেখে। মেয়েরা কারো মত নিজেদের দেখতে চায়। মানুষ অন‍্য কারো মত অর্থ উপার্জন করতে চায়। মানুষ এ লোকগুলোকে আদর্শ হিসেবে নেয়। কে এই চরিত্রটিকে আদর্শ হিসেবে নেয়, যেটি কোরআনে সংগঠিত আছে, যেটি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)। ঘুমাতে যাবার আগে আমরা চিন্তা করি,‘‘ইস, আমার যদি সিক্স প‍্যাক থাকত!’’এরকম বলি না যে, ‘‘ইস, যদি আমার জীবনে আরো বেশী সুন্নাহ থাকত!’’এরকম কে বলে? কে? এভাবেই আমরা এই কিতাবকে পরিত্যাগ করছি।

আমাদেরকে আল্লাহর এই কিতাবটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার…এর প্রতি ফিরে আসার মত মানুষ হতে হবে। আল্লাহ আমাদের এই কিতাবকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং এটিকে আমাদের জীবনের বড় একটি অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে এই কিতাবের বরকতে আমাদের জীবনের সবকিছুই কল‍্যাণময় এবং জীবন্ত হয়ে ওঠে। মহৎ ও মহিমান্বিত আল্লাহ যেন সকল মুসলমানদের এই কিতাবকে যেভাবে বোঝা দরকার সেভাবে বুঝতে সহায়তা করেন। আল্লাহ যেন আপনাদেরকে পিতামাতা হিসেবে সাহায‍্য করেন শুধুমাত্র এ কিতাবকে ভালবাসার এবং বোঝার জন‍্যই নয় বরং আপনাদের সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারার মত তৌফিক দান করেন যাতে আপনাদের সন্তানেরা শেষ বিচারের আপনাদের পক্ষে সাক্ষী দিতে পারে। মহৎ ও মহিমান্বিত আল্লাহ যেন সাহায‍্য করেন মসজিদগুলোকে, স্কুলগুলোকে, হাফেজী মাদ্রাসাগুলোকে, সকল বাচ্চাদেরকে যারা কোরআন মুখস্থ করে আল্লাহ যেন তাদের শুধু কোরআন মুখস্থ করতেই সাহায‍্য না করেন বরং তার প্রত‍্যকটি শব্দ যেন তারা বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী চলতে পারে তার তৌফিকও দান করুন। নামাজ পড়ার সময় তারা যেন নিজের জিহ্বা দিয়ে না পড়ে মন থেকে পড়তে পারে। মহৎ ও মহিমান্বিত আল্লাহ আমাদের যেন আমাদেরকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন যাঁরা কোরআন অনুযায়ী চলেন এবং যাদের হৃদয়ে কোরআন বিদ‍্যমান। এই আয়াতগুলো যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়ছে তাদের বুকে অন্তর্নিহিত রয়েছে, কোরআন ব‍্যক্তির হৃদয়ে বাস করে।