ইসলামে চরমপন্থাঃ খারেজী থেকে আইএসআইএস (১ম পর্ব)

আমার প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, হুনাইন যুদ্ধের পর, যখন আমাদের রাসূল (স) যুদ্ধের গনিমাত বণ্টন করছিলেন … আমরা আমাদের সিরাত লেকচারে উল্লেখ করেছিলাম যে, সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে… এক লোক রাসূল (স) এর নিকট এলো। আর তার ছিল ঘন কোঁকড়া দাড়ি, সে ছিল এক বেদুঈন, তার ছিল লম্বা কপাল এবং কামানো চুল। যখন সে দেখল রাসূল (স) তাকে অন্যদের সমপরিমাণ মালামাল দিচ্ছেন না, তখন সে রাসূল (স) কে ন্যায্য না হওয়ার অভিযোগ করলো!! সে বলল – হে মুহাম্মাদ! ন্যায় বিচার করুন। সে রাসূল (স) কে তাঁর নামের প্রথমাংশ ধরে সম্বোধন করলো। এটা খুবই অসম্মানজনক। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের শরিয়তে রাসূল (স) কে তাঁর নামের প্রথমাংশ ধরে সম্বোধন করার অনুমোদন নেই। আমরা বলি ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া নাবিয়াল্লাহ।

কিন্তু বেদুঈন লোকটি এলো এবং রাসূল (স) কে কর্কশ এবং অসম্মানজনক ভাবে সম্বোধন করলো। তারপর বলল – “আল্লাহকে ভয় করুন, এবং ন্যায়বিচার করুন।” তখন রাসূলুল্লাহ (স) বললেন- “তোমার ধ্বংস হউক, এই পৃথিবীতে আমি যদি ন্যায়বিচার না করি, তাহলে কে ন্যায়বিচার করবে”। অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে তিনি বলেন – “যিনি আসমানে রয়েছেন তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন, আর তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না?” লোকটি তখন চরম ঔদ্ধত্য সহকারে সেখান থেকে উঠে চলে গেল। স্পষ্টতই এটা চরম পর্যায়ের ঔদ্ধত্য। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের ধর্মে রাসূল (স) কে কটাক্ষ করা এবং তাঁর প্রতি অন্যায্যতার অভিযোগ আনা কুফরি। সাহাবায়েকেরাম (রা) তাকে হত্যা করার অনমুতি চাইলেন। রাসূল (স) বললেন – তাকে ছেড়ে দাও। তোমরা তাকে হত্যা করতে সমর্থ হবে না। তার বংশধর থেকে, তার মন-মানসিকতা থেকে উদ্ভূত হবে অন্য এক দল। অন্য এক দলের আবির্ভাব হবে।

এদের বৈশিষ্ট্য কী? তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে, কিন্তু তাদের তিলাওয়াত কণ্ঠ ভেদ করে যাবে না। এটা একটি আরবি অভিব্যক্তি। এর মানে হলো – তারা কুরআন উপলব্ধি করতে সমর্থ হবে না। তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে। বাহিরের দিক থেকে দেখে তাদের মুসলিম মনে হবে। কিন্তু তারা এমনভাবে ধর্ম ত্যাগ করবে যেভাবে একটি তীর শিকার ভেদ করে চলে যায়। মনে করুন আপনি একটি হরিণ শিকার করছেন খুবই তীক্ষ্ণ আর ধারালো তীর ব্যবহার করে, যখন আপনি এটা ছুঁড়লেন তখন তীরটি শিকারের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাসূল (স) বললেন- “তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে যেভাবে একটি তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। যখন এই দলের আবির্ভাব হবে তখন যদি আমি জীবিত থাকি, তাহলে আমি তাদের ধ্বংস করবো যেভাবে আল্লাহ আদ জাতিকে ধ্বংস করেন। এই হাদিস থেকে আমরা একটি ভবিষ্যতবাণীর কথা জানতে পারি। আর সেই ভবিষ্যতবাণীটি হলো – আমাদের উম্মায় এমন একটি দলের আবির্ভাব হবে, আমাদের উম্মায় এমন সব মানুষের আবির্ভাব হবে, তারা মুসলিম হবে – আমরা বলছি না যে তারা মুসলিম নয় – আর তারা দাবিও করবে যে তারা মুসলিম। এবং তারা কুরআনও তিলাওয়াত করবে, কিন্তু আমাদের ধর্মের সত্যিকারের শিক্ষার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। ইবন তাইমিয়া এবং অন্যরা বলেন, দশটারও অধিক সহিহ হাদিসে এই দল সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। অন্য কোন দলের আবির্ভাব সম্পর্কে এতো বেশী বর্ণনা পাওয়া যায় না। অন্য কোন পথভ্রষ্ট দল সম্পর্কে আমাদের রাসূল (স) এতো ভবিষ্যতবাণী করেননি যতটা এই দল সম্পর্কে করেছেন।

অন্য আরেকটি বিখ্যাত হাদিসে আমাদের রাসূল (স) বলেন – আমার উম্মাতের মাঝে বহু মতপার্থক্য তৈরি হবে। এই সব দলের মাঝে এমন একটি দল ভবিষ্যতে আসবে যাদের বক্তব্য হবে সেরা বক্তব্য, তারা সুন্দর সুন্দর কথা বলবে, কিন্তু তাদের কাজ কর্ম হবে জঘন্য। তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করবে না, তারা ধর্ম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর তার শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা হলো সৃষ্টির নিকৃষ্ট। আমাদের রাসূল (সা) এই দলটিকে বলেছেন সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যদিও এর ঠিক আগেই তিনি বলেছেন যে, তারা কুরআন পড়ে থাকে। সুতরাং, এরা অমুসলিম নয়, যাদের সম্পর্কে তিনি বলছেন। এরা এমন ধরণের মানুষ যারা কুরআনে বিশ্বাস করে এবং কুরআন পড়ে। আর এই হাদীসে রসূল (সা) বলেছেন, তারা আল্লাহর কিতাবের প্রতি আহ্বান করে, কিন্তু তাদের আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তারা শরীয়ার প্রতি আহ্বান করে, কিন্তু শরীয়ার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

রাসূলের (স) কথাগুলোর প্রতি খেয়াল করুন। তিনি এমন একটি জনসমষ্টির ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করছেন, যারা আল্লাহর কিতাব, শরীয়ার প্রতি আহ্বান করছে, কিন্তু স্বয়ং তিনিই বলেছেন, তাদের শরীয়ার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আর রাসূল (সা) বলেছেন, যারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তারাই ঐ দলটির তুলনায় আল্লাহর কিতাবের বেশী নিকটবর্তী। অর্থাৎ, যারা এই দলটির বিরোধীতা করবে, তাদের সাথে শরীয়ার সম্পর্ক বেশী ঐ দলটির তুলনায় যারা শরীয়ার দিকে আহ্বানের দাবী করছে। অন্য একটি হাদীসে রাসূল (স) বলেছেন, শেষ যুগে এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে… বয়সে নবীন এবং নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ স্বপ্ন সহযোগে। সুতরাং এই দলটি এমন হবে না যে তারা হবে উম্মাহর প্রবীণ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে বিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা কোনটাই থাকবে না। তারা জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী হবে না। তারা হবে অতিউৎসাহী স্বভাবের একদল নবীন।… যাকে আমরা আমাদের ভাষায় বলি, একদল শিশু। কম বয়সের, কিশোর – তরুণ, ২০/২৫ বছরের, ….। ২০ বছর বয়সে আপনার নেতা হওয়ার কথা না, আপনি একটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা না যখন জীবন সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। না, শুধু তাই নয়।…। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো হলো সবচেয়ে অদ্ভুত আর আজগুবি। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো পুরোপুরি অবাস্তব। তা সত্ত্বেও তাদের কথাগুলো মধুরতাপূর্ণ।….। তাদের কথা শুনলে, সে কথার মাধুর্যে আপনি সম্মোহিত হয়ে যাবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রাসূল (স) বলেছেন যে, তারা ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর তার শীকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।…

আমাদের রাসূল (সঃ) আরও বললেন – অর্থাৎ, তাদের নামাজ যখন দেখবেন, তখন আপনার নামাজকে মনে হবে খুবই মূল্যহীন, আর আপনার কুরআন তিলাওয়াতকে তাদের তুলনায় মূল্যহীন মনে হবে, আর আপনার ধমর্ পালনকে মনে হবে মূল্যহীন যখন আপনি এদেরকে দেখবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রাসূল (স) বলেছেন, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই , তাদের সাথে আমার কোন সম্পকর্ নেই। আর সর্বশেষ হাদীস যেটা বর্ণনা করবো, আমাদের রাসূল (স) বলেছেন যে, এই লোকেরা হলো আমার উম্মাহর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, আর যারা তাদেরকে হত্যা করবে অথবা তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করবে, তারা হলো উম্মাহর মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। হাদীসটি রয়েছে আল-বায্যার এবং অন্যান্য গ্রন্থে। তো, রাসূল (স) তাদেরকে বলেছেন উম্মার সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এই সকল লোকেরা কে, এরা কারা ? দশটিরও বেশি হাদীস আছে এই অতীউৎসাহী গোঁড়াদের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী সহকারে। দশটির উপরে হাদীস, প্রত্যেকটিই এই সকল লোকেদের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে।

তারা হলো বয়সে তরুণ, তারা হলো ক্ষমতালোভী (upstartish), মূর্খতাপূর্ণ, তাদের স্বপ্নগুলো হলো অবাস্তব, তারা চমকপ্রদ কথা বলে, প্রত্যেক হাদীসেই তাদের কথার ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তাদের কথাগুলো সম্মোহনকারী। অর্থাৎ, তারা ভালোর দিকে আহ্বান করে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে তারা শরীয়ার দিকে আহ্বান করে, তারা ডাকে আল্লাহর কিতাবের দিকে, তারা ডাকে ইসলামের দিকে, কিন্তু তাদের কাজের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।