মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগের আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি

খলিফা হারুন অর রশিদ, তিনি তখন রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন, আমির উল মু’মিনিন। সেই সময় আমির উল মু’মিনিনগণ সালাতের ইমামতি করতেন, বিশেষভাবে হজ্বের সময়। এরকম এক সময় তিনি হজ্ব পালন করতে গেছেন, তাহলে কে তখন ইমামতি করবেন? আমির উল মুহ’মিনিন হিসেবে তিনিই ইমামতি করবেন। যাই হোক, তিনি প্রথম কাতারে ছিলেন। কারণ তিনি ইমামতি করবেন। আর তিনি ছিলেন হানাফি মাজহাবের অনুসারী। উনার হজ্বের যিনি মুয়াল্লিম ছিলেন, আপনারা তো জানেনই মুয়াল্লিম কাকে বলে – মুয়াল্লিম হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি আপনাকে হজ্বের বিভিন্ন নিয়মকানুনগুলো সঠিকভাবে শিখিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই আমির উল মু’মিনিনের মুয়াল্লিমও হানাফি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। তিনি ছিলেন কাজী ইউসুফ, হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা। ইমাম আবু হানিফার সবকিছু উনিই লিপিবদ্ধ করতেন। যাইহোক, এই কাজী ইউসুফই ছিলেন আমির উল মুহ’মিনিনের মুয়াল্লিম। পৃথিবীর বুকে হানাফি মাজহাবের সবচেয়ে বিজ্ঞ যে আলেম তিনি হচ্ছেন তাঁর মুয়াল্লিম! তাঁরা দুজনেই সামনের কাতারে আছেন এবং আমির উল মুহ’মিনিনের একটু পরেই সালাতের ইমামতি করার কথা।

কিন্তু খলিফা হারুন অর রশিদ, হিজামা করিয়েছেন। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই হিজামা কি। হিজামা হচ্ছে এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেটা কাপিং এর মাধ্যমে করা হয় এবং এর ফলে শরীর থেকে রক্ত বের হয়। এখন, হানাফি মাজহাব অনুসারে শরীর থেকে রক্ত বের হলে অজু নষ্ট হয়ে যাবে। খলিফা হারুন অর রশিদ একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি জানতেন যে তিনি যদি আবু ইউসুফকে এখন জিজ্ঞাসা করেন যে আমার অজু কি নষ্ট হয়েছে কি না? তাহলে আবু ইউসুফ কি বলবেন? বলবেন যে, হ্যাঁ, অজু নষ্ট হয়ে গেছে। আর সে ক্ষেত্রে তাঁকে এখন প্রথম কাতার থেকে বের হয়ে, সবগুলো কাতার পার হয়ে অজুখানায় যেয়ে অজু করতে হবে। এরপরে, আবার সেই পেছন থেকে প্রতিটি কাতারে বিভিন্ন মানুষজনের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে সামনের কাতারে ফেরত আসতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে যে সময় লাগবে তাতে করে আসরের ওয়াক্ত পার হয়ে মাগরিবের সময় হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁকে তো তখনই সালাতের ইমামতি করতে হবে এবং তিনি যদি আবু ইউসুফকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে উনি বলবেন যে আপনার সালাত আদায় হবে না, কারণ আপনার অজু নেই!

ঘটনাচক্রে ইমাম মালিকও প্রথম কাতারে ছিলেন। এমতাবস্থায় খলিফা উদ্দেশ্যপ্রনেদিতভাবে ওনার নিজের মুয়াল্লিমকে এই বিষয়ে না জিজ্ঞাসা করে, ইমাম মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন। কারণ, মালিকি মাজহাব অনুসারে, রক্তপাত হলেও অজু ভঙ্গ হয় না এবং খলিফা এটা জানতেন! তাই তিনি ইমাম মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা আমি যে কাপিং করালাম, আমার অজু কি নষ্ট হয়েছে? ইমাম মালিক বললেন, না না, আপনার অজু ভঙ্গ হয় নি; দয়া করে জামাতের ইমামতি করুন! ফলশ্রুতিতে খলিফা হারুন অর রশিদ ইমামতি করলেন হজ্বের সময়ের সেই বিশাল জামাতের! কাজী আবু ইউসুফ, ইমাম মালিক দুজনেই সেই জামাতে ওনার পেছনে ছিলেন। আর কাজী ইউসুফ ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত স্কলারদের মধ্যে অন্যতম। যার কারনে তিনি একা হজ্বে আসেন নি, তাঁর সাথে অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন যারাও হজ্ব করতে এসেছেন। সেই শিক্ষার্থীরা কিন্তু পেছনে ছিলেন, তারাও এই ঘটনা ঘটতে দেখলেন এবং নামাজ পড়ছিলেন। আর নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরা দৌড়ে কাজী ইউসুফের কাছে গেলেন এবং বললেন, আমরা কি আবার সালাত আদায় করবো? আপনি কিভাবে ওনাকে কাবার সামনে, অজু ছাড়া, ইমামতি করতে দিলেন? তখন কাজী আবু ইউসুফ, যিনি কিনা হানাফি মাজহাবের অনুসারী, তাঁর শিক্ষার্থীদের বললেন – ‘যে পুনরায় সালাত আদায়ের দুঃসাহস দেখাবে, সে খাওয়ারিজদের অন্তর্ভুক্ত। সে বা তাঁরা এই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।’

কেন তিনি এইরকম বললেন? কারণ ফতোয়া নিয়ে তাঁর চিন্তার প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন ছিল। ওনার চিন্তার প্রকৃতি এইরকম ছিল যে, রক্তপাত এর সাথে অজু নষ্ট হওয়ার বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয় নি। এটি এমন একটি বিষয় যেটা নিয়ে গবেষণা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন আমাদের গবেষণা অনুসারে অজু নষ্ট হবে। আর ইমাম মালিকের গবেষণা অনুসারে অজু নষ্ট হবে না। এটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত গবেষণার ফলাফল। কুরআনে এমন কোন আয়াত নেই যেখানে বলা হয়েছে যে রক্তপাত হলে অজু নষ্ট হবে, এমন কোন হাদিসও নেই যেখানে বলা হয়েছে রক্তপাতের কারণে অজু নষ্ট হয়। তাই আমরা কেউই এই নিয়ে তর্ক করতে পারি না যে আমার প্রাপ্ত ফলাফলটিই সঠিক, কারণ এটা একান্তই আমার সীমিত জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত ব্যক্তিগত মতামত। যার ফলে আমি কিন্তু এটাও জানি না যে আমি সঠিক কি না আর উনি ভুল কি না। আর এটা নিয়ে তর্ক করতে যেয়ে আমি যে মূলনীতি জানি – ‘ ঐক্য হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি’, সেটাকে বিসর্জন দিতে পারবো না। إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ (মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই), ‘وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ‘(এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়।) এগুলো হচ্ছে মূলনীতি। নিজের ফতোয়ার প্রতি অনড় থাকতে যেয়ে আমি এই মূলনীতিকে অমান্য করতে রাজি নই।

এরকম ছিল তাদের চিন্তা ভাবনা। এভাবেই ওনারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতেন। আপনি যদি ফিকাহ নিয়ে পড়াশোনা করেন তাহলে দেখবেন, সেখানে কেউ যখন অন্য আরেকজনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন তখন শুরুতে তিনি যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন তাঁর জন্য দোয়া করে এক পৃষ্ঠা লেখেন, এর পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন যে কেন তিনি একমত নন। একইভাবে অপরজন যখন এর উত্তর দিতেন, তখন তিনি ও এইভাবে বলতেন যে, আপনার দোয়ার জন্য ধন্যবাদ এবং আপনার জন্যও নিন্মোক্ত দোয়া রইল। আর এই হচ্ছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা যে কারনে আমি আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।