কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ২৪)

আমরা যখন কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করি, আমাদের খুশু থাকা উচিত কারণ আমরা আল্লাহর কালাম বা কথা পড়ছি। আমরা যখন সিজদায় যাই, আমরা জানি আল্লাহ আমাদের প্রার্থনার জবাব দেন, তাই আমরা বেশী মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করি। তাহলে রুকুতে আমাদের মনের কি অবস্থা থাকা উচিত?

আত্মার চাহিদা পূরণ

আমাদের সবারই কিছু প্রাত্যহিক চাহিদা আছে। একজন বাবা অপেক্ষায় থাকেন কখন কাজ থেকে ঘরে ফিরে শিশু সন্তানকে আলিঙ্গন করবেন, সন্তান যদি ঘুমিয়েও থাকে, বাবা অন্ততঃ একটি চুমু খান মনের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য। যখন আমরা খুব বেশী ক্ষুধার্ত থাকি, আমরা মাঝে মাঝে বেশী ক্লান্ত বা খিটখিটে হয়ে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না কিছু খেয়ে নেই। ঠিক যেমন আমাদের মনের ও শরীরের চাহিদা আছে, আমাদের আত্মারও কিছু চাহিদা আছে। সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের জন্য আত্মা তৃষ্ণার্ত থাকে। অনেকেই বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভব করেন, আর সেটাকে পূরণ করার জন্য অন্য কিছুর সন্ধান করেন। কিন্তু যেমন একজন ক্ষুধার্ত মানুষ দৌড়িয়ে তার ক্ষুধার চাহিদা মেটাতে পারে না- তা অবাস্তব; ঠিক তেমনি এই আত্মার তৃষ্ণাও সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ছাড়া অন্য কিছুতে মেটানো সম্ভব না।

রুকুর মাধ্যমে বিনম্রতা

আত্মার বিনম্রতার মাধ্যমেই সত্যিকারের আনুগত্য সম্ভব, আর রুকু তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। হাকিম বিন হিজাম নামক জনৈক আরব ইসলাম কবুল করার সময় রাসুল (সাঃ) কে বলেছিল যে, সে সমস্ত নির্দেশ পালন করবে শুধু নামাজের সময় রুকু করা ছাড়া, কারণ তাতে বিনীত হতে হয়। কাজেই আমরা যখন রুকুতে যাবো, আমরা সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখব যেন রুকু অবস্থায় আমাদের মেরুদণ্ড ঠিক মতো সোজা থাকে (মাটির সাথে সমান্তরাল), মাথা ঠিক মতো যথেষ্ট নোয়ানো থাকে, এবং “সুবহানা রব্বিআল ‘আযীম” (আমি আমার মহার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি) কথাটির উচ্চারণ যেন আমাদের মনের গভীর বিশ্বাস থেকে হয়।

যখন আমরা বলি “সুবহানা রব্বিআল ‘আযীম”, আমরা আল্লাহর সুবহানা ওয়াতা’আলার একত্ববাদও প্রকাশ করছি। ‘রব’ শব্দটি একাধিক অর্থ প্রকাশ করে- রব বলতে বোঝায় মালিককে, রক্ষাকর্তাকে, পালনকর্তাকে। আমরা যখন চিন্তা করি আমাদের যা যা আছে তা নিয়ে- আমাদের পোশাক, আমাদের সম্পদ, আমাদের সুস্বাস্থ্য, আমাদের প্রিয়জন- কে দিয়েছেন? তখন আমরা কিভাবে আমাদের রবের সামনে অবনত না হয়ে পারি? আর কিভাবেই বা আমরা তাঁর সাথে সেই বিশেষ অন্তরঙ্গতা অনুভব না করে পারি যে- তিনিই ‘রব্বী’, ‘আমার রব’?

মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা

রাসুল ﷺ বলেনঃ

أما الركوع فعظموا فيه الرب

“তোমরা রুকু অবস্থায় মহান প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করবে” (মুসলিম ৯৬৭, ইফা)
আপনি যখন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানবেন, আর মহিমা বর্ণনাকারী কথাগুলো অন্তর থেকে প্রতিফলন ঘটাবেন, তখন আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত সবকিছুর প্রতিই আপনার মনে যেন গভীর শ্রদ্ধা থাকে। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ

ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ

এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটাতো তার তাক্বওয়ারই বহিঃপ্রকাশ। (সূরা হাজ্জঃ ৩২)
কাজেই রুকুতে গভীর শ্রদ্ধাবোধ অন্তরের তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থেকেই আসে, আর আমরা সবাই যেন সেই তাক্বওয়া অর্জনে সচেষ্ট হতে পারি ইনশাআল্লাহ। ইবনে আল কায়্যিম বলেছেন, রুকু হল অনেকটা সিজদার ভূমিকার মতই, যেখানে আমরা এক স্তর থেকে আরেক গভীরতর স্তরে আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হই। রুকুতে বিনয়াবনত হওয়ার এই প্রচেষ্টায় আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালবাসা আরও বৃদ্ধি পায়। এবং সেই বিখ্যাত হাদীসে কুদসীটি আমরা এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারি-

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “যখন বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তখন আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যখন সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় তখন আমি তার দিকে দু’হাত অগ্রসর হই। আর যখন সে আমার দিকে হেঁটে আসে তখন আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” (বুখারীঃ ৭৫৩৬, মুসলিমঃ ২৬৭৫)
আমরা যখন আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বেশী বেশী নেক আমল করি, আল্লাহ আমাদেরকে ভালবাসেন, আর আল্লাহর ভালবাসার চেয়ে বেশী আর কি চাওয়ার আছে আমাদের? একারণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর রুকু দীর্ঘ করতেন, এমনভাবে যে তাঁর রুকু, রুকুর পর উঠে দাঁড়ানো, তাঁর সিজদা, এবং দুই সিজদার মাঝখানের বসার সময়টুকু প্রায় সমপরিমান দীর্ঘ হত। মনে রাখবেন, তাঁর রুকু দৈর্ঘ্যও রুকুর আগের তিলাওাতের সময়ের দাঁড়ানোর সমান হত। আর মাঝে মাঝে তিনি এক রাকা’আতে দাঁড়িয়ে একটানা সূরা বাক্বারা, সূরা নিসা, সূরা আল-ইমরান তিলাওয়াত করে শেষ করতেন, এবং তা ধীরে ধীরে থেমে থেমে পড়তেন (সহীহ মুসলিমঃ ১৬৯১, ইফা)।

মুসলিম বিন মাক্কী একবার আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের (রাঃ) এর নামাজের কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে রুকুতে যেতে দেখলাম। ঐ সময় আমি সূরা বাক্বারা, সূরা আল-ইমরান, সূরা নিসা ও সূরা মায়িদা তেলাওয়াত শেষ করে দেখলাম তিনি তখনও সেই রুকুতেই আছেন।’

সুবহানআল্লাহ !!!

আমরা অনেকেই হয়তো এতে অনুপ্রাণিত হবো, কিন্তু অনেকেরই মনে হবে, ‘আমি কখনই ঐ পর্যায়ে পৌছতে পারব না’ এবং এই জন্য কোনদিন চেষ্টাও করবেন না। তবুও, একবার মনে করুন সেই হাদিসে উল্লেখিত আল্লাহর বান্দার কথা যে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় এক বিঘতই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। যতক্ষণ আমরা আমাদের নামাজের উন্নতি সাধনের জন্য চেষ্টা করব, ততক্ষন অন্ততঃ হাদিসটির এই অংশটুকু আমাদের বাস্তবায়িত হতে থাকবে।

আল্লাহ যেন আমাদের রুকুর মাধুর্য আস্বাদনের তৌফিক দেন। আমীন

অনুবাদ করেছেন QuranerAlo.com – কুর’আনের আলো