কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ১-৭)

(পর্ব ১)

পরম করুনাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে

সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া আল্লাহ তায়ালার জন্যে, এবং অজস্র দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক সকল নবী রাসুল গনের উপর|

বেশ কিছুদিন আগে, কুয়েতী দা’য়ী মিশারী আল-খারাজ এর উপস্থাপনায় ”كيف تتلذذ بالصلاة؟” নামে একটি আরবি প্রোগ্রাম প্রচারিত হয়েছিল যার মানে হলো: “কিভাবে নামাজের মধুরতা আস্বাদন করা যায়?” আমা…দের প্রায় সবারই নামাজের ‘খুশু’ কমবেশি হয়ে থাকে| খুশু কী? এটা আসলে অন্তরের বা মনের একটি অবস্থা যা নামাজে প্রশান্তি, গাম্ভীর্য ও বিনম্রতা বজায় রাখে; যা হৃদয় থেকে বর্ষিত হয়ে আমাদের আল্লাহর সামনে বিনম্র ও আম্ত্মসমর্পিত করে|

কোন কোন সময় নামাজে আমাদের আরাধনা এমন হয় যেনো আমরা প্রতিটা শব্দ কে ভেতর থেকে অনুভব করি; আবার অন্য সময় নামাজ শুধু নিয়ম মেনে উঠাবসা ছাড়া আর কিছুই হয় না| ইনশা-আল্লাহ, আমরা আগামী কিছুদিন নামাজের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করব|

এক আনসারী ও এক মুহাজির এর কাহিনী:

সুনানে আবু দাউদ থেকে হাসান সনদে বর্ণিত; কোন একটি যুদ্ধের সময় নবী(সা:) দুজন পাহারাদার নিয়োগ করেন, তাদের একজন ছিলেন মুহাজিরীন, আরেকজন ছিলেন আনসার| একটা সময় আনসারী সাহাবী নামাজের জন্য উঠে পড়লেন অপরদিকে মুহাজিরীন সাহাবী তখন ক্লান্তিতে তন্দ্রা মতো এসেছিলেন| এই সময় প্রতিপক্ষের এক মুশরিক এই অবস্থা দেখে সুযোগ বুঝে আনসার সাহাবীর দিকে তীর ছুড়ে মারেন| এটা তাঁর গায়ে লাগে, কিন্তু তবুও কষ্ট করে তীর বের করে রক্তাক্ত অবস্থায় নামাজ চালিয়ে গেলেন| এটা দেখে ঐ মুশরিক আবার তীর নিক্ষেপ করলেন| আবারও আনসার সাহাবী তীরটি অপসারণ করে নামাজ চালিয়ে গেলেন| কিন্তু যখন তৃতীয় তীর আঘাত হানল; তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না এবং তিনি রুকু এবং সেজদায় চলে গেলেন, এর মাঝে মুহাজিরীন সাহাবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়(মুশরিক তা দেখে পালিয়ে যায়), এবং তাঁর সাথীর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন “সুবহান-আল্লাহ! যখন প্রথম সে তোমাকে আঘাত করেছিলো আমাকে কেন ডাকলে না?” আনসারী সাহাবীর উত্তর ছিল, “আমি তখন এমন একটি সুরা তিলাওয়াত করছিলাম যা আমি ভালবাসি, আর আমি সেটা থামাতে চাচ্ছিলাম না|” আল্লাহ আকবার, আমাদের পক্ষে কী কল্পনা করা সম্ভব কী পরিমান আবেগ ও নিষ্ঠা ছিলো তাঁর নামাজে?

নামাজের মধুরতা:

নামাজ হল সর্বোত্তম ইবাদত| যখন কেউ নামাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে সালাম ফেরায়(তাসলিম) তখন সে নিশ্চিত ভাবেই এক প্রশান্তি লাভ করে| ইবনে আল যাওজী নামাজের ব্যাপারে বলেন:
إنا في روضة طعامنا فيها الخشوع و شرابنا فيها الدموع

“আমরা এমন এক উদ্যানে অবস্থান করি যেখানে আমাদের খাদ্য হল খুশু আর পানীয় হল অশ্রু”
যে নামাজে পূর্ণভাবে আরাধনা করে তার আত্মা তার কাছে আর থাকেনা; যেমন ইবনে তায়মিয়্যাহ বলেন, তার রুহ আসলে আল্লাহর আরশের তাওয়াফ করতে থাকে|

কেউ একথা বলতে পারেন যে এরাতো আগের জামানার মানুষ| এখন কেউ এরকম অনুভব করেন না| কিন্তু এ কথা মোটেও সত্য নয়; যে কেউ নামাজের এই অমৃতসুধার সন্ধান পেতে পারে, আর এর জন্য দরকার নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং খুশু অর্জনের রহস্য উন্মোচন করা| আর এর মাধ্যমেই নামাজ হতে পারে আমাদের সব কিছুর সমাধান; সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ও হতাশার ঔষুধ, এমন কিছু যার মাঝে আমরা পরম প্রশান্তি লাভ করি; এমন কিছু যা আমরা চাই কখনও শেষ না হোক|

চলুন তাহলে শুরু করি রহস্য উন্মোচন এবং আল্লাহর সাথে কথোপকথন|

১: প্রথমত আমাদের যে কাজটি করতে হবে সেটা হলো খুশু সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিবর্তন করতে হবে| খুশু মানে শুধু এই না যে আপনি খুবই কষ্ট করে এমন মনোনিবেশ করেছেন যে আপনাকে আর ভিন্নমুখী করা সম্ভবই নয়| একাগ্রত হৃদয় বা মন হল খুশুর প্রথম স্তর| অনেকটা এরকম যে আপনি কেবল একটি বাড়ির দরজা খুলেছেন, এখনো পুরো বাড়িটা দেখা বাকি আছে| খুশুর গভীরতা অসীম|
অনেকেরই এটা মনে হয় যে মনকে একাগ্রত করা, নিজের চিন্তা চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা খুবই কঠিন কাজ| এই ধারনাকে নির্মূল করতে নামাজে আসার সময়ই আমাদের নামাজের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আসতে হবে| ধরা যাক আমাদের প্রতি নামাজে ১০ মিনিট সময় লাগে| মানে দিনে ৫০ মিনিট; এক ঘন্টাও না| বাকি তেইশ ঘন্টা আমার দুনিয়ার জন্য| এই পঞ্চাশটা মিনিটও কী আমরা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য দিতে পারিনা? এইটুকু সময়েও কী আমরা দুনিয়ার জিনিস নিয়ে ভাববো?

নামাজ শুরুর আগে এই কথা গুলো মনে মনে ভাববেন, যাতে আমাদের নফস আমাদের এই বলে ধোঁকা দিতে না পারে যে “নামাজে মনোযোগ দেয়া খুবই কঠিন”-কারণ এটা খুবই সম্ভব একটা কাজ; মনে রাখা উচিত আল্লাহর সামনে দাড়ানোর আনন্দ/মিষ্টতা দুনিয়ার যেকোনো প্রলোভনের চেয়ে অনেক অনেক আকাঙ্ক্ষিত, অনেক সুখের| শুধু একবার তা অনুভব করলে আর কিছুতেই মন উদাস হবে না|

নামাজের গভীরতা:

নামাজের আসল স্বাদ আস্বাদনের অন্যতম একটি উপায় হলো; নামাজ বুঝে বুঝে পড়া| কী তিলাওয়াত করা হছে তা বোঝা ও তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা| ঐ প্রোগ্রামটিতে, মিশারী আল-খারাজি বলছিলেন: “চলুন পরিচয় করিয়ে দেই নামাজে আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীকে|” জানেন কাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন?

মসজিদের একটি স্তম্ভ(pillar)কে! জি হ্যাঁ, মসজিদের মাঝে দাড়িয়ে থাকা স্তম্ভ| যেকোনো স্তম্ভ; তা সে বাড়িতেই হোক, অফিসে হোক আর মসজিদেই হোক তা আপনার প্রতিযোগী|কেন?

কারণ যদি আপনি নামাজে দাড়িয়ে থাকেন, স্তম্ভ আপনার চেয়ে বেশি সময় দাড়িয়ে থাকে| যখন সিজদা
করেন, আপনার চেয়ে বেশি সময় ধরে সিজদাহ করে সেই স্তম্ভ| যখন তাসবীহ পরেন, এটা আপনার চেয়ে অনেক বেসি তাসবীহ পড়ে| কিভাবে? আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:

وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ

“তাঁর পবিত্রতা তো বর্ণনা করছে সাত আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে সব জিনিসই৷ এমন কোনো জিনিস নেই যা তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে না, কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তন বুঝতে পারো না,” [সুরা বাণী ইসরাইল ১৭:৪৪]
এবং

أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يَسْجُدُ لَهُۥ مَن فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَن فِى ٱلْأَرْضِ وَٱلشَّمْسُ وَٱلْقَمَرُ وَٱلنُّجُومُ وَٱلْجِبَالُ
وَٱلشَّجَرُ وَٱلدَّوَآبُّ وَكَثِيرٌۭ مِّنَ ٱلنَّاسِ ۖ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ ٱلْعَذَابُ

“তুমি কি দেখো না আল্লাহর সামনে সিজদানত, সবকিছুই যা আছে আকাশে ও পৃথিবীতে- সূর্য, চন্দ্র, তারকা, পাহাড়, গাছপালা, জীবজন্তু এবং বহু মানুষ ও এমন বহু লোক যাদের প্রতি আযাব অবধারিত হয়ে গেছে? আর যাকে আল্লাহ লাঞ্ছিত ও হেয় করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই আল্লাহ যা কিছু চান তাই করেন৷” [সুরা হাজ্জ ২২:১৮]
যদি আমরা পিলারকে জিগ্যেস করি, তোমরা কী বুঝো? তা কখনই উত্তর দিতে পারবে না| এখন যদি আমরা আমাদের জিগ্যেস করি- আমরা তাদের চেয়ে কতটা বেশি ভালো? যখন আমরা বলি “সামি’আল্লাহু লিমান হামিদা” এর মানে কী? কিংবা তাহিয়্যাত(আত্তাহিয়াতু)ই বা কী বোঝায়? শুধু শাব্দিক অর্থই নয়; এগুলোর সুনির্দিস্ট অর্থ কী? এগুলো বলার কারণ ও উদ্দেশ্যই বা কী? ইনশা-আল্লাহ আগামী পর্বগুলোতে আমরা নামজের প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করব যাতে আমরা খুশু অর্জন করতে পারি|

শেষ কথা….

এ কথা বলা ঠিক হবে না যে “কিন্তু…আমি পারিনা!” আল্লাহ কিভাবে আমাদের খুশু অর্জনের কথা বলতে পারেন যদি তা অসম্ভবই হবে? আল্লাহ তায়ালা উদার; তাঁর উদারতার সীমা নেই, আমাদের কল্পনার বাইরে; আমরা যদি তাঁর দিকে এক পা অগ্রসর হই, তিনি আমাদের দিকে ছুটে আসবেন| আল্লাহ বলেন:

وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ

“যারা আমার জন্য সংগ্রাম- সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো৷ আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন৷” [সুরা আনকাবুত ২৯:৬৯]
তাই বিসমিল্লাহ(আল্লাহর নামে) ও ইনশা-আল্লাহ, চলুন পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ আমাদের সবার খুশু বাড়িয়ে দেন এবং নামাজের প্রশ্নটিকে উপলব্ধি করার তৌফিক দেন| আমীন|

(পর্ব ২)

আবু নুয়াস এর তাওবা:

আবু নুয়াস এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যে কিনা খুব মদ পান করতো এবং অশ্লীল কথাবার্তা বলতো; সে বিভিন্ন অসংলগ্ন বিষয় কল্পনা করে নিয়ে কবিতা বানাতো ও
তা আবৃতি করে বেড়াতো| যাইহোক, সে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করে| মানুষজন এতে খুব অবাক হয় যে- “আবু নুয়াস? যে কিনা মাতাল হিসেবেই সবার
কাছে পরিচিত? যে কিনা একটা লম্পট?” এটা একরকম সবারই বিশ্বাস ছিলো যে আল্লাহ তাকে কখনই ক্ষমা করবেন না, আল্লাহ তার প্রতি করুনা করবেনই না| তাই সে নতুন একটি কবিতা রচনা করে- যেটা তার মৃত্যুর পর তার বিছানার নিচে থেকে পাওয়া যায়: কবিতার বাণী গুলো অর্থ অনেকটা এরকম ছিলো—

“হে আমার রব, যদিও আমার পাপ অসংখ্য কিন্তু আমি জানি তোমার ক্ষমা তার চেয়েও অনেক বিশাল
যদি শুধু পুণ্যবানরাই তোমাকে ডাকে, তুমি কী অপরাধীদের ফিরিয়ে দিবে?
হে আমার রব আমি তোমার পানে চেয়ে আছি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে, যে ভাবে তুমি চেয়েছ,
এখন যদি তুমি আমায় ফিরিয়ে দাও, আর কে আছে যে আমাকে রক্ষা করবে?”

কেমন লাগছে আপনাদের?

গতকাল আমরা কথা বলেছিলাম দুটি বিষয় নিয়ে;

১: নামাজে নিজেকে একাগ্রত রাখা

২: প্রতিটা কাজ বুঝে বুঝে অন্তর থেকে অনুভব করে, চিন্তা করে করা|

আজকে, ইনশা-আল্লাহ নামাজের আরো গভীরে প্রবেশ করব| আমাদের বেশির ভাগেরই নামাজে আমরা কোন আবেগ অনুভব করিনা| যখন আমরা কোন বন্ধুর সাথে দেখা করি আমরা আনন্দ অনুভব করি, যখন কেউ দুরে চলে যায় তখন দুঃখ অনুভব করি, কেউ যখন অনেক
দিন ধরে দুরে থাকে আমরা তার অভাব অনুভব করি| বন্ধুদের জন্য আমরা কতই না
আবেগ আক্রান্ত হয়ে থাকি; অথচ নামাজের সময় আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করি কিন্তু আমরা কিছুই অনুভব করি না| এ কারণেই নামাজ আমাদের উপর কোন কার্যকর
প্রভাব ফেলতে পারছে না|

তাহলে, আমাদের কী অনুভব করা উচিত? চলুন জেনে নেই|

গভীরতার তৃতীয় স্তর:

এই তৃতীয় স্তর কোনটি? ক্ষমা ও করুনা লাভের জন্য আল্লাহর কাছে আসা| এবং এই আশা করা যে ইনশা-আল্লাহ তিনি আমাদের কবুল করবেন এবং আমাদের তাঁর আরও নিকটে নিয়ে আসবেন| এই তৃতীয় স্তর টিকে বলা হয় “রযা”| যে ব্যক্তি এই ‘রযা’ অনুভব করতে পারে তার অবস্থান আল্লাহর কাছে অনেক উচুতে| কারণ এটা অন্তরের ব্যপার|
হাজার মনোযোগ দিয়ে, আর বুঝে কীই বা লাভ যদি সবকিছু যান্ত্রিক হয়? নামাজের সত্যিকারের স্বাদ আহরণ তখনি সম্ভব যখন আমরা তাঁর(আল্লাহর) কাছে ‘রযা’ নিয়ে দাড়াবো|

এটা কিভাবে অর্জন করা সম্ভব?

এটা অনুভব করা সম্ভব যদি আপনি আল্লাহকে জানেন, চিনেন| আল্লাহ তায়ালাকে যতবেশী চিনবেন, তত আল্লাহর ‘রযা’ লাভ করবেন|
আমাদের প্রত্যেকের প্রতি আল্লাহর করুনা আমাদের মায়ের করুনার চাইতেও অনেক অনেক বেশী| আমাদের যা করতে
হবে তা হল আল্লাহর কথা বেশী বেশী স্মরণ করতে হবে, তাঁর গুনাবলী নিয়ে আলোচনা করতে হবে, চিন্তা করতে হবে, ভাবতে হবে| আমরা যা ভাববো তিনি তাই; যদি আমরা
তাকে অসীম দয়ালু ও পরম করুনাময় মনে করি, তাহলে তিনি তাইই| খুবই সোজা সরল কথা-কারণ আল্লাহ তায়ালা এ কথা নিজেই বলেছেন: নবী(সা:) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা
বলেন, ‘আমার বান্দা যা মনে করে আমি সে রকমই, তাই সে যেনো এমন কিছু ভাবে যাতে সে খুশি হয়|’|”

এইসব কথার মর্মার্থ নিয়ে যদি আমরা আমাদের নামাজ শুরুর ঠিক আগমুহুর্তে চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের নামাজে তার সু-প্র্রভাব পরবে|
ইবনে আল-কাইয়িম বলেছেন: “তোমার প্রতি আল্লাহর কোন ক্ষোভ নেই যে তিনি তোমাকে শাস্তি দিয়ে তার জ্বালা মিটাবেন|”

মানে আমাদের প্রতি তাঁর কোনই ক্ষোভ নেই এবং তিনি চানও না আমাদের শাস্তি দিতে| তাঁর করুনা তাঁর আযাবের চেয়ে অনেক বেশী| রহমত করাকে তিনি তাঁর নিজের করে নিয়েছেন| আল্লাহ তায়ালা বলেন-

كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَىٰ نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ

তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন [সুরা আনআম ৬:৫৪]
সুবহান-আল্লাহ(গৌরব, অহংকার এবং মহিমা আল্লাহরই)-আমরা প্রায় সবাই বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়ে চলেছি অথচ কখনও আবেগ সহকারে আল্লাহর নিকটে আসতে পারিনি, তবুও তাঁর কাছে করুনা প্রার্থনা করা তিনি পছন্দ করে চলেছেন| আল্লাহ তায়ালা
পবিত্র কোরআনে বলেন:

وَاللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَن تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا

يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُخَفِّفَ عَنكُمْ وَخُلِقَ الْإِنسَانُ ضَعِيفًا

“হ্যাঁ, আল্লাহ তো রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান৷ কিন্তু যারা নিজেদের প্রবৃত্তির লালসার অনুসরণ করছে তারা চায় তোমরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে চলে যাও৷আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ হাল্‌কা করতে চান৷ কারণ মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে৷” [সুরা নিসা ৪:২৭-২৮]

এর পরের নামাজে এই পন্থা প্রয়োগ করে দেখুন

নিজের মন থেকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করুন যে আল্লাহতায়ালা আপনাকে ক্ষমা করে দিতে চান, মার্জনা করে দিতে চান এবং আপনার প্রতি করুনা বর্ষণ করতে চান|
বিশ্বাস করুন এবং মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করুন যেনো তিনি আপনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস করেন, এবং শুধু তাইই না, আপনি যেনো জান্নাতে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর
প্রতিবেশী হোন| এগুলো আকাশচুম্বী কল্পনাপ্রসূত কোন গল্প নয়| বরং আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ

তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। [সুরা গাফির ৪০:৬০]

নবী(সা:) বলেন: “আল্লাহর কাছ থেকে নিশ্চয়তার সাথে প্রার্থনা করো|” যদি আপনি তা করেন; আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তার থেকেও অনেক বেশী দান করবেন| কিন্তু মনে
রাখবেন এসব চাইতে হবে ‘রযা’ অবস্থায় “আমানি” অবস্থায় না| পার্থক্য কোথায়?

‘রযা’ হল এতক্ষণ ধরে যা বলা হল তা সব, কিন্তু এসব করতে একাগ্র চিত্তে ও পরিশ্রমের মাধ্যমে; একবারে না হলে পুনরায় চেষ্টা করতে হবে, চাইতে হবে আল্লাহর কাছে তিনি যেনো আপনার জন্য ‘রযা’ পাওয়াকে সহজ করে দেন, যদি তা না
করি তাহলে সেটা হল ‘আমানি’..সঠিক একাগ্রতা আর অধ্যাবসায় ছাড়া এমনি এমনি আল্লাহর করুনা প্রার্থনা করা- তিনি(আল্লাহ) তা করা পছন্দ করেন না|

আল্লাহতায়ালা বলেন:

وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ

আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। [সুরা তাহা ২০:৮২]
আর এমন করলেই তিনি আপনাকে আপনার প্রতাশার চাইতেও বেশী কিছু দান করবেন|

আল্লাহর করুনা:

আল্লাহ তাঁর করুণাকে ৯৯ ভাগে ভাগ করেছেন, এবং তার মাত্র একটি ভাগ তিনি সমগ্র পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন| এই এক ভাগই এত শক্তিশালী যে তা সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মায়েদের, বাবাদের, সন্তানদের, স্বামীদের, স্ত্রীদের এমনকি
সকল পশু প্রানীদের মাঝে এমন ভাবে বিদ্যমান- যে সন্তান যতই যা করুক মা তাঁর সন্তানের একটু কষ্ট দেখলে কী যন্ত্রনাই না পায়; কোন বাবা তার সন্তানের জন্য কত কী না করেন; জন্ম দেয়ার পর মা কিভাবে আগলে রাখে তার সন্তান
দের….আরো কত…|
আরেকটি উদাহরন দেই-নিজের জন্মের আগের অবস্থা কল্পনা করুন – কিছুই ছিলেন না আপনি, নয় মাস মায়ের পেটে থেকে মাকে ব্যথা দিয়েছেন, এত কষ্ট দিয়েও ক্ষান্ত হননি, পৃথিবীতে আসার মুহূর্তেও মাকে দিয়েছেন কী অসম্ভব
কষ্ট, কী পরিমান কষ্ট সয্য আপনার মা আপনাকে জন্ম দিলেন অথচ জন্মের পরপরই আপনিই হয়ে গেলেন তার নয়নমনি, আদরের ধন …একবার কী চিন্তা করেছেন আপনি কী এমন করেছিলেন যে আপনি আপনার মার এত ভালোবাসা, দয়া, করুনার পাত্র হয়ে গেলেন? এসবি যদি সেই একটি ভাগেরই অংশ হয়ে থাকে তবে বাকি ৯৯ ভাগের কথা কী কল্পনা করা সম্ভব? কখনই না ..তার করুনা অসীম; শেষ বিচারের দিন তিনি যখন এই সমগ্র করুনা নিয়ে আমাদের বিচার করবেন তখন কী অবস্থা হতে পারে? এটা কী
আমাদের আবৃত না করে পারবে? আমাদের চেয়ে অনেক পাপী মানুষ যাদের আল্লাহ তাঁর স্বীয় করুনায় ক্ষমা করে দিয়েছেন, যেমন সেই মানুষটি যে ৯৯জনকে হত্যা করেছিলো তারপর আরও একজন কে হত্যা করে ১০০ পুরো করছিলো আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন | তাহলে কিভাবে তিনি আমাদের ক্ষমা ও করুনা না করে থাকতে পারেন?

তাহলে আপনি আমি কী তাঁর অসীম করুনার ভাগিদার হতে পারিনা? অবশ্যই পারি| চলুন তাহলে আজ থেকেই এভাবে নামাজ পড়ি ও প্রার্থনা করি|

(পর্ব ৩)

আলী(রা:) এর নামাজ:

যখন নামাজের সময় হত, আলী(রাদি আল্লাহ আনহু- আল্লাহ তাঁর উপর রাজি ও খুশি হোন) কাঁপতে শুরু করতেন এবং তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যেত| যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “অসুবিধা কি?” তিনি উত্তর বলেন, “এমন একটি আমানতের সময় শুরু হচ্ছে যে আমানতের ভার জান্নাত, পৃথিবী ও পাহাড়ের উপর অর্পণ করা হয়েছিল কিন্তু তারা তা বহন করতে নিজেদের দুর্বল মনে করেছিলো(সুরা আল আহজাব ৩৩:৭২) আর আমি এখন সেই আমানতের ভার নিতে যাচ্ছি|”

তাদের নামাজ আমাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল, কারণ নামাজে তাদের আবেগ-অনুভুতি ছিলো ভিন্নতর| আমরাও নামাজের মধুরতার সেই অনুভুতিগুলো আমাদের হৃদয়ে অনুভব করতে চাই|

আগের পোস্ট দুটিতে এখন পর্যন্ত আমরা জেনেছি যে একাগ্র থাকতে হবে, বুঝে শুনে, গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ করতে হবে এবং রযা(যা আগের নোট এ বর্ণিত) অর্জন করতে হবে| এখন আমরা এই রযাকে আরেকটি অনুভতির সাথে মেলাবো|

শুরু করার আগে বলে নেই যে, এখনো আমরা নামাজের প্রস্তুতি পর্যায়েই আছি, এখনো নামাজের আসল স্বাদ আস্বাদনের রহস্য উন্মোচন শুরু করিনি| আজকেও শুরু হবে না তবে ইনশা-আল্লাহ খুব তারাতারিই শুরু হবে- একটু ধৈর্য ধরে সাথেই থাকবেন আশা করি|

হায়বা

হায়বা হল এমন এক ধরনের ভয় যা আমাদের আল্লাহ তায়ালার প্রতি থাকা উচিত| দুঃখজনক হলেও সত্যি যে যখন আরবি ‘হায়বা’, ‘খশিয়া’, ‘খউফ’ ইত্যাদিকে অনুবাদ করা হয়, এসবের আসল অর্থ গুলো হারিয়ে যায়| এই তিনটি শব্দকেই বাংলায় অনুবাদ করা হয় ‘ভয়’ দিয়ে, অথচ এদের মাঝে সূক্ষ্ণ এবং জটিল পার্থক্য রয়েছে|

ইবনে আল-কায়য়িম বিচক্ষনতার সাথে এই পার্থক্য গুলো তুলে ধরেছেন:

‘খউফ’ মানে হল এমন ভয় যার কারণে ভয়ের সেই বস্তু থেকে মানুষ দুরে থাকতে চায়; এর জন্য জিনিসটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকলেও আমরা ভয় পাই| যেমন অন্ধকারে আমাদের ভয় লাগে বা ‘খউফ’ অনুভব করি| তাহলে এটা হল অজান্তেই যে সব ভয় পাই সেগুলো|

অন্যদিকে ‘খশিয়া’ হল একটা জিনিস সম্পর্কে জেনে শুনে ভয় পাওয়া| যেমন অনেকে কুকুর ভয় পায়, অনেকে সাপ দেখলে রাতে ঘুম আসেনা| আল্লাহ তায়ালাকেও অনেকে খুব ভয় পান, যে জাহান্নাম সম্পর্কে যত বেশি জানতে থাকে, এ দুনিয়ার আযাব সম্পর্কে যত বেশি জানতে থাকে, কবরের আযাব নিয়ে যতবেশী জানতে থাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমাদের ‘খউফ’ ধীরে ধীরে ‘খশিয়া’তে পরিনত হতে থাকে| যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

“….আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞান সম্পন্নরাই তাকে ভয় করে…..৷” [সুরা ফাতির ৩৫:২৮]
কিন্তু “হায়বা” হল কারো সম্মান, শ্রদ্ধা, মহিমা, ক্ষমতা সম্বদ্ধে সঠিক ধারণা সহকারে ভয়| উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- আমরা আগুনকে ভয় পাই, কারণ আমরা জানি আগুন আমাদের ক্ষতি করতে পারে কিন্তু আগুনের কোন ‘হায়বা’ নেই; আমরা তাকে কোন শ্রদ্ধা দেখাইনা, এটা হল ‘খশিয়া’| কিন্তু আমাদের পিতা-মাতাদের, শিক্ষকদের ‘হায়বা’ আছে, কারণ যখন আমরা খারাপ কিছু করি তখন তাদের ভয় করি, তাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জাবোধ করি- তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কারণে|

প্রথমে ‘রযা’, আবার এখন ‘হায়বা’?

এই দুইটা অনুভুতি তো পরস্পর বিরোধী| তাহলে, কিভাবে আমরা এই দুটিকে এক জায়গায় করতে পারি? আসলে এটা একদমই কঠিন কোন কাজ না, আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনেই এই কাজটা করে থাকি যখন চারপাশের মানুষের মাঝে চলাফেরা করি| যেমন একজন ছাত্র প্রশ্ন কমন না পেলে হাবিজাবি অনেক কিছুই লেখে দিয়ে আসে পরিক্ষার খাতায়, সে জানে যে তার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে এবং হয়তো পাসও করবে না তবুও একইসাথে সে এই আশাও করে যে স্যার হয়তো দয়া করে পাস করে দিবেন, এটাই হল রযা এবং হায়বা একত্রে|

আল্লাহতায়ালার ব্যাপারেও অন্যকিছু না| আমাদের কৃত পাপ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি, এইসব পাপ স্মরণে রেখে যখন আল্লাহর নিকটে আসি, আমাদের মনে শাস্তির অনেক ভয় থাকে কিন্তু একইসাথে আমরা তাঁর অসীম করুনায় ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি| এটা আরো স্পষ্টরূপে বোঝা যায় ‘সায়্যিদ আল-ইস্তিগফার’ বা ক্ষমা চাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ দুয়ায়, যা প্রত্যেক সকালে ও সন্ধায় পড়তে বলা হয়, যেটা নবী(সা:) ক্ষমার চাওয়ার সেরা উপায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেই দুয়াতে:

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَمَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلا أَنْتَ

“আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা, আন্তা খালাকতানি ওয়া আনা আ’ব্দুকা, ওয়া আনা আ’লা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাত’তু, আ’উজু বিকা মিন শাররী মা সানা’তু, আবু-উ লাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়া, ওয়া আবুউ লাকা বিযানবি ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরু আজনুবা ইল্লা আন্তা” [সহিহ বুখারী ৭/১৫০, নাসাঈ, তিরমিজী]

অর্থ: ইয়া আল্লাহ, তুমি আমার পালনকর্তা, কেউই ইবাদাতের যোগ্য নয় একমাত্র তুমি ব্যতীত| তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ এবং আমি তোমারই বান্দা| আমি আমার সাধ্যমতো যতটুকু পারি তোমারই নিয়ম ও আমার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চলি| আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সেই সব পাপ থেকে যা আমি করে ফেলেছি| আমি আমার ভুল স্বীকার করছি এবং আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি| আপনি আমাকে ক্ষমা করুনা; আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই যে আমায় ক্ষমা করতে পারে|”

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় এই দুয়ায় রযা এবং হায়বা দুটিরই সংমিশ্রণ ঘটেছে; আপনি আপনার ভুল গুলোও স্বীকার করেছেন, এবং সাথে সাথে প্রতাশায় আছেন যে তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন|

এ ধরনের ভয়ের আসল সৌন্দর্য:

আমরা যা কিছু ভয় করি, আমরা সবসময় তার থেকে দূরে থাকি, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বাদে| আল্লাহর ভয় আমাদের আল্লাহর আরো নিকটে নিয়ে আসে| আল্লাহ বলেন:

فَفِرُّوا إِلَى اللَّهِ ۖ إِنِّي لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌ مُّبِينٌ

অতএব, আল্লাহর দিকে ধাবিত হও। [সুরা যারিয়াত ৫১:৫০]
নবী(সা:) তাঁর দুয়ায় বলতেন:

لا ملجأ ولا منجأ منك الا اليك

“তোমার কাছে ছাড়া, তোমার (শাস্তি) থেকে বাঁচার আর কোন আশ্রয় বা নিরাপদ জায়গা নেই|”
নবী(সা:) আরো বলতেন:

اللهم إني أعوذ برضاك من سخطك، وأعوذ بمعافاتك من عقوبتك، وأعوذ بك منك لا أُحصي
ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك

“ইয়া আল্লাহ, আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি তোমারই পরিতোষে, তোমার ভয়ানক রোষ থেকে, এবং তোমারই ক্ষমা প্রার্থনা করি তোমার ভয়ংকর শাস্তি থেকে, তোমারই কাছে-তোমারই থেকে| তোমার উপযুক্ত প্রশংসা তো আমি কোনদিনও করতে পারবনা তা শুধু তোমার দ্বারাই সম্ভব|”
আল্লাহর শাস্তি চরম পর্যায়ের কিন্তু তাঁর কাছেই আমাদের ক্ষমা, তাঁর কাছ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করা| ইবনে আল-কায়য়িম এই দূ’আ সম্পর্কে বলেন এই শব্দ গুলোতে যে কি পরিমানে আল্লাহর একত্ববাদ, জ্ঞান ও দাসত্ব লুকিয়ে আছে-খুব উচুঁ স্তরের জ্ঞানীরা ছাড়া কেউই তা কেউ জানেনা| তিনি বলেন যে যদি কেউ এই দূ’আর অর্থ বিশ্লেষণ করতে চায় তাহলে বিশাল বই লিখতে হবে, আর এই জ্ঞানসমুদ্রে একবার ঢুকতে পারলে এমনসব কিছু তার সামনে উন্মোচিত হবে যা চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শুনেনি, কেউ কখনো কল্পনাও করেনি|

আল্লাহকে জানা এবং নিজেকে জানা:

‘হায়বা’ হল সর্বোচ্চ স্তরের ভয়, যার সাথে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও জ্ঞান মিশ্রিত রয়েছে| এই ভয় বাড়তে থাকে যখন বান্দা আল্লাহর সম্পর্কে বেশী বেশী জানতে থাকে একইসাথে নিজেকেও চিনতে থাকে| যখন আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রতাপ সম্পর্কে আমরা বেশী বেশী জানতে থাকি আমাদের ভয় বাড়তে থাকে| নবী(সা:) যে রাতে আল্লাহর কাছে উর্ধাগমন করেছিলেন, সে রাতের বর্ণনায় নবী(সা:) জিবরাইল(আ:), যাঁর কিনা ৬০০ পাখা রয়েছে এবং যিনি অহি নিয়ে আসার যোগ্যতায় ভূষিত, এর ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা বর্ণনা করেছেন|

যখন আমরা আমাদের কৃত পাপের কথা স্মরণ করি তখনো আল্লাহর ভয় বাড়তে থাকে| আমরা আমাদের হীনতা ও দুর্বলতা বুঝতে পারি, আমাদের অবজ্ঞা আমাদের কাছে ধরা পরে যায় যে এত পাপ করার পরও কতখানি ধৈর্য ধরে আল্লাহ আমাদের শাস্তি না দিয়ে সুযোগ দিয়ে চলেছেন|

সব ধরনের ভয়ই আমাদের বিচলিত করে শধু আল্লাহর ভয়, হায়বা, ছাড়া, কারণ এই ভয়ের কারণেই আমরা প্রবল আশায় বুক বাঁধি যে আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করবেন এবং জান্নাতের পথে পরিচালিত করবেন|

চলুন তাহলে আজ থেকে নামাজে রযার সাথে সাথে হায়বা-কে এক সাথে জুড়ে দিই|

(পর্ব ৪)

আবেগ-অনভূতির সর্বোচ্চ শিখর:

আজ আমরা আরো গভীরে প্রবেশ করব; এখন পর্যন্ত আমরা একাগ্র হয়েছি, যা উচ্চারণ করি তা অর্থ বুঝে করি, এবং দুই ধরনের আবেগ নিয়ে নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়াই, আর আজকে আরো এক ধরনের আবেগ নিয়ে কথা বলবো|এই আবেগ নিয়ে নামাজে দাড়ালে আমাদের নামাজকে খুব কম সময়ের নামাজ বলে মনে হবে, কিন্তু নামাজ শেষ করে ঘড়ি দেখলে মনে হবে, “আরে! এত তারাতারি ১০ মিনিট পার হয়ে গেছে?” কিংবা ১৫ মিনিট বা ২০ মিনিট(ইনশা-আল্লাহ)| যে ব্যক্তি নামাজে এই আবেগটা প্রয়োগ করতে শুরু করবে তার ইচ্ছা হবে এই নামাজ যেনো কখনো শেষ না হয়|এটি এমন একটি আবেগ যা সম্পর্কে ইবনে কায়য়্যিম বলেন, “যার জন্যে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করে….এটা হল আত্মার জন্য পুষ্টি আর চোখের জন্য শীতলতা|” তিনি আরো বলেন, “যদি হৃদয় থেকে এই অনুভুতি বের হয়ে যায়, এটা অনেকটা এমন যেমন প্রাণ ছাড়া শরীর|”

এই আবেগ কোনটি জানেন?

ভালোবাসা(الحب)

কিছু কিছু মানুষের আল্লাহর সাথে সম্পর্ক শুধু তাঁর আদেশ আর নিষেধ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ, যাতে সে জাহান্নাম থেকে বাঁচা যায়| অবশ্যই আমাদের আদেশ, নিষেধ মেনে চলতে হবে, কিন্তু এটা শুধু ভয় আর আশা নিয়ে নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার প্রতি পরম ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে করতে হবে| আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন:

‘…..অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে|’ [আল মাঈদা ৫:৫৪]
সচারচর দেখা যায় যখন মানুষ তার পছন্দের মানুষের কাছে আসে, হৃদয়ে চাঞ্চল্যতা আসে, আন্তরিকতা আসে| কিন্তু আল্লাহর সাথে দেখা করার সময়, নামাজে আমরা বিন্দুমাত্রও এই আবেগ অনুভব করিনা| আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ ۗ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ

“আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী|” [সুরা বাকারা ২:১৬৫]
যখন আমরা নামাজের জন্য হাত উপরে তুলি তখন সেখানে আল্লাহর জন্য আকুলতা থাকা উচিত, ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় আমাদের হৃদয় পূর্ণ থাকা উচিত কারণ আমরা এখন আল্লাহর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি|

নবী(সা:) এর একটি দূ’আ আছে:

اللهم إني أسألك الشوق الى لقائك

“ইয়া আল্লাহ, তোমার সাথে মিলিত হবার আকুলতা আমার হৃদয়ে স্থাপন করে দাও|”( নাসাঈ, হাকিম)
ইবনে আল কায়য়িম তাঁর ‘তারিখ আল-হিজরাতাঈন’ নামক বইতে বলেন আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসুলদের এবং তাঁর মুমিন বান্দাদের ভালোবাসেন, এবং রাসূলগণ এবং মুমিনরাও তাঁকে ভালোবাসেন এবং তাদের কাছে আল্লাহতায়ালার চেয়ে বেশী প্রিয় আর কিছু নেই| পিতামাতার প্রতি ভালোবাসার মাধুর্য এক ধরনের, সন্তানের প্রতি ভালোবাসাও আরেক রকম, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভালোবাসা অন্যসব কিছুর তুলনায় বেশী মাধুর্যময়| নবী(সা:) বলেছেন:

“ যে ব্যক্তি তিনটি গুনকে একত্রে সংযুক্ত করতে পারবে সে ঈমানের প্রকৃত মজা পাবে…”
প্রথম যে জিনিসটি তিনি(সা:) উল্লেখ করেন সেটা হল যে: “..আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশী প্রিয় হতে হবে…”

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন, “যেহেতু ‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়’[সুরা আস-শুরা ৪২:১১] সেহেতু তাকে ভালোবাসার অনুরূপও আর কিছুই হতে পারেনা|”যদি আপনি এই ভালোবাসার গভীরতা ও মাধূর্য একবার অনুভব করতে পারেন, তাহলে আপনার আর নামাজ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করবে না|

আমি এই ভালোবাসা অনুভব করতে চাই; কিন্তু কিভাবে?

আপনি কি সত্যিই এই ভালোবাসা অনুভব করতে চান? তাহলে নিজেকেই জিগ্যেস করুন- কেন আপনি আল্লাহকে ভালোবাসতে চান? কারণ এটা জেনে রাখেন যে মানুষ মূলত ভালোবাসে তিনটি কারণের যেকোনো একটির(অথবা কমবেশি মাত্রায় তিনটির জন্যই) জন্য:

১. তাদের সৌন্দর্যের জন্য;

২. তাদের মান-সম্মান বা উচ্চমর্যাদার জন্য;

৩. অথবা তারা আপনার জন্য ভালো কিছু করেছে এই জন্য;

আরও এটা জেনে রাখেন যে আল্লাহতায়ালা এই তিনটি গুনেই অন্য সবার চেয়ে অনেক অনেক উপরে|

১. সৌন্দর্য

সৌন্দর্য সবসময়ই আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়| এটা অনেকটা আমাদের ফিতরাত(যা প্রাকৃতিকভাবে থাকে)এর মতো| আলী ইবনে আবি তালিব (রাদি-আল্লাহু আনহু) নবী(সা:)সম্পর্কে বলেন যে “তাকে দেখে মনে হত তাঁর মুখ থেকে সূর্যের কিরণ বের হচ্ছে|” জাবির(রা:) বলেন: “রাসূলুল্লাহ(সা:) পূর্নিমার চাঁদের চেয়েও সুশ্রী, সুন্দর এবং উজ্জ্বল ছিলেন|” (তিরমিজী) আল্লাহতায়ালা তাঁর সকল নবী রাসূলগনকে অসাধারণ সৌন্দর্য দান করেছিলেন যাতে মানুষ তাঁদের প্রতি প্রাকৃতিকভাবেই আকৃষ্ট হয়|

আর সৌন্দর্য শুধু মানুষের মুখের মাঝেই সীমাবদ্ধ না, সৌন্দর্য সকল সৃষ্টিজগতের মাঝেই ছড়িয়ে রয়েছে এবং প্রায়ই তা আমাদের মুগ্ধ করে, আমাদের করে বাকহারা এবং সাথে সাথে আমাদের দেয় এক স্বর্গীয় শান্তির অনুভুতি| পূর্ণিমা রাতের শান্ত চাঁদের আলো, পাহাড় বয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির ঝর্না, কিংবা সমুদ্র পাড়ের রক্তিম সূর্যাস্ত…ইত্যাদির সামনে এলে কেমন যেনো একটা গভীর অনুভুতি আমাদের মাঝে বয়ে যায় যা খুবই পবিত্র, আমাদের করে তোলে মোহিত, মুগ্ধ| অবশ্য আজকাল শহরের যান্ত্রিকতা আর রুক্ষতা অবশ্য আমাদের এই পবিত্র অনুভুতি গুলোকেও মলিন করে দিয়েছে|

আর আল্লাহতায়ালা হলেন সেই সত্তা যিনি এইসব সৌন্দর্যকে সৃষ্টি করেছেন, সাজিয়েছেন, সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন| তাহলে আল্লাহর নিজের সৌন্দর্য কোন পর্যায়ের হতে পারে? ইবনে আল-কায়য়িম বলেন, “আর আল্লাহতায়ালার সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্যে এটা জানা থাকাই যথেষ্ঠ যে এই জীবন এবং এর পরের জীবনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সকল সৌন্দর্য তাঁরই সৃষ্টি, তাহলে তাদের সৃষ্টিকর্তা কতটা সুন্দর হতে পারেন?”

আল্লাহতায়ালা সুন্দর, এ জন্যেই সৌন্দর্যের জন্য আকর্ষণ আমাদের ফিতরাত| আল্লাহতায়ালার একটি নাম হল আল-জামীল(যিনি সবচেয়ে সুন্দর)| ইবনে আল-কায়য়্যিম বলেন আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্য এমন যে কেউ শুধু তা জেনে রাখতে পারেন, তা কল্পনা করার ক্ষমতা কারোরই নেই| এই মহাজগতের সকল সৌন্দর্য একত্রেও তাঁর নিজের সৌন্দর্যের এক বিন্দুও নয়| ইবনে আল-কায়য়িম বলেন সুর্য কিরণের যেমন সূর্যের সাথে তুলনা হয় না, ঠিক তেমন যদি সময় সৃষ্টির শুরু থেকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত সকল কিছুর সৌন্দর্য একত্র করা হয়, তবুও তা আল্লাহর সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করারো যোগ্য হবে না| আল্লাহতায়ালা এত প্রবল সৌন্দর্যের অধিকারী যে এই জগতে আমাদের তা সহ্য করার ক্ষমতা নেই| পবিত্র কোরআনে, আল্লাহ তায়ালা মুসা(আ:)এর অনুরোধ বর্ণনা করেন:

وَلَمَّا جَاءَ مُوسَىٰ لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِي أَنظُرْ إِلَيْكَ ۚ قَالَ لَن تَرَانِي وَلَٰكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي ۚ فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقًا ۚ فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ

“তারপর মূসা যখন আমার প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী এসে হাযির হলেন এবং তাঁর সাথে তার পরওয়ারদেগার কথা বললেন, তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রভু, তোমার দীদার আমাকে দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই। তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখতে পাবে না, তবে তুমি পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক, সেটি যদি স্বস্থানে দঁড়িয়ে থাকে তবে তুমিও আমাকে দেখতে পাবে|’ তারপর যখন তার পরওয়ারদগার পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন…|” [আল আরাফ ৭:১৪৩]
পাথরের পাহাড়ও আল্লাহর সৌন্দর্যের সামান্য জ্যোতি বহন করতে পারেনি এবং বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, এবং এই ঘটনা দেখে মুসা(আ:) জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন| এ কারণেই হাশরের ময়দানে সবকিছু আল্লাহর সৌন্দর্যে দীপ্তিময় হয়ে উঠবে| আমরা শুধু তাঁর সৌন্দর্যের কথা আলোচনাই করতে পাড়ি কিন্তু তা অবলোকন করা আমাদের আয়ত্তের বাহিরে| এই বিশ্বজগতের এত সুন্দর, এত মোহনীয় সব জায়গা, জিনিস, মানুষ অথবা তাদের সবার সৌন্দর্য একত্রেও একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝেই সীমাবদ্ধ; আসল মহিমা আর সৌন্দর্যতো আল্লাহতায়ালার| আল্লাহতায়ালা বলেন:

وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

আর তখন শুধু বাকি রয়ে যাবে আপনার রবের মহিমা এবং সম্মান|[আর রাহমান ৫৫:২৭]
এসব কিছু ভেবেই, মহানবী(সা:) বলেছেন:

إن الله ينصب وجهه لوجه عبده في صلاته ما لم يلتفت

বান্দা যখন নামাজে দাঁড়ায় আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার দিকে তাকান এবং যতক্ষণ সে নামাজে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাঁর মুখ ফেরান না| (তিরমিজী)
নামাজে দাঁড়িয়ে এই কথা মাথায় রাখবেন, এবং প্রার্থনা করবেন যেন আল্লাহ আপনাকে জান্নাতে তাঁকে দেখার সুযোগ দেন|

(পর্ব ৫)

ভালোবাসা

আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা যত বেশী হবে, নামাজে খুশুও তত বাড়তে থাকবে| যখন অনেক পছন্দের মানুষের সাথে দেখা হয় তখনকার অনুভূতি আর সাধারণ মানুষের সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতির বিস্তর ফারাক আছে|

আগের লেখাতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, কারো প্রতি ভালোবাসা মূলত তার সৌন্দর্য, গুনাবলী এবং তার করা সাহায্য থেকে সৃষ্টি হয়; এবং আল্লাহতায়ালা এই তিনটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত| আমরা তার সৌন্দর্যের কথা তো আগেই বলেছি; কিন্তু তাঁর গুনাবলী কি কি? কিংবা তিনি আমাদের জন্যে কিই বা করেছেন? আমরা জানি একটা মানুষের চরিত্র বা তাঁর দোষ-গুন আমাদের সামনে আসে যখন আমরা তাদের সাথে চলাফেরা করি, তাদের সাথে মিশি| তাহলে আমরা আল-হালীম(সবচেয়ে বড় ধৈর্যধারণকারী), আর-রহীম(পরম করুনাময়) আল-কারীম(যিনি উদারতায় সর্বশ্রেষ্ঠ) আল-ওয়াদুদ(যিনি সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন) সম্পর্কে কি জানি আর কি বলতে পারি?

আল্লাহর সাথে সম্পর্ক:

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন আমরা তাঁর করুনা সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি যখন তিঁনি তার বান্দাদের সাথে অতি মধুর সুরে কথা বলেন| যখন তিনি সীমালংঘনকারীদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন তখন তিঁনি বলেন না যে “ওহে পাপিষ্ঠ!” বরং তিঁনি বলেন:

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

“হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু|” [আল-জুমার ৩৯:৫৩]
খেয়াল করুন কিভাবে মহান আল্লাহতায়ালা কিভাবে আমাদের সাথে কথা বলছেন| তিঁনি আমাদের চোখ দিয়েছেন, নাক দিয়েছেন, কান দিয়েছেন, মুখ সহ অন্য সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়েছেন; তারপর আমরা সেগুলো দিয়েই তাঁর আদেশ অমান্য করে চলেছি, তারপরও তিনি আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন না; বরং তিনি ধৈর্যধারণ করে আমাদের তাঁর দিকে ফিরে আসার সুযোগ দিয়ে চলেছেন| আবার যখন আমরা তাঁর কাছে হাত তুলে তাওবা করি, ক্ষমা প্রার্থনা করি তিঁনি আমাদের সকল পাপ এমনভাবে মুছে দেন যেনো তা হয়তো কখনো করাই হয়নি|

একবার ভেবে দেখুন কিভাবে আল্লাহতায়ালা আমাদের কতবার কত বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন| এমন কতো সময় গেছে যে আপনি ভেবেছেন কত বড় সর্বনাশই না হয়ে গেলো, আল্লাহর কাছে কতইনা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অথচ পরে সবকিছুর পরিনাম দেখে বলেছেন “হায় আল্লাহ, সকল প্রশংসা তোমারই, তুমি যা করেছিলে তা ভালোর জন্যই করেছিলে|” কল্পনা করুনতো যে কেউ আপনাকে একটা উপহার দিলো, আপনার তা পছন্দ হলনা এবং আপনার আচরণেই তা তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আপনার এই ফালতু উপহার মোটেও পছন্দ হয়নি| আর পরে যখন তা আপনার উপকারে আসলো আপনি তার কাছে গেলেন আর হাত ধরে বললেন, “অনেক অনেক ধন্যবাদ, তোমার উপহারের জন্য আজ বেঁচে গেলাম|”

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে অনেক সাবধানী, কিন্তু তাঁর বান্দা তাঁর সামনে একটুকুও লজ্জ্বা বোধ করেন না|” আল্লাহ হাজার হাজার নবী রাসূল পাঠিয়েছেন যাতে আমরা সরলপথে তাঁর দিকে চলতে পারি, তিঁনি নিজে প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশে সর্বনিম্ন আসমানে নেমে এসে জিগ্যেস করেন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চায়? কেউ আছে যে তাওবা করবে? আর তিঁনি তাকে মাফ করে দিবেন| আর এসব কিছুই তিনি করেন শুধু আমাদের জন্য, আমরা না থাকলেও তাঁর কিছু যায় আসে না| আমাদেরই তাঁর কাছে সকল চাহিদা, সকল প্রার্থনা, অথচ তারপরও আমরা তাঁর সকল অনুগ্রহকে উপেক্ষা করতে লজ্জাবোধ করিনা|

আল্লাহতায়ালাকে জানা এবং চেনা:

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন যে, তুমি যদি আল্লাহতায়ালকে জানো, তাকে তুমি ভালোবাসে ফেলবেই| যিনি আপনার দূ’আ কবুল করেন, যিনি আপনাকে প্রতিটা কাজের জন্যে পুরস্কৃত করেন, যিনি ক্ষমা করে দেন, যিনি আমাদের দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখেন, যিনি আমাদেরকে আমাদের মায়ের চাইতেও অধিক ভালোবাবাসেন তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায়?

youtube এর একটি ভিডিও ক্লিপ( http://www.youtube.com/watch?v=btuxO-C2IzE ৮ MB) আছে দেখে আসতে পারেন| এটা কোন মুভির দৃশ্য নয়, বরং সত্যি ঘটনা| দুজন ব্রিটিশ ব্যক্তি একটা সিংহ শাবককে ছোট থেকে বড় করেন, বড় হয়ে যাবার পর তারা সিংহটিকে লোকালয়ে রাখতে না পেরে তাকে আফ্রিকার বনে রেখে আসে| এক বছর কেটে যাবার পর সিংহটাকে তাদের খুব দেখতে ইচ্ছা হলে তারা আবার সেখানে ফিরে যায়; তাদের কে বলা হয়েছিল যে এতদিন বন্য পরিবেশে থেকে সিংহটা খুব হিংস্র হয়ে গেছে; কিন্তু সুবহান-আল্লাহ(সকল গৌরব, অহংকার ও মহিমা আল্লাহর) অনেক খোঁজাখুজির পেয়ে যখন তারা সিংহটির কাছে গেলো; তখন সে তাদের সাথে কি আচরণ করলো তা না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব না; এমনকি সিংহটি তার সিংহীকেও তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়|

এই সম্পর্ক কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তোলে যে আল্লাহতায়ালার সাথে আমাদের কি রকম সম্পর্ক হওয়া উচিত| প্রতিদিন ঘুমের সময় নিজের রুহকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সঁপে দেই আমরা, তিঁনি যদি তা ফিরিয়ে না দিতেন তবে কি আমরা কেউ কিছু করতে পারতাম? প্রতিদিন তিনি আমাদেরকে আলো বাতাস পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, প্রতিদিন আমাদের রিজিক এর সুব্যবস্থা করে দিচ্ছেন; আবার যখন সীমালংঘন করছি, পাপ কাজ করছি, তাওবা করার সাথে সাথে মাফ করে দিচ্ছেন| আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:

هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ

সৎকাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত আর কি হতে পারে? [আর রাহমান ৫৫:৬০]
একটা বন্য ও হিংস্র প্রাণী যদি তাকে কিছুদিনের জন্য দেখভাল করায় এতটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে; তাহলে আমাদের আল্লাহতায়ালার প্রতি কি পরিমান কৃতজ্ঞ আর অনুগত হওয়া উচিত? নামাজে ঠিক সেই পরিমান বিনীত হয়ে দাড়ানো উচিত আমাদের| আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ

এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত। [আল-আম্বিয়া ২১:৯০]
এখন যদি আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চান, তাহলে আগে ঠিক জায়গায় যোগাযোগ করে সময় নির্ধারণ করতে হবে, যদি তিনি আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হোন তবেই তার সাথে কথা বলতে পারবেন; এবং এর পরও যদি আপনি তার কাছে কিছু চান তা সে যাই হোক না কেন, তিনি রাজি হতেও পারেন নাও হতে পারেন| যদি আপনার দাবি পূরণ হয় তাহলে আপনি তার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ হবেন, সবার কাছে তার সুনাম করে বেড়াবেন|

(পর্ব ৬)

অনুগ্রহ

এখন পর্যন্ত আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে নামাজে অবশ্যই আমাদের আবেগ নিয়ে দাড়াতে হবে; আবেগবিহীন নামাজ এখন আমাদের কাছে অতীত হয়ে গেছে| কারণ আমাদের নামাজ এখন আর শুধু নিয়ম মেনে উঠাবসা করাই নয়; বরং নামাজ মানে মহান আল্লাহতায়ালার সামনে দাঁড়ানো, তার সাথে কথা বলা| আর একটি মাত্র বিষয়ে কথা বলে ইনশা-আল্লাহ আগামী পর্ব থেকে আমরা নামাজের ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিটা অংশ নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করব| যে জিনিসটা নিয়ে আমাদের কথা না বললেই নয় সেটা হল আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ এবং আশীর্বাদসরূপ দেয়া তাঁর অসংখ্য নিদর্শন সমূহ যা প্রতিনিয়ত আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে চলেছে| এর কোন ভুমিকা টানার প্রয়োজন নেই| আল্লাহতায়ালা বলেন:

وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا

“যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না|” [সুরা ইবরাহীম ১৪:৩৪]

যখনই আমরা এই আয়াত শুনি তখনই এটা আমাদের ভাবিয়ে তোলে আমাদের যা আছে সেসব নিয়ে; আমাদের ঈমান থেকে শুরু করে পরিবার, সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি; এছাড়াও যেসব জিনিস আমরা আমাদের জন্য অবধারিত ছিলো বলে ধরি যেমন কথা বলতে পারার ক্ষমতা, হাটা-চলার ক্ষমতা, দেখতে পাবার ক্ষমতা, শুনতে পাবার ক্ষমতা আরও কত কি| আমরা এসবকে আমাদের নিয়ামত হিসেবে দেখিইনা| এগুলোর আসল গুরুত্ব অনুভূত হয় যখন এগুলোর কোন একটি ছাড়া নিজের জীবন কল্পনা করব তখন; তখন বুঝে আসবে কত বড় নিয়ামত আল্লাহ তায়ালা আমাদের দিয়ে রেখেছেন অথচ তাঁর প্রতি আমরা কত অকৃতজ্ঞ| আল্লাহতায়ালা বলেন:

وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ إِنَّ الْإِنسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ [١٤:٣٤]

“যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ|”[সুরা ইবরাহীম ১৪:৩৪]

এখন আমরা আরো দুটি নেয়ামত নিয়ে অল্প কিছু কথা বলবো: ঈমান(এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস) এবং আমান(নিরাপত্তা)|

ঈমান [إيمان]

আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, আমরা জানি কে আমাদের পালনকর্তা(রব), এবং এও জানি যে তিনি এক, অদ্বিতীয়| কতো মানুষ তাদের বিধাতাকে তাঁরই বিভিন্ন সৃষ্টির মাঝে তাঁকে খুঁজে বেড়ায়, কতকিছুর পূজাই না সে করে, তা সে পশুপ্রানিই হোক, মানুষই হোক, কোন বস্তুই হোক অথবা নিজের প্রবৃত্তিই হোক| কিন্তু আমরা জানি, নামাজে আমরা আর কোন কিছুর পূজা করি না, শুধু মাত্র তাঁরই ইবাদত করি এবং সরাসরি তাঁরই কাছে এসে দাড়াই| আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:

إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي [٢٠:١٤]

আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমারই এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থেই নামায কায়েম কর। [তা-হা ২০:১৪]

আমান [أمن]

দুই ধরনের আমান বা নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলবো আমরা: অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক| অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি আদর্শ উদাহরণ হল আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা| আমরা এ ব্যাপারে খুব কমই নজর দেই বা খেয়াল করি| আমাদের শ্বেত রক্তকনিকা সব সময় দেহে প্রবেশ করা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দের ধ্বংস করে চলেছে| চলুন দেখে আসি দেহের ভেতরে কি হয়|

বড় যে সচল কোষটি দেখা যাচ্ছে সেটা হল শ্বেত রক্তকনিকা| গোল গোল প্রায় স্থির গুলো হল লোহিত রক্তকনিকা| আর পিপড়ার মতো কালো ছোট জিনিসটা হল ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া| আমাদের অজান্তেই, আমাদের কোন প্রচেষ্টা ছারাই কিভাবে আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছে, সত্যিই অসাধারণ|

আর বাহ্যিক নিরাপত্তা? আমাদের কেউ কি আজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠার সময় ভেবেছে যে কেউ হয়তো তাকে হত্যা করবে? অথবা আজ আমার বাসায় ডাকাতি হবে? কেউ ভাবিনি, আমরা খুব নিশ্চিন্তভাবে ঘুমাই আর ঘুম থেকে উঠি| কল্পনা করুন একবার গাজার(ফিলিস্তিন) কথা, অথবা ইরাকের কথা? যেখানে তারা জানেনা কাল সকালের সূর্য দেখার সৌভাগ্য তাদের হবে কিনা; তারা জানেনা আজ রাতেই তাদের থাকার জায়গায় বিমানহামলা হবে কিনা, জানেনা কখন ঘাতক বুলেট এসে প্রাণ নিয়ে যাবে, তারা জানেনা কবে এই অত্যাচার, এই জুলুম থামবে| যদি বাহ্যিক নিরাপত্তা না থাকতো তাহলে কি হত তা আসলে কল্পনা করে বোঝানো সম্ভব না যদি সত্যিই তাদের জন্য না ভাবেন| আর আল্লাহতায়ালা আমাদের এত নিরাপদে রেখেছেন, এতো আরামে রেখেছেন যে আমরা তাঁকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে যাই, মনে করি এসব তো আমাদের প্রাপ্য ছিল|

হায়া [حياء]

এখন আরেকটি আবেগ নিয়ে কথা বলবো, সেটা হল-হায়া, অথবা দুর্বল অনুবাদ হিসেবে বলা যেতে পারে লজ্জাবোধ| নামাজে এই বোধটাকে আমাদের মাঝে নিয়ে আসা উচিত| এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে-আল্লাহ্তায়ালার কাছে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এ প্রশ্নের উত্তর হল কারণ আল্লাহ আমাদের উপর ধৈর্যধারণ করে আছেন| আমরা যা করি তারপরও ধৈর্যধারণ করা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব| তিনি আমাদের হাত, পা, চোখ, নাক, মুখ সহ সবকিছু দান করেছেন, কিন্তু আমরা সেসব দিয়েই তাঁর অবাধ্যতা করি, পাপ কাজ করি, সীমালংঘন করি; তারপরও তিনি ধৈর্য ধরেন, সবার সামনে উন্মোচিত না করে আমাদের দোষগুলোকে তিঁনি গোপন রাখেন, আবার তৎক্ষনাত শাস্তিও দেন না| এ সবের পরেও, তিনি আমাদের তাওবা কবুল করেন; শুধু তাইই নয়, তিঁনি তাঁর বান্দার কোন আবদার ফিরিয়ে দিতেও লজ্জা বোধ করেন, যখনই বান্দা তাঁর কাছে কিছু চায় তিনি তা দিয়ে দেন অথবা জান্নাতে তার জন্য আরো বেশী কিছু নির্ধারণ করে রাখেন, যা নবী(সা:) বলে গেছেন| তাহলে আমরা কি লজ্জিত না হয়ে তাঁর সামনে নামাজে দাঁড়াতে পারি?

আল্লাহ আমাদের নামাজ কে নিখুঁত ভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন| আমীন|

(পর্ব ৭)

বিক্ষিপ্ত চিত্ত/মন!

আগের লেখা গুলোর সবই ছিলো ইট-কাঠ-পাথরের দেয়ালে আটকে থাকা আমাদের কঠিন হয়ে পড়া অন্তরগুলোকে সিক্ত করার জন্য- ওগুলোতে মূল নামাজের চেয়ে বেশী গুরত্ব দেয়া হয়েছে আল্লাহতায়ালাকে আরো ভালোভাবে জানার প্রতি, তাঁর প্রতি কি রকম অনুভূতি নিয়ে দাঁড়ানো উচিত- এসব নিয়ে, যাতে করে যখন আমরা নামাজে দাঁড়াই তখন আমরা যেনো এটা জেনে দাঁড়াই যে কোন মহান সত্তার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি| নামাজে আসার আগ মুহুর্তে অবশ্যই আগে যা শিখেছি সেগুলো মনে মনে স্মরণ করতে হবে, যাতে নামাজে আমাদের আর জড়তা না আসে, যাতে নামাজ আমাদের কাছে একটা নতুন মর্যাদা লাভ করে এবং আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে|

এত কিছুর পরও আমাদের বেশির ভাগের নামাজেই বারবার বিঘ্ন ঘটে, মনোযোগ সরে যায় নিজের অজান্তেই| এটা ঠিক যে, আমরা আল্লাহতায়ালাকে ভালবাসি, তাঁকে ভয় পাই, তাঁর করুনা প্রত্যাশা করি কিন্তু তারপরও আমরা আমাদের মনকে শুধু নামাজের মাঝেই কেন্দ্রীভূত করতে পারিনা| উল্টাপাল্টা চিন্তা হুটহাট করে মাথার ভেতর উদয় হয়: মনে করতে চেষ্টা করি হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটা কোথায় রেখেছিলাম, দিবাস্বপ্ন দেখত শুরু করি

যে কিভাবে পৃথিবী থেকে সব সমস্যা দূর করা যায় অথবা আজ রাতে কি দিয়ে ভাত খাবো তা নিয়ে ভাবতে থাকি| আর এ সব কিছুর শুরু হয় যখন আমরা নামাজের জন্য হাত তুলে “আল্লাহ আকবার” বলে নামাজ শুরু করি ঠিক তখন থেকে| আর যখন সালাম ফেরাই তখনই সব চিন্তা হাওয়া হয়ে যায়|

হয়তো একটা জিনিসই আমাদের এসব অযাচিত চিন্তাভাবনা থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারে আর তা হল: মনে প্রাণে এটা বিশ্বাস করা যে নামাজে পুরোপুরি একাগ্র না হলে সে নামাজ আমাদের কোনই কাজে আসবে না| কিন্তু আসলেই কি তাই? আমাদের মন সরে গেলে নামাজ কি ভেঙে যায়? না! নামাজ ভাঙ্গবে না, আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু নামাজের সওয়াবের দিক থেকে এটা বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করবে| নবী(সা:) বলেন:

“বান্দা নামাজ আদায় করলে, সেই নামাজের এক-দশমাংশ বা এক-নবমাংশ বা এক-অষ্টমাংশ বা এক-ষষ্ঠাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ বা এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক সওয়াব পেতে পারে|” [আবু দাউদ, আহমাদ]

কারণ:

ليس للمرء من صلاته إلا ماعقل منها

“বান্দা তার নামাজের শুধু মাত্র সেই অংশের সওয়াব পায়, যে টুকু অংশ সে সজ্ঞানে(বুঝে শুনে) করে|” [আবু দাউদ]

এটা দেখে আবার এ রকম মনে করা উচিত না যে, “থাক তাহলে নামাজ না পড়াই ভালো” অথবা “আমার দ্বারা এরকম নামাজ কখনই হবে না”| ধরুন যে এক পথিক উত্তপ্ত মরুভুমির ভেতর হেটে যেতে যাচ্ছে, চলার এক পর্যায়ে তার একটা স্যান্ডেল ছিড়ে গেলো; তাই সে এক পায়ে স্যান্ডেল নিয়েই চলতে থাকলো| তারপর একসময় বলে উঠলো, “আমার এক পা তো মরুভুমির উত্তপ্ত বালিতে পুড়ছেই, যাকগে আরেকটা পাও পুড়িয়ে দেই|” আর তারপর সে ছেড়া স্যান্ডেল ঠিক করার চেষ্টা করা বাদ দিয়ে স্বেচ্ছায় আরেকটা স্যান্ডেল খুলে সেই পা টাও পোড়াতে লাগলো| এই ব্যক্তিকে কি বলবেন? নিশ্চিতভাবেই তাকে বোকা বা গাধা বা বলবেন মস্তিস্কবিকৃত মানুষ| এখন আমরা যদি নামাজ ঠিক করার বদলে হাল ছেড়ে দিই তাহলে আমাদের আর এই ব্যক্তির কোন পার্থক্য থাকলো কি?

একটি গোপন অস্ত্র

অবশেষে প্রথম রহস্য উন্মোচিত করা হবে এখন| এমন কঠিন কিছুই না, কিন্তু এটা খুবই তাড়াতাড়ি আমাদের নামাজের ধরন পাল্টে দেবে| তার আগে একটা প্রশ্ন: বছরের কোন সময় টাতে আমাদের খুশু সবচেয়ে বেশী থাকে? খুবই সহজ উত্তর: রমজান মাসে| আর রমজানের কখন আমাদের খুশু সবচেয়ে বেশী থাকে? সম্ভবত রাতের নামাজের সময়| আর সেই নামাজের কখন সবচেয়ে বেশী মনযোগ থাকে, কখন সবচেয়ে বেশী অশ্রুপাত হয়? যখন আমরা দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি| এই সময়টাতেই আসলে আমরা সেই গোপন অস্ত্রটি ব্যবহার করে থাকি|

কিভাবে? ঐ সময়টাতে আমরা সত্যিই আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলতে থাকি, তাঁর কাছে দাবি নিয়ে চাইতে থাকি এবং তাঁর সাড়া পাবার আশা করতে থাকি| আর এই অনুভুতিটাই আমাদের মন ও অন্তরকে নামাজের ভেতরে মগ্ন করে ফেলে, আমরা নামাজের মাধূর্য অনুভব করতে থাকি|

তাহলে গোপন জিনিসটি কি? তিন বাক্যে বলা যেতে পারে:

১. আল্লাহর সাথে কথা বলা

২. আল্লাহকে তার বিভিন্ন নাম(নামের অর্থ বুঝে সেই গুণটির মূল্য বুঝে) ধরে ডাকা

৩. তাঁর কাছ থেকে পাবই এমন দাবি নিয়ে চাওয়া, কথোপকথন চালানো|

নবী(সা:) বলেন:

إذا كان أحدكم في الصلاة فإنه يناجي ربه

“নামাজের সময় বান্দা তাঁর রবের সাথে খুব আপনভাবে কথা বলে” [বুখারী, মুসলিম]

ইবনে উথায়মান বলেন যে যখন কেউ নামাজে প্রবেশ করে, তার এমন অনুভব করা উচিত যেন সে তাঁর রবের আরশের পাশে অবস্থান করছে এবং তাঁর সাথে কথা বলছে|

সমস্যা হল আমরা আমাদের নামাজে আল্লাহর সাথে যোগাযোগটাকে অনুভব করতে পারি না; আমাদের মনে হয় যে আমরা শুধু বলেই যাচ্ছি কোন উত্তরতো পাচ্ছি না, একপেশে সংলাপ বলে মনে হয়| আসলে আমরা যখন বলি “আলহামদুলিল্লাহি রব আল-আ’লামীন” আমাদের এইটা ভেতর থেকে অনুভব করতে হবে যে সত্যিই সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা সারা বিশ্ব জগতের মালিক আল্লাহর| সেজদাহর সময় আমদের মনে এই অনুভূতি থাকতে হবে যে “ইয়া আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিও না, তুমি ছাড়া আমারতো কেউ নেই, আমাকে তোমার দুয়ার হতে ফিরিয়ে দিওনা|” শুধু মন্ত্র পাঠ করার মতো বারবার তাসবিহ পড়ে কোন লাভ নেই, যা বলবেন অর্থ বুঝে, বিশ্বাস করে, নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে বলবেন| যদি এমনটা করতে পারেন তাহলে সব নামাজই রমজানের রাতের ক্রন্দনরত নামাজের মতো হবে|

আমরা যখন সেজদাহবনত থাকি, তখন আমাদের সবাই মুখস্ত করা তাসবিহ পড়ে থাকি| কিন্তু একজন অত্যন্ত পুন্যবান পূর্বসুরী এই সেজদাহবনত অবস্থার মূল্য জানতেন এবং দু’আর সাথে সাথে আল্লাহ কে বলতেন “ইয়া আল্লাহ, তোমার এই বান্দা(সে নিজেই) কি জান্নাতে না জাহান্নামে?” কতটা ঘনিষ্ঠতা খেয়াল করুন-তিনি জানতেন তিনি আল্লাহর খুব কাছে অবস্থান করছেন এবং এত মগ্নভাবে সেজদাহবনত ছিলেন যে তিনি অনুভব করছিলেন যে তিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলছেন|

শুধু পড়ার জন্য পড়া নয়

এই লেখা গুলো পড়া আর মাথা ঝাকানো খুব সোজা, দু’একটা জিনিস শিখলেন আর বললেন “ওহ এগুলোতো জানিই|” শুধু জেনে কোন লাভ নেই, যেটুকু জানলাম সেটুকু প্রয়োগ করা শুরু করি| চলুন সবাই মিলে একে অপরকে সাহায্য করে এই অল্প অল্প জ্ঞানগুলোকে প্রয়োগ শুরু করি:

১. এমন একজন বন্ধুকে সাথে নিন যার সাথে আপনি ইসলামের ব্যাপারে অনেক খোলামেলা| প্রত্যেক নামাজে আসার সময় একজন আরেকজনকে মনে করিয়ে দিন যে এখন আল্লাহর সাথে কথা বলতে যাচ্ছি| আল্লাহর গুনাবলী নিয়ে কথা বলুন, যেসকল কারণে তাঁর প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ সেসব নিয়ে কথা বলুন, কথা বলুন কি কি কারণে আপনি তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করেন সে সব নিয়ে|

২. যখন জায়নামাজে দাঁড়িয়ে হাত তুলবেন “আল্লাহ আকবার” বলার জন্য, তা করবেন দৃঢ় প্রত্যয়ে, নিজেকে আল্লাহর কাছে পুরোপুরি সঁপে দিয়ে| মনে করবেন যেন আপনাকে এখন পৃথিবী থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে, আপনার রুহকে তাঁর রবের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর এখনই আপনার সাথে আপনার রবের ঘনিষ্ঠ কথপোকথন শুরু হবে| এই জগতের আর কোন কিছুতেই আপনার আর মনোযোগ সরাতে পারবে না|

আল্লাহতায়ালা যেনো আমাদের নামাজকে নবী(সা:), তাঁর সাহাবাগণ(রা:) এবং তাদের যোগ্য উত্তরসূরীদের নামাজের মতো মাধুর্যময় করে তোলেন| আমীন|