কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ১৫-১৯)

(পর্ব ১৫)

আল্লাহ্‌র নামে

আমরা এখন নামাজে একটি সুন্দর জায়গায় এসে পৌঁছেছি, আমরা সবচেয়ে সুন্দর নামটি উচ্চারণ করি – বিসমিল্লাহ। এই রাজসিক নামের উচ্চারণ আমাদের অন্তরে শান্তি আনে, সমস্ত জায়গা ও সব সময় নিরাপত্তার অনুভূতি দেয় – এই নামের স্মরণ ছাড়া আত্মা কি শান্তি পায়? কোন মুসলিমের অন্তরে অবস্থিত তাঁর এই নামটিই সবচেয়ে অসাধারণ বিস্ময়কর ব্যাপার, কারন এমন কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস নেই যা এই নামের বরকতে বৃদ্ধি না পায়, আবার এমন কোন বড় জিনিষ নেই যা এই নামের বরকতে অনুগ্রহ না পায়। এই নামটি এতই চমকপ্রদ, এটি যেকোনো জায়গার, যে কোন সময়ের ক্ষতি থেকে নিরাপত্তা দেয়। মহানবী (সাঃ) বলেছেন-

কেউ যখন কোন স্থানে বিশ্রামের জন্য অবতরণ করে সে যেন বলে, আউযু বিকালিমা তিল্লা হিততা-ম্মা-তি মিন শাররি মা খালাক (আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের মাধ্যমে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাঁর সৃষ্ট বস্তুর সমুদয় অনিষ্ট হতে), কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আবার তার বাহনে আরোহণ করে।(মুয়াত্তা ৫৪/১৩৩৪)

এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাওয়াতায়ালা আপনাকে হেফাজত করবেন, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ইনশাল্লাহ। আর সকল সময়ের নিরাপত্তার জন্য মহানবী (সাঃ) বলেছেন-

بِسمِ اللهِ الذي لا يَضُرُّ مَعَ اسمِهِ شَيءٌ في الأرْضِ وَلا في السّماءِ وَهوَ السّميعُ العَليم”
من قالها ثلاثاً إذا أصبح وثلاثاً إذا أمسى لم يضره شيء

‘বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়া দুররু মা’আসমিহি শাইআন ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামা-ই ওয়াহুয়াস সামিউল আলীম’ (আমি সেই আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যার নামে শুরু করলে আকাশ ও পৃথিবীর কোন বস্তুই কোনরূপ অনিষ্ট সাধন করতে পারে না। বস্তুত তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা)যে এই দোয়া সকালে তিনবার ও সন্ধ্যায় তিন বার বলবে, কোন কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। (আবু দাউদ ৪১/৫০৬৯)

ইবনে আল কাইয়িম বলেন, শুধুমাত্র নামের মহত্ত্বই যদি এমন হয়, তবে সেই নামধারীর মহত্ত্ব কেমন হওয়ার কথা! আপনি যখন কাউকে ভালবাসেন, তখন আপনি তার নামও বার বার নিতে ভালবাসেন। কায়েস আর লায়লার বিখ্যাত কাহিনী লায়লা মজনুর কাহিনী নামে আমরা সবাই জানি। কায়েসের বাবা তাকে হজ্জ এ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে তার ছেলের এই ‘ভালবাসার রোগ’ সেরে যায়। হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে করতে কায়েসের অবস্থার উন্নতি হয়ে আসছিল। কিন্তু শেষদিকের এক দিনে তারা যখন মিনায় ছিল, এক লোক তার এক মহিলা সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলার পর জোরে জোরে তার নাম ধরে ডাকতে লাগলো – লায়লা! লায়লা! যতবার সেই লোক নামটি ধরে ডাকতে লাগলো, সেই নামটি শুনেই কায়েসের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো, তার ‘ভালবাসার রোগ’ আরও তীব্র হয়ে ফিরে এলো। আমাদের সবারই যদি এমন ভালবাসা আমাদের সৃষ্টিকর্তার জন্য থাকতো!

কুরআনের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন বাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ মুকাবিলায় অবতীর্ণ হবে তখন দৃঢ় ও স্থির থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমানে স্মরন করবে, আশা করা যায় তোমরাই সাফল্য লাভ করবে। (সুরা আনফালঃ৪৫)

ইবনে তাইমিয়্যাহ এই প্রসঙ্গে বলেন, মুমিন বান্দারা এমন যুদ্ধরত অবস্থাতেও আল্লাহর নাম নিতে, তাঁকে স্মরন করতে ভালবাসে। আনতারা নামক একজন ইসলাম পূর্বের যোদ্ধা ও কবি তার এক কবিতায় বর্ণনা করেছিল কিভাবে সে তীরবিদ্ধ হয়েও তার প্রেমিকা আবলা কে মনে করছিল। যুদ্ধের ময়দানেও যেমন করে এরা তাদের ভালবাসার জনকে স্মরন করে, আল্লাহও আমাদেরকে সংগ্রামের সময় বেশি করে তাঁকে স্মরন করতে বলেছেন।

ইবনে আল কাইয়্যিম ভালবাসার জনকে নিয়ে নির্জনতার আনন্দের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ইবনে তায়মিয়্যা তার শহর ছেড়ে মরুভূমিতে চলে যেতেন যাতে তিনি আল্লাহর সাথে নির্জনতা উপভোগ করতে পারেন। আগের সেই কবিরা যেমন তাদের ভালবাসার মানুষের স্মরনে শান্তি পেত, আমাদের উচিত আল্লাহ সুবহানাওয়াতায়ালার স্মরনে তার চেয়েও অনেক বেশি প্রশান্তি অনুভব করা। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কি কেউ আছে? তিনি ছাড়া আর কে আছে যে আমাদের প্রার্থনার জবাব দেন? তাঁর চেয়ে বেশি কে আর আছে আমাদের প্রতি এত দয়ালু?

কাজেই, যখন নামাজে আমরা বলি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”, এটি আল্লাহর সাথে আমাদের কথোপকথনের শুরু হওয়া নির্দেশ করে। আপনি যখন কুরআনের প্রথম সুরা ‘সুরা ফাতিহা’ তেলাওয়াত করা শুরু করেন, আল্লাহ তায়ালা তখন আপনার তেলাওাতের সাথে সাথে জবাব দেন। ইবনে জারীর বলেন, তিনি এটা ভেবে আশ্চর্য হন যারা কোন কিছু না বুঝেই কুরআন পড়ে যায় তারা কি করে এর মাধুর্য আস্বাদন করবে? আমাদের জানা মতে সুরা ফাতিহাই হচ্ছে একমাত্র সুরা যার তেলাওয়াতের সাথে সাথে আল্লাহ জবাব দেন। এর আর কি কি রহস্য আছে?

আল ফাতিহা

বিসমিল্লাহ বলার পর প্রথমেই আমরা যে আয়াত পড়ি তা হলঃ

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতসমূহের রব। (সুরা ফাতিহাঃ১)

আল-হামদ হল একই সাথে আল্লাহর প্রশংসা আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা। আর হামদ হল ভালবাসা আর সম্মান এর উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি অনেক গভীর একটি শব্দ, যার আরও বিস্তারিত আলোচনা আমরা আগামী পর্বগুলোতে করব ইনশাআল্লাহ। এর গুরুত্ব বোঝাতে রাসুল (সাঃ) বলেছেন-

الحمدلله تملأ الميزان

‘আলহামদুলিল্লাহ’ ওজন দণ্ডের পরিমাপকে পরিপূর্ণ করে দেবে (সহিহ মুসলিম ২য় খণ্ড, হাদিস ৪৪১)

আমরা যা কিছু অনুগ্রহ আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছি তার জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলব; এটাও মনে রাখব যে আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারাটাও আল্লাহ্‌রই আরেক অনুগ্রহ, কারণ এমন বহু মানুষ আছে যারা আল্লাহর এত অনুগ্রহ অনুধাবনও করতে না পেরে তা অস্বীকার করে।
رَبِّ الْعَالَمِينَ

এই কথাটি দ্বারা বোঝায় – ‘সৃষ্টি জগতসমূহের রব’। রব তিনিই যার সমস্ত কিছুর উপর কর্তৃত্ব আছে, যিনি সমস্ত কিছুর পালনকর্তা, সমস্ত মানুষের এবং সমস্ত জিনিসের মালিক। “জগতসমূহ” বলতে বোঝায় সমস্ত সৃষ্টিকুল যার মধ্যে রয়েছে মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা, পশুপাখি ও আন্যান্য সবকিছু; যার প্রতিটিকে একেকটি জগত বলা যেতে পারে, যেমন ‘ফেরেশতাদের জগত’, ‘পশুজগত’, ‘মানব জগত’ বা ‘জ্বিন জগত’। এটা ছোট বড় সব ধরনের সৃষ্টির ব্যাপারেই বলা যায়; যেমন ব্যাকটেরিয়া বা কোষের ও নিজস্ব জগত আছে। বেশির ভাগ সময়ই আমরা আল্লাহর সৃষ্টির এই বিশালতা ও ব্যপকতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই, এবং আল্লাহর সৃষ্টির উপর তাঁর ক্ষমতার ব্যপারে অজ্ঞ থেকে যাই।

যে কোন একটি জগতের জটিলতা কিছুটা আন্দাজ করার জন্য আমরা শ্বেতকনিকার উদাহরন নিতে পারি। মাত্র একফোঁটা রক্তের মধ্যে প্রায় সাত হাজার থেকে পঁচিশ হাজার শ্বেতকনিকা থাকতে পারে।

এখন একটি কথাই বলার থাকে –

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতসমূহের রব।

ইনশাল্লাহ, পরবর্তী পর্বে আমরা সুরা ফাতিহার অর্থ আরও গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

(পর্ব ১৬)

সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবা

সুরা ফাতিহা হল সেই সুরা যা আমরা প্রতি ওয়াক্তের প্রতি রাক’আতে পড়ি- দিনে কমপক্ষে ১৭ বার। কাজেই এই সুরার প্রতিটি আয়াতের বিস্তারিত অর্থ আমাদের জন্য জানা একান্ত প্রয়োজন যাতে আমরা যা পড়ি তার সাথে নিজের অন্তরকে যুক্ত করতে পারি।

আজ আমরা অংশ নেব এক অনন্য সাধারণ যাত্রায় যা আমাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা গেঁথে দিতে সাহায্য করবে ইনশাল্লাহ।

আল্লাহ বলেন-

قُلِ انظُرُوا مَاذَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ وَمَا تُغْنِي الْآيَاتُ وَالنُّذُرُ عَن قَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ

তাহলে আপনি বলে দিন, চেয়ে দেখ তো আসমানসমুহে ও যমীনে কি রয়েছে।……(সুরা ইউনুসঃ ১০১)
আল্লাহ আমাদেরকে আদেশ করেছেন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আর এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য। নিচের ভিডিওটি আমাদের এক শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণে নিয়ে যাবে।

এই অতল বিশাল সৃষ্টির সামনে আমরা কত নগণ্য। আমরা কখনও ভেবে দেখেছি আমাদের আর বেহেশতসমূহের মধ্যে দূরত্ব কতখানি? আল্লাহ বলেনঃ

إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ

নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন।…(সুরা আল ‘আরাফঃ ৫৪)
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাওয়াতা‘আলার কিভাবে আরশে সমাসীন হন তা আক্ষরিক অর্থে আমরা বুঝতে পারব না। কারণ আল্লাহ আরও বলেন –

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ

অর্থাৎ ‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়’ (সুরা আশশুরাঃ১১)
যাহোক, এটি আমাদের আজকের আলোচনার প্রসঙ্গও না। আমরা ভিডিওটিতে যা দেখলাম তা যদি মাত্র প্রথম আসমান হয়, তাহলে কল্পনা করে দেখুন এরকম সাতটি আসমান রয়েছে; আবার এই সাত আসমানের উপরে রয়েছে আল্লাহর কুরসী এবং তাঁর আরশ।

আমরা কি সেই কুরসী কল্পনা করতে পারি? মহানবী(সাঃ) বলেছেন –

ما السماوات السبع في الكرسي ، إلا كحلقة ملقاة بأرض فلاة

কুরসীর মধ্যে সাত আসমান ধু ধু প্রান্তরে নিক্ষিপ্ত আংটির চেয়ে বেশি কিছু না। (ইবনে হাযার)*
কুরসী যদি এমন হয়, আরশ তাহলে কেমন? তখন নবীজি (সাঃ) বলেছেনঃ

فضل العرش على الكرسي ، كفضل تلك الفلاة على تلك الحلقة

আরশের তুলনায় কুরসী প্রান্তরের তুলনায় কড়ার মত ।*
আমরা কি এই বিশালত্ব কল্পনা করতে পারি? তাহলে আমরা কিভাবে অহংকার করতে পারি? আমরা কিভাবে আল্লাহর সামনে দাড়াতে পারি এবং তাঁর বিশালতা ও মহানুভবতা অনুভব না করে পারি? আমরা মাঝে মাঝে মানুষের নানান সাফল্য ও কীর্তি যেমন উচ্চতম বিল্ডিং নির্মাণ, উড়োজাহাজের ওড়া, ক্লোনিং দেখে অবাক হই। কিন্তু আমরা যখন আল্লাহর প্রাকৃতিক সৃষ্টিসমূহ একে একে আবিষ্কার ও পর্যবেক্ষণ করি তখন আমরা শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়ের এক অনুভুতি নিয়ে বিস্ময়বিহ্বল হয়ে যাই। এই কথা গুলো মাথায় রেখে আমরা নবীজি (সাঃ) এর এই হাদিসটি পড়ি-

فإذا صليتم فلا تلتفتوا فإن الله ينصب وجهه لوجه عبده في صلاته ما لم يلتفت

যখন কেউ নামাজে দাঁড়াবে, সে যেন এদিক সেদিক না তাকায়, কারন আল্লাহ তখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখেন যতক্ষণ না পর্যন্ত সে এদিক সেদিক তাকায় (তিরমিযি)।
আমরা তাহলে কি করে আমাদের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতে পারি? ভেবে দেখুন আল্লাহর বিশালতম সৃষ্টি থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৃষ্টি সমূহের কথা। এ সমস্ত কিছুই কত চমৎকারভাবে চলছে, আমাদের কোন রকম সাহায্য বা অংশগ্রহন ছাড়াই। আমরা শুধুই বলতে পারিঃ ‘আলহামদুলিল্ললাহি রাব্বিল ‘আলামীন’ -সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সৃষ্টি জগত সমূহের রব।

নামাজঃ একটি কথোপকথন

সুরা ফাতিহা সম্পর্কে আল্লাহ হাদিসে কুদসি তে বলেছেন-

আমি সালাত (সুরা ফাতিহা) আমার ও আমার বান্দার মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছি, আর, আমার বান্দা যা চাইবে তাই তাকে দেওয়া হবে।

বান্দা যখন বলেঃ আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন বা সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের জন্য, আল্লাহ তখন বলেনঃ আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।

যখন বান্দা বলেঃ আর রহমানির রহীম বা পরম করুনাময় অতি দয়ালু, তখন আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দা আমার গুণগান করল।

যখন বান্দা বলেঃ মালিকি ইয়াওমিদ্দীন বা প্রতিফল দিবসের মালিক, তখন আল্লাহ বলেনঃ বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করল।

যখন বান্দা বলেঃ ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্ তা’ঈন বা আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য চাই, তখন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত এবং বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চাইবে।

অতঃপর যখন বান্দা বলেঃ ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম; সিরাতাল্লাযীনা আন’আমতা ‘আলাইহিম গইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ-দল্লীন বা আমাদের সরল পথ দেখাও। তাদের পথ যাদের তুমি নিয়ামত দিয়েছ, তাদের পথ নয় যারা গজবপ্রাপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট, তখন আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ এ সব তো আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা যা চাইবে তার জন্য তা-ই রয়েছে। (সহীহ মুসলিম ২য়ঃ৭৭৪)

আমাদের রবের সাথে কি চমৎকার কথোপকথনই না হয় আমাদের! ইবন আল কায়্যিম বলেন, সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হল আল্লাহ আমাদেরকে তাঁরই বান্দা বলে সম্বোধন করেছেন। আল্লাহ যখন নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)কে ইসরা এবং মিরাজে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বলেনঃ

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।(সুরা আল ইসরাঃ১)
মানুষের দাসত্ব অপমানজনক; কিন্তু আল্লাহর দাসত্ব, যার সাথে থাকে ভালবাসা, তা হল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের বিষয়।

আমরা যেন সবাই আল্লাহর প্রতি গভীর সম্ভ্রম আর ভালবাসার অনুভুতি নিয়ে নামাজে দাড়াতে পারি। আমীন।

(পর্ব ১৭)

আল ফাতিহার মাধুর্য

আমরা ১৫তম পর্বে আলোচনা করেছি “আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল ‘আলামীন” বলতে কি বুঝি। গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, সুরা ফাতিহা হল আমাদের আর আল্লাহ সুবহানা ওয়ালাতা‘য়ালার সাথে কথোপকথন। সম্ভবত নামাজে সুরা ফাতিহা তেলাওয়াতের সময়টিই সেই সময় যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি খুশুর প্রয়োজন, কারণ এ সময় আল্লাহ আমাদের জবাব দেন। কিন্তু সাধারণত সুরা ফাতিহা তেলাওয়াতের সময়ই আমাদের খুশু সবচেয়ে কম থাকে, কারণ এই সুরা আমরা বারংবার পড়তে পড়তে অভ্যাসে পরিনত করে ফেলেছি; এই অবস্থাটি পরিবর্তন করতে হবে।

আমরা যদি এই সুরার আয়াতের ক্রমের দিকে লক্ষ্য করি আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারেঃ আল্লাহ কেন প্রথম আয়াত ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব’ এর পরপরই ‘আর রহমানির রহীম’ বা পরম করুনাময়, পরম দয়ালু এই আয়াতটি বললেন? ইবনে উথাইমীন বলেন – কারণ আল্লাহর রুবুবিয়াত বা প্রভুত্বের ভিত্তি হল মুলত করুনা বা দয়াময়তা। আমরা যখন পড়ি ‘আল্লাহ সকল সৃষ্টি জগতসমূহের রব’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তিনি কেমন রব? আল্লাহ এই আয়াতে তারই উত্তর দিয়েছেনঃ

الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

যিনি পরম করুনাময় ও অতিশয় দয়ালু (সুরা ফাতিহাঃ ২)

পরম করুনাময়, পরম দয়ালু

সুরা ফাতিহা পড়েছেন এমন অনেকেই ‘আর রহমান’ ও ‘আর রহীম’ এর মধ্যে পার্থক্য জানেন না। এটা অনুবাদ করা হয় ‘পরম করুনাময় ও অতিশয় দয়ালু’। মিশরের একজন বিখ্যাত ইসলামিক আলোচক আমর খালেদ এই পার্থক্যটাকে এভাবে ব্যখ্যা করেছেনঃ

আল্লাহ যখন তাঁর সমস্ত সৃষ্টির উপর এই দুনিয়াতে দয়া বর্ষণ করেন তখন তিনি ‘আর রহমান’। আল্লাহ বলেনঃ

قُلْ مَن يَكْلَؤُكُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ مِنَ الرَّحْمَٰنِ ۗ بَلْ هُمْ عَن ذِكْرِ رَبِّهِم مُّعْرِضُون

বলুনঃ ‘রহমান’ থেকে কে তোমাদেরকে হেফাযত করবে রাত্রে ও দিনে। বরং তারা তাদের পালনকর্তার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।(সুরা আম্বিয়াঃ ৪২)

অপরদিকে ‘আর রহীম’ বলা হয় যখন আল্লাহ তাঁর বিশেষ রহমত বিশ্বাসীদের উপর বর্ষণ করেন। যেমনঃ খাদ্য, পানি ইত্যাদি রহমতসমূহ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাইকেই করুনাময় আল্লাহ দিয়ে যাচ্ছেন; আবার রমজান মাসে বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ আতিশয় দয়ালু আল্লাহ শুধু বিশ্বাসীদেরই দিয়েছেন।

‘আর রাহমানির রাহীম’ এর পরপরই ‘প্রতিফল দিবসের মালিক’ কেন? যদি উল্টোটা হত তাহলে আমাদের অন্তর ভীতিতে ভরে যেত। প্রথমে আমরা পড়ি আল্লাহই আমাদের রব, তারপরে তিনিই প্রতিফল দিবসে আমাদের বিচার করবেন। আমরা নিজ নিজ আমলের ব্যপারে ওয়াকিবহাল। কাজেই আমরা যদি বিচার দিবসের ভয়াবহতার আগে আমাদের রবের করুনার কথা জানতে পারি তবে ভয়ের মাঝেও আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়। পরম করুনাময় দয়ালু আল্লাহই প্রতিফল দিবসের মালিক।
করুনা

আমাদের উপর আল্লাহর করুনা আমরা সবসময় উপলব্ধি করতে সক্ষম হই না। চলুন নিচের ভিডিওটি দেখিঃ

দেখুন কিভাবে চিতাবাঘটি বেবুনের বাচ্চাটিকে পরম মমতায় আগলে রেখেছে- (https://www.youtube.com/watch?v=Ts_hQXYJzpg)সুবহানাল্লাহ! এই শিকারী জন্তুটি যদি এমন একটি প্রানীর উপর করুনা আর মমতায়

আচ্ছন্ন হতে পারে যেটি তার শিকার হতে পারত, তাহলে আমরা কি করে আল্লাহর নিজের ‘সৃষ্টির’ উপর তাঁর করুনার ব্যপারে সংশয় রাখতে পারি? আল্লাহর করুনা প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) কি বলেছেন দেখুন-

“ইবনে আবু মারিয়াম (র)…উমর ইবনে খাত্তাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী(সাঃ) এর নিকট কিছু সংখ্যক বন্দী আসে। বন্দীদের মধ্যে একজন মহিলা ছিল (তার শিশু সন্তান হারিয়ে গিয়েছিল যদিও পরে তাকে খুঁজে পেয়েছিল)। সে বন্দীদের মধ্যে কোন শিশু পেলে তাকে ধরে কলে নিত এবং নিজের দুধ পান করাত। নবী (সাঃ) আমাদের বল্লেনঃ তোমরা কি মনে কর এ মহিলা তার সন্তানকে আগুনে ফেলে দিতে পারে? আমরা বললামঃ না ফেলার ক্ষমতা রাখলে সে কখনও ফেলবে না। তারপর তিনি বল্লেনঃ এ মহিলাটি তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর তদাপেক্ষা অধিক দয়ালু।” (সহীহ বুখারি ৯ম খণ্ডঃ ৫৫৭৩)

কাজেই কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্ষমা, ধৈর্য ও করুনার জন্য আমরা গভীরভাবে আশা রাখব। তারপরও আমাদের এর জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ বলেছেন-

وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ

আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। (সুরা ত্বা-হাঃ৮২)

আমরা কি আল্লাহর সেই বান্দাদের মধ্যে একজন হব না যা্দের উপর আল্লাহ তাঁর পরম করুনা বর্ষণ করবেন? আমরা তা ই আশা করি, ইনশাআল্লাহ। আর আমরা আসলেই যে তা চাই তার প্রমাণস্বরূপ সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা ও আমল করব।

সেই গোপন চাবিকাঠিটি মনে আছে তো? আল্লাহর সাথ। কথা বলুন। যখনই বলবেন আর রহমানির রহীম, মনে রাখবেন আল্লাহ জবাব দিচ্ছেন – ‘আমার বান্দা আমার গুনগান করল’। এটা মনে রেখে আপনার অন্তরকে নরম করুন যে আপনি তাঁর সাথে কথা বলছেন যিনি আপানারই উপর পরম করুনাময়।

(পর্ব ১৮)

অসীম ক্ষমতাধর

আজ আমরা সেই সুরা ফাতিহা যা আমরা প্রতিদিন পড়ি তার অর্থ আরও একটু গভীরে আলোচনা করব। আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, আমাদের উদ্দেশ্য হল আমাদের নামাজের মধ্যে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে আরও বেশি করে নিবেদিত করা আর আমাদের অন্তরকে আল্লাহর কালাম দিয়ে জীবিত করা। এটা শুধু আমরা যা পড়ি তার সারমর্ম শিখেই করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সেই অর্থ গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করা।

আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি কিভাবে আল্লাহ ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’ বা ‘প্রতিফল দিবসের মালিক’ বলার ঠিক আগেই ‘পরম করুনাময় ও অতিশয় দয়ালু’ বা ‘আর রহমানির রহীম’ আয়াতটি বলেছেন; যাতে আমরা জানতে পারি যে- যিনি প্রতিফল দিবসের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি হলেন পরম করুনাময়।

আরবী ভাষায় ‘মালিক’ শব্দটির উচ্চারণের কারনে এর অর্থে সামান্য ভিন্নতা আছে। বহুল ব্যবহৃত উচ্চারণ হল – ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’ অর্থাৎ মীম এর উপর লম্বা টান বিশিষ্ট খাড়া যবর এর উচ্চারণ। আরেকটি উচ্চারণ হল- مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ বা ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’। এই দুটি উচ্চারণই সঠিক। তবে ‘মা-লিক’ এবং ‘মালিক’ এর অর্থের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাত রয়েছে। ‘মা-লিক’ বলতে বোঝায় কোন কিছুর অধিকারী হওয়া বা যার দখলে কোন কিছু আছে এমন। ‘মালিক’ হল কোন কিছুর উপর এমন আধিপত্য থাকা যে সেটির উপর যেমন খুশি তেমন কর্তৃত্ব করা যায়। কোন ব্যক্তি হয়তো কোনকিছুর শুধু ‘মা-লিক’ হতে পারে, ‘মালিক’ নয়; অথবা উল্টোটাও হতে পারে। যেমন, একজন প্রেসিডেন্টের একটি দেশের উপর কর্তৃত্ব বা আধিপত্য থাকে, সে দেশের সম্পদ যেমন খুশি তেমনভাবে কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু ৫ বা ১০ বছর পর তার সেই পদ থাকে না। এক্ষেত্রে সে মালিক ছিল, কিন্তু মা-লিক নয়। কারণ যার উপর তার ক্ষমতা ছিল, সেই দেশের পদের সে চিরস্থায়ী অধিকারী নয়। আবার, এমনও আছে যে, কোন রাজা বা রানী বংশ পরম্পরায় কোন দেশের রাজত্বের চিরস্থায়ী অধিকারী হয়ে থাকে, যেমনটি আছে যুক্তরাজ্যের বেলায়। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই যা আছে সেই দেশের প্রধান মন্ত্রীর। এক্ষেত্রে সেই রাজা বা রানীকে সেই দেশের মা-লিক বলা যায়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে মালিক নয়।

আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’য়ালা মা-লিক এবং মালিক দুটোই। তিনি কিয়ামত দিবসের এবং সেদিন যা ঘটবে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
প্রতিফল দিবস

যখন আমরা যখন বলিঃ مَالِكِ يَوْمِ الدِّين বা ‘প্রতিফল দিবসের মালিক’, আমরা এই শব্দগুলোর ক্ষমতা, ব্যপকতা ও গুরুত্ব খুব কম ই অনুধাবন করতে পারি। প্রতিফল দিবস হল চূড়ান্ত হিশাব-নিকাশের দিন, যেদিন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো, আমাদের জীবদ্দশায় যা কিছু করেছি তার বিচার হওয়ার জন্য। আল্লাহ কেন তাঁর এই দিনের আধিপত্যের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করছেন, যখন তিনি একবার বলেই দিয়েছেন যে তিনিই সমস্ত জগত সমূহের রব, যাতে বিচার দিবসও অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শেষ পরিণতি স্মরন করিয়ে দেওয়ার জন্য, যে আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাবো আমাদের আমলনামা নিয়ে, এবং এটা দেখানোর জন্য যে এই দুনিয়াতে মানুষের যত প্রভাব, প্রতিপত্তি, আধিপত্ত্য ও ক্ষমতা আছে তা সব বিলীন হয়ে যাবে; রয়ে যাবে শুধুই তাঁর সর্বময় অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। সেই দিন আমাদের একটি শব্দও উচ্চারণ করার শক্তি থাকবে না যদি না মহান আল্লাহ আমাদেরকে অনুমতি দেন, যেমন আল্লাহ বলেন-

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا ۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَٰنُ وَقَالَ صَوَابًا

যেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ব্যতিত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্যকথা বলবে। [ সুরা নাবাঃ ৩৮ ]

তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারও জন্য সুপারিশও করতে পারবে না।

مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? [ সুরা বাকারাঃ২৫৫ ]

আমাদের সবসময় এটা মনে রাখা দরকার যে, আমরা যতটা ভাবি, বিচার দিবস আসলে তার চেয়ে অনেক নিকটবর্তী। আল কুরতুবি বলেছেন – প্রতিটি ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে তার নিজস্ব ‘বিচার দিবস’ শুরু হয়ে যায়। কেউ এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। কেউ যদি একে পাশ কাটিয়ে যেতে পারত তবে নিশ্চয়ই মহানবী (সাঃ) এর জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হতেন, কারণ তিনি হলেন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা। কিন্তু যখন রাসুল (সাঃ) এর মৃত্যুক্ষণ এসে পড়েছিল, তিনি তাঁর সামনে রাখা পানির পাত্র থেকে পানি নিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মাসেহ করতেন আর বলতেন –

لا اله الا الله ان للموت سكرات

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নিশ্চয়ই মৃত্যুর অনেক যন্ত্রণা রয়েছে।’ [সহীহ বুখারি ১০/৬০৬৬ ইঃফাঃ ]

সেই দিবসের দৃশ্যাবলী

কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই শুনেছি। আল্লাহ বলেন-

إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ

সূর্যকে যখন দীপ্তিহীন করা হবে, যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে, পর্বত সমূহকে যখন চলমান করা হবে, যখন পূর্ণগর্ভা উটনী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে, এবং সমুদ্রগুলিকে যখন উদ্বেলিত করা হবে; [ সুরা তাকভীরঃ১-৬ ]

আরও ভালভাবে বুঝার জন্য আমরা ঝড়, ভুমিকম্প বা পর্বতের অগ্নুৎপাতের ধ্বংসলীলার অসংখ্য ভিডিও দেখতে পারি। কেয়ামত দিবসের তুলনায় এই সব ধ্বংসলীলা কিছুই না।

আমরা সবাই আমাদের কবর থেকে বের হয়ে আশব, আর যারা যারা অবিশ্বাসী তারা বলবে-

قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَن بَعَثَنَا مِن مَّرْقَدِنَا ۜ ۗ هَٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَٰنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ

তারা বলবেঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? দয়াময় আল্লাহ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রসূলগণ সত্যই বলেছিলেন। [ সুরা ইয়াসীনঃ৫২ ]

সেইদিন সূর্যকে আমাদের নিকটবর্তী করা হবে, আর সবাই এমনভাবে ঘামতে থাকব যে কারও কারও ঘাম তাদের চিবুক পর্যন্ত উঁচু হবে। শুধুমাত্র সাত শ্রেণীর মানুষ ছায়ার নিচে থাকবে যাদেরকে আল্লাহ নিরাপদে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর বাদ বাকি সবাই ভয়াবহ আতঙ্কে থাকবে, তখন হঠাৎ-

وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا

এবং যখন তোমার প্রতিপালক আগমন করবেন, আর ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধ ভাবে থাকবে। [ সুরা ফাজরঃ৮৯ ]

এবং আল্লাহর নূর আসমান সমূহকে ঢেকে ফেলবে,

يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُ ۖ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَٰنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا

সেই দিন তারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে, এই ব্যপারে এদিক-অদিক করতে পারবে না; দয়াময়ের সামনে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে; সুতরাং মৃদু পদধ্বনি ছাড়া তুমি কিছুই শুনবে না। [ সুরা ত্বা-হাঃ১০৮ ]

কে থাকবে সেদিন নিরাপদে?

এর জবাব পাওয়া যাবে সুরা ফাতিহার এই আয়াতে-

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

আমরা শুধু তোমার ই এবাদত করি এবং শুধু তোমার ই সাহায্য প্রার্থনা করি

এর প্রমান কি? আল্লাহ বলেন-

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

আমি নূহ (আঃ)কে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম, সুতরাং সে তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলঃ হে আমার জাতি! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন সত্য মা’বুদ নেই, আমি তোমাদের প্রতি এক মহা দিবসের শাস্তি আশঙ্কা করছি। [ সুরা ‘আরাফঃ৫৯ ]

কাজেই, সেই প্রতিফল দিবসের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহর ইবাদত ই আমাদের সেই মহাদিবসের শাস্তি থেকে বাঁচাবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা যখন এই আয়াত গুলি তেলাওয়াত করব, তখন আমরা মনে রাখব যে আল্লাহই আমাদের ‘মা-লিক’ এবং ‘মালিক’, এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবো আর সেইদিন তিনি ছাড়া কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে খুশুর সাথে নামাজ আদায় করার তৌফিক দিন। আমীন।
অসীম ক্ষমতাধর

আজ আমরা সেই সুরা ফাতিহা যা আমরা প্রতিদিন পড়ি তার অর্থ আরও একটু গভীরে আলোচনা করব। আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, আমাদের উদ্দেশ্য হল আমাদের নামাজের মধ্যে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে আরও বেশি করে নিবেদিত করা আর আমাদের অন্তরকে আল্লাহর কালাম দিয়ে জীবিত করা। এটা শুধু আমরা যা পড়ি তার সারমর্ম শিখেই করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সেই অর্থ গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করা।

আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি কিভাবে আল্লাহ ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’ বা ‘প্রতিফল দিবসের মালিক’ বলার ঠিক আগেই ‘পরম করুনাময় ও অতিশয় দয়ালু’ বা ‘আর রহমানির রহীম’ আয়াতটি বলেছেন; যাতে আমরা জানতে পারি যে- যিনি প্রতিফল দিবসের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি হলেন পরম করুনাময়।

আরবী ভাষায় ‘মালিক’ শব্দটির উচ্চারণের কারনে এর অর্থে সামান্য ভিন্নতা আছে। বহুল ব্যবহৃত উচ্চারণ হল – ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’ অর্থাৎ মীম এর উপর লম্বা টান বিশিষ্ট খাড়া যবর এর উচ্চারণ। আরেকটি উচ্চারণ হল- مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ বা ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’। এই দুটি উচ্চারণই সঠিক। তবে ‘মা-লিক’ এবং ‘মালিক’ এর অর্থের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাত রয়েছে। ‘মা-লিক’ বলতে বোঝায় কোন কিছুর অধিকারী হওয়া বা যার দখলে কোন কিছু আছে এমন। ‘মালিক’ হল কোন কিছুর উপর এমন আধিপত্য থাকা যে সেটির উপর যেমন খুশি তেমন কর্তৃত্ব করা যায়। কোন ব্যক্তি হয়তো কোনকিছুর শুধু ‘মা-লিক’ হতে পারে, ‘মালিক’ নয়; অথবা উল্টোটাও হতে পারে। যেমন, একজন প্রেসিডেন্টের একটি দেশের উপর কর্তৃত্ব বা আধিপত্য থাকে, সে দেশের সম্পদ যেমন খুশি তেমনভাবে কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু ৫ বা ১০ বছর পর তার সেই পদ থাকে না। এক্ষেত্রে সে মালিক ছিল, কিন্তু মা-লিক নয়। কারণ যার উপর তার ক্ষমতা ছিল, সেই দেশের পদের সে চিরস্থায়ী অধিকারী নয়। আবার, এমনও আছে যে, কোন রাজা বা রানী বংশ পরম্পরায় কোন দেশের রাজত্বের চিরস্থায়ী অধিকারী হয়ে থাকে, যেমনটি আছে যুক্তরাজ্যের বেলায়। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই যা আছে সেই দেশের প্রধান মন্ত্রীর। এক্ষেত্রে সেই রাজা বা রানীকে সেই দেশের মা-লিক বলা যায়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে মালিক নয়।

আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’য়ালা মা-লিক এবং মালিক দুটোই। তিনি কিয়ামত দিবসের এবং সেদিন যা ঘটবে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
প্রতিফল দিবস

যখন আমরা যখন বলিঃ مَالِكِ يَوْمِ الدِّين বা ‘প্রতিফল দিবসের মালিক’, আমরা এই শব্দগুলোর ক্ষমতা, ব্যপকতা ও গুরুত্ব খুব কম ই অনুধাবন করতে পারি। প্রতিফল দিবস হল চূড়ান্ত হিশাব-নিকাশের দিন, যেদিন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো, আমাদের জীবদ্দশায় যা কিছু করেছি তার বিচার হওয়ার জন্য। আল্লাহ কেন তাঁর এই দিনের আধিপত্যের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করছেন, যখন তিনি একবার বলেই দিয়েছেন যে তিনিই সমস্ত জগত সমূহের রব, যাতে বিচার দিবসও অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শেষ পরিণতি স্মরন করিয়ে দেওয়ার জন্য, যে আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাবো আমাদের আমলনামা নিয়ে, এবং এটা দেখানোর জন্য যে এই দুনিয়াতে মানুষের যত প্রভাব, প্রতিপত্তি, আধিপত্ত্য ও ক্ষমতা আছে তা সব বিলীন হয়ে যাবে; রয়ে যাবে শুধুই তাঁর সর্বময় অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। সেই দিন আমাদের একটি শব্দও উচ্চারণ করার শক্তি থাকবে না যদি না মহান আল্লাহ আমাদেরকে অনুমতি দেন, যেমন আল্লাহ বলেন-

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا ۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَٰنُ وَقَالَ صَوَابًا

যেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ব্যতিত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্যকথা বলবে। [ সুরা নাবাঃ ৩৮ ]

তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারও জন্য সুপারিশও করতে পারবে না।

مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? [ সুরা বাকারাঃ২৫৫ ]

আমাদের সবসময় এটা মনে রাখা দরকার যে, আমরা যতটা ভাবি, বিচার দিবস আসলে তার চেয়ে অনেক নিকটবর্তী। আল কুরতুবি বলেছেন – প্রতিটি ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে তার নিজস্ব ‘বিচার দিবস’ শুরু হয়ে যায়। কেউ এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। কেউ যদি একে পাশ কাটিয়ে যেতে পারত তবে নিশ্চয়ই মহানবী (সাঃ) এর জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হতেন, কারণ তিনি হলেন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা। কিন্তু যখন রাসুল (সাঃ) এর মৃত্যুক্ষণ এসে পড়েছিল, তিনি তাঁর সামনে রাখা পানির পাত্র থেকে পানি নিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মাসেহ করতেন আর বলতেন –

لا اله الا الله ان للموت سكرات

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নিশ্চয়ই মৃত্যুর অনেক যন্ত্রণা রয়েছে।’ [সহীহ বুখারি ১০/৬০৬৬ ইঃফাঃ ]

সেই দিবসের দৃশ্যাবলী

কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই শুনেছি। আল্লাহ বলেন-

إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ

সূর্যকে যখন দীপ্তিহীন করা হবে, যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে, পর্বত সমূহকে যখন চলমান করা হবে, যখন পূর্ণগর্ভা উটনী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে, এবং সমুদ্রগুলিকে যখন উদ্বেলিত করা হবে; [ সুরা তাকভীরঃ১-৬ ]

আরও ভালভাবে বুঝার জন্য আমরা ঝড়, ভুমিকম্প বা পর্বতের অগ্নুৎপাতের ধ্বংসলীলার অসংখ্য ভিডিও দেখতে পারি। কেয়ামত দিবসের তুলনায় এই সব ধ্বংসলীলা কিছুই না।

আমরা সবাই আমাদের কবর থেকে বের হয়ে আশব, আর যারা যারা অবিশ্বাসী তারা বলবে-

قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَن بَعَثَنَا مِن مَّرْقَدِنَا ۜ ۗ هَٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَٰنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ

তারা বলবেঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? দয়াময় আল্লাহ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রসূলগণ সত্যই বলেছিলেন। [ সুরা ইয়াসীনঃ৫২ ]

সেইদিন সূর্যকে আমাদের নিকটবর্তী করা হবে, আর সবাই এমনভাবে ঘামতে থাকব যে কারও কারও ঘাম তাদের চিবুক পর্যন্ত উঁচু হবে। শুধুমাত্র সাত শ্রেণীর মানুষ ছায়ার নিচে থাকবে যাদেরকে আল্লাহ নিরাপদে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর বাদ বাকি সবাই ভয়াবহ আতঙ্কে থাকবে, তখন হঠাৎ-

وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا

এবং যখন তোমার প্রতিপালক আগমন করবেন, আর ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধ ভাবে থাকবে। [ সুরা ফাজরঃ৮৯ ]

এবং আল্লাহর নূর আসমান সমূহকে ঢেকে ফেলবে,

يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُ ۖ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَٰنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا

সেই দিন তারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে, এই ব্যপারে এদিক-অদিক করতে পারবে না; দয়াময়ের সামনে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে; সুতরাং মৃদু পদধ্বনি ছাড়া তুমি কিছুই শুনবে না। [ সুরা ত্বা-হাঃ১০৮ ]

কে থাকবে সেদিন নিরাপদে?

এর জবাব পাওয়া যাবে সুরা ফাতিহার এই আয়াতে-

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

আমরা শুধু তোমার ই এবাদত করি এবং শুধু তোমার ই সাহায্য প্রার্থনা করি

এর প্রমান কি? আল্লাহ বলেন-

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

আমি নূহ (আঃ)কে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম, সুতরাং সে তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলঃ হে আমার জাতি! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন সত্য মা’বুদ নেই, আমি তোমাদের প্রতি এক মহা দিবসের শাস্তি আশঙ্কা করছি। [ সুরা ‘আরাফঃ৫৯ ]

কাজেই, সেই প্রতিফল দিবসের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহর ইবাদত ই আমাদের সেই মহাদিবসের শাস্তি থেকে বাঁচাবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা যখন এই আয়াত গুলি তেলাওয়াত করব, তখন আমরা মনে রাখব যে আল্লাহই আমাদের ‘মা-লিক’ এবং ‘মালিক’, এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবো আর সেইদিন তিনি ছাড়া কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে খুশুর সাথে নামাজ আদায় করার তৌফিক দিন। আমীন।

(পর্ব ১৯)

শুধু তোমারই ইবাদত করি

ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন, আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা ১০৪ টি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। সেই সবগুলো কিতাবের সারাংশ হল কুরআন, আর সম্পূর্ণ কুরআনের সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় সুরা ফাতিহায়। আর সম্পূর্ণ সুরা ফাতিহার সারাংশ হল এই আয়াতঃ

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। (সুরা ফাতিহাঃ৪)
আল্লাহর রহমত ও সর্বময় পরম ক্ষমতার বিষয়ে জানার পর, এবং তারই কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেকথা উপলব্ধি করার পর, এই আয়াত টি আমাদের জানিয়ে দেয় আমাদের এই পৃথিবীতে কি করণীও, আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি- শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা আর এই কাজেও তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করা।

ইবাদতের আন্তরিকতা ও সততা

অন্তরের ইবাদতের একটা অংশ হল শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। মহানবী (সাঃ) বলেন,

قال الله تبارك وتعالى أنا أغنى الشركاء عن الشرك من عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته وشركه

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি সমস্ত অংশীদারদের চাইতে অংশীদারি (শিরক)থেকে অধিক অমুখাপেক্ষী। কেউ যদি এমন কাজ করে, যাতে সে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করে, তাহলে আমি তাকে তার অংশীদারী (শিরক) সহ বর্জন করি’(অর্থাৎ তার আমল্ল নষ্ট করে দেই) [বুখারী ২৯৮৫]
আমরা যখন বলি ‘ইয়্যাকা না’বুদু’ বা আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, তখন আমরা আমাদের ‘ইখলাস’ বা ইবাদতের সততা ও আন্তরিকতার ঘোষণা দেই, এবং নিজেদেরও সেকথা স্মরণ করাই। কাজেই আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিৎ- আমরা যখন কোন ভাল কাজ করি, আমরা কি অন্যদের কাছ থেকে কোন রকম প্রশংসা বা বাহবা আশা করি? আমরা যদি তা না পাই, তাহলে কি মনে মনে কষ্ট পাই বা হতাশ হই? যদি হই তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের সেই ‘ভাল কাজটি’ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছিল না, পাশাপাশি অন্যের জন্যও ছিল। ইবনে কাইয়্যিম বলেছিলেন, এর প্রতিকার হল, এটা বোঝা ও আত্মস্থ করা যে- কারও প্রশংসা আমাদের কোনরকম উপকার করতে পারবে না, কারও নিন্দাও আমাদের কোনরকম ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন, যদি সবাই ভাবে যে আমরা সত্যবাদী, কিন্তু আল্লাহর কাছে আমরা আসলে তার উল্টোটা, সেই ‘সবাই’ কি আমাদের কোন উপকারে আসবে? অথবা কোন ধনী লোকের ব্যপারে যদি সবাই বলে বেড়ায় যে ‘সে ঋণগ্রস্ত, সে আসলে ধনী নয়’, তাহলে কি এতে ঐ ধনী ব্যক্তির সম্পদের কোন ঘাটতি হয়ে যাবে?

উপরন্তু, আমাদের এটা মনে রাখা উচিৎ যে, অন্যরা যদি এটা বুঝতে পারে যে আমরা অন্যের প্রশংসা পাওয়ার জন্য কোন নেক কাজ করছি, তাহলে তারাও আমাদের ব্যপারে মন্দ ধারনাই পোষণ করবে। তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের মনের এই অবস্থা গোপন করব, যখন আমরা অন্যেরা কি ভাববে এটা নিয়েই বেশী চিন্তিত থাকি; অথচ যিনি আমাদের অন্তরের সব খবর জানেন তার ব্যপারেই আমরা গাফেল থাকি? এই লোক দেখানো আমলই হল ‘রিয়া’।

সবচেয়ে জঘন্য রিয়া হল সেটা যেটাতে মিথ্যাও মিশ্রিত থাকে, যেমন এমন কোন লোক যে এমন আমলের জন্য মানুষের কাছে প্রশংসিত হতে চায় যা সে আসলে করেইনি। আল্লাহ বলেনঃ

لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوا وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلَا تَحْسَبَنَّهُم بِمَفَازَةٍ مِّنَ الْعَذَابِ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“যারা স্বীয় কৃতকর্মে কর্মে সন্তুষ্ট এবং যা করেনি তজ্জন্যে প্রশংসা প্রার্থী, এরূপ লোকদের সম্বন্ধে ধারনা করোনা যে, তারা শাস্তি হতে বিমুক্ত বরং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(সুরা আল ইমরানঃ১৮৮)
রিয়ার প্রতিকার কি? সবসময়, বারবার নিজেদের নিয়তের ব্যপারে নিজেকে প্রশ্ন করা এবং নিজেকে সংশোধনের সঙ্কল্প করা। আমরা যদি অনেক আমল জনসম্মুখে করি, তাহলে তার সমান অথবা তার চেয়ে বেশী আমল গোপনে কাউকে না বলে করার চেষ্টা করতে হবে। এটা হল এই আয়াতের সারাংশ, এবং এইজন্য আমরা প্রতিদিন এটা পড়িঃ

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা’ঈন – আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
গোপন রিয়া

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শৈশব থেকেই আমাদের ভেতর রিয়ার বীজ বপন করা হয়ে থাকে। কিভাবে? আমাদের বলা হয়, ‘এমন করো না, লোকে কি বলবে?’ অথবা বলা হয়, ‘অমন করো না, তুমি কি চাও লোকে তোমাকে বলুক তুমি আদব কায়দা জান না?’। অথচ বলা উচিৎ ছিল- এটা বা ওটা করোনা কারণ আল্লাহ দেখছেন। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমরা বেড়ে উঠেছি রিয়ার মধ্য দিয়েই। লোকজনের অনুপস্থিতিতে আমরা অনেক কিছুই করে ফেলতে পারি, কারণ কেউ তো দেখছে না! এভাবে আমরা আল্লাহর সামনে লজ্জা বোধ করার চেয়ে মানুষের সামনে বেশী লজ্জা বোধ করি।

এই গোপন রিয়া আমাদের অন্তরের গভীরে এত দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে যে, যখন আমরা নির্জনে ইবাদত করি বা নির্জনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করি, তখনও অজান্তেই রিয়া করে ফেলি। কিভাবে? পরবর্তীতে নিজের এমন কাজের জন্য নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে বা এমন আশা করে করে যে – কেউ যদি দেখত তাহলে আমাদের কেমন ভাবত! অথবা, আমরা যখন নিজেদের মহান মৃত্যুর কথা কল্পনা করি যেমন, সেজদারত অবস্থায় মৃত্যু, তখন আরও যদি ভাবি এমন ভাবে মৃত্যু হলে লোকে কি কি ভাল কথা বলাবলি করবে, এমনটি না ভেবে যে আল্লাহর সাথে এমন ভাবে সাক্ষাত হলে কেমন হবে।

আমাদের অন্তরের এমন অবস্থায় আমাদের উচিৎ এই আয়াতটি বেশী বেশী পড়ে অন্তরকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করা, আমাদের নিয়তের ব্যপারে সজাগ থাকা, এবং ইবাদতের সততার গুরুত্ব অনুধাবন করা।

নরম অন্তরের মানুষেরা

যারা সত্যিকার অর্থে এই সুরা ও এই আয়াতের মর্ম বুঝেছেন তাদের উপর এটি সুগভীর প্রভাব ফেলে। মুযাহিম বিন জাফর এর সূত্রে, সুফিয়ান আস-সাওরি নামক একজন মহান তাবি’ই (মহানবী (সাঃ) এর পরের প্রজন্মের মানুষ) একদিন মাগরিব নামজের ইমামতি করছিলেন। তিনি যখন সুরা ফাতিহার এই আয়াতে এসে পৌঁছলেন, তিনি এমন ভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন যে তিনি আর পরবর্তী আয়াত তেলাওয়াত করতে পারছিলেন না। তারপর তিনি আবার প্রথম থেকে এই সুরা পড়া শুরু করলেন।

মোহাম্মদ আল হিমসি বর্ণনা করেছেন ইবনে আবি আল হাওয়ার নামক আরেকজন সালাফ (সঠিক পথের অনুসারী প্রথম দিকের সত্যনিষ্ঠ মুসলিম) এর কথা, যিনি কাবা শরীফে ঈশার নামাজ পড়ছিলেন। যখন তিনি এই আয়াতে আসলেন “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা’ঈন” তিনি এর পরে আর পড়তে পারছিলেন না, তিনি ভীষণ কাঁদতে লাগলেন। এটা দেখে আল হিমসি তার কাবা ঘর তাওয়াফ করা চালিয়ে গেলেন, এবং যখন তিনি আবার ঘুরতে ঘুরতে আল হাওয়ারির কাছে আসলেন, দেখলেন তিনি তখনও ঐ আয়াতটিই তেলাওয়াত করছেন।

আপনার কি ধারণা তারা অতীতের লোক ছিলেন বলেই এমন করে অনুভব করতে পারতেন? তাহলে এই ভিডিওটি দেখুন। https://www.youtube.com/watch?v=7EQWYLlxz6o

এটা ছিল শায়খ সউদ আল-সুরাইমের প্রথম বছর যে বছর তিনি পুরো রমজান মাসে তারাবী নামাজের তেলাওয়াত করেন। সাধারণত সেখানে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে ২৭ রমজানে (লায়লাতুল কদরের আশায়) এবং ২৯ রমজানে কারণ সেদিন কুরআন তেয়ালাওাত খতম দেওয়া হয়। যাই হোক, বিশেষ করে সেই বছর ২৭ রমজানে কুরআন তেলাওয়াত খতম করা হয়েছিল- একারনে মানুষের উপস্থিতি সেদিন এত বেশী হয়েছিল যে তা বিচার দিবসের কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত এ কারনেই শায়খ এত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যখন তিনি তেলাওয়াত করছিলেন – ‘মালিকি ইয়াও মিদ্দীন’ (প্রতিফল দিবসের মালিক)।

শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি – বিনম্রতা

আন্তরিকতা ও সততা হল সেই উপকরণ যার কারনে আমরা নামাজ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে পারি; আর আমরা সত্যিকার অর্থে আন্তরিকও হতে পারব না যদি আল্লাহর কাছে সাহায্য না চাই। একারনে আল্লাহ আমাদেরকে ‘শুধু তোমারই ইবাদত করি’ বলার পরপরই শিখিয়েছেন ‘শুধুমাত্র তোমার সাহায্য প্রার্থনা করি’। হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন-

كلكم ضال الا من هديته فاستهدوني اهدكم

“তোমাদের সকলের জন্য রয়েছে ধ্বংস তাদের ছাড়া যাদের আমি সাহায্য করি, অতএব আমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং আমিই তোমাদের সাহায্য করব”।
একারনে পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন-

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

আমাদের সরলতম পথ দেখাও(সুরা ফাতিহাঃ৫)
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ কেমন নিখুঁত ভাবে তার কালাম গুলো সাজিয়েছেন!

ইবনে আল কাইয়্যিম বলেছেন তিনি ইবনে তাইয়মিয়্যাকে বলতে শুনেছেন, ‘ইয়্যাকা না’বুদু’ এবং ‘ইয়্যাকা নাসতা’ঈন’ বা ‘শুধুমাত্র তোমারই বন্দেগী করি’ ও ‘শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ কথা দুটি মানুষের অহংকার ও দম্ভকে দূর করে দেয়। আমরা যখন বলি ‘আমরা তোমারই সাহায্য চাই’ তখন আমরা স্বীকার করে নেই যে আমাদের সেই ক্ষমতাটি নেই যে আমরা নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করতে পারব এবং আমাদের সকল বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন। আমরা প্রায়ই এমন কথা শুনি বা বলি যে ‘কেউ এত অহঙ্কারী যে কারও কাছে হাত পাতে না’, এমন লোক নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু মনে করে বা নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারে বলে মনে করে। অপরদিকে এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা স্বীকার করছি যে আমরা অক্ষম, তাই সেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যিনি কারও মুখাপেক্ষী নন।