(পর্ব ২০)
আগের পর্বগুলোতে সুরা ফাতিহার আলোচনায় জেনেছি, কিভাবে বিশেষতঃ এই সুরাটির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে কথোপকথন করতে পারি, এবং আল্লাহ প্রতিটি আয়াতের সাথে সাথে কিভাবে জবাব দেন। এই সুরা আল্লাহর রুবুবিয়াতের (আল্লাহই সমস্ত সৃষ্টি জগতসমূহের রব) ঘোষণা দেয়, সাথে সাথে এটাও বর্ণনা করে যে আল্লাহর রুবুবিয়াতে রয়েছে তাঁর রহমত ও করুনার প্রাধান্য, যে কারনে সৃষ্টি জগতসমূহের রবের প্রশংসার পর পরই আমরা বলি –‘আর রহমানির রহীম’। কিয়ামত দিবসের মালিকত্বের বর্ণনার আগেই আমরা জানতে পারি যে তাঁর করুনা তাঁর ক্রোধের চেয়ে বেশী। অতঃপর আমরা জানতে পারি কেন আমাদেরকে এই করুনা করা হয় – যাতে আমরা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করি। এবং তাঁর ইবাদত করতেও আমরা তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। একারনে আমরা বলি –
إِيّاكَ نَعبُدُ وَإِيّاكَ نَستَعينُ
“শুধুমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি”
কাজেই আমরা যদি সাহায্য পেতে চাই, আমাদেরকে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
পথপ্রদর্শন
এখন আমরা প্রকৃতপক্ষে দোয়া শুরু করছি।
اهدِنَا الصِّرٰطَ المُستَقيمَ ﴿٦﴾ صِرٰطَ الَّذينَ أَنعَمتَ عَلَيهِم غَيرِ المَغضوبِ عَلَيهِم وَلَا الضّالّينَ ﴿٧
“আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন; তাদের নয় যাদের প্রতি আপনার গজব বর্ষিত হয়েছে এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট।” (সুরা ফাতিহাঃ৬-৭)
ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, সুরা ফাতিহার এই দোয়াটিই হল সর্বশ্রেষ্ঠ, বিজ্ঞতম, এবং সবচেয়ে উপকারী দোয়া। আল্লাহ যদি আমাদের সরলতম পথ প্রদর্শন করেন, তিনি আমাদের তাঁর ইবাদত করতেও সাহায্য করেন।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, ‘আমি যদি সঠিক পথেই থাকি তবে আবার কেন পথপ্রদর্শনের জন্য প্রার্থনা করব? আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, কুরআন তেলাওয়াত করি- আল্লাহ তো নিশ্চয়ই আমাকে হেদায়াত করেছেনই।’ প্রথমত, হেদায়াতের সর্বোচ্চ পর্যায় হল মহানবী (সাঃ) এর সমান পর্যায়ে পৌছতে পারা, অথচ আমরা কেউই এমনকি সাহাবীদের পর্যায় পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়েছি বলেও দাবী করতে পারি না। একারনেই আমরা প্রার্থনা করি যাতে আল্লাহ আমাদের আরও বেশী করে হেদায়াত দান করেন। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর উপর নির্ভরতা ও তাঁর সামনে আমাদের বিনয়াবনত অবস্থার উপর হেদায়াত প্রাপ্তি নির্ভর করে, এবং আল্লাহর কাছে আরও হেয়াদায়াতের জন্য প্রার্থনাও সেটাই সাক্ষী দেয়। আমরা যদি আল্লাহর কাছে প্রার্থনাই না করি, তবে আমরা কি করে দাবী করতে পারি যে আমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হয়েছি? মহানবী (সাঃ) বলেনঃ
من لم يسأل الله يغضب عليه
‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হন’ (সুনান ইবনে মাজাহঃ৩৮২৭ ইঃফাঃ)
ইবনে কাইয়্যিম বলেছেন, আমরা আল্লাহর কাছে যে সরল পথ প্রদর্শনের জন্য প্রার্থনা করি তাতে দুইটি বিষয় রয়েছে, ইলম এবং আমল, আবার এই দুটোই বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ। কোন বান্দার সমস্ত বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকতে পারে, যেমন কি করা উচিত, কোনটা পরিত্যাগ করা উচিত, কিসে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন, কিসে অসন্তুষ্ট হবেন। বান্দার অজ্ঞতার পরিমান তার জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশী হতে পারে। কাজেই, আমরা আল্লাহর কাছে যখন পথ প্রদর্শনের বা হেদায়াতের প্রার্থনা করছি, তখন আল্লাহর কাছে আমাদের জ্ঞানের বৃদ্ধির জন্যও প্রার্থনা করছি। আবার অনেক সময়, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমরা কিছু আমল করতে পারি আবার অনেক কিছুই করতে পারি না। যেমন আমরা জানি, আমাদের হজ্জ করতে যাওয়া উচিত, কিন্তু আমাদের অনেকেরই সাধ্য থাকে না। আবার, অনেক সময় আমাদের জ্ঞান আর সাধ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের নফসের বা প্রবৃত্তির কারনে অনেক আমল আমরা করতে পারি না। যেমন আমরা কিয়াম-উল-লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজের অপরিসীম ফজীলতের কথা জানি, কিন্তু আলস্যের কারনে অনেকেই এই নামাজ পড়ার উদ্যোগ নিতে বা ঘুম থেকে উঠতে পারি না। আমরা যখন আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাই, তখন এই প্রার্থনাও করি যেন আল্লাহ আমাদের অন্তর বা নফসকেও সংশোধন করে দেন।
আবার, এমনও হতে পারে যে আমাদের জ্ঞান, সাধ্য, সৎ আমল করার সদিচ্ছা সবই আছে, কিন্তু তারপরও হয়তো আমরা সত্যিকার ভাবে আন্তরিক হতে পারছি না। হয়তো আমাদের নিয়ত পুরপুরি খাঁটি নয়। আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করার অর্থ এটাও প্রার্থনা করা যেন তিনি আমাদের আন্তরিক হওয়ার তৌফিক দেন। কারণ আমলে অন্তর উপস্থিত থাকা আমাদের সঠিক পথে অটল থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করার অর্থ এটাও প্রার্থনা করা যেন আমরা মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাহ পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারি, এবং এতে দৃঢ় ও অটল থাকতে পারি।
সীরাতুল মুসতাকিমঃ সরলতম পথ
“আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন যে রাসুল (সাঃ) কি কিয়ামত দিবসে উনার হয়ে সুপারিশ করবেন কিনা। উত্তরে নবীজী (সাঃ) বললেন, ‘করব’। তখন আনাস (রাঃ) আবার প্রশ্ন করলেন, আমি আপনাকে ঐ দিন কোথায় খুঁজে পাব? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘আমাকে যখন তোমার প্রয়োজন হবে, আমাকে পুলসীরাতের কাছে খুঁজবে’। আনাস (রাঃ) আবার জিজ্ঞেস করলেন, আর যদি সেখানে খুঁজে না পাই? মহানবী (সাঃ) বললেন- ‘তখন আমাকে মীযানের (দাঁড়িপাল্লার) কাছে খুঁজবে’। আনাস (রাঃ) আবার প্রশ্ন করলেন, মীযানের কাছেও যদি না পাই তবে আপনাকে কোথায় খুঁজে পাব? মহানবী (সাঃ) জবাবে বললেন, ‘তখন আমাকে হাউয এর কাছে খুঁজবে। আমি তখন এই তিনটি জায়গা ছাড়া কোথাও যাবো না।” (তিরমিযীঃ ২৪৪২; আহমাদঃ ১২৮২৫)
কাজেই, রাসুল (সাঃ) এর কাছে সুপারিশ চাওয়ার প্রথম জায়গা হবে পুলসীরাত। পুলসীরাত হল জাহান্নামের উপর দিয়ে সেতু যার অপর প্রান্তে রয়েছে জান্নাত। এটি চুলের মত সরু এবং পিচ্ছিল একটি সেতু। আমরা কিভাবে এই সরু ও পিচ্ছিল পুলসীরাত পার হব? মানুষ তার আমল অনুযায়ী এই সেতু পার হবে।
রাসুল (সাঃ) বলেন, পুলসীরাত হল মারাত্মক পিচ্ছিল জায়গা, যার উপর লহার আংটা এবং বড় ও বাঁকা ফাটা থাকবে, যা দেখতে নাজদ এলাকার সা’দান গাছের কাঁটার মত। মুমিনগণ এ পুলসীরাতের উপর দিয়ে কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ উড়ন্ত পাখির গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ উটের গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ সহিহ সালামতে পার হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ ক্ষতবিক্ষত দেহে পার হবে। আবার কোন হতভাগ্য আগুনে পতিত হবে। শেষ নাগাত মু’মিনরা দোযখ থেকে নাজাত পেয়ে যাবে। (মুসলিমঃ ৪৬২)
ইবনে আল কাইয়্যিম বলেন- আল্লাহ এই দুনিয়াতে সরল পথ অবলম্বন করতে বলেছেন। যে এই দুনিয়াতে সরল পথে চলার জন্য হেদায়াত প্রাপ্ত হবে, পরবর্তী জীবনে সেই পুলসীরাত ও তার জন্য সহজ হবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা এই জীবনে সরল পথের উপর কতটুকু দৃঢ় থাকব তার উপর আমাদের আখেরাতের জীবনে সেই সীরাতে আমাদের অবস্থা নির্ভর করবে।
আমরা কি তাহলে এখন বুঝতে পারছি, যে দোয়াটি আমরা প্রতিদিন করছি তার গুরুত্ব কতখানি?
আমীন
যখন আমরা সুরা ফাতিহার শেষে “আমীন” (হে আল্লাহ, কবুল কর) বলি, তখন তা আমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ থেকে বলা উচিত। কারণ, এই সুরার সমস্ত অর্থ অনুধাবন করার পর, আমাদের অন্তরে গভীর অনুরক্তি ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত যেন আল্লাহ আমাদের এই প্রার্থনা কবুল করে নেন। আবার, আমাদের মন যদি আমাদের প্রার্থনার মধ্যে না থাকে, তাহলে সে দোয়ার জবাব আল্লাহ দিবেন না। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-
ادعوا الله وأنتم موقنون بالإجابة فإن الله لا يستجيب من قلب غافل لاه
“আল্লাহর কাছে এই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করবে যে আল্লাহ জবাব দিবেন, জেনে রেখ অবহেলার আর অমনোযোগী হৃদয়ের প্রার্থনার জবাব আল্লাহ দেন না।” (তিরমিযী)
ইবন আল কাইয়্যিম বলেছেন, যখন কেউ সুরা ফাতিহা পড়ে, সে যেন প্রতিটা আয়াত থেমে থেমে পড়ে, কারণ আল্লাহ প্রতিটি আয়াতের জবাব দিচ্ছেন। উম্মে সালামা (রাঃ) এর বর্ণনায় রাসুল (সাঃ) এমন করে থেমে থেমে পড়তেন।
(পর্ব ২১)
গত পর্বে আমরা সরল পথের কথা বলেছিলাম যেটি আমাদের এই জীবনে অনুসরণ করতে হবে যাতে আমরা পরকালে সহজে পুলসীরাত পার হতে পারি। আমরা তখন সূরা ফাতিহায় আরও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করি আমরা কোন সরল পথের সন্ধান চাই। আমরা বলিঃ
صراط الذين أنعمت عليهم
“তাদের পথ যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন”
আমরা যখন এই আয়াতটি পড়ব, আমাদের অন্তরকে নরম করব, কারণ আমরা সেই নবী (আঃ) গণ, রাসুল (সাঃ), সাহাবাগণ (রাঃ), সত্যের পথ অনুসরণকারীগণের কথা স্মরণ করছি যাদের উপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ রহমত নাযিল করেছেন। এই আয়াতটি পড়ে আমরা স্বস্তি পাই কারণ আমরা জানতে পারি, যারা এই সরল পথ অবলম্বন করে চলেন আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন; কাজেই যখন অন্যেরা আপনাকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, আপনার আকীদার ব্যপারে লজ্জিত হবেন না। অথবা আপনার মদ্যপান না করা, দাড়ি-টুপি পড়া বা হিজাব পড়া নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, কুঁকড়ে যাবেন না। কুরআনের অনেক সূরাতে আমরা নবীগনের এমন কাহিনী পাই, যা আমাদের রাসুল (সাঃ) কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নাযিল করা হয় যখন তিনি কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতেন। এই আয়াতটিও আমাদের জন্য ঠিক তেমনই হওয়া উচিত- আমাদের মনে রাখা উচিত আমরা যতক্ষণ সরল পথ অনুসরণ করব, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।
এই আয়াতের বাকী অংশে আমরা পড়িঃ
غير المغضوب عليهم ولا الضالين
“তাদের পথ নয় যাদের উপর আপনার গজব বর্ষিত হয়েছে এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট।”
তারা কারা যাদের উপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হয়েছে? ইবনে কাসীর বর্ণনা করেন এরা তারা যারা সব কিছু জেনেও তা অনুসরণ করে না। আর পথভ্রষ্ট তারা যারা জ্ঞান রাখে না। আমাদের এই দুই পথ সম্পর্কেই সাবধান থাকতে হবে যাতে আমরা এর কোন একটিও অনুসরন না করি। কাজেই সরল পথে থাকতে হলে আমাদের জ্ঞান এবং আমল দুটোরই সমন্বয় করতে হবে।
সূরা ফাতিহা আমাদের সঠিকভাবে দোয়া করার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেয়- যে আমরা প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে দোয়া শুরু করব, তারপর আমাদের প্রয়োজনের কথা বলব।
আমীন
আমরা গত পর্বে ‘আমীন’ বলা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে জেনেছি, যে আমরা কিভাবে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে আকাঙ্খা করব যেন তিনি আমাদের সূরা ফাতিহায় যা চাওয়া হয়েছে তা দেন। আবার আমরা যখন আমীন বলি তখন অন্য ব্যপারও ঘটে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
“যখন ইমাম বলবে ‘গাইরিল মাগদুবি ‘আলাইহিম ওয়ালাদ্দ-ল্লীন’ তখন তোমরা বলবে ‘আ-মীন’- অর্থ আল্লাহ আপনি কবুল করুন। যার পড়া ফেরেশতাদের পড়ার সময়ের সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহীহ বুখারীঃ ৪১২৩ ইফা)
আমরা যখন আমীন বলি যার অর্থ ‘হে আল্লাহ কবুল করুন’, ফেরেশতারাও বেহেস্তে আমীন বলে, আর তা যদি আমাদের বলার সাথে মিলে যায় তাহলে আল্লাহ আমাদের পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেবেন। একারনেও আমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে এটা বলা উচিত- যাতে আল্লাহ আমাদের আন্তরিক দোয়া কবুল করেন এবং আমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেন।
কুরআন
আমরা সূরা ফাতিহা পড়ার পর ছোট কোন সূরা তেলাওয়াত করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাঝে মাঝে আমরা নামাজে অতিঅভ্যস্ততার কারণে মনেও করতে পারি না কোন সূরা পড়ে ফেলেছি। আমাদের যাদের এই সমস্যা আছে, তাদের আল্লাহর এই কথা গুলো স্মরণ করা উচিত যে, আল্লাহ বলেছেন –
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪)
মুহাম্মাদ বিন কা’ব আল ক্কারযী বলেন- রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সূরা যালযালা থেকে সূরা ক্কারিয়াহ পড়া এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা আমার কাছে চিন্তাবিহীন সমগ্র কুরআন পড়ার চেয়ে বেশী পছন্দনীয়।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর একজন প্রতিবেশী বর্ণনা করেন যে, যখন ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন তখন তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করে থামতেন। আবার কিছুক্ষন পর আরেকটি আয়াত তেলাওয়াত করে থামতেন। প্রতিবেশীটি তাকে এরূপ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তিনি এরূপ করতেন যাতে আয়াতের কথাগুলোর প্রতি তিনি মনোনিবেশ করতে পারেন। আমরা প্রায়ই গুনগত মানের চেয়ে পরিমানের দিকে বেশী প্রাধান্য দেই। আমরা কেউ কেউ পুরো এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করে ফেলি, অথচ এর পর যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পারা পড়ে কি কি শিখলাম, হয়তো কিছুই বলতে পারি না। ইবনে কাইয়্যিম বলেন কেউ যদি কুরআন পড়ে লাভবান হতে চায়, সে যেন নিশ্চিত করে যে তার অন্তরও তারা সাথে উপস্থিত আছে; সে যেন আল্লাহর কথাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তেলাওয়াত করে বা শ্রবণ করে, এটা যেন ভাবে যে আল্লহ তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছেন।
আল্লাহর এই সব কালাম এতই শক্তিশালী যে আল্লাহ বলেন-
لو أنزلنا هذا القرآن على جبل لرأيته خاشعاً متصدعاً من خشية الله
“যদি আমি এই কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি দেখতে যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা’আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে।” (সূরা আল হাশরঃ ২১)
সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের জন্য কেমন রূপক উপস্থাপন করেছেন। কেমন করে কুরআনের ওজন বুঝিয়েছেন; যা আমরা প্রতিদিন তেলাওয়াত করে যাই কিন্তু মোটেও অনুধাবন করি না যে কথাগুলো আমাদের উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে এবং আমাদের পথপ্রদর্শনের জন্য বলা হয়েছে। আমরা অনেকেই বলি যে আমরা তো আরবী ভাষা বুঝি না, অথচ আমাদের নামাজে পড়ার জন্য কিছু সূরা বা কিছু আয়াত অন্ততঃ মুখস্থ করা আছে। আমাদের সেই সব সুরা বা আয়াতের তাফসীর পড়তে হবে যাতে আমরা তার অর্থগুলো বুঝতে পারি এবং তা তেলাওয়াত করার সময় আমাদের অন্তর তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই যে প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃ কয়েক পৃষ্ঠা করে যে সূরা গুলো জানি তার তাফসীর পড়ব তাহলে বেশী সময়ও লাগবে না। আমরা কয়েকজন একত্র হয়েও এই কাজ করতে পারি এবং জামা’আতে আল্লাহর কালাম নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য তাতে বরকতও লাভ করতে পারি।
ইবনে কাইয়্যিম বলেন, আমাদের মধ্যে ভালবাসা, ভয় এবং আশা এই তিন অনুভূতি থাকতে হবে। আমরা যখন আল্লাহর রহমত বিষয়ক আয়াত পড়ব তখন আমাদের জীবনে আল্লাহর রহমতের কথা স্মরণ করে অন্তরে ভালবাসা অনুভব করতে হবে। যখন আমাদের পূর্ববর্তীদের কথা পড়ব ও তাদের উপর আসা শাস্তির কথা পড়ব, তখন আমাদের অন্তরে এই ভেবে ভয় অনুভব করতে হবে যে আমরাও তাদের অনুরূপ শাস্তি পেতে পারি। যখন আমরা এমন আয়াত পড়ব যেখানে আল্লাহর ক্ষমার কথা বলা হয়েছে, তখন আমরা আশান্বিত হব আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নামাজ কোন একতরফা কথামালা নয়, নামাজ হল আল্লাহর সাথে একান্তে কথোপকথন। আর কুরআন হল আমাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহর বানী।
(পর্ব ২২)
রুকুঃ বাহ্যিক আমল
নিজেদেরকে নামাজের জন্য প্রস্তুত করার মানে হল এটা উপলব্ধি করা যে আমরা কার সামনে দাড়াতে যাচ্ছি- আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’আলার সামনে, আমাদের রবের সামনে, সমস্ত দয়ালুর চেয়েও মহান সেই দয়ালু ও পরম করুনাময়ের সামনে। আমরা বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন করি কারণ আমরা পবিত্রতম সত্তা আল্লাহর সামনে দাঁড়াচ্ছি; আর আমাদের অন্তরকে বিনীত করি কারণ আমরা তাঁর সামনে দাঁড়াচ্ছি যিনি সর্বোচ্চ মহান। আমাদের মন ভয় আর আশার মাঝে অবস্থান করে, কিন্তু পুরো মন জুড়ে থাকে তাঁর প্রতি ভালোবাসা। যখন আমরা সূরা ফাতিহা পড়ি, আমরা প্রতিটি আয়াত একটু থেমে থেমে পড়ি কারণ আল্লাহ স্বয়ং আয়াতগুলোর জবাব দিচ্ছেন এবং আমরাও যেন সেই আয়াত নিয়ে চিন্তা করতে পারি। আর যখন এরপর অন্য একটি ছোট সূরা পড়ি, আমরা বুঝতে পারি এই কালামগুলো আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন।
যখন আমরা সূরা ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা পাঠ করে শেষ করব; তারপর আমাদের দুইহাত উঠিয়ে বলব “আল্লাহু আকবর”।
‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখেছি, তিনি যখন সালাতের জন্য দাঁড়াতেন তখন উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। এবং যখন তিনি রুকু’র জন্য তাকবীর বলতেন তখনও এরূপ করতেন। আবার যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখনও এরূপ করতেন এবং ‘সামি’আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতেন। তবে সিজদার সময় এরূপ করতেন না।’ (সহীহ বুখারীঃ ৭০০ ইফা)
মনে রাখবেন, নামাজের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ভঙ্গি পরিবর্তনের সময় আমরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলি (রুকু থেকে উঠার সময় ছাড়া)। এতে আমরা নিজেদেরকে সজাগ করি এবং এটা স্মরণ করাই যে আমাদের মনের ভেতরের দুনিয়াবি সমস্ত কিছুর চেয়ে আল্লাহ মহান। তারপর রুকুতে আমরা আমাদের মাথা ঝুকাই। আর যখন আমরা মাথা নোয়াবো, তখন তা আমরা আমাদের নবী (সাঃ) অনুকরণে করব। রুকুর সময় হাত দুটিকে হাঁটুর উপর দৃঢ়ভাবে রাখব এবং আঙ্গুলগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে রাখব (সুনানে আবু দাউদঃ ৮৬৮ ইফা)।
আমরা অনেকেই রুকু এবং সিজদায় যেয়ে তাড়াহুড়া করি, অথচ এই রোকনগুলোতে যথাযথ সময় পর্যন্ত আমাদের অবস্থান করা খুবই জরুরী।
‘বারা’আ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালাতে দাঁড়ানো ও বসা অবস্থা ছাড়া নবী (সাঃ) এর রুকু, সিজদা, দুই সিজদার মধ্যবর্তী সময় এবং রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো, এগুলো প্রায় সমপরিমান ছিল।’ (সহীহ বুখারী ৭৫৬ ইফা)
‘হাফস ইবনে উমর (রাঃ)… যায়িদ ইবনে ওয়াহব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযাইফা (রাঃ) এক ব্যাক্তিকে দেখলেন যে, সে রুকু ও সিজদা ঠিকমতো আদায় করছে না। তিনি তাকে বললেন, তোমার সালাত হয়নি। যদি তুমি (এই অবস্থায়) মারা যাও, তা হলে আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে প্রদত্ত আদর্শ হতে বিচ্যুত অবস্থায় তুমি মারা যাবে।’ (সহীহ বুখারীঃ ৭৫৫ ইফা)
রুকুর দোয়া
আমরা আগের পর্বগুলোতে উল্লেখ করেছিলাম যে নামাজের শুরুতে বিভিন্ন দোয়া বা সানা আছে (পর্ব ১৩)। ঠিক তেমনি রুকুরও বিভিন্ন দোয়া আছে। আমরা চেষ্টা করব সেই দোয়া গুলো মুখস্থ করে নিতে এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেক সময় একেক দোয়া পড়তে; যাতে দোয়া গুলো আমাদের সচেতন প্রার্থনা হয়, শুধুমাত্র মুখস্থ বুলি না হয়।
১। আমরা তিনবার বলবঃ
سبحان ربي العظيم
সুবহানা রব্বিয়াল ‘আযীম
“আমার মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি” [সহীহ আত-তিরমিযী ১/৮৩]
যখন আমরা বলি ‘সুবহানাল্লাহ’ বা ‘সুবহানা রব্বিই’, আমরা আল্লাহ যে সমস্ত রকম অপূর্ণতা বা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত তা ঘোষণা করছি। আর ‘রব্বিই’ বলতে ‘আমার রব’ বোঝায়, যা দিয়ে আমাদের সাথে আল্লাহর অতি নিকট-সম্পর্ক ও ভালোবাসা অনুভব করি।
২।
سُبُّوحٌ، قُدُوسٌ، رَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوحِ
সুব্বুহুন, ক্কুদ্দুসুন, রব্বুল মালা-ইকাতি ওয়াররুহ
“ফেরেশতাবৃন্দ এবং রুহুল কুদস (জিব্রাঈল আঃ) এর রব প্রতিপালক স্বীয় সত্তায় পূত এবং গুণাবলীতেও পবিত্র।” [মুসলিম ১/৩৫৩, আবু দাউদ ১/২৩০]
৩।
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي
সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রব্বানা ওয়া বিহামদিকা আল্লাহুম্মাগফিরলী
“হে আল্লাহ! আমাদের রব। তোমার পূত পবিত্রতা ঘোষণা করি, তোমার প্রশংসা সহ। হে আল্লাহ আমাকে তুমি মাফ করে দাও।” [বুখারী ১/৯৯, মুসলিম ১/৩৫০]
৪।
اللَّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ خَشَعَ لَكَ سَمْعِي، وَبَصَرِي وَمُخِّي، وَعَظْمِي، وَعَصَبِي، وَمَا اسْتَقَلَّ بِهِ قَدَمِي”
আল্লাহুম্মা লাকা রাকা’তু ওয়াবিকা ‘আ-মানতু ওয়ালাকা আসলামতু খশা’আ লাকা সাম’ঈ ওয়া বাসারী ওয়া মুখখী ওয়া ‘আযামী ওয়া ‘আসাবী ওয়া মাতাক্কল্লাবিহী ক্কদামী
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রুকু (মাথা অবনত) করেছি, একমাত্র তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি, আমার কান, আমার চোখ, আমার মস্তিস্ক, আমার হাড়, আমার স্নায়ু, আমার সমগ্র সত্তা তোমার ভয়ে শ্রদ্ধায় বিনয়াবনত।” [মুসলিম ১/৫৩৪]
৫।
“سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوتِ، وَالْمَلَكُوتِ، وَالْكِبْرِيَاءِ، وَالْعَظَمَةِ”
সুবহানা যীল জাবারু-তি ওয়াল মালাকু-তি ওয়াল কিবরিয়াই ওয়াল ‘আযামাতি
“পাক পবিত্র সেই মহান আল্লাহ যিনি বিপুল শক্তির অধিকারী, বিশাল সাম্রাজ্য, বিরাট গৌরব, গরিমা এবং অতুল্য মহত্বের অধিকারী।” [আবু দাউদ ১/২৩০]