সফল হওয়ার মানে কী?

বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।
আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।

إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا لِّيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا وَيَنصُرَكَ اللَّهُ نَصْرًا عَزِيزًا

ইনশাআল্লাহ আজকের এই সিক্রেট টপিক, আয়োজকদের বলেছিলাম সিক্রেট টপিক কারণ আমি তখনও এটি নিয়ে চিন্তা করছিলাম। যেটি নিয়ে আমি গত কয়েকটি মাস ধরে চিন্তা করে যাচ্ছি, সেটি নিয়ে কথা বলবো। আমি অনুভব করি যে আমাদের উম্মাহের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন অনেক গুলো ব্যাপারে বিভ্রান্তি কাজ করে। আমরা আমাদের চারপাশে বাস্তবতা দেখছি, সেটা হতে পারে রাজনৈতিক বাস্তবতা অথবা সামাজিক বাস্তবতা কিংবা ইকোনোমিক বাস্তবতা অথবা আমাদের নিজেদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত বাস্তবতা। আমাদেরকে সবসময়ই কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে, কোন একটা খবর এর অর্থ বুঝার চেষ্টা করতে হচ্ছে অথবা আমাদের জীবনের কোন একটি চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করার উপায় খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু আমি খুব বেশি একটি ব্যাপার অনুভব করি যে, আমরা আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকে আল্লাহর বইয়ের সাপেক্ষে বিচার করি না। অন্যভাবে বলা যায় যে, বাস্তবতাকে বুঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের বিভিন্ন concept কে ভালোভাবে বুঝা। এবং যখন আপনি এগুলো শিখে যাবেন, তখন আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, আপনার দৃষ্টিকোণ এবং মতামত বদলে যাবে।

আমি একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করবো। আপনি কল্পনা করুন যে আপনার চোখের দৃষ্টি খুবই দুর্বল কিন্তু আপনি আপনার চশমাটি ব্যবহার করছেন না। এই অবস্থাতেও আপনি দেখতে পারবেন, কিন্তু সেই দেখার মাঝে অনেক কিছুই মিসিং থাকবে। আপনি হয়তো একটি সাইনবোর্ডের আকৃতি বুঝতে পারবেন, কিন্তু সেটাতে কি লিখা আছে তা পড়তে পারবেন না। কিন্তু যখনই আপনি আপনার নির্দিষ্ট পাওয়ারের চশমা পড়ে নিবেন, তখনই সব কিছু পরিষ্কার ভাবে পড়তে পারবেন। এখন আপনি পবিত্র কোরআনকে এমনই একটি সঠিক পাওয়ারের চশমা হিসেবে ভাবুন। যখনই আপনি কোরআনের আলোকে বিবেচনা করবেন, চিন্তা করবেন, তখনই বাস্তবতা সহজবোধ্য হয়ে যায়। আপনি বাস্তবতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে শুরু করবেন, যা পূর্বে উপলব্ধি করেননি। আজকে যে আয়াত নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, সেই আলোচনা শুরু করার আগে আমি আরো একটি উদাহরণ দিতে চাই। আর এটা আমার জন্য প্রায় ৬ মাস থেকে একবছর বা তার থেকে বেশি সময় নিতে পারে এই সুরা ব্যাপক অধ্যয়ন করার জন্য, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে। কিন্তু এখন শুধু কিছু ধারণা সম্পর্কে বলব, তার আগে একটি উদাহরণ শুনুন। মনে করুন একদল মহিলা এবং পুরুষদের নিয়ে একটি বাসে করে ভ্রমণ করছি। আমাদের যাত্রাপথে পাহাড়ের চূড়ায় একটি অসম্ভব সুন্দর বাড়ি আমার চোখের পড়লো। বাড়িটির অন্যপাশে দিয়ে সাগর দেখা যাচ্ছে। একবারে অসাধারন সুন্দর বাড়ি। এবং বাড়িটিতে ডুকার রাস্তার সামনেই একটি আলিশান গাড়ি পার্ক করে রাখা। একইসাথে বাড়িটির পিছনে উঠানে সুইমিং-পুল সহ বিলাসিতার সকল উপকরণ উপস্থিত। ঠিক যেন দুনিয়ার বুকে এক টুকরো জান্নাত। এখন আমরা বাড়ির মালিককে ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ভিতরে যেতে দেখলাম। তখন আমি আমার সাথের তরুণদের জিজ্ঞাসা করলাম যে, তোমরা কি মনে করো এই লোকটি একজন সফল মানুষ? সংখাগরিষ্টদের মতামত হবে যে, হ্যাঁ অবশ্যই এই লোক সফল, সে অনেক কিছু অর্জন করেছে। এ তো একজন খুবই সফল ব্যক্তি।

এখন এমন একজনের ছবি কল্পনা করুন যে গ্রাজুয়েশন শেষ করলো তারা কলেজ প্রেসিডেন্ট এর সাথে হান্ডশেক করছে, সার্টিফিকেট তাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। তখন কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো, এই মানুষটি কি একজন সফল মানুষ? মানুষ কি বলবে? মুসলিম অমুসলিম সকলেই বলবে, এটা একধরণের সফলতা। আমার বাচ্চারা যখন কলেজ শেষ করবে, আমি তাদের অভিনন্দন জানাবো। কারণ এটাও একধরণের সফলতা। যখন কেউ একজন চাকরি পায় এটা কি সফলতা? হ্যাঁ, অবশ্যই। কেউ চাকরি পেলে আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই। কেউ যখন বাড়ি কেনে, ব্যবসা শুরু করে, গাড়ি কেনে বা বিয়ে করে… মানুষ জীবনে বিভিন্ন অর্জন করে। আমরা তখন তা উদযাপন করি। কারণ এগুলো বিভিন্ন রকম সফলতা। তাই নয় কি? তো, আমাদের বাস সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে আমরা আরো একজন লোককে দেখলাম। বাড়িঘর ছাড়া মানুষটি রাস্তার পাশে একটি ছোট কার্ডবোর্ডের ঘরে থাকেন। তার কাপড়চোপড় দেখে মনে হয় এগুলো কয়েক বছরের পুরনো। এবং আপনারা তার আশেপাশে যেতে চাইবেন না দুর্গন্ধের কারণে। এখন আমি আমার স্টুডেন্টদেরকে আবারো জিজ্ঞাসা করলাম যে, আপনারা কি মনে করেন এই লোকটি জীবনে সফল। তারা সবাই জবাব দিল যে, না – এই মানুষটি কোন সফল মানুষ না। এখন মনে করুন আমি ঐ বাসটিতে মুসলিম তরুণ তরুণীদের সাথে ভ্রমন করছিলাম না বরং তারা ছিল কিছু খ্রিষ্টান ছেলে মেয়ে, বা ইহুদী ছেলে মেয়ে, বা অজ্ঞেয়বাদী ছেলে মেয়ে বা বৌদ্ধ ছেলে মেয়ে। এবং যদি আমি তাদেরকেও একই প্রশ্ন করতাম, তাহলে আমি কি একই জবাব পেতাম? হ্যাঁ, তাদের সবার জবাব একই হতো। সমস্যাটা এইখানেই।

আমরা যেভাবে সফলতা কে সংজ্ঞায়িত করছি, এবং আমরা যেভাবে বিফলতাকে বিচার করছি, তা আমাদের জন্য, মুসলমানদের জন্য ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। পৃথিবীর সকল মানুষ বাস্তবতাকে যেকোন ভাবে বিচার করতে পারে। সফলতা এবং ব্যর্থতাকে তারা বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তায়ালা পরিস্কার চশমা দিয়েছেন। আর আপনি যখন একবার বাস্তবতাকে এই চশমা দিয়ে দেখতে শুরু করবেন, আপনি তখন এমন কিছু দেখতে পাবেন যা অন্যরা দেখতে পাবে না। যখন আপনি কোরআন এর আলোকে সবকিছুকে দেখা শুরু করবেন, তখন আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে জাকজমকপূর্ণ, আলিসান, বিলাসিতায় পরিপূর্ণ অট্টালিকাটি ছিল ফেরআউন এর। এ পর্যন্ত নির্মিত হওয়া বিস্ময়কর বাড়িগুলোর অন্যতম ছিল সেটি। এখন আমাদের বাস যদি ফেরাউনের প্রাসাদের পাশ দিয়ে যেত, আর আমরা ফেরাউনকে প্রবেশ করতে দেখতাম এবং আমি আমার মুসলিম স্টুডেন্টদের জিজ্ঞাসা করতাম লোকটি সফল কি না, তাহলে তাদের জবাব কি হত? তারা বলত- ফেরাউন সফল নয়, সে মানব ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ মানুষদের একজন। ঠিক না? এখন দ্বিতীয় বার আমরা কোন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম? এখন বিশাল ম্যানসন এ প্রবেশ করিছল আর অন্যজন কে ছিল? গৃহহীন ব্যক্তি। ঠিকাছে?

ইব্রাহিম (আঃ) কে তাঁর ঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তিনি একজন ঘরহীন মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি কি সফল মানুষ ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। মূলত তিনি জগতের সবচেয়ে সফল কয়েকজন মানুষদের মাঝে একজন। এখন কুরআন আমাকে শেখাচ্ছে যে, একজন গৃহহীন ব্যক্তিও সফল হতে পারে। আর অন্যদিকে ওই বিশাল অট্টালিকার অধিকারী লোকটি অসম্ভব পরাজিত একজন মানুষ। কুরআন আমাদেরকে শিখায় যে একজন মানুষের সফলতার সাথে তাঁর সম্পদের কোন সম্পর্ক নেই এবং বিফলতার সাথে দারিদ্রতার কোন সম্পর্ক নেই। সফলতা এবং ব্যর্থতার ধারণা আমাদের নিকট অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। যে সব বাবা মায়েরা এখানে আছেন এ বিষয়টা চিন্তা করে দেখুন, আপনারা সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিতে চান। কিন্তু কেন ভাল শিক্ষা দিতে চান? কারণ আপনি তাদেরকে সফল হিসেবে দেখতে চান, ঠিক কিনা? আপনি চান তারা যেন ভাল চাকরি পায়, উন্নত ক্যারিয়ার গঠন করে, উন্নত জীবন যাপন করে। আপনি তাদের জন্য ভাড়া বাসা চান না, আপনি চান তারা যেন নিজেদের বাড়ীতে থাকে। আপনি তাদের জন্য ভাল বেতনের চাকরি চান। আপনি চান তারা যেন আইনজীবী, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়। এটাই আপনি আপনার সন্তানের জন্য চান, একটি ভাল জীবন।

এখন আমাকে বলুন। কখনো কখনো আমরা আমাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য বিদেশে পাঠাই। বা অন্য জেলায় অথবা অন্য শহরে পাঠাই। এমনকি যখন আমাদের সন্তানরা ঐ সব স্কুলের জন্য বাড়ি ছাড়ে আপনি লক্ষ্য করা শুরু করেছেন যে, তারা আপনার অবাধ্য হতে শুরু করেছে। তারা আর আপনার কথা শুনছে না, নামাযে আস্তে আস্তে অমনোযোগী হতে শুরু করেছে। তখন আপনি ভাবতে লাগলেন, তারা ঐ শহরে গেলে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে। তারা হয়ে যাবে আরও বিদ্রোহী, আরও স্বাধীন, আরও যত্নহীন। কিন্তু আপনি আবার ভাবেন, যদি তারা অন্য শহরের অন্য কলেজে না যায় তারা সফল হতে পারবে না। তাই বেশীরভাগ বাবা মা কি করে, কি সিদ্ধান্ত নেয়? তারা তাদের যেতে দেয়। এভাবে বছর চারেক পার হয়। এরপর আমি ই-মেইল পাই। আমাকে ই-মেইল করে বলে, আমার ছেলে আমার সাথে কথা বলে না। আমার ছেলে আমার সাথে কিছুই করতে চায় না। আমার ছেলে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে এবং এক অমুসলিমকে বিয়ে করে ফেলেছে। আমার বাচ্চা বলছে ইসলামের উপর তার আর বিশ্বাস নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ পরিবর্তন রাতারাতি হয়নি। প্রক্রিয়াটা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। কারণটা কি জানেন, অনেক সিরিয়াস মুসলিম পরিবারও সফলতা এবং ব্যর্থতার ব্যাপারে নিজেদের জন্য এবং সন্তানদের জন্য যথেষ্ট পরিস্কারভাবে চিন্তা ভাবনা করেনি যেন তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ তাদের মাথায় আছে যে, কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার মানেই হলো সফলতা। ফলে অনেক মূল্য দিতে হলো। মূল্যটা শুধু টিউশন ফি নয়। আপনি শুধু টিউশন ফি দেন নি। আপনি কোন কোন ক্ষেত্রে হেদায়েতের মূল্যও দিয়েছেন। আর এটা খুবই উচ্চ মূল্যের জিনিস। আমাদের পরিবারের কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে। তো, এটা শুধু সফলতা এবং ব্যর্থতার ধারণা বুঝানোর জন্য একটা উদাহরণ ছিল। কুরআনের চশমা দিয়ে সফলতা ব্যর্থতাকে দেখলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। অন্য সবার মত করে আমরা আর একে দেখতে পারি না।