স্বপ্নের প্রকারভেদ (১ম পর্ব)

আমরা কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে জানতে পারি যে, স্বপ্ন আসতে পারে আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে, স্বপ্ন আসতে পারে শয়তানের কাছ থেকে এবং আপনি নিজের কল্পনা থেকেও স্বপ্ন দেখতে পারেন। সুতরাং স্বপ্নের তিনটি বিভাগ রয়েছে। আল্লাহর কাছ থেকে স্বপ্ন। নবীরা এ ধরনের স্বপ্ন দেখে থাকেন। তাঁরা অন্য দু’ধরনের স্বপ্ন দেখেন না। এটা নবীদের বেলায় ঘটে। নবীরা শুধু আল্লাহর কাছ থেকে স্বপ্ন দেখেন। আল্লাহ তাদের স্বপ্ন শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন। এবং আল্লাহ তাদের নিজেদের কল্পনা থেকেও তাদের স্বপ্নকে সংরক্ষিত করেছেন। আর তাই যখনই একজন নবী একটি স্বপ্ন দেখেন সেটা অহি হিসেবে গণ্য করা হয়। এটাকে আল্লাহর নিকট থেকে অহি হিসেবে দেখা হয়। একজন নবীর প্রতিটি স্বপ্ন হল আল্লাহর নিকট থেকে অহি। আমরা ব্যাপারটি ইব্রাহীম (আ) এর পরিবারের বেলায় দেখেছি। ইব্রাহীম (আ) এর কি ঘটেছিল? তিনি ইসমাইল (আ) এর ব্যাপারে একটি স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন যে, তিনি ইসমাইল (আ) কে কুরবানি করছেন। ‘ইন্নি আরা ফিল মানামে আন্নি আজবাহুক’ আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি।

তাহলে নবী ইব্রাহীম (আ) আমাদেরকে স্বপ্নের বাস্তবতা সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর পরবর্তী বংশধর ইউসুফ (আ)ও একটি স্বপ্ন দেখেন। সুতরাং স্বপ্ন এমন একটা বিষয় যা আল্লাহর নবীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এটা একমাত্র নবীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। এটা সম্ভব যে, নবী নয় এমন মানুষও এ ধরনের স্বপ্ন দেখতে পারেন। তিরমিজি শরিফের একটি হাদিসে রাসূল (স) বলেন- নবুওতের অংশ থেকে শুধু ‘মুবাশশিরাত’ বা সুসংবাদ অবশিষ্ট রয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল – ‘মুবাশশিরাত’ কি? হে আল্লাহর রাসূল (স)। তিনি বলেন- “এমন স্বপ্ন যা তুমি দেখ বা অন্য কেউ দেখে যেখানে তুমি রয়েছ।” হয় তুমি দেখেছ বা অন্য কেউ দেখেছে আর সে এসে তোমাকে বলে যে, ভাই আমি আপনাকে একটি স্বপ্নে দেখেছি। আমি এরূপ এরূপ দেখেছি। এটাকে বলা হয় ‘মুবাশশির’। ‘মুবাশশির’ শব্দের অর্থ কি? এর অর্থ হল – সুসংবাদ।

সুতরাং এখান থেকে আমরা জানতে পারি যে, যখনি আল্লাহ কাউকে স্বপ্ন দেখান সেটা সবসময় ইতিবাচক কিছু। আপনার স্বপ্নের মাঝে একটি সুসংবাদ রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। স্বপ্ন সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলতে গেলে… আমরা বলেছি যে- স্বপ্ন তিন ধরনের।

এক নাম্বারঃ এমন স্বপ্ন যা আপনার কল্পনা থেকে আসে।

আরবিতে একে বলা হয় ‘হাদিসুন নাফস’। এটা আপনার কল্পনাশক্তি থেকে আসে। উদাহরণ স্বরূপ – আমাদের কেউ একজন দামী একটি গাড়ি চাইছেন। তিনি জাগুয়ার, মার্সিডিজ বা এরকম লেটেস্ট মডেলের কোন গাড়ি কিনতে চান। আপনি সব সময় এটা নিয়ে চিন্তা করছেন। তারপর আপনি ঘুমাতে গেলেন আর স্বপ্নে দেখেন যে, আপনি সেই গাড়িটি চালাচ্ছেন। এটা আপনার ‘হাদিসুন নাফস’ বা কল্পনা শক্তি থেকে উদগত। বিজ্ঞানীরা বলেন – মুসলিম স্কলাররা না- বিজ্ঞানীরা বলেন… বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন অধ্যয়ন করেন। বিশেষ ধরনের বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন অধ্যয়ন করে। আমার কাছে এটা খুবই মজার মনে হয় যে তারাই একমাত্র মানুষ যারা ঘুমন্ত অবস্থায়ও চাকরি করেন। তো, বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন অধ্যয়ন করেন।

এইসব বিজ্ঞানীরা আমাদের বলেন যে, এই ধরণের স্বপ্ন প্রতি রাতেই ঘটে। আমাদের ঘুমের একটা পর্যায় আছে যখন সবাই স্বপ্ন দেখে। এই ধরণের স্বপ্নের লক্ষণ হল জেগে উঠার সাথে সাথে স্বপ্নের সবকিছু আপনার মনে থাকে। কিন্তু তারপর পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আপনি সব ভুলে যান। এটাই এই ধরণের স্বপ্নের লক্ষণ; আপনার কল্পনা শক্তি থেকে উৎসারিত স্বপ্ন। আপনার বাহ্যিক আবেগ অনুভূতি দ্বারা এই স্বপ্ন প্রভাবিত হয়। যেমন, কেউ যদি আপনাকে পানি নিক্ষেপ করে তখন আপনি হয়তো স্বপ্নে দেখবেন আপনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন। আপনার অ্যালার্ম বেজে উঠলে কোনভাবে এটাও আপনার স্বপ্নকে প্রভাবিত করতে পারে। ঠিক? কিছু একটা ঘটবে আপনার স্বপ্নের মাঝে।

কেউ যদি ফজরের সময় আপনাকে এই বলে জাগায়- জেগে উঠো, জেগে উঠো। এটাও আপনার স্বপ্নে পরিবর্তিত কোন এক রূপে দেখা দেবে যে কেউ একজন আপনাকে জাগাচ্ছে। ঠিক না? এই ধরণের স্বপ্নের সাথে ভাল মন্দের কোন সম্পর্ক নেই। এসব আপনার নিজস্ব কল্পনা প্রসূত স্বপ্ন বা হাদিসুন নাফস। এই ধরণের স্বপ্নের লক্ষণ হল আপনি এর কিছুই মনে রাখতে পারেন না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বা দিনের অর্ধেক পার করতেই আপনি সব ভুলে যান। সুতরাং এটা হল হাদিসুন নাফস।

দ্বিতীয় শ্রেণীর স্বপ্ন হল- আরবিতে একে বলা হয় ‘আল হুলম’। আল হুলম হল অশুভ স্বপ্ন, যাকে আমরা দুঃস্বপ্ন বলি। এ ধরণের স্বপ্ন আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। এ ধরণের স্বপ্নের লক্ষণ হল এটা দেখার পর আপনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে আপনি অশুভ, জঘন্য, ঘৃণ্য প্রকৃতির কিছু দেখতে পান। আপনি দেখেন আপনার নিকটতম কারো করুণ মৃত্যু, দেখেন যে আপনি নিজে গাড়ি দুর্ঘটনার কোলে পড়েছেন, দেখতে পান এলিয়েন বা কোন ভয়ংকর প্রাণী আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই ধরণের স্বপ্নের মানে হল – এই ধরণের স্বপ্নের মাধ্যমে শয়তানেরা আপনাকে জ্বালাতন করতে চায়। তারা আপনাকে নিয়ে শুধু কৌতুক করল। এই ধরণের স্বপ্ন কস্মিনকালেও সত্য নয়। কারোই এই ধরণের স্বপ্নে বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারোই দুঃস্বপ্নে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

আমাদের রাসূল (স) বলেন- “দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলা উচিত নয়।” আপনি কোন দুঃস্বপ্ন দেখলে মানুষকে বলবেন না। কেন? কারণ শয়তান আপনাকে বোকা বানাচ্ছে। একদা এক লোক রাসূল (স) এর কাছে এসে বললেন- ও আল্লাহর রাসূল (স)! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমার মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এবং সেই কর্তিত মস্তক বলের মত ঘুরপাক খেতে লাগলো। আর একে তুলে নিতে আমি এর পিছে পিছে ছুটতে লাগলাম। রাসূল (সঃ) বললেন- “শয়তান গত রাতে তোমাকে নিয়ে কিভাবে মজা করেছে তা মানুষকে বলে বেড়িও না।” মানুষকে বলো না। সে এখন হাসছে কারণ তুমি সেটা বিশ্বাস করেছ। এই ধরণের স্বপ্নের লক্ষণ কি? আপনি প্রচণ্ড ভীত হয়ে জেগে উঠেন। গভীর রাতে ঘর্মাক্ত অবস্থায় জেগে উঠেন। এটা কি ছিল? কি দেখলাম আমি? এ লক্ষণগুলো বলে দেয় যে এটা শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান ভবিষ্যৎ জানে না। রাতে যদি আপনি নিজেকে কোন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়তে দেখেন আর সকালে আপনার বসকে ফোন করে বলেন আমি আজ চাকরিতে আসতে পারবো না, কারণ আমি ড্রাইভ করতে চাই না। তখন শয়তান আপনাকে নিয়ে হাসা হাসি করে। কারণ আপনি তাকে বিশ্বাস করেছেন।

দুঃস্বপ্নগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, কারণ এতে সত্যের কোন লেশমাত্র নেই। আপনি যদি তা অনুসরণ করেন বা বিশ্বাস করেন তবে শয়তানের জয় হল। আপনি যদি এ ধরণের কোন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেন, আমাদের রাসূল (স) বলেন – আপনি আল্লাহর নিকট শয়তানের আক্রমণ থেকে আশ্রয় চাইবেন। বলবেন- আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম এবং আপনার বাম পার্শ্বে থুতু নিক্ষেপ করবেন। আমাদের রাসূল (স) এখানে এমনভাবে থুতু নিক্ষেপ করতে বলেছেন যাতে শুধু আওয়াজ হবে কিন্তু আপনার মুখ থেকে কোন লালা বের হবে না। এভাবে থু থু… একে বলা হয় ‘নাফাস’, যাতে আওয়াজ করা হয় কিন্তু সত্যিকারের কোন থুতু বের হয় না। এটা করা হয় শয়তানকে তাড়ানোর জন্য–আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম।

আমাদের রাসূল (স) আরও বলেন আপনি যে পার্শ্বে থাকেন তা পরিবর্তন করে অন্য পার্শ্বে শয়ন করুন। কেন? কারণ শয়তান যখন আপনাকে বিরক্ত করছে সে হয়তো আপনার পাশে বা আপনার উপর বসে আছে; তাই আপনি যখন আউজুবিল্লাহ বলেন এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করেন তখন তাকে পালিয়ে যেতে হয়। রাসূল (সঃ) আরও বলেন স্বপ্ন যদি খুবই খারাপ হয়ে থাকে তাহলে উঠে দু’রাকাত নামাজ পড়ুন। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করুন। আপনার এই স্বপ্নের কথা আপনার প্রিয় কাউকে, স্বামী/ স্ত্রীকে বা বন্ধু কাউকে জানাবেন না; কাউকে না। এই ধরণের স্বপ্নের কথা ভুলে যান।

ইনশাআল্লাহ চলবে …।