কুরআনের গঠন বিন্যাস একটি অন্যতম কারণ যার জন্যে মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে এটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ হতে পারে। আধুনিক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে যে কুরআনের একটি বিশেষ গঠন বিন্যাস রয়েছে। এই বিন্যাসের নাম হল “বৃত্তাকার গঠন বিন্যাস”। এটির উদাহরণের জন্য আসুন আমরা কুরআনের দ্বিতীয় সুরাটি নিয়ে পর্যালোচনা করি। এর নাম হল “বাকারা” অর্থাৎ গাভী। এই সুরাটিতে মোট ২৮৬ টি আয়াত আছে। পুরো সুরাটিকে ৯ টি অংশে ভাগ করা যেতে পারে, বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে। প্রথম অংশের আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস নিয়ে। এই একি আলোচনার প্রতিফলন হয়েছে ৯ম অংশে। ২য় অংশে আলোচিত হয়েছে সৃষ্টি রহস্য এবং জ্ঞান নিয়ে, যার প্রতিফলন হয়েছে শেষ থেকে ২য় অর্থাৎ ৮ম অংশে। ৩য় অংশে আছে সেইসব আইন যা বনী ইসরাইলকে দেয়া হয়েছিল। যার প্রতিফলন হয়েছে ৭ম অংশে, যেখানে আছে মুসলিমদেরকে দেয়া আইনগুলো। ৪র্থ অংশে আছে ইব্রাহিম (আঃ) এর পরীক্ষাগুলো, যার প্রতিফলন হল মুসলিমদের জন্যও পরীক্ষা, যা হল ষষ্ঠ অংশের বিষয়। আর মাঝের অংশ অর্থাৎ ৫ম অংশটি হল পুরো সুরাটির মুখ্য আলোচনা, সালাতের কিবলার দিক পরিবর্তন। “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে…. আপনি যে কেবলার উপর ছিলেন, তাকে আমি এজন্যই কেবলা করেছিলাম, যাতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, কে রসূলের অনুসারী থাকে আর কে পিঠটান দেয়।” (আল কুরআন ২:১৪৩) এই কিবলার পরিবর্তন, যা ছিল জেরুসালেম থেকে মক্কার দিকে, এটি ছিল আসলে বিশ্বাসীদের জন্যও এক বিরাট পরীক্ষা। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই সুরাটির ঠিক মধ্যম অংশে। ঠিক ১৪৩তম আয়াতে। আরও উল্লেখ্য হল এই আয়াতেই আছে ”মধ্যপন্থী সম্প্রদায়” শব্দটি।
এই ৯ টি অংশ একসাথে একটি বিশাল বৃত্তাকার বিন্যাস গঠন করে। খুব সহজেই দেখা যাচ্ছে যেঁ এই বৃত্তাকার বিন্যাসটি হল একটি পূর্ণ বৃত্ত যার মূল অর্থটি আছে এর কেন্দ্রে। আপনারা একে আয়নার প্রতিফলনের মতও ভাবতে পারেন যেখানে আয়নাটি আছে বৃত্তের ঠিক মাঝে। যেখানে প্রথম পাশে যা বলা হয়েছে তা দ্বিতীয় পাশে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা যদি আরও ভিতরে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, প্রতিটি অংশের ভিতরে আবার একটি করে নিজস্ব বৃত্তাকার বিন্যাস আছে। তারমানে দেখা যাচ্ছে একটি মূল বৃত্তটি আসলে অনেকগুলো বৃত্তের সমন্বয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ৮ম অংশের কথা, যার বিষয় হল আল্লাহর সৃষ্টি এবং জ্ঞান। আমরা দেখতে পাই যে এই অংশটির শুরু এবং শেষের বিষয় হল দানশীলতা, আর আল্লাহর ক্ষমতা এবং জ্ঞান হল এর কেন্দ্রীয় বিষয়। একে আরও গভীর ভাবেও দেখা যায়।
এই কেন্দ্রীয় বিষয়টিও আসলে একটি বৃত্তাকার বিন্যাস। যা হল আয়াত নম্বর ২৫৫ , আয়াতুল কুরসি। সিংহাসনের আয়াত। পুরো সুরাটির মত এই সিংহাসনের আয়াতটিকেও ৯ টি অংশে ভাগ করা যায় বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে। ১ম এবং ৯ম অংশে আছে আল্লাহর গুণবাচক নাম। ২য় এবং ৮ম অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ কখনও ক্লান্ত হন না। ৩য় এবং ৭ম অংশে আছে, আসমান ও জমিনের সবই আল্লাহর অধীনে। ৪র্থ এবং ৬ষ্ঠ অংশে আছে যে আল্লাহ আমাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং আমরা তার কাছেই মুখাপেক্ষী। লক্ষ করুন, মাঝের অংশে আছে আগে এবং পিছে এই শব্দ দুটি। যা আরও একবার বৃত্তাকার বিন্যাসের নির্দেশনা দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সিংহাসনের আয়াতটি শুধু নিজেই বৃত্তাকারে বিন্যস্ত নয়, বরং এটি আরও দুটি বৃত্তের উপবৃত্ত। যারা হল সমকেন্দ্রিক। আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, এই সুরাটি বিস্ময়করভাবে বিন্যস্ত। খুবই সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধ ভাবে এই বৃত্তাকার বিন্যাসটি গঠিত হয়েছে।
অলৌকিকত্বের প্রমাণ এই বিন্যাসের নির্ভুলতা আরও বিস্ময়করভাবে ভেসে উঠে যদি আমরা এর অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের দিকে দেখি। এটা বুঝার জন্যও আসুন আমরা একে দালান নির্মাণের সাথে তুলনা করি। মনে করুন যে আপনাকে একটি বাসা বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আপনি সকল উপকরণ সংগ্রহ না করে এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা না করে বরং আপনি কাজ শুরু করে দিলেন এর সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়াই। একটির সাথে আরেক টুকরো জুড়ে দিলেন, হাতের কাছে যা পেলেন তা দিয়েই। এটার সম্ভাবনা কতটুকু যে এই পদ্ধতিতে আপনি একটি ভাল বাড়ি বানাতে পারবেন? একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি যেখানে সকল উপাদানের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়েছে, তার বদলে এখানে মনে হচ্ছে যেনতেন ভাবে যখন যেটা হাতের কাছে ছিল তাই দিয়ে কাজ সারা হয়েছে। এমন অবস্থায় খুব সম্ভবত বাড়িটি হবে খুবই অপরিকল্পিত। যা যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। এর সম্ভাবনা নেই বলেই চলে যে, এই অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তা সুপরিকল্পিত বাড়িটির মতই চমৎকার হবে।
কিন্তু আমরা কুরআনের গঠনের দিকে তাকালে ঠিক এই পদ্ধতিটি দেখতে পাই। আমাদের উদাহরণে যিনি বাড়িটি বানাচ্ছেন তিনি হলেন মহানবী (সা), যে বাড়িটি বানানো হচ্ছে তা হল কুরআন। আর বাড়িটির ঘর এবং ইট হল কুরআনের সূরা এবং আয়াত। নবী (সা) এর পক্ষে কখনই সুপরিকল্পিত ভাবে এটা করা সম্ভব ছিল না, কারণ অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে। যা ছিল উনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জ যা তিনি নবুয়তের সময় সম্মুখীন হয়েছেন। এর উদাহরণ হল, বিশ্বাসীরা উনার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আসত, অথবা শত্রুরা আসত চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এর উত্তর অবতীর্ণ হত উনার উপর অহি আকারে, যাতে বলা থাকত সেসবের উত্তর। তাহলে তার পক্ষে কি এটা সম্ভব ছিল পরিকল্পনা মোতাবেক করার যেখানে কোন আয়াত কখন অবতীর্ণ হবে এটা ছিল সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। আর এধরনের বিন্যাস অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত হতে হবে, কিন্তু এটা কখনই উনার নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল না। তার অর্থ হল এই যে, কুরআনের রচয়িতা হল এমন কেউ, যিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানেন। আর ভবিষ্যৎ জানা হল স্রষ্টার গুণ, মানুষের নয়। কিছু সমালোচক এটা বলে থাকে যে কুরআনের আগেও কিছু বই ছিল যাতে অনেকটা এটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তাই কুরআনকে অলৌকিক বলা যায় না। কিন্তু কুরআনকে অন্য বই এর সাথে তুলনা করা অনেকটা রাত আর দিনকে তুলনা করার সমান। অনেক কারণেই তা বলা যায়। প্রথমত নবী (সা) কোনও কবি ছিলেন না এমনকি তার অক্ষর জ্ঞান ছিল না। তখনকার দিনের অনেকের মতই তিনি লিখতে বা পড়তে জানতেন না।
দ্বিতীয়ত, অনেকেই এটা অনুমান করবেন যে কুরআনকে সাজানো হয়েছে সময়ের উপর ভিত্তি করে, অর্থাৎ প্রথম আয়াতটি সবার আগে নাযিল হয়েছে এবং শেষের আয়াতটি সবার শেষে। বেশিরভাগ বই এভাবেই লিখা হয়, একটি শুরুর অংশ তারপর মাঝের অংশ এবং সবশেষে সমাপ্তি। কিন্তু কুরআনকে যেভাবে সাজানো হয়েছে তা আর অন্য কোনও বইয়ে পাওয়া যায় না। যেমন আল বাকারা, যে সুরাটি আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম, তা কিন্তু প্রথমে আয়াত ১ তারপর ২ তারপর ৩ এভাবে অবতীর্ণ হয়নি। বরং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়ছে বিচ্ছিন্ন ভাবে অনেক বছর ধরে, এমনকি অন্য সুরার আয়াতও এর মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। আর কুরআনের অবতীর্ণ হওয়ার এই পদ্ধতির কারণে একে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করা অত্যন্ত কঠিন অন্যান্য বইয়ের তুলনায়।
তৃতীয়ত, বই সাধারণত অনেক ধাপ সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে যায়, যার ফলে একজন লেখক সহজেই লিখার মান আরও ভাল করতে পারেন। কিন্তু কুরআন কখনো সম্পাদিত হয়নি। কোনও আয়াত অবতীর্ণ হওয়া মাত্রই নবী (সা) একে জায়গামত বসিয়ে দিতেন। প্রতি আয়াতের প্রেক্ষিতে তিনি এটা চিন্তা করতেন না যে, এর আগে কি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং কিভাবে একে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করা যায়। বরং সকল আয়াতের অবস্থান আগে থেকেই পূর্বনির্ধারিত ছিল। যদি আমরা কুরআনের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে আমরা এমনটি কখনই দেখব না যে কোনও আয়াতের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে এর বিন্যাস সুগঠিত করার জন্য।
চতুর্থত, সাধারণ বইয়ে বৃত্তাকার বিন্যাস আনা সহজ যেহেতু এর লেখকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে বইটির বিষয়বস্তুর উপর। এর ফলে একে পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করা সম্ভব। অথচ আমরা আগে দেখেছি যে, কুরআনের অবতীর্ণ হওয়া নির্ভরশীল ছিল নির্দিষ্ট ঘটনাবলির উপর, যা ছিল নবী (সা) এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলশ্রুতিতে, তার পক্ষে এটা পরিকল্পনা মোতাবেক করা সম্ভব ছিল না। পঞ্চমত কুরআন অবতীর্ণ হয়ছে মৌখিক আকারে। লিখিত আকারে নয়। লিখিত বইয়ের ক্ষেত্রে এর বিন্যাস পরিবর্তন করা সহজ যেহেতু আগে যা লিখা হয়েছে তার বিন্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব। অথচ কুরআনের ক্ষেত্রে, যা মৌখিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, নবী (সা) কে পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয়েছে তার স্মরণশক্তির উপর এটা মনে করার জন্যও যে এর আগে কি অবতীর্ণ হয়েছে। যা আরও অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
এত সব কিছুর প্রেক্ষিতে এটাই কি মনে করা স্বাভাবিক নয় যে, কুরআন হবে অবিন্যস্ত? অথচ আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে কুরআনের একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত গঠন বিন্যাস রয়েছে। তাই কুরআন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হওয়া সত্তেও এর মধ্যে যে সাবলীল বিন্যাস রয়েছে, তা এই মতকেই সমর্থন করে যে কুরআন অলৌকিক।
‘’তোমাদের সংগী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কোরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। তাঁকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা। ‘’ (আল কুরআন ৫৩:২-৫)।