বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
[উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ]
ইসলামের পথে আমার যাত্রার গল্প হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একজন মুসলিম হিসেবেই। আমার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন আমার পরিবার ইউনাইটেড স্টেটসে চলে আসে। কয়েক বছরের মাঝেই সঙ্গ আর পরিবেশের প্রভাবে ধর্ম আমার জীবন থেকে পুরোপুরি হারিয়ে তো গেলই, সেই সাথে আমি ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম, বিশেষ করে কয়েকটা দর্শন (ফিলোসফি) ক্লাস করার পর।
আমার মনে হয়, দীনের পথে আমার ফিরে আসার যাত্রাটা একটা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছিল। ১৯ বছর বয়সে যখন আমি ইসলামের প্রকৃত মানে কি সেটা জানা আবিস্কার করা শুরু করলাম, তখন আমি নিউ ইয়র্কে। নিউ ইয়র্ক একটা চমৎকার জায়গা। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ জায়গাগুলোর মাঝে একটা। সেখানে আমি অনেকগুলো গ্রুপের সাথে মিশেছিলাম, যারা সবাই নিজেদের সুন্নী ইসলামের প্রতিনিধি বলে দাবী করত।
আমি যখন কোন একটা গ্রুপের স্টাডি সার্কেলে বসতাম, তখন আমি প্রায়ই “অন্য” গ্রুপগুলোর বিভ্রান্তি সম্পর্কে শুনতে পেতাম। হয়তো রাস্তার ঠিক ওপারে থাকা “অন্য গ্রুপটা” যে কতটুকু নষ্ট, বিভ্রান্ত, বিপথগামী, এমনকি তারা আমার নিজের পরিত্রাণের জন্য কতটা বিপজ্জনক, এসব প্রায়ই আমার কানে আসত। ভালর জন্য হোক কিংবা খারাপের জন্য হোক, আমি শেখার জন্য একটা নিয়ম দাঁড় করিয়ে ফেললাম যে আমি দুই গ্রুপের কথাই শুনে দেখব। এরকম কোন “বিচ্যুত” গ্রুপের (অন্যদের চোখে) কথা আমার কানে আসলেই আমি সেই “বিচ্যুত” লোকগুলোর সাথে দেখা করে তাদের সাথে কথা বলতাম, যাতে তারা আসলে কি বলেছে সেটা সরাসরি তাদের মুখ থেকেই শুনতে পারি। এখন আমি বুঝতে পারছি যে, সে বয়সে সেটা করা অনেক বিপদজনক কাজ ছিল, কিন্তু ইসলামের পথে ফিরে আসার জন্য সেটাই ছিল আমার প্রথম পদক্ষেপ।
আমি ইসলামের পথে ফিরে আসার কথা চিন্তাই করতাম না যদি আমার মাঝে সামান্য হলেও খোলা মন না থাকত। আমি আমার মনের সেই অংশটা আমি একেবারে বন্ধ করে দিতে পারি না। আমাকে কি বলা হচ্ছে সেটা আমার নিজের জন্য জন্যই বিবেচনা করে দেখতে হবে। কিছু আরবি পড়ার পর এবং ইসলামের বিভিন্ন মতবাদ যেমন: অতি – সনাতন, আন্দোলন ভিত্তিক, আক্ষরিক, পশ্চিমা প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদির সংস্পর্শে আসার পর আমি কয়েকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম যেগুলো আমি এখনো শক্তভাবে ধারণ করি। এই ছোট্ট প্রবন্ধে আমি সেগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
* মূলধারার ইসলাম যেটা বর্তমানে প্রকট, সেটা প্রাচীন (Monolithic) কিছু নয়। সেটা বললে বাস্তবতাকে কিছুটা হলেও অস্বীকার করা হবে। মূল কিছু ব্যাপারে মুসলিমদের চিন্তাধারায় ভিন্নতা থাকলেও প্রচুর পরিমাণে ঐক্যমতও রয়েছে।
আমি যতটা সম্ভব আমার নিজের কাছে সৎ থাকব, আমার রাসুলের (স) অনুগত থাকব এবং আমার প্রভুর প্রতি আন্তরিক থাকব । এর ফলে আমি কিছু ধারণা, ত্বত্ত এবং রায়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করব যেগুলোকে আমি সেই ইসলামের সাথে খাপ খাওয়াতে পারব না যে ইসলামকে আমি এখনও জানছি এবং ভালবাসি। এমনকি সেগুলো যদি সেসব সূত্র থেকেও আসে যাদের বিবেচনা অন্যান্য বিষয়ে আমার যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে, তবুও নয়।
* আমার ব্যক্তিগত ভিন্নমত কখনো জনসম্মুখে প্রকাশ করব না, কারণ এতে ভাল কোন কিছু নেই। আমি বিতর্ক, দলিল নিয়ে বাকযুদ্ধ, বিভিন্ন নাম দেয়া ইত্যাদি এসব অনেক দেখেছি বলে কোনটা অনর্থক বকাবকি সেটা পার্থক্য করতে পারি।
* আমার ব্যক্তিগত ভিন্নমতগুলো আমি সেসব বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবিদের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে প্রকাশ করব যারা সেই মতবাদে বিশ্বাসী। বিতর্কের উদ্দেশ্যে নয়, বরং তাদের অবস্থানটা আরো ভালভাবে বোঝার জন্য। এবং সেই বিষয়টি সম্পর্কে আমার নিজের ধারণাগুলো পুরোপুরি ভুলও হতে পারে, সে সম্ভাবনা থাকলে আমি সেটা মেনে নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকব।
* আমি আমার কুরআন শিক্ষাকে সারাজীবন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেব, এবং কুরআনের সনাতন ও সমসাময়িক দুধরনের মতবাদকেই সম্মান করব, যদি তাদের বিবৃতিগুলো অবান্তরও (আমার সীমিত জ্ঞানে) হয়, তবুও। কেউ কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আমার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেন বলে আমি তার সব কথাকেই উড়িয়ে দেব না। তার প্রতি আমার পূর্ণশ্রদ্ধা ও দ্বিমত দুটোই বজায় রেখে আমি তার কাছ থেকে উপকৃত হতে থাকব, সেটা যে বিষয়েই হোক না কেন।
* আমি কঠিন তাফসীরগুলোর বিষয়ে কোন মতামত ধারণ করার আগে একাধিক পণ্ডিতদের পরামর্শ চাব।
* বিভিন্ন মতাদর্শের “নাম বা উপাধি” আমাকে প্রভাবিত করবে না, যাতে বর্তমান মুসলিমরা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি মানুষকে শুধুমাত্র তার “আদর্শের নাম” থেকে বিবেচনা করব না। আমি সত্যকে পুরোপুরি মেনে নেব, সেটা যেই বলুক না কেন।
“কারও একটি বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া মানে আমার কাছে তার সব বিষয়ে করা সব বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া। একটি বিষয়ে কারো সাথে কোনভাবে একমত হওয়া মানে তার সবকিছুকে অনুমোদন করা”, আমার বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ ওঠার ভয়ে আমি ভীত হব না।
* আমার জীবন অনেক ছোট এবং যেগুলোকে আমি ভাল বলে বিশ্বাস করি, সেগুলোকে ছড়িয়ে দেবার কাজে আমার যতটুকু ক্ষুদ্র শক্তি আছে তা ব্যয় করব। অন্যান্য মুসলিমদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আমার শক্তি ব্যয় করব না। এমনকি আমি যদি তাদের সাথে পুরোপুরি দ্বিমতও পোষণ করি, তবুও না। আমি তার করব না কারণ, আমি বিশ্বাস করি যে, কুরআন ও সুন্নাহ এর প্রকৃত শিক্ষা থাকলে সেসবের আর প্রয়োজন হবে না। যেকোন ধর্মের উগ্রপন্থা বাঁচে দ্বন্দ ও তার উপর মনোযোগের উপর ভর করে। “একটা মন্দকে প্রতিহত করছি” সেটা ভেবে আমি প্রতারিত হব না। এসবে জড়ানো মানে আমি একটি অসীম বিতর্ককে আরো লম্বা করে তুলছি যা আমার বা অন্য কারো জীবনে কোন ভাল কিছু আসবে না।
* আমি ইসলামিক প্রয়াসগুলোর ভাল গুণাবলী ও অবদানকে স্বীকৃতি দেব, তাদের অবলম্বনকৃত কৌশল বা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমি ব্যাপকভাবে একমত না হলেও।
ভাল আচরণ, ভাল কাজের ও উৎসাহের কথা বলা সহীহ হাদীসগুলো ছাড়া আমি আমার কোন বক্তব্যে কোন হাদীস উদ্ধৃত করব না। হাদীসের ঐতিহ্যের প্রতি পুরোপুরি ভালবাসা আর সম্মান থেকেই আমি এটা করব। হাদীসের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট জানার, গভীর বিশ্লেষণের ও ঐতিহাসিক বিষয়ে সেরা পণ্ডিতদের আলোচনাগুলো জানবার মেধা ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য আমার নেই, তাই হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়াটাই আমার কাছে বিপদজনক মনে হয়। কারণ সেই হাদীসটি থেকে আমার বা কোন একজন সাধারণ মুসলিমের টানা উপসংহার এমন হতে পারে যে সেটা সুন্নাহ এর পুরোপুরি বিপরীত।
* আমি মনে করি, আমার নিজের, আমার সন্তানদের এবং ইনশাআল্লাহ অন্যান্য মুসলিমদের জন্য আমি যে অবদান রাখতে পারি, তা হল, কুরআনের প্রতি ভালবাসা, মর্যাদাদান এবং উপলব্ধিকে আরো বাড়িয়ে তোলা। ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের উপর উপর আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা অব্যাহত থাকবে। কারণ, সেগুলোকে আমি গুরুত্বপূর্ণ/বিশেষায়িত মনে করি। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যেসব বিদ্বানদের আমার ব্যক্তিগতভাবে জানার সুযোগ হয়েছে, তাদের উপর আমার আস্থা বজায় থাকবে।
আমার প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য হবে (যেটাকে আমি বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করি) আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে লালনপালন, যাতে তারা আল্লাহকে, তার কিতাব কে, তার রাসূল (স) কে ভালবাসে, এবং তারা তাদের ইতিবাচক অবদানগুলোর মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্যকে মানবতার সামনে তুলে ধরে। সন্তানদের সঠিকভাবে লালনপালন করতে না পারার কারণে আমরা আমাদের যুবসমাজকে আধ্যাত্মিকভাবে, নৈতিকভাবে হারিয়ে ফেলছি এবং এমনকি তারা মুসলিম হিসেবে তাদের পরিচয়টুকুও হারিয়ে ফেলছে। আমার সন্তানেরা ফিতনাহ থেকে আপনার সন্তানদের চেয়ে খুব একটা দূরে নয়। এই সমস্যায় আপনি আমি সবাই পড়েছি। ভবিষ্যতের উম্মাহকে গড়ে তোলার জন্য আমাদের একে অপরকে সাহায্য করতে হবে।
* যে কারণে আমার বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বাইরের কোন হাদীস নিয়ে আমি আলোচনা করব না, সেই একই কারণে আমি প্রকাশ্যে ফিকহ এর কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব না। এটি একটি বিশেষ জ্ঞান এবং এ বিষয়ে আপনার একজন বিশেষজ্ঞের সাথেই কথা বলা উচিত, ঠিক যেভাবে আমার কোন প্রশ্ন থাকলে আমিও তাদের সাথে কথা বলে থাকি।
আমি আমার মনের কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম, কারণ প্রতিনিয়ত আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় আমি “কী”। কোন দৃষ্টিতে তারা আমাকে দেখছে তার উপর ভিত্তি করে, আমি “কী”, সেটা জানতে মানুষ সবসময়ই উৎসুক থাকবে। নিজেকে নিয়ে আমার বর্ণনা হচ্ছে, “আমি একজন সাধারণ মুসলিম যে আল্লাহর কিতাবকে ভালবাসে এবং সেখান থেকে শেখার চেষ্টা করছে এবং যৎসামান্য অংশ সে সেখান থেকে জানে, তা শেখাতে চেষ্টা করছে”।
[মূল লিংকঃ http://www.nakcollection.com/video-lectures/islam-and-me-by-nouman-ali-khan ]