(১ম পর্ব)
(সুরা আরাফঃ১৭৫-১৭৬)
আল্লাহ তা’আলা কুরআনের সপ্তম সুরা আরাফের, -যেটা একটি অন্যতম দীর্ঘ মাক্কী সুরা- শেষের দিকে বলেছেন যে উনি নিজেই আয়াত ব্যাখা করেন। আমরা জানি যে আল্লাহ অধিকাংশ সময়ই বলেছেন উনি আমাদের কাছে আয়াত নাজিল করেছেন কিন্তু কখন কখনো এও বলেছেন যে, ‘وَكَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ ’ ‘এভাবেই আমরা, আমাদের আয়াতগুলোকে ব্যাখা করি’। আয়াত শব্দটি দিয়ে শুধু ওহীই বোঝায় না, এটা দিয়ে বাস্তব জিনিসও বোঝায়। আল্লাহ আমাদের চারিপাশের সবকিছুই ব্যাখা করেছেন, এবং যখনি কোন কিছু ব্যাখা করেছেন, তার পেছনে অবশ্যই কোন উদ্দেশ্য আছে। আর এই নিদৃষ্ট আয়াতে যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে তা কিছুটা অদ্ভুত কারন আল্লাহ বলেছেন ’ লা আল্লাহুম ইয়ারজিয়ুন’, ‘’যেন তারা ফিরতে পারে’। আল্লাহ এই আয়াতটিতে একটা কিছু ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছেন আর তার উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা আল্লাহ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তাদের সাথে কথা বলা, তারা যেন আবার ফিরতে পারে। এটাই এর উদ্দেশ্য। এই কারণেই উনি বলেছেন, ’ লা আল্লাহুম ইয়ারজিয়ুন’। যেন তারা ফিরতে পারে।
এই আয়াতে একটি অদ্ভুত কাহিনী বলা হয়েছে, অনেক সময় এমন হয় যে কুরআনে আল্লাহ কোন কাহিনী হয়তো বলেছেন কিন্তু সেই কাহিনীর চরিত্রগুলোর নাম, তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানান না। জায়গার বা সময়ের ব্যাপারেও বলেন না। বা এর পেছনের ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট বর্ননা নেই যার মাধ্যমে আমরা পুরো ঘটনাটা জানবো। যা সাধারণত যে কোন ইতিহাসের বই থেকে ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, এই আয়াতের ভাষা এতই সাধারণ যে এটা যে কারো জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু তা স্বত্তেও আল্লাহ এটিকে নির্দিষ্ট করেছেন এই বলে যে ‘وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا’ ‘ আর আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন, সে লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের আয়াতসমূহ দান করেছিলাম। এখন কে এই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাঁর আয়াত দিয়েছেন? প্রথম লক্ষ্যণীয় জিনিসটি হচ্ছে ‘ওয়াতলু’ শব্দটি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার অক্ষরজ্ঞানহীন লোকদের কাছে এসেছিলেন এবং উনি নিজেও ছিলেন, ‘নাবিই আল উম্মি’, ‘অক্ষরজ্ঞানহীন’ নবী। তাই উলামারা বলছেন যে কিভাবে উনি তাহলে অন্যদেরকে পড়ে শোনাচ্ছেন? আসল ব্যাপারটি হচ্ছে এই কাহিনী হোক বা অন্য যে কোন কাহিনীই হোক যখন আল্লাহ ওয়াতলু শব্দটি বলছেন, উনি আসলে মক্কাবাসী এবং সাথে সাথে আমাদেরকেও বলতে চাচ্ছেন যে উনি আমাদেরকে এমন কিছুর জ্ঞান দিবেন যা আমরা পূর্বে জানতাম না। এবং এমন কিছু যেটা বার বার বলা হবে কারন এর প্রাসঙ্গিকতা কখনোই শেষ হবে না। ব্যাপারটি এমন না যে এটি পূর্বে হয়েছে, ব্যাস শেষ। এটা আমার আপনার উপরও প্রযোজ্য, এটা একটি জীবন্ত বই। এটা একটি জীবন্ত বিবরণ। আর সেই কারণেই এর ভাষাটা সার্বজনীন থাকাটাই যুক্তিসংগত। আমি আগেও বলেছি এই ক্ষেত্রে আল্লাহ কোন বিশেষ লোক বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি। কেন? কারন এটি একটি ‘আর্কি টাইপ’ যে কেউ হতে পারে, আমি, আপনি বা যে কেউ। এটা আমাদের যে কারো কাহিনীই হতে পারে। তাই মনযোগ দিয়ে শুনুন, আর ভাবুন এটা আপনার জন্য প্রযোজ্য কিনা, আমিও মনোযোগ দেই আর দেখি এটি আমার জন্য প্রযোজ্য কিনা।
আল্লাহ বলেন ‘ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا’ ‘যাকে আমি আমার আয়াত দিয়েছি’ অন্য কথায় এই সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তাআলা তাঁর পথ দেখিয়েছেন। কোন স্কলার যে কিনা কুরআন হাদিস, শরিয়াহ আইন, ফিকহ নিয়ে ৫০ বছর ধরে পড়া শুনা করছেন, তাকে আল্লাহ তাঁর আয়াত দিয়েছেন। আবার এমন কেউ যে কিনা কোন পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে হয়তো কুরআনের একটি অনুবাদ করা কপি পড়ে মুসলিম হয়েছে, তাকেও আল্লাহ তাঁর আয়াত দিয়েছেন। তাই আল্লাহ এ আয়াতের বক্তব্য বিশাল পাণ্ডিত্যের অধিকারী কারো জন্য সীমাবদ্ধ করেননি। বা বিপরীতে শুধু অল্প জানা কারো জন্যও নয়। এখানে আমাদের সবার সম্পর্কেই বলেছেন। কারণ আল্লাহ সবাইকে কিছু না কিছু জ্ঞান দিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে, এখানে বসে যারা জুমার খুতবা শুনছেন, আমি সহ আমাদের সবাই আল্লাহর আয়াত প্রাপ্ত। হয়তো কম বা বেশি কিন্তু আমাদের সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি আপনি যদি সামান্য একটু কুরআনও জানেন, সামান্য একটুও আল্লাহর হেদায়েতের সংস্পর্শে আসেন এমনকি আপনি যদি শুধু ফাতিহার প্রথম শব্দটা জানেন, অথবা আপনি শুধু জানেন বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম, এটাও কিন্তু আল্লাহর আয়াতই। এটাও আয়াতের কিছুটা যা আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন। তাই এই আয়াতে আল্লাহর অনুগ্রহটা হচ্ছে তাদের উপর যারা এখন শুনছেন, এমন কারো কথা বলছে না যা আমার বা আপনার থেকে উচু স্তরে রয়েছে। ‘آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا’ এর পরে আল্লাহ সমস্যার বর্ননা করেছেন। এই ধরনের লোকের খবর জানাচ্ছেন। আপনাদেরকে এই লোকের পরিচয় বলি, এই লোককে আমরা আমাদের পথ নির্দেশনা দিয়েছি, আমাদের আয়াত দিয়েছি, এই বিশ্বাস সম্পর্কে তাকে কিছুটা শিখিয়েছি। আল্লাহ নিজেই বলছেন তিনি নিজেই সেই শিক্ষার পথ তৈরি করে দিয়েছেন।
তারপর তিনি বলছেন ‘فَانسَلَخَ مِنْهَا’ আরবীতে ইনসিলাখ শব্দটি যখন কোন প্রানী তার খোলস ফেলে দেয় সেটা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়, সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হবে সাপের, আমরা জানি যে সাপ একটা সময়ে তার খোলস ফেলে দেয়। তাতে সে তার বাইরের চামড়াটা ফেলে দেয়, বিশেষত বড় সাপের ক্ষেত্রে। এটা তারা প্রায়ই করে। এবং আপনি শুধু দেখবেন যে বাইরের চামড়াটি পড়ে রয়েছে। যদিও এই শব্দ থেকে সাপের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো সাপ নিয়ে কথা বলছেন না্ উনি বলছেন মানুষ নিয়ে যাদেরকে আল্লাহ তাঁর দ্বীনের জ্ঞান দিয়েছেন, তাদেরকে উনার আয়াত দিয়েছেন। এর সাথে খোলস পরিবর্তন কারী সাপের সম্পর্ক কি? আসলে আল্লাহ তায়ালা এমন একজন ব্যক্তির ছবি দেখিয়েছেন যে ধর্মটাকে বাহ্যিকভাবে ধরে রেখেছে হয়তো কিন্তু ভিতরে আসলে সে এটা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে, তার অন্তরে আসলে দ্বীনের কিছুই নেই। অর্থাৎ তারা দ্বীনটাকে অনেকটা একটা ছদ্মবেশের মত ধারন করতো। তাদের অন্তরে এর কোন প্রভাব নেই আসলে। যদিও তার হয়তো দ্বীনের অনেক কিছুই পালন করে বাহ্যিকভাবে, যেমন নামাজ পড়া, হালাল খাবার খাওয়া, সালাম বিনিময় করা, অথবা বিশেষ ভাবে পোশাক পরা, এর সবই বাহ্যিক, কিন্তু ভিতরে দ্বীনের কিছুই অবশিষ্ট নেই, ঐ ব্যক্তির আত্মা বলতে আর কিছু নেই যা বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। শুধু কৃত্রিম ধার্মিকতার বহিঃপ্রকাশ, এটা অনেকটা ভিতরে ডিমবিহীন খালি খোলসের মত। তাই আল্লাহ বলছেন আমি তোমাদেরকে সেই লোকের কাহিনী বলতে চাই, যাকে আমি দ্বীনের কিছুটা হলেও জ্ঞান দিয়েছিলাম, তারা ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছিল কিন্তু তারা শুধু সেটাকে বাইরেই ধারণ করেছিল। আর তাদের ভিতরে সেটা থেকে তারা যোজন যোজন দূরে ছিল।
তাই তাদেরকে দেখে হয়তো মনে হয় তার অনেক বড় মুসলিম, তারা দ্বীনের ব্যাপারে সচেতন, নিয়মিত দ্বীন পালন করে, ইত্যাদি, কিন্তু তাদের ভিতরে আসলে কিছুই নেই, কি ভীতিকর একটি ব্যাপার, ফানসালাখা মিন্নাহা।। এখন চলুন এটার বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করি। আমি প্রথমেই বলেছি এটা সেরকম লোকের ক্ষেত্রে হতে পারে যে দ্বীনের খুব সামান্য কিছুই জানে। আবার এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে যে হয়তো তার পুরো জীবন দ্বীন শিক্ষায় ব্যয় করেছে। এমন ব্যক্তি যাদের কাছে দ্বীনের নূন্যতম জ্ঞান আছে, কিংবা এমন ব্যক্তি যে দ্বীন শিক্ষায় আলিম। এমন হতে পারে যে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে তারা হয়তো আল্লাহ যা তাদেরকে দিয়েছে তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। (আল ইন্সিলাখ আর আল ইবতিয়াদ সমার্থক -নিজেকে দূরে সরানো) আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়েছেন তারা তার থেকে দূরে সরে যায়। কেউ একজন যদি আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তার থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে সে জীবনে যত জ্ঞানই অর্জন করুক না কেন, যত পড়াশুনাই করুক না কেন দ্বীন নিয়ে বা ইবাদাত করুক না কেন, এই দ্বীনের প্রকৃতি হচ্ছে এটা পাওয়ার পর আপনি কোন পরিশ্রম করা ব্যতীত ধরে রাখতে পারবেন না। আপনি এরকম বলতে পারবেন না যে আমি দুই বছর আগে পুরা কুরআন পড়েছিলাম, এখন আমি জানি এতে কি আছে। এটাই যথেষ্ট। এরকম হবে না। আল্লাহ ইস্রাইলিদেরকে বলেছেন, খুজুমা আতানাকুম বি কুউয়াতীন, ওয়াজকুরু মা ফিহি। অন্য আরেক জায়গায় বলেছেন ওয়াসমায়ু। ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি প্রবল শক্তি দিয়ে তা ধরে রাখ। আপনাকে এই কিতাব শক্ত করে ধরতে হবে এবং এতে কি আছে তা বারবার নিজেকে স্মরণ করাতে হবে। আরেক জায়গায় আল্লাহ বলছেন বার বার শুনতে থাক। এমন পরিবেশে আপনার থাকতে হবে যেখানে আপনি শুধু উপদেশ দিবেন না উপদেশ নিবেনও। আপনি এমন হতে পারবেন না যে আমি সব জানি আপনাকে বারবার তা নিজেকে মনে করাতে হবে। বারবার দ্বীনের সাথে আপনার নিজেকে সম্পর্কিত করতে হবে, অন্যথায় যেটা হবে, বাহ্যিকভাবে আপনি জ্ঞানীই থাকবেন, বাহ্যিকভাবে আপনি হয়তো যখন তখন আয়াত কোট করতে পারবেন, বাইরে থেকে মনে হবে আপনি খুব ধার্মিক, কিন্তু, ভিতরে? আপনার অন্তর আল্লাহর ক্বালাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই আয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে যা আপনাকে দেওয়া হয়েছিল। তাই আল্লাহ বলছেন, ফান্সলাকাহ মিন্নাহা। মানে হচ্ছে সে ভিতরে, মানসিক ভাবে, আত্মিক ভাবে, আল্লাহর আয়াত থেকে সে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই ভিতর আর বাইরের মাঝে এখন অনেক ফারাক রয়েছে।
আর যখুনি এরকম হয়, ‘ফা আতবায়াহু শাইতান।’ শয়তান সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করা শুরু করে, তাকে পথভ্রষ্ট করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। আরবিতে ‘তাবিয়া’ মানে হচ্ছে, কাউকে অনুসরণ করা, আর ‘আতবায়া’ হয় এটাকে আরবিতে বলা হয় মুবালাগা, মানে হচ্ছে কোন কিছু জোর দেওয়া বুঝানো। আর অর্থ দাঁড়ায় সে তাকে প্রতি পদে পদে অনুসরণ করে। একটা সেকেন্ডও এমন যায় না যে শয়তান তাকে ছাড়ে। এখানে শয়তান সম্পর্কে একটা জিনিস জানতে পারছি যে এমন ব্যক্তি যে আল্লাহর দিকে এসেছিল, যাকে আল্লাহ আয়াত দিয়েছিলেন, যখন সে আল্লাহ থেকে দূরে সরতে থাকে, শয়তান সুযোগ দেখতে পায় এবং সে তার পেছনে উঠে পড়ে লাগে। সে লোক হয়ে পড়ে তার প্রধান প্রজেক্ট। সে সবকিছু ছেড়ে আপনার পেছনে লাগে, এটাই ‘ফা আতবায়াহুশ শায়তান’ এর অর্থ। তাই শয়তান তাকে প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকবে। আরে যেটা হবে শয়তান তাকে যখন ওয়াসওয়াসা করতে থাকবে, সেটা আল্লাহর আয়াতের ঠিক বিপরীত। আল্লাহ এই ব্যক্তিকে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করতে শিখিয়েছিলেন। তাকে বিনয়ী, ভদ্র, দয়ালু এবং স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হবার মাঝে পার্থক্য শিখিয়েছিলেন। কিন্তু শয়তান তাকে অনুপ্রেরনা দেওয়া শুরু করে তখন সে চায় ওই ব্যক্তি তাকে অনুসরন করুক, এবং সে ঐ ব্যক্তি এবং আল্লাহর আয়াতের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে দেয়। আল্লাহর অবাধ্যতা করাকে তার কাছে সৌন্দর্য মণ্ডিত করে তুলবে। ‘শয়তান তাদের কাজ তাদের নিকট সুন্দর করে তুলে’ আর যখুনি সে এটা শুরু করে তখন কি হয়? আল্লাহ বলছেন فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ ‘ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়েছে।’ আরবীতে ‘গাওআ’ দিয়ে বুঝায় যখন কেউ সোজা পথে চলছিল, কিন্তু এক সময় সে হয়তো এমন একটা মোড় নিল যাতে সে একদমই ভুল পথে চলে গেল। ব্যাপারটা অনেকটা হাইওয়েতে ভুল এক্সিট নেবার মত যাতে করে আপনি আর হাইওয়েতে ফিরতে পারবেন না। এটাই গ্বয়ীন। আল্লাহ এখানে খুবই ভীতিকর একটি পরিস্থিতির বর্ননা দিয়েছেন।
(২য় পর্ব)
এই আলোচনায় শয়তানের টার্গেট এ ধরণের লোক নয় যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে বা বিশ্বাস করে না, এখানে তাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে না। এখানে ভাল লোকদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যাদেরকে আল্লাহর আয়াত দেয়া হয়েছিল, কোন কারণে তারা ভুল পথে চলা শুরু করেছে, ইসলাম থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছে। আর এই সুযোগে শয়তান তাদের চেপে ধরে। আর একবার শয়তান যখন এমন লোকের পিছে লাগে সে তাকে দিয়ে এমন কাজ করাবে যা অধার্মিক লোকেরা পর্যন্ত করার সাহস পায় না। এই ব্যক্তি, যে কিনা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার এমন অধঃপতন তার হতে পারে। সে এমন কাজ করতে পারে যা অমুসলিমরা পর্যন্ত করে না। সে এমন নিচে নামতে পারে। মানে হচ্ছে আস্ফালা সাফিলিন। নীচু থেকেও নীচু। আর এই আয়াত যতই অগ্রসর হচ্ছে এই ধরনেই লোকদের কাহিনী নিয়ে, যারা কিনা আল্লাহর পথ থেকে সরে গিয়েছে আর শয়তান তাদেরকে পাকড়াও করেছে, তক্ষুনি আল্লাহ এর করুন পরিণতিটা বলছেন। ‘ওলাও শি’না,লা রাফাআনাহু বিহা। ‘‘যদি আমরা চাইতাম আমরা তাকে অনেক উঁচু আসনে আসীন করতে পারতাম, তার জ্ঞানের কারণে ’। অর্থাৎ যে আয়াত আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন। ‘বিহা’ দিয়ে আয়াত উদ্দেশ্য করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ আপনাকে যে আয়াত দিয়েছেন তার উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে সম্মানের আসলে আসীন করা। উঁচুতে উঠানোর ধারনাটি কুরআনের চিত্রকল্প সমূহের একটি।
কুরআনের আরেক জায়গায়, সুরা নূরে আল্লাহ দুনিয়ার তিন ধরনের সৃষ্টির কথা বলেছেন। তাদের মাঝে একটা হচ্ছে মানুষ, যারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এরপর আসছে ‘ইয়ামশি আলা আরবাআ,’ যারা চার পায়ে চলে, চারপায়ে চলা প্রাণীরা। ‘ইয়ামসি আলা বাতনিহি,’ যারা পেটের উপর ভর দিয়ে চলে। যেমন সাপ। এখানে ইতমধ্যেই আপনারা দেখেছেন সাপের একটি চিত্রকল্প উল্লেখ করা হয়েছে। সাপ হচ্ছে সেই প্রাণী যা মাটির সবচেয়ে কাছে থাকে। আর মানুষের ক্ষেত্রে, তার মুখ , চোখ, শরীর, মাটি থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে একমাত্র পা মাটি স্পর্শ করে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, যারা চারপেয়ে প্রাণী তারা কিন্তু সব সময় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটে। তাদের শরীর এমন ভাবে তৈরি যে তারা সবসময় মাটির দিকে চেয়েই হাঁটে। তাই প্রাণীকূলের মাঝে নিচু প্রানী হচ্ছে সাপ। আর আল্লাহ বলছেন যদি উনি চাইতেন সে লোককে মানুষের মত মানুষ বানাতে পারতেন যে সোজা হয়ে চলে। লারাফাআনাহু বিহা- এর দ্বারা তাকে উঁচু করতে পারতেন। যেভাবে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ও আরেকটি কথা মানুষ যখন উপরে তাকায় তারা তাকায় আকাশের দিকে। তাদের লক্ষ্য অনেক উঁচুতে। আমরা এমন জিনিসের আশা করি যা আকাশ থেকে আসে। যা অন্য প্রাণীদের মত নয়, যাদের একমাত্র লক্ষ্য শুধু মাটির দিকে। তারা শুধু সেদিকেই তাকিয়ে চলে। তারা উপরে তাকায় না। সম্মুখেও তাকায় না। أَفَمَن يَمْشِي مُكِبًّا عَلَىٰ وَجْهِهِ أَهْدَىٰ أَمَّن يَمْشِي سَوِيًّا عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ (সুরা মুলকঃ ২২)) ”যার মুখ মাটিতেই আটকে আছে সেই কি সৎ পথে চলে, না সে ব্যক্তি যে সোজা হয়ে চলে? ” এই আয়াতে এটাই কুরআনের অংকিত ছবি। আল্লাহ বলছেন যদি আমরা চাইতাম আমরা তাকে উঁচুতে উঠাতে পারতাম। অন্য কথায় আমরা তাকে ভাল থেকে উত্তম, উত্তম থেকে উৎকৃষ্টে পরিণত করতে পারতাম। আপনি দ্বীন সম্পর্কে খুব অল্প জানেন, খুব বেশি জানেন না। কিন্তু ওই সামান্যটুকুর কারণেই, আল্লাহ আপনাকে পরের স্তরে উন্নীত করতে পারতেন। সেখান থেকে তারও উপরের স্তরে, সেখান থেকে আরো উপরে। এখানে আপনাকে হয়তো কোন ইমামের সাথে, আলিমের সাথে বা সেরা কোন আবিদের সাথে তুলনা করা হয়নি, আপনি নিজেই নিজেই ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে চলতে পারতেন। শুধুমাত্র এই কারণে যে আল্লাহ আপনাকে শুরু করার জন্য অতি সামান্য কিছু হলেও জ্ঞান দিয়েছিলেন, পথ দেখিয়েছিলেন।
‘ওয়ালা কিন্নাহু আখলাদা ইলাল আরদ।’ কিন্তু সেই ব্যক্তি পুরোপুরি তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ভূমির দিকে, মানে নিচের দিকে। আখলাদা শব্দটি এসেছে খুলুদ থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আসল শব্দটা হচ্ছে এখানে ইখলাদ, যার অর্থ হচ্ছে, কোন কিছুকে স্থায়ী বানিয়ে ফেলা, স্থায়ী হওয়া নয়। মানে হচ্ছে আখলাদা নাফসাহু ইলাল আরদ। আখলাদা হাওয়াহু ইলাল আরদ। আখলাদা হাম্মাহু ইলাল আরদ। সেই ব্যক্তি যাই করতে চাইতো না কেন তার সবকিছুই এখন দুনিয়াকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এ সেই ব্যক্তি যে জান্নাত সম্পর্কে জানে, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত সম্পর্কে জানে, সে কিয়ামতের দিন সম্পর্কে জানে, কিন্তু তা স্বত্তেও নিজেকে দূরে সরানোর কারণে, এখন একমাত্র যা নিয়ে চিন্তা করে, ভালবাসে, যা তার একমাত্র প্রধান লক্ষ্য তার সবকিছুই এই দুনিয়া কেন্দ্রিক। যা কিছুর আকাঙ্খা তাদের আছে, টাকা, সম্পদ, খ্যাতি, লোভ, এগুলো নিয়েই তারা সব সময় চিন্তা করে। এর বাইরে তারা আর কিছু ভাবতে পারে না। তারা আল্লাহর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই। কি দুঃখজনক ব্যপার, যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে জানে, জানে যে তাদের লক্ষ্য আরো উঁচু হওয়া দরকার, কিন্তু তারা শুধুই এই দুনিয়া নিয়ে চিন্তা করে। আখলাদা ইলাল আরদ। আর এই রুপক আয়াতটি আল্লাহ শেষ করছেন এইভাবে যে, ফামাথালুহু, কিভাবে এই ব্যক্তিকে বর্ননা করা যায়। সেই ব্যক্তি যে কিনা সাপের মত ব্যবহার করছে, তাই এখন আল্লাহ এর থেকেও খারাপ একটি উদাহরণ দিচ্ছেন। উনি বলছেন, ফামাথালুহু, কামাথালিল কালব। তার উদাহরণ হচ্ছে একটি কুকুরের মত। এটাই যথেষ্ট অপমান জনক। কারণ কুকুর হচ্ছে এমন একটি প্রাণী, হ্যা এটি বিশ্বস্ত, কিন্তু আল্লাহ আসলে কথা বলছেন একটি ছন্নছাড়া কুকুরের। এটা আমরা দেখবো আয়াতের ভাষা থেকে। এই যে কুকুরটি যার বর্ননা আল্লাহ দিচ্ছেন, আপনারা জানেন কুরআনে আমরা বিভিন্ন মানুষের উদাহরণ পাই, যাদেরকে কোন প্রানীর সাথে তুলনা করা হয়েছে, যেমন ইস্রাইলীরা, যারা তাদের উপর অবতীর্ন কিতাবের মর্যাদা দিতে পারেনি, তাদের তুলনা করা হয়েছে গাধার সাথে। তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধা, যে পুস্তক বহন করে,(সুরা জুমুয়া)।
কিন্তু এখানে বর্ণিত ব্যক্তি, তার থেকেও খারাপ, তার তুলনা হয়েছে কুকুরের সাথে। আর কি বলছেন আসলে আল্লাহ এই কুকুর সম্পর্কে? উনি বলছেন إِن تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَث তুমি যদি এই কুকুরের উপর কোন বোঝা চাপাও কোন বোঝা বেঁধে দেয়া হয় এবং তারপর সেই বোঝা বহন করতে দেওয়া হয়, কুকুরটিকে কোন বোঝা বহনের কাজ দেয়া হয় তখন সে জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। এমন ধরনের হাঁপানো যাতে শব্দ হয় এবং জিহবা বের করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। হাঁহ হাঁহ। কুকুর এটাই করে। কোন প্রাণী যখন তার জিহবা বের করে দিয়ে নিশ্বাস নিতে থাকে, তার অর্থ হল, সে ক্লান্ত। আল্লাহ তায়ালা খুবই নিঁখুত ভাষার ব্যবহার করেছেন চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরতে। যে তোমরা যদি এর উপর বোঝা চাপাও তাহলে সে হাঁপানো শুরু করে। ওয়াইন তাতরুখহু, আর যদি একে এমনিতেও রেখে দাও, ইয়ালহাথ, তখনো সে তার জিহবা বের করে হাঁপাবে। এর অর্থটা কি? এর সাথে আমার, আপনার, অথবা সে ব্যক্তি যে আল্লাহর পথ প্রাপ্ত তার সম্পর্ক কি? যে আল্লাহ তায়ালা এমন একটি অদ্ভুত তুলনা করেছেন? একটি কুকুর, সে অনেক কাজ করলেও হাঁপায় আবার না করলেও হাঁপায়। এই হাঁপানোর ব্যাপারটি, এটা আসলে যেকোন সৃষ্টির জন্যই স্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। যেকোন প্রানী হোক, মানুষ হোক, কখনোই হাঁপায় না যদি না স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। উত্তেজিত হলে, বিরক্ত হলে, অসন্তুষ্ট হলে, পিপাসা পেলে। এটা এমন কারো চিত্র যে অতৃপ্ত, অপূর্ণ। আমাদের উলামারা এই ‘হামল’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিশদ আলচনা করেছেন। যার অর্থ হলো কারো উপর বোঝা চাপানো। আর এটা কুরআনে ওহী নাজিল করা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন এই লোকটি হয়ে গেছে কুকুরের মত, সে ধর্ম সম্পর্কে কিছু শুনলেই বিরক্ত হয়ে যায়। এই ব্যক্তিই কিন্তু সেই ব্যক্তি যে দ্বীন সম্পর্কে জানতো, সে ধার্মিকও ছিল কিন্তু যখনি সে এর থেকে দূরে যাওয়া শুরু করলো, তারপর যখন ইসলামে কোনটা সঠিক কোনটা ভুল এ সম্পর্কে কিছু শুনে মনে মনে সে এটা আর পছন্দ করে না, সেটাতে বিরক্ত হয়। তারা নামাজ পড়ে কোন শান্তি পায় না, মুসলিমদের কোন জমায়েতে সে অস্বস্তি বোধ করে। কোন কিছু জানতে সে বিরক্ত হয়। তাই তারা মুসলিম সঙ্গ থেকে দূরে সরতে থাকে এবং তারা অন্ধরকার জগতের সঙ্গী বেছে নেয়। বাজে ধরনের পরিবেশে তারা মিশতে শুরু করে, কিন্তু সেখানে গিয়েও তারা অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। তারা ভাবে যে ইসলামিক পরিবেশ ছেড়ে সেই পরিবেশে গিয়ে তারা কিছুটা শান্তি পাবে, কিন্তু আসলে তারা শান্তি পায় না।
আবার কোন কোন উলামার মতে এটা তাদের অতৃপ্ত দুনিয়াবি কামনা বুঝাচ্ছে। যখন তারা দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার জন্য তাদের তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে দেন, শয়তানও তাদের পিছনে পড়ে, কারন শয়তানকে তারাই পিছনে পড়তে সুযোগ দিয়েছিল। এখন যেটা হয়েছে শয়তান তাদেরকে খালি ভোগের পর ভোগ করতে বলছে, যদিও তাদের হয়তো ভোগের আর প্রয়োজন নেই। এর মানে কি? এর মানে হচ্ছে এমন কেউ যে হয়তো টাকা পয়সা কামানোতে আসক্ত হয়ে পড়ে, কামনা, বাসনা চরিতার্থ করায় ধান্দায় থাকে, অতি ভোজনে আসক্ত হয়ে পড়ে বা এরকম কিছুতে। তারা খাবার কথা চিন্তা করে যখন তারা ক্ষুধার্ত থাকে আবার যখন থাকে না তখনও তারা খাবারের কথাই চিন্তা করে। তারা হয়তো দুপুরের খাবার খাচ্ছে আর তখন চিন্তা করছে রাতের খাবারে কি খাবে। তারা জিনিসপত্র কেনাকাটা নিয়েও অতিরিক্ত মগ্ন থাকে, হয়তো তারা দেনার ভারে ডুবে আছে, তখনো ভাবতে থাকে আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কি কেনা যায়। আর কি পাওয়া যায়। এভাবে মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকে এবং কোন ভাবেই নিজেকে প্রতিহত করতে পারে না, যেভাবে একটি কুকুরও নিজের হাঁপানো বন্ধ করতে পারে না। কারণ থাকুক আর না থাকুক, প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক হাঁপাতে থাকে।