আসসালামু আলাইকুম, সবাইকে স্বাগতম ‘বিস্ময়কর কুরআন’ সিরিজে। কুরআন অধ্যয়নের সময় বিস্ময়কর কিছু পেলে আমি এই সিরিজে তা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পছন্দ করি।
আজ আমি কুরআনে উল্লেখিত ইয়াকুব আঃ এর একটি উক্তি নিয়ে কথা বলতে চাই। উনি উনার সন্তানদের সাথে কথা বলার সময় এই উক্তিটি করেন, যখন তার সন্তানরা তার উপর হতাশ হয়ে পড়ছিল এ কারণে যে উনি ইউসুফ আঃ এর কথা ভুলতে পারছিলেন না, আর এটা নিয়ে সবসময় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে থাকতেন। تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُف আপনি কি ইউসুফের কথা মনে করতেই থাকবেন যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করেন ? আপনি কি এটা থেকে নিবৃত হবেন না? তখন তিনি এর জবাবে বলেন – قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ আমি আমার দুঃখ এবং অস্থিরতা শুধু আল্লাহর সমীপে নিবেদন করছি।
এই কথাগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের সবারই জীবনে কোন কোন সময় দুঃখজনক ঘটনার মর্মযাতনা সইতে হয়। আর আমরা আমাদের এই দুঃখ অন্যের সাথে শেয়ার করতে চাই। কোন বন্ধু, জ্ঞানী লোক বা আমরা বিশ্বাস করি এমন কারো সাথে এই দুঃখ ভাগ করে নিলে আমরা কিছুটা নিস্তার পাই। মাঝে মাঝে আমরা আমাদের সমস্যার কথা মাতা পিতার সাথে ভাগ করি, বা কোন কাছের বন্ধু, বা কোন ইমামের সাথে। মানুষ আমাকে ইমেইল করে তাদের সমস্যার কথা জানায়। অথবা কোন কনফারেন্সে গেলে এক পাশে ডেকে নিয়ে তাদের বৈবাহিক সমস্যার কথা বলে, ভাই- বোনের দ্বন্দ্বের কথা বলে বা সন্তানদের সাথে বা পিতা- মাতার সাথে গণ্ডগোলের কথা ইত্যাদি বহু রকমের বিষয়।
এই আয়াতে ইয়াকুব আঃ এর কথার মধ্য দিয়ে একটি গভীর সত্য প্রকাশিত হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা একে অন্যকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি কখনই আপনার ব্যথা বুঝতে সমর্থ হবো না। এবং আপনি কখনও আমার ব্যথা উপলব্ধি করতে পারবেন না। এটা কখনই ঘটবে না। আমি যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাই তা শুধু আমিই জানি। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো আমরা নিজেদের দুঃখকে অন্যের দুঃখের সাথে তুলনা করি। অথবা আমরা এরকম বলি- তোমার অবস্থা তো তার মত। কিন্তু প্রত্যেকটা অবস্থাই স্বতন্ত্র। প্রতিটা দুঃখ, প্রতিটা বেদনা স্বতন্ত্র। আর একমাত্র যিনি আপনার ব্যথা বুঝতে পারেন তিনি হলেন আল্লাহ। ‘ইন্নামা’ শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এটা দ্বারা বুঝায় যে, আপনাকে সবার আগে বুঝতে হবে- সত্যিকার অর্থে একমাত্র যিনি আপনার অবস্থা বুঝতে পারেন, এবং আপনার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন – – যে সহানুভূতি কারো পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এমনকি আপনার সেরা বন্ধুর পক্ষেও না – তিনি হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। আর ইয়াকুব আ বলেন – وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তা তোমরা জান না। আমি জানি যে, আল্লাহ আমাকে এমনভাবে জানেন যেভাবে তোমাদের পক্ষে জানা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আয়াত দ্বারা এটা এবং আর কিছু বুঝায়।
আল্লাহর উপর ভরসা করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা মৌলিক ভিত্তির কাজ করে। এটা জানা যে, আল্লাহ আপনাকে যেভাবে বোঝেন অন্য কেউ আপনাকে সেভাবে বুঝতে পারে না, তিনি যেভাবে আপনাকে উপলব্ধি করেন অন্য কেউ সেভাবে করে না, তিনি আপনার প্রতি যেভাবে সহানুভূতি দেখান অন্য কেউ সেভাবে দেখাতে পারে না। তাই আপনার অভিযোগ, অনুযোগগুলো সর্ব প্রথম আল্লাহর সমীপে পেশ করুন। আল্লাহর নিকট হাত তুলে বলুন- ইয়া আল্লাহ, আপনি জানেন কি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছি।
আর কান্না করা দোষের কিছু নয়। এই বিষয়টা বলেই শেষ করব। এই বিষয়ে আগেও কথা বলেছি, কিন্তু আবার বলাটা গুরুত্বপূর্ণ। যখন কেউ কাউকে হারায় বা পরিবারের কাউকে হারায় তারা কান্না করে। তখন পরিবারের অন্য কোন সদস্য হয়তো বলে- তোমার কান্না করা ঠিক নয়, তোমার ধৈর্য ধারণ করা উচিত। অথবা এভাবে বলে- তোমার সুখী হওয়া উচিত কারণ বাচ্চা তো জান্নাতে। হ্যাঁ, এটা সত্য আমাদের খুশি হওয়া উচিত কারণ বাচ্চা জান্নাতে, কিন্তু আমরা তো মানুষ আর আমরা কাঁদি। আর দুঃখিত হওয়া দোষের কিছু নয়। যদি একজন নবী বছরের পর বছর কাঁদতে পারেন ভুলে না গিয়ে, এমনকি তার ছেলেরা পর্যন্ত তাকে বলছেন, আপনি কি এটা ভুলতে পারেন না? আর জবাবে তিনি বলেন- আমি শুধু আল্লাহর নিকট কাঁদছি। তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? এটা আমার এবং আল্লাহর মাঝে।
মানুষের এই চমৎকার আবেগকে আল্লাহ অস্বীকার করেন না। দুঃখিত হওয়া খারাপ কিছু নয়। কান্না করা দোষের কিছু নয়। এটা আপনার জন্য প্রয়োজনীয়। আল্লাহ বলেন না যে আপনার ধৈর্য নেই। আল্লাহ রোবট সৃষ্টি করেনি, তিনি আবেগপ্রবণ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এমনকি নবীদেরও এসব আবেগ ছিল। আর কুরআনে একে বৈধতা দেয়া হয়েছে। কিভাবে আমরা একে মানুষের জন্য অস্বীকার করি? আমরা এটা করতে পারি না। এটা আমাদের জন্য আল্লাহর একটা উপহার যে আমরা আল্লাহর নিকট অভিযোগ পেশ করতে পারি।
কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, যখন আপনি এমন কারো সাক্ষাত লাভ করেন যে সত্যিকার অর্থে আপনাকে ভালবাসে আর আপনি মন খুলে তার সাথে কথা বলেন, আপনি তখন অটোম্যাটিক্যাললি কাঁদতে শুরু করেন। আপনি যখন আপনার চেপে রাখা কষ্টের কথা বলা শুরু করেন, আপনি আর থাকতে পারেন না কাঁদতে শুরু করেন। আর আল্লাহর নিকট এভাবে কান্না করা দোষের কিছু নয়। তাঁর নিকট আপনার অভিযোগ পেশ করা ঠিকাছে। আপনার সমস্যাগুলো তাঁকে জানানো দোষের কিছু নয়। সুবহানাল্লাহ! এটা আপনাকে এমন সান্ত্বনা দিবে যা অন্য কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয়। সুবহানাল্লাহ! আমাদের দুঃখের সময়গুলোতে আল্লাহ আমাদের সান্ত্বনা দান করুন! এবং নিজেদের বা অন্যদের দুঃখ প্রকাশের ক্ষেত্রে যেন আমরা নির্মম না হই।