নোমান আলী খান – সুরা নাসের তাফসীর এর অংশ বিশেষ
সুরাতুন নাসে আল্লাহর কাছে আমরা শুধু শয়তানের ওয়াসওসা (কুমন্ত্রণা) থেকে নয়, বরং মানুষের ওয়াসওয়াসা থেকেও আশ্রয় চাই। এটা পরিষ্কার যে শুধু মানুষের কথা বা পরামর্শ দ্বারা নয় বরং তাদের চাহুনির দ্বারাও ওয়াসওসা হয়ে থাকে।আপনার আত্মসম্মান যদি দুর্বল হয়… আমার মেয়ে আছে। তাই এটা নিয়ে অনেক ভাবি। কারণ, মেয়েদের জন্য আত্মসম্মান বিশাল এক সমস্যা। তাই না? কোনো মেয়ে মনে করে সে কুৎসিত। সে কোনো বিয়েতে গেলো। সেখানে তার চোখে সুন্দরী এক মেয়ে তার দিকে মুখ বাঁকা করে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল। এটুকুই… সাময়িক একটু ইঙ্গিত। এই মেয়েটি এখন মায়ের সাথে ঝগড়া করবে। “আমি মেকআপ করতে চাই, এরকম কাপড় পড়তে চাই, এটা করতে চাই, ওটা করতে চাই…” এ সবকিছুই শুরু হয়ে কোত্থেকে? একটি বিয়েতে, একটি মাত্র মেয়ে তাকে দেখে মুখ ভেংচি দিলো। এটুকুই হয়েছিল! আর তার জীবন বদলে গেলো!বুঝতে কি পারছেন ওয়াসওয়াসা কতোটা শক্তিশালী? কীভাবে আল্লাহ্র কাছে আপনার আশ্রয় চাওয়া উচিত মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া থেকে?কখনো কখনো আমাদের খুব কাছের মানুষও এমন কিছু বলতে পারে যা সারাজীবনের জন্য ক্ষত তৈরি করে! সারাজীবনের জন্য!
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাকে অসাধারণ পিতামাতা দিয়েছেন। কিন্তু আমি ঘটনা শুনি এমন সব পিতামাতার যাদের কিনা সন্তানকে সবচাইতে বেশী ভালোবাসার কথা তারাই সন্তানদের কথা শুনিয়েছে। এমন কথা বলেছে যে, “আমি জানি, তোমাকে দিয়ে জীবনে কিচ্ছু হবে না।”আপনি এই একটা কথা বলে বিরিয়ানি খেতে লাগলেন। কিন্তু এই ছেলেটি কলেজে যাওয়া বাদ দিলো, চাকরি ছেড়ে দিলো, বিষণ্ণতায় ডুবে গেলো, নেশা শুরু করলো, মদপান শুরু করলো। তার জীবনটা আপনি ধ্বংস করে দিলেন কারণ তার মাথায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে, “আমাকে দিয়ে তো এমনিতেই কিছু হবে না”। আর এটা সেই পিতার কাছ থেকেই এলো যার কাছ থেকে তার সাহস পাবার কথা ছিল!এমনটা করে আপনি নিজেই হলেন আল ওয়াসওয়াসিল খান্নাস। যেটা আপনার সন্তানের মনের ভেতর, হৃদয়ের ভেতর ওয়াসওসা বা কুমন্ত্রণা তৈরি করছে! খুবই কঠিন জিনিস এটা!মানুষকে আমরা যে কথা বা পরামর্শ দেই, এমনকি যেভাবে তাদের দিকে তাকাই , যেভাবে তাদের সাথে ব্যবহার করি কিংবা যেভাবে তারা আমাদের সাথে ব্যবহার করে তা আমাদের ব্যক্তিত্বে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে! দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে। আর সেটা থেকেই আমরা সুরাতুন নাসে আল্লাহ্র আশ্রয় চাই।
এই সূরার প্রধান শব্দ হলো “খান্নাস”। কারণ আল-খান্নাস মানে সে আপনাকে বিলম্বিত করায়। আল্লাহ অসাধারণ কাজের জন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানুষকে বিস্ময়কর বোধ-বুদ্ধি দিয়েছেন।মা খালাক্বাল্লাহু খালক্বান আক্বরামা ‘আলাইহি মিনাল ‘আক্বল- আল্লাহ আকল বা বুদ্ধির চাইতে উত্তম কিছু সৃষ্টি করেননি। মানুষকে এই আকল দ্বারাই শক্তিশালী করা হয়েছে। এই শক্তি দিয়ে আমরা জীবনে অসাধারণ কিছু করে ফেলতে পারি। আমরা মানবতার সেবায় এ বুদ্ধি নিয়োগ করতে পারি। আর এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহ শুধু ইবাদাতের জন্য না বরং নির্দিষ্টভাবে ইবাদত করার জন্য আমাদেরকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। ইল্লা লি’আবুদুন- শুধু আমার ইবাদতের জন্য। কিন্তু সেই ইবাদতের মানে কী ? তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করছেন—
هُوَ اَنۡشَاَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ وَ اسۡتَعۡمَرَکُمۡ فِیۡهَا –
“তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আবাদের ব্যবস্থা করেছেন।” (১১:৬১)
তিনি তোমাদের পৃথিবীতে রেখেছেন যেন একে আবাদ করতে পারো, একে আরও উন্নত করতে পারো। তিনি তোমাদের এখানে রেখেছেন উন্নতি সাধনের জন্য। এজন্যই আল্লাহ আমাদের এখানে রেখেছেন।আপনাদের কারও কারও বিস্ময়কর প্রকৌশলি মনন আছে, কারও আছে গাণিতিক বুদ্ধি, কারও শৈল্পিক, কারও সাহিত্যিক। কেউ আছেন ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী, কেউ অন্যকে হাসাতে ওস্তাদ। কেউ আবার অসাধারণ পরামর্শদাতা! এই বিস্ময়কর প্রতিভাগুলো এখনো ব্যবহার করেননি। জানেন কেন? কারণ, কোনো একজনের ওয়াসওয়াসা বা বাজে মন্তব্য আপনাকে টেনে নামিয়ে এনেছে এমনভাবে যে আপনি আল্লাহ্র খেদমতের এই সম্ভাবনাকে বিলম্বিত করেই যাচ্ছেন।আপনি বারবার দেরী করছেন, আরও দেরী, আরও দেরী… কারণ নিজের উপর আপনার আর ভরসা নেই। ইবলিসের কোনো একটি কৌশল আপনাকে ধরে ফেলেছে। সেটা শয়তানের মাধ্যমে হোক কিংবা কোনো মানুষের মাধ্যমে। الَّذِیۡ یُوَسۡوِسُ فِیۡ صُدُوۡرِ النَّاسِ – যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ- (এই কুমন্ত্রণাদাতা হচ্ছে) “জিনের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।”