সুস্থ হৃদয়

—নোমান আলী খান

হৃদয়ের জন্য দুটো প্রতিশব্দ আছে, বলুন তো সেগুলো কি কি? ক্বালব আর ফুআদ। ক্বালব হলো হৃদয়ের সাধারণ প্রতিশব্দ। ফুয়াদ ব্যবহৃত হয় যখন…? যখন কোনো ধরণের উত্তেজিত কিংবা আবেগপ্রবণ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

আপনারা কি জানেন কুরআনে খুবই সুন্দরভাবে আল্লাহ এই ব্যাপারগুলোর হিসেব রাখেন। তাই আপনারা সুরাতুল ক্বাসাসে দেখবেন এই একই জিনিসের জন্য দুটো শব্দ একইসাথে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন- وَ اَصۡبَحَ فُؤَادُ اُمِّ مُوۡسٰی فٰرِغًا ؕ اِنۡ کَادَتۡ لَتُبۡدِیۡ بِهٖ لَوۡ لَاۤ اَنۡ رَّبَطۡنَا عَلٰی قَلۡبِهَا لِتَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ (২৮:১০) মূসা (আ) এর মায়ের হৃদয় উড়েই যাচ্ছিল, ধড়ফড় করছিল, খালি হয়ে গেলো। কারণ তিনি তার বাচ্চাকে একটি বক্সে বন্দী করে মাত্রই পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। এখন বাচ্চাটি এতো দূরে চলে গেছে যে তিনি আর দেখতে পাচ্ছেন না। তাই তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন।

একই সময়ে তার ভয়, তার দুঃখ, তার কষ্ট, ধকল, প্রচণ্ড আবেগ-অনুভূতির ব্যাপ্তি এতোই প্রকট ছিল যে তার হৃদয়কে শুধু ক্বালব বলা হয়নি, বরং কী বলা হয়েছে? ফুয়াদ। কারণ তা সম্পূর্ণরূপে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, পুড়ে যাচ্ছিল!

তারপর আল্লাহ বলছেন, তিনি গোপন বিষয়টি ফাঁস করেই দিচ্ছিলেন। إِن كَادَتْ لَتُبْدِى بِهِ মানে তিনি প্রায় ঘর থেকে ছুটেই চলে যাচ্ছিলেন বাক্সটির প্রতিঃ আমার বাচ্চা!! তিনি নিজেকে থামাতে পারছিলেন না। কিন্তু তাকে আল্লাহ্‌র টেনে ধরতে হলো। এটা বোঝা জরুরি, কারণ কোনো মায়ের নিজেকে থামানো সম্ভবত মানসিকভাবে অসম্ভব। সম্ভবত একেবারেই অসম্ভব। আমি এমনটা হবার কোনো কারণ দেখি না। অন্য কথায়, কোনো বাচ্চা… ধরুন বাচ্চাকে দোকানে নিয়ে গেছেন।

আর সে আপনার আঙ্গুল ধরে আছে, আপনি হাঁটছেন। হঠাৎ করে দুই সেকেন্ডের জন্য আপনি তার হাত আর অনুভব করছেন না। তৎক্ষণাৎ কি করেন আপনি? করিম! করিম! আআআআ! হাহাহা কতক্ষনের মধ্যে কোনো মা পাগল হয়ে যায়? আমি তো মনে করি দশ সেকেন্ড। আর বাবা! বাচ্চাকে না দেখলে বলে, “হ্যাঁ! আছে কোথাও।” হাহা “কাছেই আছে!” তাই না? কিন্তু মা, দশ সেকেন্ডের মধ্যেই, একেবারে পাগল! উন্মাদ হয়ে যায়। মা’রা কিছুই মানে না। তার মধ্যে সন্তান রক্ষার এমনই এক পশু প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় যে, তিনি আর কিছুই পাত্তা দেন না।

আমি এমনও অনেক দেখেছি মানুষকে রাস্তায় গাড়ি চালাতে, খুবই ধীরে, ধরুন ১৫ মাইল গতির রাস্তায় ১৮ মাইল গতিতে। আর বাচ্চারা উঠানে খেলছে, রাস্তায় না কিন্তু। এতেই মা লাঠি হাতে বের হয়ে আসেন, “আস্তে চালাও! আমার বাচ্চারা খেলছে এখানে!” “ওরে আল্লাহ! আন্টি! আচ্ছা আচ্ছা!” কারণ এটাই মা’দের প্রতিরক্ষামূলক প্রকৃতি। (protective instinct)। আর এই মা’টি নিজের বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দিয়েছেন। তার প্রথম প্রবণতা কী হবে? আপনাদের কি মনে হয়, যা করলেন তা নিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত? “হ্যাঁ ভালোই কাজ করলাম! টাটা!!” না। তিনি তাকে ফিরিয়ে আনতে চান। আর এখন সে যেহেতু চলেই গেছে, তিনি আর শান্ত থাকতে পারছেন না। তিনি বলতে গেলে ঘর থেকে বের হয়ে সব প্রকাশ করেই দিচ্ছিলেন। তাই তাকে টেনে ধরতে হবে তো কিছু একটার।

তাই আল্লাহ বলছেন- لَوْلَآ أَن رَّبَطْنَا عَلٰى قَلْبِهَا -আমি যদি বেঁধে না দিতাম, গিঁট না দিতাম তার হৃদয়ের উপর—মানে আল্লাহ তাকে মানসিক শান্তি, প্রশান্তি, স্থিরতা দিয়েছিলেন যেন তিনি ধৈর্য্য হারিয়ে না ফেলেন এবং বাচ্চার পেছনে ছুটে না যান। কারণ, তার শান্ত থাকাটা তখন জরুরি ছিল। যদিও মানসিকভাবে তা অসম্ভব। আল্লাহ হস্তক্ষেপ করলেন। তাই তার হৃদয়ের প্রশান্তি নিজে থেকে আসেনি। আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আল্লাহর কাছ থেকেই আসা দরকার ছিল। তিনি নিজে একে শান্ত করার সামর্থ্য রাখেন না। কারণ, এটা যে ছিল তাঁর ফুয়াদ। আল্লাহ স্বয়ং তার হৃদয় শান্ত করলেন।

আর যখন হৃদয় শান্ত হয়, অনুভূতির চাপে পিষ্ট হয় না তখন তা কি হয়ে যায়? ক্বালব। তাই তিনি বলছেন, لَوْلَآ أَن رَّبَطْنَا عَلٰى قَلْبِهَا যখন শান্ত হলো তা আবার ক্বালব হয়ে গেলো। এর মাঝে আমাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কেও অসাধারণ শিক্ষা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আমার রাগের সমস্যা আছে, এটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার অনেকে বলে, আমি সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি, খুব বিষণ্ণতায় ভুগি। কি আর করবো আমি? কিছুই করার নেই। আমি এমনই। না, আপনি এমন না। আর কিছু মানুষের অবস্থা এমনও যে, তারা মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়ায়। আপনার কোন কাজিন, কিংবা ভাই বা বোনের সাথে ঝগড়া হলো, তখন আপনি বলেন, “তার নামও বলো না। তার নাম শুনলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

আমি তার কথা চিন্তাও করতে চাই না। আমার খুব রাগ লাগে।” তাই না? “অন্য কিছু নিয়ে কথা বলো।” আপনি তাদের দিকে তাকাতে চান, কথা বলেন না, চিন্তাও করতে চাননা কখনো। আপনাদের কারও কারও আবার এই সমস্যা আছে শাশুড়ি, শ্বশুর বা অন্য কারও সাথে। তাই না? এমন ঘটনা তো হয়! কখনো ভাইবোনের মাঝেও এমন হয়! বন্ধুদের মাঝেও হয়! আগে বন্ধু ছিল, এখন সহ্যই করতে পারেনা। একে অন্যকে দেখতেই পারে না। তারা বলে, “আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। হৃদয়টা ঠিক হচ্ছে না। আমি ভুলতে পারছি না। যা হয়েছিল তা ভুলতেই পারছি না। কষ্টটা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে পারছি না। আমি জানি সে তার কাজের জন্য দুঃখিত, জানি সে বদলে গেছে, জানি সব ঠিক আছে এখন। তবুও যা হয়েছে তা মেনে নিতে পারছি না।”

এই আয়াতের বিষয়টি হলো, মুসা আলাইহিস সালামের মা তার বাচ্চাকে মাত্রই পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। এখন বাচ্চা দৃষ্টির সীমানা থেকে হারিয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, তার বাচ্চা আর কখনোই ফিরে আসবে না। সে আজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে। এই ধরণের ব্যাপার, এগুলো কি মানসিকভাবে কাউকে, কোন মা’কে অসুস্থ করে দিতে পারে? এমন কিছুর সম্মুখীন হলে? আপনি বলতে পারেন, এমন কিছুর সম্মুখীন হবার পর তিনি আর কখনোই ভালো হবেন না। কখনোই সুস্থ হবে না। কিন্তু আল্লাহ হস্তক্ষেপ করে তাকে সাথে সাথেই সুস্থ করে দিলেন।

তাৎক্ষণিকই আল্লাহ তার ক্বলবে রাবত দিলেন। এখন বলুন তো, মূসা (আ) এর মা কি নবী ছিলেন? না। গুহার যুবকগুলো কি নবী ছিলেন?

وَرَبَطْنَا عَلٰى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ (১৮:১৪) আল্লাহ হৃদয়কে বাঁধেন, শান্ত করেন, শক্তি প্রদান করেন এবং অন্তরকে সুস্থ করে তোলেন।

তিনি শুধু নবীদের জন্যই এটা করেন না। আল্লাহ হস্তক্ষেপ করেন আপনার আর আপনার হৃদয়ের মধ্যেও। আল্লাহ আপনার হৃদয়ে হস্তক্ষেপ করে সেটাকেও সুস্থ করে দেন।

وَاعْلَمُوٓا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ

(আর জেনে রেখ যে আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে যান। ৮:২৪)

আল্লাহ নিজেই বলছেন। তিনি আপনার হৃদয়ে হস্তক্ষেপ করেন। ভিন্নভাবে বললে, আল্লাহ্‌র ক্ষমতা আছে আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার, আপনার অতীতকে ভুলিয়ে দেবার। আগের ক্ষতগুলো ভালো করে দেবার, যেন আপনি স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। অনেক মানুষ, এখানে বসে থাকা অনেক মানুষও অতীতকে পুঁজি করেই বেঁচে আছেন। কিছু একটা হয়েছিল, আপনি ভুলতে পারছেন না। সারাক্ষণ তা নিয়েই চিন্তা করেন। তা আপনার ক্ষত বাড়িয়েই দেয়। তাই তা আরও স্মরণ করেন, আরো মন খারাপ হয়।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে ছয় মাস আগে। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু হটাত একদিন স্ত্রী বললো, মনে আছে আমাদের ঝগড়ার কথা? স্বামী বলছে, হ্যাঁ! কি হাস্যকর ছিল! “না হাস্যকর না! গুরুতর ছিল সেটা। এখনো সব মনে আছে আমার।” এভাবে তা আবার শুরু হয়ে যায়! “ছয় মাস আগের জিনিস! আবার শুরু করছো কেন?” যেন তাদের মাত্রই ঝগড়া হলো! কারণ স্ত্রী ভুলতে পারছে না। যদিও পরে সবকিছুই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে ভুলতেই পারছে না। কখনো স্বামীও ভুলতে পারে না। এটাই রাবতুল ক্বালব। আল্লাহ আপনার হৃদয়কে শক্তি দেবেন, যদি আপনি তাঁর কাছে চান। সাধারণত আমরা ইসলামে যখন হৃদয়, অন্তর নিয়ে আলোচনা করি, সেগুলো হয় ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহ ভীতি, খাশিয়া আর খুশু। মানে আল্লাহ্‌র সাথে আমাদের সম্পর্কগুলোই, যখন হৃদয় নিয়ে চিন্তা, আলোচনা করি। প্রকৃতপক্ষে কুরআনের ভেতর হৃদয়ের আলোচনা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সাথে আমাদের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ না, মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিয়েও কথা আছে। কারণটা হলো… আল্লাহ বলছেন বিচার দিবসে

“إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ”—

বিচার দিবসে শুধুমাত্র তারাই বেঁচে যাবে যারা আল্লাহ্‌র কাছে সুস্থ হৃদয় নিয়ে আসবে। (26:89)

কিন্তু আমার হৃদয়ে তো শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভয়, আশ্বাস নেই। আমার হৃদয়ে আরও আছে মায়ের প্রতি, স্ত্রী, সন্তান, সবার প্রতি ভালোবাসা। আর যদি কোন ঝগড়া, হিংসা, রাগ, ক্রোধ আর অন্যান্য জিনিস থাকে, সেগুলোও কোথায় বাস করে? আমার হৃদয়ের ভেতরেই! তাই অন্যের প্রতি এই অনুভুতিগুলো যদি হৃদয়ে থাকে তবে সেটা তো সুস্থ হৃদয় হলো না। আল্লাহ্‌র সামনে আসতে হলে আমার সুস্থ হৃদয় দরকার।

শুধু তাঁর প্রতিই সুস্থ না, সামগ্রিকভাবেই সুস্থ হৃদয়। অর্থাৎ মানুষের সাথে আমার বোঝাপড়াও ভালো হতে হবে। সঠিক হতে হবে। সম্পর্ক মেরামত করতে হবে। সেটাই আছে لَوْلَآ أَن رَّبَطْنَا عَلٰى قَلْبِهَا এর ভেতরে। সুবহানআল্লাহ!