নূরুন ‘আলা নূর

— উস্তাদ নোমান আলী খান 

আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা বলেন – 

اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونِةٍ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ نُّورٌ عَلَى نُورٍ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আল্লাহ হলেন সমস্ত আসমান ও যমীনের নূর (আলো)। তাঁর নূরের দৃষ্টান্ত হলো যেন একটি তাক – যার ভিতরে রয়েছে একটি প্রদীপ; প্রদীপটি রয়েছে একটি স্বচ্ছ কাঁচপাত্রের আবরণের ভিতরে; কাঁচটি (নিজেও) যেন একটি উজ্জ্বল তারকা, যা প্রজ্জ্বলিত করা হয় বরকতময় যায়তুন গাছ (থেকে নিসৃত তেল) দ্বারা; যা পূর্বমুখি নয়, আবার পশ্চিমমুখিও নয় (বরং উভয়দিক থেকেই আলোপ্রাপ্ত, সর্বদা প্রজ্জ্বলিত)। আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও সেই তেল এতই বিশুদ্ধ স্বচ্ছ যে (তাতে আগুন না দিলেও) তা যেন নিজে নিজেই জ্বলে উঠার নিকটবর্তী। আলোর উপরে আলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তার নূরের দিকে পথ দেখান। আল্লাহ মানুষের (বোঝানোর) জন্য (এসব) দৃষ্টান্ত পেশ করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। 

[সূরা নূরঃ ৩৫]

আপনাদের অনেকেই এই আয়াতের সাথে পরিচিত। এর সাধারন অনুবাদ করা হয় “আল্লাহ হলেন আকাশ এবং পৃথিবীর জ্যোতি।” পরবর্তী কয়েক মিনিটে আমি এই আয়াতগুলো নিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই। 

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে পারি, আল্লাহর কিতাবকে গভীরতার বিভিন্ন ধাপে অধ্যয়ন করা যায়। আর আল্লাহর এই কিতাবের গভীরতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এর কোনো শেষ নেই। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এই কিতাব নিয়ে অধ্যয়ন করছি। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এমনকি একটি আয়াত নিয়ে অনেক অধ্যয়ন করার পরও আপনি কেবল আপনার সামর্থ অনুযায়ী অল্পই জ্ঞান লাভ করতে পারেন। তারপর যখন এই আয়াত নিয়ে এমন কারো ব্যাখ্যার সন্ধান পান যিনি এর উপর আরো গভীর এবং ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করেছেন, তখন উপলব্ধি করেন আপনি আসলে এই আয়াত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। তাই, এই কিতাবের গভীরতার আসলে কোনো শেষ নেই। আল্লাহ তা’য়ালার অতি চমৎকার এবং নিখুঁত এই কিতাবের প্রতিটি আয়াতে প্রজ্ঞারও কোনো অন্ত নেই।

একদিকে একথা যেমন সত্য। ঠিক তার বিপরীতে মুসলমানদের বেলায় আরেকটা দুঃখজনক দিক আছে। আমি অনুভব করি, আজকের মুসলমানদের অনেক করুণ ব্যাপারের মাঝে একটি হলো – আল্লাহর কিতাবের সাথে দূরত্ব। একদিকে, কেউ হয়তো কুর’আনের অনুবাদ পড়ে আর মনে করে যে, সে যা বুঝেছে সেটুকুই কুর’আনের সব। এর বেশি কিছু আর এখানে কুর’আনের দেবার নেই। আমি মনে করি, এটা একটা মর্মান্তিক ব্যাপার। আমি মনে করি, এটা ভাবা ইনসাফ হবে না যে, আমরা একটা অনুবাদ পড়েই ধারণা করে বসি যে আল্লাহ যা বলতে চেয়েছেন আমরা তা বুঝে গেছি। অথচ আল্লাহ যা বলতে চেয়েছেন তা সীমাহীন গভীর। অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এবং সৌন্দর্যে সবকিছু ছাড়িয়ে অনন্য। আর এসব কোনো মানবীয় বুদ্ধি এবং প্রচেষ্টা দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর সেটা অনুবাদ করে বোঝানোর কথা না হয় বাদই দিলাম। এটা সম্ভবনারও অতীত। 

তো, একদিকে আপনি এমন অনেক মুসলমান পাবেন যারা কুর’আনের মূল্য, অতল শক্তি এবং সৌন্দর্যকে অবমূল্যায়ন করছে। অন্যদিকে আপনি এমন অনেককেই পাবেন – যারা আল্লাহর কিতাবকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। এর সৌন্দর্য় ও শক্তিমত্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যখন তারা মানুষের নিকট তা উপস্থাপন করেন বা অন্ততপক্ষে শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন এমন কঠিন, দুর্বোধ্য এবং নিরস পন্থায় সেগুলো তুলে ধরেন যা সাধারণ মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানুষ কিছুই বুঝতে পারে না। “তিনি কী নিয়ে কথা বলছেন? তিনি প্রায় ৮০ জন তাফসীরকারকের উদ্ধৃতি দিলেন এবং ব্যাকরণগত খুঁটি-নাটি বললেন, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

 তারপর মানুষ এ ধরণের আলোচনা থেকে বের হয়ে এসে বলে, 

– “ভাই, আলোচনাটি খুব গভীর ছিল।”

তারপর আপনি জিজ্ঞেস করেন – “তিনি কী নিয়ে কথা বললেন?” 

– “আমি ঠিক জানি না, কিন্তু এটা খুব গভীর আলোচনা ছিল, খুবই গভীর!” 

এজন্য আমি নিজেও বিচলিত হয়ে যাই। একদিকে এই আয়াতগুলো গভীর সৌন্দর্যতায় পরিপূর্ণ। সামান্য যা কিছু আমি অধ্যয়ন করতে পেরেছি তাতেও মাঝে মাঝে কুর’আনের গভীরতা দেখে এতই অভিভূত হয়ে পড়ি যে, তখন পড়া বাদ দিয়ে উঠে যেতে বাধ্য হই। আমাকে বিরতি নিতে হয়। 

মাঝে মধ্যে কুর’আনের কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে পড়ার ইচ্ছে করি। ফলে, ঐ বিষয়ে কিছু আয়াতের উপর হয়তো কয়েক সপ্তাহ বা অনেক সময় কয়েক মাস ধরে অধ্যয়ন চালাতে থাকি। একটা তাফসির পড়ি। কিছু নোট করি। বা হয়তো ঐ বিষয়ে কোনো আলেমের বক্তব্য শুনতে থাকি। তা থেকে কিছু টুকে রাখি। এসব করতে করতে অনেক সময় এমন একটা অংশে এসে পড়ি, এতোটাই অবাক হয়ে যাই যে সেখানেই আমাকে থামতে হয়! ফলে, আমাকে উঠে যেতে হয়। তখন হয়তো গিয়ে বাচ্চাদের সাথে খেলা করি বা কিছু একটা করি; যেন মস্তিস্ককে কিছুটা বিশ্রাম দিতে পারি। আমি অন্য জগতে চলে যাই। কারণ, এর এতোটা গভীরতা আমাকে পুরোপরি অভিভূত করে ফেলেছিলো। 

এখন এই আলোচনায় আয়াতের কোন অংশটা আপনাদের বলবো আর কোনটা থেকে বিরত থাকবো তা নিয়েও আমি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে আছি। কারণ স্পষ্টত, আমাদের মাঝে এমন অনেকই আছেন যাদের আরবী ভাষার উপর কোনো পূর্বধারণা নেই। এমনকি তাফসীর বলতে কী বোঝায় তাও অনেকে জানে না। এখানে তাদের দোষ নেই। কিন্তু তারাও কুর’আন থেকে ভালো কিছু জানতে চান। আর অবশ্যই তারা জানতে চাওয়ার যোগ্য। তারা জানতে চান কোন ব্যাপারগুলো কুর’আনকে এতো সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলেছে। 

তাই, আমি চেষ্টা করবো বিষয়টি ভালোভাবে উপস্থাপনের। কুর’আনের এই অসাধারণ সুন্দর আয়াতগুলো থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি তার কিছুটা আপনাদের জানাতে চেষ্টা করবো। আশা করি, আপনারাও এই সৌন্দর্যটা উপলব্ধি করতে পারবেন। 

প্রথমে বলে রাখছি, এই টপিকের এই আয়াতগুলো কেন বাছাই করলাম। 

সারা দুনিয়াজুড়ে অসংখ্য মুসলিম যুবক আজ বিশ্বাসের সংকটে ভুগছেন। তাদের সাথে আমার আলাপচারিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিষয়টি বাছাই করেছি। যারা বিশ্বাসের সংকটে ভুগছেন তাদের মাঝে কেউ কেউ এসে আমাকে বলে – “উস্তাদ নোমান! আমি কিছুটা সন্দেহে আছি। উস্তাদ নোমান! আমি পুরোপুরি ইসলামের এই এই বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত নই। উস্তাদ নোমান! কেন দয়াময় আল্লাহর কুর’আনে এতো বেশি সংখ্যকবার জাহান্নামের আগুনের কথা বলেছেন? উস্তাদ নোমান! কেন তিনি কুর’আনে অমুক অমুক বিষয়টি বলেছেন? আমি এটা নিয়ে অস্বস্তিতে আছি। আল্লাহ কেন এমন করবেন? কেন এমনটা ঘটছে?…”

তাদের এরকম বহু গভীর প্রশ্ন রয়েছে। আর এগুলো জিজ্ঞেস করছে চৌদ্দ বছরের কিশোরেরা!! আজব ব্যাপার!! “আরে! তুমি তো এখনো দর্শন শাস্ত্র পড়োনি। কোত্থেকে এগুলো তোমার মাথায় এলো?” ইউটিউব থেকে।

তো, আমাদের শিশু-কিশোররা অল্প বয়স থেকেই এরকম দার্শনিক প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়ে পড়ছে, আর বর্তমান পৃথিবীর অন্যান্য সমস্যা তো তাদের জীবনে আছেই। পারিবারিক কোন্দলের কথা ধরা যাক। আজকাল অনেক পিতা-মাতাই জানেন না কীভাবে সন্তানকে বড় করে তুলতে হবে। আমরা জানি না বাচ্চাদের সাথে নিয়মিত কার্যকর আলাপচারিতা বলতে কী বোঝায়। আমরা এসব করি না। আমরা এই বিষয়টা কল্পনায়ও আনতে চাই না যে, আমাদের বাচ্চারা কিশোর বয়স থেকেই গুরুতর বিশ্বাসের সংকটে ভুগতে পারে। আমরা মনে করি, বড় হয়ে উঠলে তারা এমনিতেই ভালো মুসলমান হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এক সময় তারা যখন ইসলাম নিয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা শুরু করে, আমরা পিতা-মাতারা তখইন আতংকিত হয়ে পড়ি। “ওহ! আমার সন্তানের উপর শয়তানের আছর পড়েছে। তাকে ইমামের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ইমাম দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেই সে ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু ইমাম ঝাড়-ফুঁক দেয়ার পরও তার মনে প্রশ্নগুলো রয়ে যায়। আসলে, দিন দিন তার মনে প্রশ্নের সংখ্যা আরো বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। এটাই বর্তমান বাস্তবতা। 

আমি যত কিশোরের সাথে তাদের বিশ্বাসের সংকট নিয়ে কথা বলেছি উপলব্ধি করেছি যে, প্রায় সবার ক্ষেত্রে এটা আসলে দু’টি বিষয়ের সংমিশ্রণে ঘটে থাকে। একদিকে, এর মূলে রয়েছে আধ্যাত্মিক রোগ। আর এটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। কিন্তু মূল সমস্যাটা আধ্যাত্মিক। আর আমি বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যাটাকে ছোট করে দেখছি না। আমি মনে করি, উভয় সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হবে।

কিন্তু চিকিৎসা পথ্য দেওয়ার আগে তো আমাদেরকে সমস্যার কারণ খুঁজে পেতে হবে। তো, আমাদের সন্তানরা যখন এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় আর আমরা তাদেরকে কোন হুজুরের কাছে ঝাড়-ফুঁক দেয়ার জন্য নিয়ে যাই, এর মাধ্যমে আমরা আসলে আধ্যাত্মিক সমস্যাটি মোকাবেলার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখানে যে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা রয়েছে বা থাকতে পারে আমরা সে বিষয়টি পুরোপুরি অবজ্ঞা করছি। হয়তো এখানে কোনো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও থাকতে পারে। 

আমি মনে করি কুর’আনের এই আয়াতগুলো উক্ত সমস্যাকে মোকাবেলা করেছে। এ আয়াতগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেকের এ আয়াতগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করা উচিত। জানেন, আমি যখন কলেজ ছাত্র ছিলাম এই আয়াতগুলো আমাকে শিখিয়েছে আমি কে? কী আমার পরিচয়? আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সাইকোলজিতে একটা বিষয় আছে যাতে কোনো ঐকমত্য পাওয়া যায় না। কী সেটা জানেন? ব্যক্তিত্ব (personality)। ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব কাকে বলে? আপনি সাইকোলজিতে পিএইচডি করেছেন। মনোবিজ্ঞান পুরোটাই হিউমান পার্সোনালিটি নিয়ে। কিন্তু এরপরেও আমরা “ব্যক্তিত্ব” কাকে বলে বুঝতে পারিনি। সুবহানাল্লাহ!

—————  

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেনঃ وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُم مِّن الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً “তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে? আপনি বলে দিন যে রূহ আল্লাহর আদেশমাত্র। আর এ সম্পর্কে তোমাদের খুবই অল্প জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।” (সূরা বনি ইসরাঈলঃ ৮৫) আমরা নিজেদের সম্পর্কেই যা কিছু জানি সেটাও হিমবাহের অগ্রভাগ মাত্র। আপনি জানবেন যে আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে এমন কিছু বলেছেন যা দর্শনে পাবেন না, পাবেন না সাইকোলজিতেও। এটি কেবলই আল্লাহর কাছ থেকে আগত। আমি যখন এই আয়াতের আলোকে নিজেকে দেখতে শুরু করলাম, আমি নিজের সম্পর্কে এমন কিছু আবিষ্কার করলাম যা কোনদিন নিজে নিজে আবিষ্কার করতে পারতাম না। আমি তখন নিজেকে ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করলাম। আশা করছি সেখানকার কিছু অংশ আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারবো, ইনশা আল্লাহ। 

চলুন শুরু করি। আল্লাহ এভাবে শুরু করেছেন, তিনি নিজেকে আসমান ও জমিনের আলো হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক আলেমই বলেছেন এটি আসলে এক প্রকার আলঙ্কারিক রূপকের ব্যবহার। অর্থাৎ, আসমান এবং জমিনের আলো নিয়ে আপনি যেভাবে চিন্তা করেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সম্পর্কেও সেভাবে ভাবতে পারেন। এই রূপকের অর্থ কী? প্রথমত, এই রূপকটি এতোই শক্তিশালী যে এখানে কোন “اداة التشبيه” নেই। একে রূপক বলার মতো উপায়ও নেই। আরবি ভাষায় এমনটি করা হয় যখন তুলনীয় দুইটি বিষয়ের মাঝে ঘনিষ্ঠ মিল থাকে। সুতরাং আল্লাহ চাচ্ছেন আমরা যেন আলোর আইডিয়া নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, আলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখি। আমি আলো নিয়ে কিছু কথা বলবো প্রথমে। 

যদি আলোর অস্তিত্ব না থাকে তবে এই পৃথিবী যতই অনিন্দ্য সুন্দর হউক না কেন আমরা তার কিছুই দেখতে পাবো না। আলোর উপস্থিতি ছাড়া আমাদের চোখ মূল্যহীন। আমাদের চারপাশের বাস্তবতা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। চারপাশে কেবল অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আর ঘটনাচক্রে আমরা এখন জানি যে, আলো কেবল দেখার জন্যই অত্যাবশ্যকীয় নয়, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে জীবনের জন্যেও আলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আলো ছাড়া উদ্ভিদ জন্মায় না। আর উদ্ভিদ ছাড়া জীবন অসম্ভব। তাই জীবনের জন্য আলো অপরিহার্য ও মৌলিক। 

আশ্চর্যজনকভাবে, ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলোতে সূর্যের আলো কিছুটা কম থাকে, যে অঞ্চলগুলো বছরের অধিকাংশ সময় তমসাচ্ছন্ন এবং মেঘলা থাকে, সেসব অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনে (বিষণ্নতায়) ভোগে। সেখানকার মানুষজন জীবনে কোন মজা খুঁজে পায় না। তারা মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। 

ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরের কথাই ধরা যাক। খুবই সুন্দর একটি শহর। উন্নত এলাকা, আড়ম্বরপূর্ণ শহর। রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর পর্বতমালা। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হলো এখানেই আমেরিকার সর্বাপেক্ষা বেশি আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। অনেক সাইকোলজিস্ট এর জন্য অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়াকে দোষারোপ করেছেন। এখানে সূর্যের দেখা মেলা ভার, হয়তো বছরে কয়েক সপ্তাহ মাত্র। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ আলোর কি সুন্দর রূপকের বর্ণনাই না দিয়েছেন! 

আলো নিয়ে চলুন আরেকটু চিন্তা করি। প্রসঙ্গত, আরবিতে চোখের জন্য একটি শব্দ হল – নূর (আলো)। দৃষ্টিকেও বলা হয় নূর। আমাদের চারপাশের বাস্তবতা অবলোকন করার জন্য দুটি জিনিসের প্রয়োজনঃ আপনার চোখের আলো বা ‘নুরুল আইন’ এবং বাহিরের জগতের আলো। যদি এই দুই ধরণের আলোর কোন একটা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে আমরা আসলে অন্ধ। আমাদের পক্ষে শুধু এক আলো দিয়ে কোন কিছু দেখা সম্ভব নয়। 

চলুন বিষয়টি নিয়ে আরেকটু অগ্রসর হই। আমি এতক্ষণ যে আলোর কথা বললাম সেটি আসলে বাহ্যিক আলো। কিন্তু আল্লাহ এখানে আধ্যাত্মিক আলোর ব্যাপারে কথা বলছেন। তিনি আমাদেরকে চিন্তা করতে বলছেন বাহ্যিক আলো নিয়ে। যেন বাহ্যিক আলো দিয়ে আমরা আধ্যাত্মিক আলোকে বুঝতে সক্ষম হই। কারণ বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক আলো সাদৃশ্যপূর্ণ।  

আধ্যাত্মিক অর্থে আমাদের অন্তরে এক প্রকার আলো রয়েছে। এর অবস্থান অন্তরের গহীনে, ব্রেইনে নয় কিন্তু। আমাদের অন্তরে আল্লাহ আলো দিয়েছেন। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম ফেরেশতা তখন মায়ের গর্ভে আলো প্রবেশ করিয়েছেন। এই আলো দিয়েই আমি প্রি-প্রোগ্রাম হয়ে থাকবো। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই যে রূহ (আত্মা) রয়েছে সেটি এক প্রকার (আধ্যাত্মিক) আলো। এই আলো আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই রয়েছে। 

কিন্তু এই আলোর পক্ষে বেশি কিছু দেখা সম্ভব হয় না, যতক্ষণ না এটি বাহিরের আলোর দেখা পায়। বাহিরে অবশ্যই আলো থাকতে হবে, এটি আবশ্যক। এই বাহিরের আলোটি কী? আল্লাহ তাঁর কিতাবকে আলো হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন –  فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنزَلْنَا  “অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে আলো অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন।” (সূরাঃ আত-তাগাবুন ৮)

বাহ্যিক আলোর যেমন দুটি উপাদান রয়েছে তেমনি আধ্যাত্মিক আলোরও দুটি উপাদান রয়েছে। মানবজাতির ভেতরে রয়েছে এক ধরণের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের ভেতরে এমন এক জ্যোতির অবস্থান রয়েছে যা কিছু একটা কামনা করে, এটি একধরনের পূর্ণতার জন্য অপেক্ষারত। কারণ এর আগমন ঘটেছে একটি পূর্ণতার উৎস থেকে। সুতরাং যখন ওহী আসলো, আল্লাহর বাণীর আগমন ঘটলো, নবীর শিক্ষা আসতে থাকলো – এগুলো সবই আমাদের ভেতরের আলোকে পূর্ণ করে দিলো। আজকের আলোচ্য আয়াতগুলো সেই দুটি আলোর সম্মিলনের বর্ণনা প্রসঙ্গে। 

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে খুবই ইন্টারেস্টিং একটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমরা এখন একটি ইনডোর হলের ভেতরে অবস্থান করছি। এখানে লাইটিং এর সুব্যবস্থা আছে। আর এই বাতিগুলো আমাদের প্রয়োজন। কেননা এগুলো ছাড়া বাহিরে আলো থাকলেও আমরা হলের ভেতরে অন্ধকার পরিবেশে থাকতাম। 

রাতের সময়ের কথা চিন্তা করুন। রাতের বেলা শুধু একটি শহরকে আলোকিত করার জন্য কত টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়! কতটুকু এনার্জি খরচ করতে হয়! সূর্যের আলো যখন স্তমিত হয়ে যায়, তখন কেবল একটি শহরকে আলো দিয়ে ভরিয়ে দিতে মানুষকে কত প্রচেষ্টা চালাতে হয়! ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! আশ্চর্যজনক!  

আল্লাহর একটি বাতি হল সূর্য। তিনি তাঁর এই বাতিটি সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদেরও বাতি আছে। আল্লাহ যখন তাঁর বাতিটিকে নিয়ে নেন তখন আমরা আমাদের বাতিগুলো জ্বালাতে উঠে পড়ে লাগি। যেমন প্রাচীনকালে ছিলো লন্ঠন, দোয়াত, কূপি বা হারিকেন। সেখানে তৈল ভরতে হতো, জ্বালানো মূখ বের করতে হতো। আর এখন সুইচ টিপে লাইট জ্বালাতে হয়। অর্থাৎ আলো জ্বালাতে মানব প্রচেষ্টার কোন শেষ নেই। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমরা কি কখনো আল্লাহর মত জ্যোতি তৈরি করতে পারবো? আমাদের লাইটের আলো কি তাঁর প্রদত্ত দিনের আলোর মত এতোটা উজ্জ্বল হবে? না, কখনো নয়। সুবহানাল্লাহ! মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তার তৈরি আলোর পরিমাণ হবে সীমিত। তদুপরি, পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল অন্ধকারেই রয়ে যাবে।

আর আল্লাহ যখন তাঁর আলো প্রস্ফুটিত করেন, তখন কী ঘটে? আরবীতে একটি প্রবাদ আছে – اغنى الصباح عن المصباح –  “সকালের আগমন ঘরের বাতিকে অকার্যকর করে দিয়েছে”। আপনি দিনে নিশ্চয় আলো জ্বালান না। কারণ দিনে সূর্যই আলো দেবার জন্য যথেষ্ঠ। দরজা খুলে দিন, জানাল খোলা রাখুন। সূর্যের আলোই ঘরের জন্য পর্যাপ্ত। অন্য কথায়, আল্লাহর আলো অপ্রতিরোধ্য, সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে যায়। কোনকিছুই তাঁর আলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। এটি অনিবার্য। অস্বীকার করার কোন জো নেই। সব জায়গায়ই আল্লাহর আলো বিস্তৃত।

আপনাদের মনে আছে তো? আগে যে বলেছিলাম বাহ্যিক আলো সম্পর্কে জানার মাধ্যমে আমরা আধ্যাত্মিক আলো সম্পর্কে শিখবো। বাহ্যিক আলোর এই আলোচনা থেকে আমরা একটা ব্যাপার বুঝতে শুরু করলাম। আমার ভেতরে আধ্যাত্মিক আলো রয়েছে। আর এই আলো সীমিত। আমি চেষ্টা করলেও এই আলো দিয়ে বেশি কিছু দেখতে পারি না। কিন্তু আল্লাহর আলো (আল কুরআন) অসীম, সীমানাহীন। আমি এই আলোকে কোনকিছুর সাথে তুলনাও করতে পারি না। এর আগমন ঘটেছে অনেক উচ্চতর উৎস থেকে, অসীম ক্ষমতাধর থেকে।

———— 

এরপর আল্লাহ তায়ালা আরো ভালোভাবে এই আলোকে বুঝানোর জন্য আমাদের আরও সামনে নিয়ে যাচ্ছেন। আলোর এই উপলব্ধিকে আরো গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেনঃ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ – তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একট কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ (সূরা নূরঃ ৩৫)

বর্তমানে আমরা টিউবলাইট, বাল্ব ইত্যাদির মাধ্যমে ঘর আলোকিত করে রাখি। কিন্তু প্রাচীনকালে এসবের অস্তিত্ব ছিল না। তখন তারা কীভাবে ঘরবাড়ি আলোকিত রাখতো? তারা দেয়ালের মাঝে খাঁজ কেটে ছোট ছোট বাঁকানো খিলান (তাকের মত) তৈরি করে রাখতো। যেন এর ভেতরে প্রদীপ রাখা যায়। এভাবে যখন দেয়ালের খিলানে প্রদীপ রাখা হত তখন প্রদীপের আলো গিয়ে বাঁকা খিলানে পড়তো এবং প্রতিফলিত হয়ে পুরো রুমে আলো ছড়িয়ে যেত। তারা এমনভাবে এটাকে ডিজাইন করেছিল, এটা প্রথমে আলো ধারণ করতো এবং পরে তা আশে পাশে ছড়িয়ে দিত। এর আকৃতি ছিল বাঁকানো তোরণের মত। প্রাচীন কোন মসজিদের বাঁকানো দরজার মত। একেই বলা হত মিশকাত বা কুলঙ্গি।  

আল্লাহ তাঁর আলো সম্পর্কে বলছেন, যদি আপনি আল্লাহর আলোর উদাহরণ নিয়ে ভাবতে চান তবে এটার একপ্রকার অর্থ হবে – কুলুঙ্গির/কোটরের (Niche) ভেতরে প্রদীপ। ফিইহা মিসবাহ। মিসবাহ শব্দটি আরবীতে ইসমে আলাহ। ‘صبح’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। অর্থ সকাল। মিসবাহ প্রকৃতপক্ষে এমন যন্ত্র যা সকালের আলোর মত আলো তৈরির চেষ্টা করে। সকাল যে কাজ করে এটাও তা করার চেষ্টা করে। এটি সচেতনতা ও সতর্কতা বুঝাতেও ব্যবহৃত হত। এজন্যই প্রাচীন আরবীতে কাউকে মনযোগী হওয়ার জন্য বলা হত ‘আসবিহ’। স্পষ্টত আপনি যদি আপনার চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হতে চান আপনার এমন কিছুর দরকার যা আলো তৈরি করে।

এই সুন্দর রূপকের উদাহরণ নিয়ে চলুন আরেকটু অগ্রসর হই। বাড়িতে একটি কুলুঙ্গি বা কোটর আছে, যে কোটরের ভেতরে প্রদীপ আছে। ফিহা মিসবাহ। فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ  আগের দিনে বর্তমান সময়ের মত বাল্ব, লাইট ইত্যাদি ছিল না। তখনকার সময় মানুষকে মোমবাতির মত কিছু একটাতে আগুন জ্বালাতে হত। কিন্তু জ্বলন্ত মশালকে উন্মুক্ত রাখা হলে তা বাতাসে দুলতে থাকে, ঝির ঝির করে কাঁপতে থাকে। ফলে, আলোর ওসব বিক্ষিপ্তাবস্থা স্থির করার জন্য, কাঁপনি বন্ধ করতে আলোর চারিপাশে গ্লাস বা কাঁচ লাগাতে হত।  

গ্লাস আবার বিভিন্ন কাজ করে। আলোর শিখা-কণাগুলো যখন কাঁচে প্রতিফলিত হয় তখন তা আলোকে বিভিন্ন দিকে আরো ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। তাই এখন আলোর বিচ্ছুরণের জন্য দুইটি উপায় হয়ে গেলো। আবার বাহির থেকে যদি বাতাস আসে বা ঘরে যদি ফ্যান থাকে তবুও আলো নিভবে না। ঘটনাচক্রে, আজকের দিনের বাল্বগুলো কি চারিদিকে গ্লাস দিয়ে নির্মিত না? অবশ্যই। তাই, আগের ধারণা আসলে অতোটা পরিবর্তিত হয়নি। الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَة প্রদীপটি গ্লাসের ভেতরে অবস্থিত। আমি কিন্তু এখনো রূপকটির ব্যাখ্যা করিনি। কেবল অনুবাদের অর্থ বুঝাচ্ছি এখনো। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ “গ্লাস নিজেই যেন অতি উজ্জ্বল তারকা!” 

আচ্ছা, আমরা এতক্ষণ যা পড়ে বুঝলাম তাতে তো প্রদীপটি অতি উজ্জ্বল হিসেবে মনে করেছিলাম। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, এমনকি প্রদীপটির চারিপার্শ্বস্ত গ্লাস যখন মিট মিট করে জ্বলতে থাকে তখন গ্লাস নিজেই যেন অতি উজ্জ্বল তারকা!  এরপর আল্লাহ دُرِّيٌّ (দুররি) শব্দ্যটি ব্যবহার করেছেন। রূপকের আয়াতে ব্যবহৃত এই আরবী শব্দটি বেশ মজার। এর অর্থ কোনোকিছু নিজে নিজেই জ্বলে ওঠা, যেন আলোটি নিজেরই অথচ সেটা নিজের আলো নয়! গ্লাসটি নিজে জ্বলে না, কিন্তু জিনিসটি এতটাই পরিষ্কার ও ঝকঝকে যে যখন তা দ্বীপ্তিময় হয়ে উঠে তখন মনে হয় সেই আলো যেন তার নিজের আলো! এমনই উজ্জ্বল কাঁচ সেটি। এটিই প্রদীপটির চারিপার্শ্বে ঘেরা কাঁচ। 

চলুন আরেকটু সামনে এগিয়ে যাই।  يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ ধীরে ধীরে বিষয়গুলো আরো ইন্টারেস্টিং হচ্ছে। এই প্রদীপটিতে এখন জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রাচীনকালে আপনি বর্তমানের মতো বাল্বের লাইট পাচ্ছেন না। তখন আলোর প্রদীপে তৈল থাকতে হতো। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ জ্বালানি হিসেবে তৈল এর কথা বলছেন না বরং একটি গাছের কথা বলছেন। গাছ থেকে এই জ্বালানি আসছে। 

কিন্তু মজার কথা হলো, এই যে আমরা এতক্ষণ আলোর রূপকের চিত্রটি নিয়ে কথা বলছি, সেটা বাহিরের নাকি ঘরের জিনিস? অবশ্যই ঘরের জিনিস। রূপকের উদাহরণে একটি কোটর আছে। কোটরের ভেতরে আছে প্রদীপ। এই প্রদীপটির অভ্যন্তরে আছে জ্বালানি। আর এই জ্বালানি আসে একটি বৃক্ষ থেকে! এখন বলুন, গাছ কি ভেতরের জিনিস নাকি বাহিরের? বাহিরের। এর মানে আল্লাহ তায়ালা ঘর ছেড়ে বাহিরের একটি জিনিসের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন। এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ জানেন? শেষে সবগুলো পয়েন্ট একত্রিত করে সামগ্রিকভাবে যখন ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করবো তখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এখন শুধু উপমাটির অনুবাদ বোঝার চেষ্টা করছি। 

প্রদীপটি তার জ্বালানী সংগ্রহ করে বাহিরের কোন উৎস থেকে। আর সেই উৎসটি হল, বাহিরের কোন বৃক্ষ। তো, সেই গাছের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলোঃ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ – সাধারণভাবে এর অনুবাদ করা হয় – “একটি বরকতময় বৃক্ষ” নামে। কিন্তু আরবীতে ‘বারাকাহ’ শব্দটি কয়েকটি বিষয় বোঝায়। এর একটি অর্থ ‘বৃদ্ধি’। আরেকটি অর্থ ‘আশাতীত বৃদ্ধি পাওয়া’। শব্দের উৎসগতভাবে এর অর্থ ‘কোনোকিছু তার নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা’। 

আল্লাহ এখানে বলছেনঃ এই প্রদীপটি যে বৃক্ষ থেকে আর জ্বালানী সংগ্রহ করে সেই বৃক্ষটি দৃঢ়ভাবে তার নির্দিষ্ট স্থানেই অবস্থিত। গাছটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গাছটি যা কিছুই প্রদান করে যেমন ফল, শক্তি, জ্বালানি, তৈল যাই হউক না কেন, এটি আপনার প্রত্যাশার চাইতেও অনেক বেশি প্রদান করে। আপনি এই পাওয়াকে সীমাবদ্ধ করতে পারবেন না। চৌহদ্দির সীমানায় এর অকল্পনীয় বারাকাহকে সীমিত করা যায় না। প্রতিবার আপনি যা আশা করেন তার চাইতেও বৃক্ষটি অনেক বেশি প্রদান করে। সুতরাং এই যে প্রদীপটির কথা আয়াতে বলা হচ্ছে, এর শক্তির উৎস অসীম, কোনো সীমাবদ্ধতায় যা আটকানো যায় না। কারণ এর উৎস মোবারাক-বরকতময়।  

আমি কিন্তু মূল বিষয়টি এখনো খোলসা করার দিকে যাইনি! সেটা সেটাপ করার কাজ করছি মাত্র। এরপর আল্লাহ ঐ বৃক্ষের আরেকটি বৈশিষ্ট্যর কথা বলছেনঃ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونِةٍ এটি একটি অলিভ গাছ (যয়তুন বৃক্ষ – জলপাই গাছ)।

আচ্ছা, এই পৃথিবীতে অলিভ গাছ বা যয়তুন বৃক্ষ কেন বিদ্যমান? আরবী ভাষায় তৈল এর প্রতিশব্দ ‘যাইত’। সবচেয়ে পরিশুদ্ধ তৈল, যে তেলের প্রতি আরবরা হাজার হাজার বছর ধরে বিস্মিত এমনকি আজকের দিন পর্যন্ত, সেটি অলিভ অয়েল (যয়তুন বা জলপাইয়ের তৈল)। খাবারের টেবিলে এই তৈল না থেকে পারে না। তারা যখনই তৈল বা জাইত এর কথা মনে করে তখন তারা যয়তুন এর কথা স্মরণে আনে। এজন্যই একই শব্দ থেকে ‘যাইত’ শব্দের উৎপত্তি। তারা একত্রে বন্ধনযুক্ত। সুতরাং, এটা সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ তৈল, যা দিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে উপকারিতা পাওয়া যায়। এই তৈল খাওয়া যেতে পারে, খাবার তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। সুগন্ধি তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। এটা শরীরেও ব্যবহার করা যেতে পারে আবার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। এটাই যায়তুন। 

এবং এরপর আল্লাহ তায়ালা আরো অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এই গাছটির। তিনি বলেনঃ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِي “যা (গাছটি) পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়।”

অর্থাৎ, গাছটি পূর্ব বা পশ্চিম প্রান্তের কোনো অরণ্যের নয়। এটা নিজের স্থানে নিজেই অনন্য। সূর্য পূর্বপাশে থাকলে তা গাছটির পূর্ব পাশটিতে আলো দিচ্ছে। আবার সূর্য পশ্চিম পাশে থাকলে তা গাছটির পশ্চিম পাশে আলো দিচ্ছে। সূর্যের যতপ্রকার উপকারিতা দেওয়ার আছে সমস্ত উপকারিতা নিচ্ছে এই গাছটি! আর এ ধরণের গাছ সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ তৈল সরবরাহ করে। 

চলুন এবার রূপকের উদাহরণে ফিরে যাওয়া যাক। সংক্ষেপে পুরো বিষয়টা আরেকবার ঝালাই করে নেই। আল্লাহ তায়ালা যে আলোর (নূর) কথা বলেছেন তা একটি ঘরের মধ্যে দেয়ালের কোটরে আবদ্ধ। ঘরে আলো অবশ্যই রাতে প্রজ্জ্বলিত হয়। সুতরাং আপনি রাতে আলো জ্বালালেন। আলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে এর চতুর্দিকে গ্লাস দিয়ে প্রদীপটিকে সুরক্ষিত করে রাখলেন। এই গ্লাসটি আবার অতি উজ্জ্বল দীপ্তিময়, যেন আকাশে উজ্জ্বল তারকাগুলির মতো আলো ঠিকরে পড়ছে। তারকার কথা বললে কিসের কথা মনে পড়ে? আকাশের কথা। এরপর এই প্রদীপের জ্বালানী এমন বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী উৎস থেকে আগত যা পূর্বমুখী নয় আবার পশ্চিমমুখীও নয়। ফলে সূর্যের পূর্ণ উপকারিতা সে পেয়ে থাকে। 

এবার চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই। মানুষের বুকের খাঁচা অনেকটা দেয়ালের ভেতরের বাঁকা কোটরের মতো বা মিশকাতের মতো। এর ভেতরেই আল্লাহ একটি ছোট্ট প্রদীপ প্রবেশ করিয়ে রেখেছেন। এটা কি জানেন? আমাদের হৃদয় (Heart)। আর এই হৃদয়ের (হার্ট) ভেতরে আল্লাহ এমন এক ধরণের জ্বালানি শক্তি রেখেছেন যা এতটাই বিশুদ্ধ যা অন্য কোথাও থেকে আসতে পারে না, আসা সম্ভব না; না পূর্ব থেকে আর না পশ্চিম। এটা সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত, সম্পূর্ণ আল্লাহর নূরে উদ্ভাসিত, ঠিক যেমন একটি গাছ সরাসরি সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত। এই জ্বালানি শক্তিই আমাদের রূহ।  আমরা সরাসরি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপস্থিতিতে ছিলাম, যখন তিনি আমাদের যখন প্রশ্ন করেছিলেনঃ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ – আমি কি তোমাদের প্রভু নই? আমরা উত্তর দিয়েছিলামঃ قَالُواْ بَلَى شَهِدْنَا – হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনিই আমাদের প্রভু। [সূরা আরাফঃ ১৭২] 

আল্লাহ ঐ নূরের বিশুদ্ধ জ্বালানি শক্তি নিয়ে আপনাকে আমাকে বানিয়েছেন, আপনার আমার মতো প্রদীপের ভেতরে সেই নূর বসিয়েছেন। আপনার এবং আমার ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে জ্যোতি; সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ জ্যোতি।

এর চারিপাশের গ্লাস ময়লাযুক্ত নাকি পরিষ্কার? খুবই পরিষ্কার, তাই না? মানুষ যখন পাপ কাজ করে তখন তাদের হৃদয় কেমন হয়ে যায়? তখন গ্লাসটি ময়লাযুক্ত হতে থাকে, আরো বেশি ময়লাযুক্ত হতেই থাকে এমনকি শেষ পর্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন মিশমিশে কালো হয়ে যায়। আল্লাহ আপনাকে প্রথম অবস্থায় ময়লাযুক্ত অন্তর (হৃদয়) দেননি, যেমন অন্য ধর্মের লোকেরা বলে আমরা নাকি আদি পাপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমরা আসলে পরিচ্ছন্ন হৃদয় নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের হৃদয় একদম পরিষ্কার, স্বচ্ছ। আমাদের হৃদয় মাঝেমধ্যে ময়লাযুক্ত অপরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের পাপের কারণে।

আচ্ছা, প্রদীপ যখন দীর্ঘদিন যত্নহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, পরিষ্কার করা না হয় তবে কি এটা অপরিষ্কার হয়ে যায়? অবশ্যই এটা অপরিষ্কার হয়ে যায়। প্রদীপ নিজেই নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে না। এটা স্বয়ংক্রিয়  জিনিস নয়। আপনাকে এটা পরিষ্কার করতে হবে। মূল জিনিসটি অনেক সুন্দর কিন্তু পরিষ্কার না রাখলে আপনি জানতে পারবেন না সৌন্দর্য কতোখানি। জানা সম্ভব না। 

সুতরাং, আমাদের ভেতরে আছে আলো (নূর), আছে জ্বালানি শক্তিও। কিন্তু এখনো এই নূরকে সম্পূর্ণরূপে প্রজ্জ্বলিত করা হয় নি। আল্লাহ কেবল গ্লাস এবং অন্যান্য জিনিসগুলো বর্ণনা করেছেন এখন পর্যন্ত। এরপর আল্লাহ বলেনঃ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ  যেন এর তেল লাফ দিতে চাচ্ছে ও আগুনকে ধরতে যাচ্ছে। وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ – এমনকি আগুন এখনো সেটা স্পর্শ করতে পারেনি…। 

এই তেল এমনই পরিশুদ্ধ, প্রজ্জ্বলন করার জন্য এতোটাই উন্মুখ হয়ে আছে তেল যেন বলছে, ”আমাকে কেবল একটি ম্যাচ দাও! আমাকে জ্বলতে দাও, আমার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে দাও।” আপনারা নিশ্চয় পেট্রোল দেখেছেন। যদি কখনো পেট্রোলে আগুন ধরাতে চেষ্টা করেন দেখবেন, মনে হয় যেন এটা আগুনের দিকে ঝাঁপ দিচ্ছে, আগুনের স্পর্শ পেতে মরিয়া হয়ে আছে। এমন একটি ধারণা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। এরপর আল্লাহ বলেনঃ  نُّورٌ عَلَى نُورٍ     

নূরের উপর নূর (আলোর উপর আলো)। 

এর দ্বারা কী বোঝায়? এর দ্বারা বহু কিছু বোঝায়। আমি শুধু এখানে আপনাদের সাথে অল্প কয়েকটি বিষয় আলোচনা করবো। আমাদের ভেতর অবাক করা এক প্রদীপ রয়েছে। এই বাতি নিজে নিজেই জ্বলতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নয়। এমনকি এর চারপাশের স্বচ্ছ কাঁচকেও বাতির মতো মনে হয়। 

যখন আল্লাহর ওহীর আলো আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, যখন সাহাবারা রাসূলুল্লাহ (স) কে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখতেন এবং এই দেখার মাধ্যমে ওহীর আলো তাদের চোখ দিয়ে হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতো – আমাদের অন্তরে ইতিমধ্যেই জ্বালানি বিদ্যমান আছে – তখন ওহীর আলোর একটু খানি স্পর্শের ফলেই দুই আলোর সম্মিলনে হৃদয়ের গহীনে আলোর এক বিস্ফোরণ ঘটে! এটাই ” নুরুন আলা নূর – আলোর উপরে আলো।” আমাদের হৃদয়ের আলো তথা ফিতরাতের আলোর সাথে আল্লাহর ওহীর আলোর এই সম্মিলনই হল নূরুন আলা নূর। এই দুই ধরণের আলোকে একসাথে মিলিত হতে হবে। 

চলুন আরো সামনে যাই। আমরা কখন আলো জ্বালাই? রাতের সময়। আল্লাহ যখন তাঁর সূর্যের আলো নিয়ে নেন, আল্লাহর আলোর অনুপস্থিতিতে আমাদের নিজেদের বাতির দরকার হয়। আমাদের বাতির জ্বালানির সাথে আবার সূর্যের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সূর্যের আলোর সাহায্যেই এর জ্বালানি তৈরি হয়েছিল। যেন সূর্যের অনুপস্থিতিতেও আলো প্রজ্বলিত করার একটা ব্যবস্থা থাকে। 

একজন বিশ্বাসী এবং তাঁর হৃদয়ের আলো তমসাচ্ছন্ন সময়ের জন্য অত্যাবশ্যক। এখন যেহেতু আর আকাশ থেকে ওহীর আলো অবতীর্ণ হয় না, তাই এখন আমি আর আপনিই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর আলোর উৎস। এই কুরআনের আলো শুধু আপনার নিজের জন্য নয়; এই আলো আপনার প্রতিবেশীর জন্য, আপনার পরিবারের জন্য, আশে পাশের সবার জন্য। যদি একটি বাতি তাঁর চারপাশ আলোকিত করতে না পারে তাহলে এই বাতি থাকার আর কীইবা অর্থ আছে। 

বস্তুত, আল্লাহ এই বাতি এবং তার চারপাশের গ্লাসকে একটি উজ্জ্বল তারকার সাথে তুলনা করেছেন। যখন তারার কথা ভাবেন তখন কি আকাশের কথা মনে হয় না? ইমাম আল-রাজী (রাহিমাহুল্লাহ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ 

“আকাশের অধিবাসীরা অর্থাৎ ফেরেশতারা পৃথিবীর প্রজ্বলিত আলোর দিকে তাকায় আর জমিনের অধিবাসীরা আকাশের প্রজ্বলিত তারকারাজির দিকে তাকায়।” এখানে আল-রাজী (র) কি দৃশ্যমান আলোর দিকে তাকানোর কথা বলেছেন? না, দৃশ্যমান আলোর কথা বলেননি তিনি। ফেরেশতারা এই আলোর দিকে তাকায় না। তারা মুমিনদের হৃদয়ের আলো (নূর) দেখে। তারা জমিনের দিকে তাকায় এবং রাতের সময়ে আলো দেখতে পায়। আর আমরা আসমানের দিকে তাকাই এবং ফেরেশতাদের আলো দেখতে পাই! সুবহানাল্লাহ! 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কি অনিন্দ্য সুন্দর আশ্চর্যজনক রূপকের বর্ণনাই না দিয়েছেন! বিশেষ করে তমসাচ্ছন্ন সময়ের জন্য।

আমরা প্রকৃতিগতভাবে মন্দ নই। আমরা খারাপ প্রজাতি নই। আল্লাহ আমাদের ভেতরে নিখাদ এবং পরিশুদ্ধ একটি জিনিস দিয়েছেন। অনেকে বলে থাকে, আমি আসলে ভালো মানুষ হতে পারবো না, আমার সেই যোগ্যতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, আপনি ভালো মানুষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতাবান। আপনি আসলে ফিতরাত অনুসারেই ভালো মানুষ এবং ভালোর দিকে রয়েছে আপনার অবিশ্বাস্য রকম ঝোঁক। শুধু ভালো মানুষ নয়, অবিশ্বাস্য রকম ভালো মানুষ হওয়ার যোগ্যতা আপনার রয়েছে।

এই অধ্যায়টি পড়েই আমি ভাবতে থাকলাম – ওয়াও! কী আমি ভেতর থেকে প্রজ্বলিত হই!! এই জ্বালানি শক্তি আমি কীভাবে ধরে রাখবো? কারণ জ্বালানি আসলে ভেতর থেকে আসে না, তাই না? জ্বালানি আসতে হয় বাহির থেকে। কারণ আমাদের হৃদয়কে খাবার দিতে হয়, হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন-পরিষ্কার করতে হয়। আর এজন্যই আল্লাহ আমাদেরকে ওহী দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে এই কিতাব দিয়েছেন যেন আমরা সর্বদা এটি পড়ি, মুখস্ত করি এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। আর প্রতিবার যখন এগুলো করতে থাকি তখন আমাদের নূর (আলো) আরো শক্তিশালী থেকে অধিক শক্তিশালী হতে থাকে। অন্তরের শক্তি দৃঢ় হতে দৃঢ়তর থেকে দৃঢ়তম হতে থাকে। আল-কুরআনের আলো (নূর) এটাই করে।

এরপর আল্লাহ বলেনঃ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন তাঁর নূরের দিকে। 

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার নূরের দিকে নিয়ে আসেন। এর মানে আমরা যারা এখন এই বই পড়ছি তিনি তার কিতাবের দিকে, ওহীর দিকে আমাদের হেদায়াত প্রদর্শন করেছেন, তাঁর রাসূলের সুন্নাহর দিকে পথ দেখিয়েছেন। আমাদের ভেতরে যে আলো রয়েছে সেটাকে মূল্যায়ন করছেন। তিনিই আমাদেরকে সেই আলো দিয়েছেন। কিন্তু জানেন? আল্লাহ বলেননি যে يَهْدِي اللَّهُ الي ِنُورِهِ (ইহায়দিল্লাহু ইলা নুরিহি), বরং তিনি বলেছেন يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ, (ইহায়দিল্লাহু লি নুরিহি) এই ‘লাম’ ব্যবহৃত হয় যখন কোন শেষ সীমায় পৌঁছান। এর অর্থ কী? আপনি-আমি যখন আল্লাহর রহমতে শেষ দিবসে জান্নাতের দরজার কাছে যাবো আমরা তখন কি বলবো? الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي هَدَانَا لِهَـذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلا أَنْ هَدَانَا اللّهُ – আলহামদুলিল্লাহ…যিনি সমস্ত পথ দিয়ে দিয়ে…এই দরজা পর্যন্ত আমাদের পথ প্রদর্শন করে এনেছেন… (সূরা আরাফঃ ৪৩)।

 হেদায়াত জিনিসটি এখানে লাম দিয়ে তুলে আনা হয়েছে – কোনকিছুর শেষ সীমানা পর্যন্ত। তার মানে আল্লাহ বলছেন, তুমি যদি এটা ধরে রাখতে পারো তবে আমি তোমাকে আমার নূর পর্যন্ত হেদায়াত (পথ দেখানো) দিবো এবং আমার সাথে সাক্ষাত করাবো। একদিন তুমি আমার নূর-ও দেখতে পারবে! তুমিও একদিন আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকবে – يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء – “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন তাঁর নূরের দিকে।”

 —— * ————————