আপনার পা কিনতে চাই, মূল্য কত ?

— নোমান আলী খান 

আল্লাহ তায়ালা বলেন – لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ – “যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।” (৩৫:৩০) 

আজ আমি আপনাদের সাথে আল কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর একটি অনন্য এবং অসাধারণ নাম সম্পর্কে আলোচনা করবো। এই নামটি অনন্য কারণ আল্লাহ এই একই নাম তাঁর নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন আবার বিশ্বাসীদেরকেও এমন হতে বলেছেন। আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে বলেছেন – وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ – “এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শাকুর”। (৩৪:১৩)  ‘শাকুর’ অর্থ – চরম কৃতজ্ঞ এবং চরম গুণগ্রাহী।(appreciative) 

আর কৃতজ্ঞ হওয়া এবং গুণগ্রাহী হওয়া দুটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। কৃতজ্ঞ মানে কেউ যদি আপনার কোনো উপকার করে, তাহলে আপনি তাকে ‘থ্যাংক ইউ বা ধন্যবাদ’ বলেন এবং মনে মনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। ‘গুণগ্রাহী’ মানে আপনি সবকিছুতে ইতিবাচকতা প্রত্যক্ষ করেন। সব পরিস্থিতিতেই আপনি ভালো কিছুর সন্ধান পেয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি খারাপ হলেও আপনি তাতে ভালো কিছু হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন। 

আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) এর জীবনে অন্যতম দুর্বিষহ একটি ঘটনা ছিল ‘ইফকের ঘটনা’, যখন মদীনাতে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অপমানজনক অপবাদ রটনা করা হয়। আর এই মিথ্যা অপবাদ রটনার কাজ ত্রিশ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। ত্রিশ দিন পর আল্লাহ নাজিল করেন –  لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ – “এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে করো না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” (২৪:১১) 

তো, এভাবে আল্লাহ আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং তিনি চান আমরা যেন শাকুর হই। যার অর্থ চরম গুণগ্রাহী হওয়া, চরম তারিফ করা, আল্লাহর তারিফ করার জন্য উপায় খোঁজা, কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা। ‘শাকুর’ এর এই অর্থ আমাদের জন্য। আর আমাদের জন্য ব্যাপারটা উপলব্ধি করা সহজ।  

কিন্তু আল্লাহ, সবকিছুর মালিক নিজেকে ‘শাকুর’ বলেছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেছেন – إِن تُقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۚ وَاللَّهُ شَكُورٌ حَلِيمٌ – “যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তিনি তা তোমাদের জন্য দ্বিগুন করে দিবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, পরম ধৈর্যশীল।” (৬৪:১৭) সূরা তাগাবুনের এই আয়াতে আল্লাহ নিজেকে ‘শাকুর’ বলেছেন। আর সূরা ফাতিরে তিনি নিজেকে দুইবার ‘শাকুর’ বলেছেন। 

এখন আল্লাহ ‘গুণগ্রাহী’ হওয়ার মানে কী? শাকুরের যে আরেকটি অর্থ আছে ‘কৃতজ্ঞ’, সেটি আমরা আল্লাহর জন্য ব্যবহার করি না। আমরা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার জন্য শাকুরের অর্থ হিসেবে ‘গুণগ্রাহী (appreciative)’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন তিনি চরম গুণগ্রাহী। 

তাই, আমি আপনাদের সবার জন্য বিষয়টি সহজ করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যেন আমরা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং বুঝতে পারি আল্লাহ কেন আমাদের জন্য এমন একটি শব্দ ব্যবহার করলেন – যে গুণটি আমাদের থাকতে হবে –  যা তিনি তাঁর নিজের নাম হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। 

আমাদের কোন কিছুই আল্লাহর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা আমাদের সবকিছুর জন্য আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ হলেন ‘গানী’ তিনি সবধরনের প্রয়োজন থেকে মুক্ত। তিনি হলেন ‘হামিদ।’ কেউ তাঁর প্রশংসা না করলেও, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেও –  তিনি নিজে নিজেই প্রশংসিত। কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকলেও আল্লাহর প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা এমনিতেই বর্তমান আছে। তদুপরি, আমাদের যা কিছু রয়েছে – وَآتَاكُم مِّن كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ – “যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন।”(14:34)  – তোমাদের যা কিছুর প্রয়োজন হত তার সবকিছুই আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। এটা আমাদের উপর আল্লাহর দাবী। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ। 

আমাদের সম্ভাব্য প্রতিটি প্রয়োজন তিনি পূর্ণ করেছেন এবং এতো অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন যে আমরা কোনদিনও তার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হব না। যেমন, নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষমতা। এই কক্ষে উপবিষ্ট সবার দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমাদের প্রায় সবাইকে দৃষ্টি শক্তি প্রদান করা হয়েছে, আমাদের সবারই উঠে দাঁড়ানোর এবং চলাফেরা করার ক্ষমতা রয়েছে। এই পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে পারে না। আমরা যে ঘুমাতে পারি এটাকে আমরা কোন নিয়ামতই মনে করি না। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণার কারণে নিদ্রাহীন রাত কাটায়। আমাদের হাতের আঙ্গুলগুলোকেও আমরা কিছুই মনে করি না। মনে হয় যেন আমরা এগুলোর মালিক। এমন অনেক মানুষ রয়েছে যাদের হাত নেই বা প্যারালিসিস এর কারণে হাত নাড়াতে পারে না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ ছাড়া আর কিছুই নাড়াতে পারে না, বা বাসায় পড়ে রয়েছে। 

ব্যাপারটা হল, এই পৃথিবীতে আমাদের যা কিছু আছে তার সবই মূল্যবান। আর আমরা মূল্য নির্ধারণ করি টাকার অংকে। এখন কেউ যদি বলে, “আপনার পা কিনতে চাই, মূল্য কত? আপনার উভয় চোখ কত টাকা মূল্যে বিক্রি করবেন? আপনার ফুসফুস কিনতে চাই। আপনার পা কিনতে চাই, শুধু একটা, শুধু একটা কিনতে চাই। আমার উভয়টার দরকার নেই।”…. আল্লাহর দেয়া এই মহামূল্যবান উপহারগুলো আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করে চলছি। প্রতিনিয়ত কোন কিছু ব্যবহার করতে থাকলে আমাদের কাছে তার মূল্য কমে যায়। “এটা আর এমন কি, জাস্ট একটা পায়ের পাতা।” আবার অভিযোগ করি, এটা খালি চুলকায়। 🙂 তো, আমরা এই মহামূল্যবান উপহারগুলো যেমন, আমাদের শরীর, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, আমাদের পরিবার, বাতাস, ভূমি যার উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি… আচ্ছা কোন কারণে ভূমিকম্প হচ্ছে না? 

পৃথিবী সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনাদের বলছি। আল্লাহ পৃথিবীকে তৈরি করেছেন তাঁর অনুগত করে। আর যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পিত তারা কখনো আল্লাহর অবাধ্যতা সহ্য করতে পারে না। মনোযোগ দিয়ে শুনুন। যা কিছুই আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে তার নিকট আল্লাহর অবাধ্যতা অসহনীয়। আর পৃথিবীর উপর বিচরণকারী মানব সম্প্রদায় আল্লাহর অবাধ্যতা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সত্য কিনা? হ্যাঁ, সত্য। আর যখন তারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় তখন পৃথিবী তাদের চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে চায়। পৃথিবী ঐ সব মানুষদের ধ্বংস করতে চায় যারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত, কারণ তার নিকট আল্লাহর অবাধ্যতা অসহনীয়। আল্লাহ বর্ণনা করেন, প্রতিবার যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন – تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا – “এতে আসমানসমূহ ফেটে পড়ার, যমীন বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।” (19:90) এতে সাত আসমান ফেটে পড়ার উপক্রম হয়, যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তারা এমন জঘন্য কথা সহ্য করতে পারে না। পৃথিবীও খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, যখন কেউ এমন পাপপূর্ণ কথা উচ্চারণ করে।   

আর এই যমীন মানব জাতির অসংখ্য পাপ সহ্য করে যাচ্ছে প্রতিদিন। সব কিছু চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্য এটি আল্লাহর কাছে অনুমতি ভিক্ষা করতে থাকে। আর আল্লাহ একে থামিয়ে রাখেন। পরিশেষে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ পৃথিবীকে অনুমতি প্রদান করবেন, আদেশ নয়। “বি আন্না রাব্বাকা আওহা-লাহা ”  আল্লাহ একে অনুমতি দিবেন যেন এতদিন যাবত সে তার ভেতরে যত যাতনা বহন করে চলছিল তা উগড়ে ফেলতে পারে। এতোসব পাপ নিয়ে আমরা যখন পৃথিবীর উপর দিয়ে চলতে থাকি, এটি যে কম্পন সৃষ্টি করে আমাদের ধ্বংস করে না তার জন্য আমরা কতটুকু কৃতজ্ঞ? কতটুকু কৃতজ্ঞ?  আমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত গুণে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের যে অসংখ্য অগণিত উপহার দান করেছেন তা আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার বাহিরে। 

এই জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কৃতজ্ঞ মানুষের কথা মনে করুন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে পড়ে ইব্রাহিম (আঃ) এর কথা। ইব্রাহিম (আঃ) এর গোটা জিন্দেগী ছিল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার জিন্দেগী। জানেন, আল্লাহ কীভাবে তাঁর সমগ্র জীবনকে বর্ণনা করেছেন? তিনি বলেন – شَاكِرًا لِّأَنْعُمِهِ – তিনি শুধু অল্প কিছু অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে পেরেছিলেন। (১৬:১২১) ”আনউম” ব্যবহার করা হয় অল্প কিছু অনুগ্রহের জন্য। আর “নিয়াম” শব্দটি ব্যবহার করা হয় অনেক বেশি নেয়ামতের জন্য। 

অর্থাৎ, আল্লাহর অসাধারণ দাস ইব্রাহিম (আ) এর মত ব্যক্তিও যদি তার সমগ্র জীবন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্যয় করেন, তিনি শুধু সামান্য কয়েকটি নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারবেন। আল্লাহ তাঁকে যত কিছু দিয়েছেন তার তুলনায়। এরপর তিনি বলেন- (وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا) যদি তোমরা আল্লাহর শুধু একটি অনুগ্রহ পুরোপুরি উপলব্ধির চেষ্টা কর, তোমরা সম্পূর্ণরূপে এটি গণনা করতে সমর্থ হবে না। (16:18) আল্লাহর সকল অনুগ্রহ নয়,  শুধু একটি – নে’মাতাল্লাহ (একবচন)। লা তুহসুওহা- গণনা করে শেষ করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপঃ চিন্তা করার সামর্থ্য, এটা শুধু একটি অনুগ্রহ। আল্লাহর এই একটি অনুগ্রহ প্রতিদিন, প্রতি মিনিটে কতভাবে আমার উপকার করে!!  আমি আল্লাহর শুধু একটি অনুগ্রহের উপকার গণনা করে শেষ করতে পারব না। কীভাবে আমি আমার প্রতি তাঁর প্রদত্ত সকল অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করবো?? 

আমাদের প্রতি আল্লাহর ‘য-হেরা’ বা প্রকাশ্য অনুগ্রহ যেমন আছে তেমনি আছে ‘বা-তিনাহ’ বা গোপন অনুগ্রহ। তিনি বলেন – (وَ اَسۡبَغَ عَلَیۡکُمۡ نِعَمَہٗ ظَاہِرَۃً وَّ بَاطِنَۃً – এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘য়ামাতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ৩১:২০) তিনি আমাদের প্রতি অগণন প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন।

কতজন মানুষ উপলব্ধি করে যখন তারা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হয় তখন আল্লাহ গাড়ির সামনে এবং পেছনে প্রতিরক্ষক ফেরেশতা পাঠিয়ে এর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন? যেন আপনি নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে পারেন। আপনার গাড়ি যে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েনি, ব্রেক ভালভাবে কাজ করার কারণে এমনটি হয়নি, আপনার গাড়ি রাস্তায় টিকে আছে কারণ আল্লাহ গার্ডিয়ান ফেরেশতা পাঠিয়ে এর সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কতজন মানুষ এটা উপলব্ধি করে? তাই, আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এতো অসংখ্য অগণিত পরিমাণ যে, আমরা যদি প্রতি নিঃশ্বাসে শুকরিয়া আদায় করি তবু সামান্য কিছু নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করতেও সমর্থ হব না।   

————————- 

এই জন্যই আল্লাহ মানবজাতি সম্পর্কে বলেছেন – “মা  কাদারুল্লাহা হাক্কা কাদ্রিহি –  – “ তারা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারেনি।” তারা পারেনি। যেভাবে আল্লাহর গুণ গাওয়া উচিত ছিল মানুষ সেভাবে তাঁর গুণগান করতে পারেনি। এটা এক ব্যাপার। এখন, এখানে একটু থেমে চলুন, মানবজাতি সম্পর্কে একটু কথা বলি।  

যখন কারো কোন উপকার করেন, যখন আপনার ছোট ভাইকে সাহায্য করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন… সে একদিন ফোন করে বলল, 

– ভাইয়া, আমার একটু সাহায্য দরকার। আপনি কি অফিস থেকে একটু আসতে পারবেন? 

– আমি তো একটা মিটিং-এ আছি। 

– কিন্তু আমার আপনার সাহায্যের খুবই দরকার। এখনি কি আসতে পারবেন? 

তারপর আপনি মিটিং ক্যান্সেল করে, ট্রাফিক জ্যাম অতিক্রম করে ছুটে গেলেন এবং তার কাজে তাকে সাহায্য করলেন। আর এটা বড় কোন ব্যাপার ছিল না। তাই ছোট একটি কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে আসায় আপনি কিছুটা বিরক্ত। “সিরিয়াসলি!! তুমি এই সামান্য কাজের জন্য আমাকে এভাবে ডেকেছ!!” কিন্তু এরকম শুধু একবার নয়, সে বার বার আপনার সাহায্যের জন্য আপনাকে আহবান করে। বার বার আপনাকে ডেকে ডেকে এভাবে বিরক্ত করে। এরপর একসময় আপনি আর তার কোন ফোন কল রিসিভ করেন না। “আবার সে ফোন দিয়েছে!!” তখন টেক্সট মেসেজ পাঠান – “কাজ শেষে আমি তোমাকে ফোন দিব। আমি এখন ব্যস্ত।” কল এলে কেটে দিব না, তাহলে সে বুঝে যাবে এরচেয় বরং রিং হতে থাকুক। মানুষ এভাবে বার বার সাহায্য চাইলে আমরা বিরক্ত হয়ে পড়ি। 

তদুপরি, উপকার করলেও তাদের মনে থাকে না। আমাদের কথা ভুলে যায়। তারা এমনকি ধন্যবাদও দেয় না। তাদের কাছে এই উপকারের কোন মূল্য থাকে না। তারা মুখ ঘুরিয়ে বলে, “তুমি আমার জন্য কী করেছ?” মানুষ এমনটি করে কিনা? আপনি তাদের জন্য সব করলেও তারা অকৃতজ্ঞের মত অস্বীকার করে। “তুমি আমার জন্য এমন কি আর করেছ?” এমন কথা শুনার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, আমি জীবনে কোনদিন তোমার আর কোন উপকার করবো না। “তুমি? তুমি বলছ আমি কোন দিন তোমার জন্য কিছু করিনি? তোমার মত ব্যক্তি এই কথা বলছ?” এরপর আপনার তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে তার জন্য কি কি করেছেন। এতে সে হয়তো বলবে – “ও! তুমি এখন খোঁটা দিচ্ছ? লোকজনকে দেখাচ্ছ যে তুমি কেমন উপকারী লোক!!” একজন বিশ্বাসী হিসেবে এমনিতেই আমাদের কাউকে উপকারের কথা মনে করিয়ে দেয়া উচিত নয়।  لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُم بِالْمَنِّ وَالْأَذَىٰ – “তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না।” (2:264)  

এখন, একবার ভেবে দেখুন, আল্লাহ আমাদের জন্য কত কিছু করেন প্রতিদিন আর আমরা কত অল্প ধন্যবাদ দেই তাঁকে। আমরা কত সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখাই। তারপর, আমাদের যখন আবারো কিছুর দরকার হয়, প্রয়োজনটা আমরা এমনকি মুখ ফুটে চাইও না– আমার ফুসফুসের প্রতি নিঃশ্বাসে বাতাসের দরকার হয়, ঠিক কিনা? এমনকি আমি যখন আল্লাহর অবাধ্যতা করছি তখনো বাতাসের দরকার হয়, ঠিক কিনা? আমি আল্লাহকে ভুলে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে ভুলে যান না, তিনি আমার প্রয়োজন পূরণ করেন। আমার ফুসফুস তাঁর কাছে চায়, আমার হার্ট আরেকটা স্পন্দের জন্য তাঁর কাছে চায়, আমার চোখ আদ্র থাকার জন্য তাঁর কাছে চায় যেন সে দেখতে পারে। আমি যখন এমনকি চাওয়ারও প্রয়োজন বোধ করি না তখনো তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর এতোসব অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। 

চলুন, এখন, আমরা ‘শাকুর’ নামের অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আপনি সামান্য যা কিছুই করেন – কারণ, আমরা যাই করি না কেন তা সবসময় সামান্যই হবে – আল্লাহ বলছেন তিনি আপনার এই সামান্য চেষ্টাকে দারুণ কদর করেন। ইয়া রব! আপনি আমাদের জন্য সবকিছু করেন। যেমন, আপনাদের একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আপনার প্রতিটি পয়সা, প্রতিটি র‍্যান্ড(দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা), একজন আমেরিকানের প্রতিটি ডলার, একজন পাকিস্তানীর প্রতিটি রুপি, ব্যাংকে আপনার যত টাকা আছে, আপনার পকেটে যত টাকা আছে, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড যাই থাকুক না কেন – এর সবকিছুই এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। তিনিই আপনাকে প্রতিটি পয়সা দান করেছেন। আর আপনি তার থেকে খুবই সামান্য একটি পার্সেন্টেজ দান করলেন। কেউ আপনার দরজায় এসে করাঘাত করল – আপনি তাকে সামান্য কিছু দান করলেন। কিন্তু আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন তার প্রায় সবটাই এখনো আপনার কাছে রয়ে গেছে। সবকিছু তো আর দান করেননি, দিয়েছেন সামান্য কয়েক টাকা। আর আল্লাহ ভালো করেই জানেন যে আপনি অধিকাংশই নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন, দান করেছেন সামান্য কয়েক টাকা মাত্র। এখন, আল্লাহ বলছেন আমি তোমার এই সামান্য দানের মহাগুণগ্রাহী। সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! 

প্রথমত, এই টাকাটা তো আমার ছিল না। এই টাকাটা তো আল্লাহরই। এটা তো আমার ছিল না। আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন এতো (উস্তাদ দুই হাত প্রসারিত করে দেখিয়েছেন) পরিমাণ আর আমি দান করেছি চিমটি পরিমাণ। কিন্তু আল্লাহ এই অল্প দানেরও দারুণ কদর করে থাকেন। তিনি আমার এই নগণ্য দানও স্বীকার করেন। আমাদের প্রতি আল্লাহর নাম আস শাকুরের অনুগ্রহ এটি, আস-শাকুর নামের অনুগ্রহ এটি। 

‘শাকুর’ নামটি আরও দুইটি নামের সাথে যৌথভাবে এসেছে, ‘গাফুরুন শাকুর’ এবং ‘শাকুরুন হালিম।’ আমার কাছে এই ব্যাপারটি অসাধারণ চমকপ্রদ লেগেছে। ‘গাফুরুন শাকুর’ মানে, আমরা যখন নামাজ পড়ি আল্লাহ আমাদের নামাজ পড়া পছন্দ করেন। আর আমাদের নামাজে কত শত ভুল থাকে? নামাজে কত মানুষ দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে চিন্তা করে?  কত মানুষ চিন্তা করে তারাবি কি চৌদ্দ নাকি পনের রাকাত হল? কতজন মানুষের রুকু-সেজদা নিখুঁত হয় এবং অন্তর আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে?  কতজন মানুষ এটা অর্জন করতে পারে? এতোসব ভুল থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ কী করেন? মনে করুন, নামাজ যদি একটি বিল্ডিং নির্মাণ করার মত হয়, আপনি আল্লাহকে দিয়েছেন কয়েকটি ভাঙ্গা ইট মাত্র। আল্লাহ কী করেন? আল্লাহ আপনার এই সামান্য ভাঙ্গা ইটের টুকরাগুলো নিয়ে আপনার জন্য বিশাল এক দালানে তৈরি করে দেন। কারণ তিনি গাফুরুন শাকুর। তারপর তিনি কী করেন? ‘গাফুর’ নামের দয়ায় এটাকে পূর্ণ এক দালানে পরিণত করার পর তিনি কী করেন? তিনি আপনার এই নামাজ পড়াকে সমাদর করেন, এই সুন্দর বিল্ডিংয়ের সমাদর করেন, যা আপনি নির্মাণ করেননি; আপনি শুধু কয়েকটি ভাঙ্গা ইট দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ আমাদের জন্য ‘গাফুরুন শাকুর’।    

অর্থাৎ, এমনকি আমাদের সওয়াবের কাজেও ত্রুটি রয়েছে, খুঁত রয়েছে। প্রথমে আল্লাহ স্বয়ং ঐ ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করে দিবেন। তারপর আমাদের এই ত্রুটিপূর্ণ, ভঙ্গুর প্রচেষ্টাগুলোর জন্য আমাদের প্রশংসা করেন। ইবাদাত সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমি যে দুঃখজনক অজুহাতগুলো দেখাই তিনি তা ঢেকে দেন তারপর তিনি আমার এই প্রচেষ্টাকে   আপ্রিশিয়েট করেন। ইনিই আমাদের রব, গাফুরুন শাকুর। এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। 

যদি আপনার বসের কোন কাজ কোনরকমে করে দেন, মামুলিভাবে করে দেন, তিনি আপনাকে অমুক প্রোজেক্টটি করতে দিয়েছেন, ৩০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছিলেন, আপনি মাত্র দুই পৃষ্ঠা লিখে বসের হাতে তুলে দিলেন। তারপর বললেন, আপনার খুশি হওয়া উচিত, আমি তো দুই পৃষ্ঠা লিখেছি। কী হবে ভাবতে পারছেন? 

মানুষের পক্ষে কোন দিন আল্লাহর মত ‘গাফুরুন শাকুর’ হওয়া সম্ভব নয়। যদি প্রত্যাশার চেয়ে কম করেন তাহলে যার জন্য কাজটি করেছেন তিনি আপনার প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ বলছেন তুমি তো অন্তত চেষ্টা করেছো; আমি তোমার ত্রুটিগুলো ঢেকে দিচ্ছি। “আন ইয়াজিদাহুম মিন ফাদলিহ” তিনি যে শুধু আপনার ত্রুটিগুলো ঢেকে দেন তাই নয়, তিনি ভালো কাজের এতো সমাদর করেন যে তদুপুরি তিনি আপনাকে পুরস্কৃত করেন, ইয়াজিদাহুম মিন ফাদলিহ”। 

পরিশেষে, মানুষ যখন জান্নাতে গিয়ে উপনীত হবে, তারা আল্লাহকে স্মরণ করবে। কিন্তু কীভাবে তারা আল্লাহকে স্মরণ করবে? মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তাদের দুঃখগুলো দূর করে দেয়ার জন্য, তারা বলবে, আল্লাহ তাঁর নাম পূর্ণ করেছেন। কোন নাম? আল্লাহ আমাদের সবগুলো ত্রুটি ঢেকে দিয়েছেন। আর তিনি আমাদের প্রচেষ্টাগুলোর সমাদর করেছেন এবং আমরা যা করেছি তার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন তিনি এমনটি করবেন। আর শুধু এ কারণেই আজ আমরা জান্নাতে। কারণ, আমাদের কাজগুলো যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রচেষ্টাগুলো যথেষ্ট নয়। তো, মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করার পর ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে এবং স্বীকার করবে। 

‘শাকুর’ এর সাথে সম্বন্ধযুক্ত আল্লাহর আরেকটি নাম হল, ‘হালিম।’ এটাও আল্লাহর খুবই শক্তিশালী একটি নাম। ‘হালিম’ এর অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। কিন্তু আজ আমি আপনাদের নিকট শুধু এর একটি অর্থ তুলে ধরব। ‘হালিম’ বলতে এমন কাউকে বোঝায়, আপনি যখন ভুল করেন……  কয়েক মিনিট আগে আমি বলেছিলাম আমাদের ভালো কাজ জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, আমরা এখন সেটা সম্পর্কে কথা বলছি না। 

আমরা এখন কথা বলছি, আমার আর আপনার ভুল কিছু করা সম্পর্কে, কোন পাপ করা সম্পর্কে, খারাপ কিছু করা সম্পর্কে। দুনিয়ার এই জীবনে আপনি যখন খারাপ কিছু করেন, কোন পাপ কর্ম সম্পাদন করেন, যখন মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন, চুরি করেন, যখন কাউকে কষ্ট দেন, অপমান করেন, এই জীবনে যখন এমন ধরণের কিছু করেন — তখন এতসব কিছুর পর তাদের জন্য আপনাকে ভালবাসা কঠিন হয়ে পড়ে। খুবই কঠিন। মা আপনাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু, আপনার মাকে যদি ধমক দিয়ে কথা বলেন, চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, কোন কোন মানুষ এমনকি মার-ধরও করে – আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদেরকে তওবা করার সুযোগ দান করুন। যদি কোন সন্তান এমন কিছু করে তাহলে মায়ের জন্যেও কী করা কঠিন হয়ে পড়ে? জড়িয়ে ধরা এবং বলা যে আমি তারপরেও তোমাকে ভালবাসি। সন্তানের এই অন্যায়ের কারণে মুখে হাসি ফোটানো কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি সহ্য করবেন, অন্তরে ব্যথা পাবেন, কিন্তু সন্তানের জন্য ভালোবাসা তখন আর থাকবে না। 

‘হিল্ম’ শব্দের অর্থ হল, সেই ব্যক্তির জন্য আপনার ভালোবাসা এবং যত্ন রয়েছে যে আপনার প্রতি অন্যায় আচরণ করছে, তারপরেও। তারপরেও আপনার ‘হিল্ম’ রয়েছে, তারপরেও আপনার ভালোবাসা রয়েছে, যত্ন রয়েছে। 

এখন, এটা নিয়ে চিন্তা করুন। আমরা সামান্য কিছু ভালো কাজ করি। যদিও তা পারফেক্ট হয় না, আগে এ সম্পর্কে বলেছি। কিন্তু আমরা অগণিত খারাপ কাজ করে যাই। ভুলে যাই, বলা উচিত হয় এমন কথা বলে ফেলি, তাকানো উচিত নয় এমন কিছুর দিকে তাকিয়ে ফেলি, এমন কাজ করি যা করা উচিত নয়, আমরা মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় করি, আল্লাহর বিরুদ্ধে অন্যায় করি। 

এমন কাজ করলে মানুষ কী করে? কেউ যদি জানে অমুক তার প্রতি অন্যায় করেছে, আপনি যদি জানেন অমুক ব্যক্তি আপনাকে অপমান করেছে…তখন সে যা কিছুই করুক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি তখন শুধু তার ব্যাপারে একটা জিনিসই মনে রাখেন। কী সেটা? “ঐ ব্যাটা আমাকে অপমান করেছে!! আমি তার সাথে কথা বলতে চাই না।” সে লোক হয়তো হজ্ব করেছে, সে হয়তো দান-খয়রাত করে, এতিমের দেখা শোনা করে, কুরআন মুখস্ত করে, সে হয়তো প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, কিন্তু আপনি তার কোন কিছুরই পরোয়া করেন না। সে আমাকে অপমান করেছে। তাকে আমি পছন্দ করি না। আমি তার সাথে কথাও  বলতে চাই না। আমি জানি সে কেমন লোক। 

জানেন? কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে কোন অন্যায় করে, আমরা মনে করি ঐ লোক আর মানুষ না, সে তখন ঐ একটা অপরাধে পরিণত হয়। সে ব্যক্তি মানে ঐ অপরাধ। তাকে দেখলেই ঐ অপরাধটা চোখে ভেসে উঠে। সে যা কিছু ভালো কাজ করেছে সব অদৃশ্য হয়ে যায়। এসবের আর কোন অস্তিত্ব নেই। 

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা নিজেকে ‘শাকুরুন হালিম’ হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে বলছেন, তিনি আমাদের ক্ষুদ্রতম ভালো কাজেরও সমাদর করেন। তিনি আমাদের ভয়ানক অন্যায় কাজের কারণে আমাদের ভালো কাজগুলো মুছে দেন না। তিনি ডিলিট করে দেন না। তিনি ভালো কাজগুলো স্বীকার করেন, মুছে দেন না। কিন্তু মানুষ এই কাজ করে। তাই, তিনি শাকুর এবং হালিম। পাপ করা সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে ভালবাসেন। তিনি তবু তাদের ভালবাসেন এবং তাদের ভালো কাজের সমাদর করেন। তাদের ভুল কাজগুলো সত্ত্বেও। 

ভাবতে পারেন?  আয়েশা (রা) হলেন আমাদের মা। রাসূলুল্লাহ (স) এর সময়কালে কিছু মুসলিম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলে ফেলেন যা বলা উচিত ছিল না। তারা এই অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। যখন তারা এসব বলাবলি করছিল, আবু বকর (রা) খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন আয়েশার বাবা। তিনি আবার রাসূলুল্লাহ (স) এরও খুব কাছের মানুষ ছিলেন। কেউ যদি আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলে তখন আপনার কেমন লাগবে? কীভাবে এমন কথা সহ্য করবেন? আর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এমন মানুষদের বর্ণনা দিচ্ছেন যারা হযরত আয়েশা সম্পর্কে বাজে কথা বলেছিল। তোমার উচিত তাদের ক্ষমা করে দেওয়া। তাদের একজন মক্কা থেকে এসেছিলেন। এই ঘটনা মদিনায় ঘটে। কিন্তু তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন?  মক্কা। তিনি আবার বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ হালিম – তিনি তাদের ভুলগুলোর আলোকে তাদের সম্পর্কে কথা বলার পরিবর্তে তাদের ভালো কাজগুলোর আলোকে তাদের সম্পর্কে কথা বললেন। আল্লাহ তাদের ভুল কাজের কারণে তাদের ভালো কাজগুলো নির্মূল করে দেননি। তিনি আবু বকর (রা) কে উৎসাহিত করেন এই বলে – أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ – তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? (24:22)  তিনি তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। সুবহানাল্লাহ! এটা হল মানুষের জন্য আল্লাহর হিল্ম। মানুষের জন্য আল্লাহর হিল্ম। 

আমাদের হিল্মের অভাব রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের নিজদের জন্য আমাদের এটা দরকার। ভাবতে পারেন? আমরা অন্যদের সাথে যেমন আচরণ করি আল্লাহ যদি আমাদের সাথে তেমন আচরণ করতেন? কেউ খারাপ কিছু করলে তার অন্য কোন ভালো কাজের আমরা আর কোন মূল্য প্রদান করি না। ঠিক কিনা? আল্লাহ যদি সেভাবে আমাদের সাথে আচরণ করতেন? 

শেষ যে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলতে চাই তা হল, আল্লাহ কোন কাজের মূল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সূক্ষ্ম! وَلَا يَطَئُونَ مَوْطِئًا – আল্লাহ বলেন, একজন বিশ্বাসী যখন ভালো কাজ করে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য সওয়াব লেখা হয়।  (৯:১২০) 

আমরা এখানে নামাজ পড়তে এসেছি। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন নামাজের জন্য আমাদের পুরস্কৃত করেন। কিন্তু আমরা জানি না যে নামাজে আসার জন্য যখন আমরা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছিলাম আল্লাহ আমাদের জন্য সওয়াব লিখেছেন, আমরা যখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম তখনো তিনি সওয়াব লিখেছেন, চাকার প্রতিটি ঘূর্ণনের বিনিময়ে আল্লাহ সওয়াব লিখেছেন, ডিজেল এবং গ্যাসোলিন কেনার জন্য যত টাকা খরচ করেছেন তার জন্যেও আল্লাহ সওয়াব লিখেছেন। মসজিদে আসার পর যখন ওযু করার জন্য যাচ্ছিলেন প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য আল্লাহ সওয়াব লিখেছেন। 

কিয়ামতের দিন মানুষ শুধু মন্দ কাজ দেখে তাজ্জব হবে না, মানুষ অবাক হয়ে যাবে – “ইয়া আল্লাহ এই সামান্য ভালো কাজটাও আপনি আমার জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন!” এই হলেন আল্লাহ শাকুরুন হালিম!! আল্লাহ আমাকে আপনাকে কী কী দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন শুধু এই ভাবনাই আমাদের অবাক করে দেয়। সুবহানাল্লাহ! 

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদেরকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ করে তুলুন, যেন আমরা তাঁর প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে পারি, আল্লাহ আমাদের কাছে সামান্য যা কিছু চেয়েছেন তা যেন দিতে পারি। তিনি আমাদের কাছ থেকে বেশি কিছু চান না। তিনি আমাদের নিকট বেশি আশা করেন না। আমরা সামান্য একটুও যদি তাঁকে প্রদান করি, আল্লাহ তা বহুগুণে বহুগুণে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। 

দোয়া করি আল্লাহ যেন আমাদের সকল ভালো কাজের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন এবং তাঁর অনুগ্রহে আমাদেরকে তাঁর জান্নাতে প্রবেশ করতে দেন।

‐————-***-‐——-‐—–