– নোমান আলী খান
আজ আমি আপনাদের সাথে আমাদের প্রিয় নবী (স) সম্পর্কে কিছু কথা এবং আমাদের সাথে তাঁর সম্পর্কের স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত তার উপর আলোকপাত করতে চাই। আলোচনার প্রথম দিকে আপনাদের কাছে হয়তো এমনটি মনে হবে না। কিন্তু শেষের দিকে গেলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে আমি এ বিষয় নিয়েই কথা বলতে চেয়েছি।
আমার নিজের জন্যেও, কুরআনে আমি যা কিছু অধ্যয়ন করেছি এটা সবচেয়ে শক্তিশালী শিক্ষা। এবং আমি এই শিক্ষা দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়েছি। আমি দোয়া করছি, এই সূরা থেকে যা কিছু আমি অধ্যয়ন করেছি এবং যে সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পেরেছি তার কিছু কিছু যেন আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারি। এই পাঠটি সূরা ইয়াসিনের অন্তর্গত। কুরআনের ছত্রিশ তম সূরা। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই সূরায় নবীদের অনন্যসাধারণ একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। সাধারণত দেখা যায় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা একটি অঞ্চলের জন্য একজন রাসূল প্রেরণ করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন – إِذْ أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمُ اثْنَيْنِ – আল্লাহ তাদের জন্য দুইজন রাসূল প্রেরণ করেন।(36:14) فَكَذَّبُوهُمَا – আর সেই জাতি উভয় রাসূলকেই অস্বীকার করে। فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ – “তখন আমি তাদেরকে শক্তিশালী করলাম তৃতীয় একজনের মাধ্যমে।”
তাই দেখা যাচ্ছে, এই জাতির ঘটনা অন্য সব জাতির তুলনায় অনন্যসাধারণ। কারণ তিনজন রাসূল একই সময়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। এই রাসূলদের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল…। আলোচনা চালিয়ে যাবার পূর্বে আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মূসা (আ) কে – কুরআনে বর্ণিত সবচেয়ে ভয়ংকর ভিলেনদের একজন – ফেরাউনের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। আর এই কাজে তিনি কার সাহায্য চান? হারুন (আ) এর। তাহলে তাঁরা ছিলেন দুইজন। এমনকি এই ক্ষেত্রেও আপনি যদি ভালভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন, সব কথা মূসা (আ) বলেছিলেন, হারুন (আ) নীরব ছিলেন। সব কাজ মূসা (আ) করেছিলেন। হারুন (আ) তাঁর সমর্থনে ছিলেন। اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي – وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي – “তার মাধ্যমে আমার কোমর মজবুত করুন। এবং তাকে আমার কাজে অংশীদার করুন। (20:31-32)” তাঁর চাকরি ছিল প্রধানত মূসা (আ) কে সাপোর্ট দেয়া।
আর এই রাসূলদের ক্ষেত্রে তিনজনের সবাই দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তাঁদের সবাই বার্তা পৌছিয়ে দিচ্ছিলেন। এবং সবাই একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ ۖ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ – “আমরা তোমাদেরকে অশুভ-অকল্যাণকর দেখছি। যদি তোমরা বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করব لَنَرْجُمَنَّكُمْ -।” وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ – “এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে।” তোমরা ভালো চাইলে থামো। এভাবে তিনজনের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ঘটনা যখন এভাবে ঘটে চলছিল আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা চতুর্থ ব্যক্তির আগমন ঘটালেন। তিনজনের দাওয়াতেও তারা ঈমান না আনায় চতুর্থ ব্যক্তির আগমন ঘটল। কিন্তু চতুর্থজন রাসূল ছিলেন না। وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَىٰ – “অতঃপর শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি দৌড়ে এল।” অর্থাৎ মনে করুন তারা এই শহরে ছিল অতঃপর প্রতিবেশী অঞ্চলের কেউ একজন এই তিনজন রাসূলের দাওয়াতের কথা শুনতে পেল। “কেউ তাঁদের কথা মানছে না, আমার উচিত তাঁদেরকে গিয়ে সাহায্য করা।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে, একজন মুমিন হিসেবে তিনি অন্য শহর থেকে এসে মানুষকে দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। সূরা ইয়াসিনের এই ঘটনায় যে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য তা হল, কুরআনে এই তিনজন রাসূলের একটি বা দুইটি উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্য শহর থেকে এই ব্যক্তির আগমন ঘটার পর থেকে আলোচনার বাকি সব কথা এই ব্যক্তির। কুরআনে বর্ণিত তাঁর বক্তব্য তিনজন রাসূলের সমন্বিত বক্তব্যের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি। এটা অবিশ্বাস্য!
আমাদের সীমিত জ্ঞানে আমরা যা বুঝি, আপনার সামনে যদি বেশি জ্ঞানী কেউ থাকে তাহলে আপনার উচিত চুপ থাকা। প্রাচীন আরবি একটি প্রবাদ আছে – اغنى الصباح عن المصباح – “প্রভাত এসে গেলে আর বাতির দরকার হয় না।” তো, এখানে যে পয়েন্টটি বোঝাতে চাচ্ছি, আমাদের সামনে বেশি জ্ঞানী কেউ থাকলে আমাদের উচিত চুপ থাকা। তিনজন রাসূল, তিনজন রাসূল তাঁর সামনে উপস্থিত, কিন্তু তিনি অনুভব করলেন তাঁরও কথা বলা দরকার। আমরা হলে মনে করতাম, আরে! তিনজন রাসূল আমাদের সামনে উপস্থিত, তাঁদের উপস্থিতিতে আমার কথা বলা সাজে না।
তাহলে ব্যাপারটা কী? আল্লাহ এখানে আমাদের একটি বিষয় শিক্ষা দিচ্ছেন। রাসূলদের নিজস্ব দায়দায়িত্ব রয়েছে। আর উম্মার তথা যারা রাসূলদের উপর বিশ্বাস এনেছে তাঁদেরও নিজস্ব দায়-দায়িত্ব রয়েছে। রাসূলরা তাঁদের কাজ করবেন আর মুমিন ব্যক্তিও তাঁর নিজের দায়িত্ব পালন করবেন। আর তারা একে অন্যের কাজ করে দিতে পারবেন না। তাদের এভাবে বললে হবে না, “রাসূলরা তো ইতিমধ্যে কাজ করছেন সুতরাং আমার কাজ না করলেও চলবে।” না, আপনাকে আপনার কাজ করে যেতে হবে।
তাই সেই ব্যক্তি শহরবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলেন। আর কুরআনে তাঁর বক্তব্যকে বেশি সময় ধরে রেকর্ড করা হয়েছে, ঐ সমস্ত রাসূলদের সমন্বিত বক্তব্যের চেয়েও।
এখন আমাদের রাসূল (স) এর ক্ষেত্রে যে শিক্ষাটি আমরা এখান থেকে গ্রহণ করবো, বিশ্বাসীদের এভাবে বললে হবে না – “রাসুলূল্লাহ (স) ইতিমধ্যে এসে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। তাই আমার আর কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না।” বুঝতে পারছেন?
এই ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ কী করলেন? এই ঘটনা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ এমন কিছুর বর্ণনা দিলেন…এই জায়গাটাতে আমি আপনাদের তীব্র মনোযোগ আশা করছি … আল্লাহ এমন কিছুর বর্ণনা দিলেন দৃশ্যত মনে হয় এর সাথে বর্ণিত ঘটনার কোন যোগসূত্র নেই। তিনি চাঁদ এবং সূর্য নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। তিনি চন্দ্র সূর্য নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন।
তিনি চাঁদ সম্পর্কে বলছেন – وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ – “চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়।” বিশেষ করে আমরা রমজান মাসে চাঁদের বিভিন্ন মনজিল অবলোকন করি। তো, তিনি বলেন চাঁদ বিভিন্ন পর্যায়ক্রম অতিক্রম করে। তিনি সূর্য সম্পর্কেও কথা বলেন। তারপর তিনি একটি বিবরণ প্রদান করেন। তিনি বলেন – لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ- “সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, ” وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ – “প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষ পথে ভেসে বেড়ায়।” সবার নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে।
এর পূর্বের ঘটনা ছিল, রাসূলদের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে আর অনুসারীদেরও নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে। এখন আল্লাহ বলেছেন… ঠিক একইভাবে কার কার নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে? চাঁদের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে এবং সূর্যেরও নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে।
এখন আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (স) এর কথা আলোচনা করছি, তখন এ ব্যাপারটি কেন শক্তিশালী? সুরাতুল আহজাবে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের নিকট রাসূলুল্লাহ (স) এর একটি বর্ণনা প্রদান করেন। এই আয়াতে তিনি তাকে জানাচ্ছেন তাকে কোন কোন ভূমিকা পালন করতে হবে। يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا – وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا – (সূরা আহজাব, ৩৩ তম সূরা, আয়াত ৪৫-৪৬) আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স) সম্পর্কে বলছেন তিনি কয়েকটি ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু সবগুলো ভূমিকা বর্ণনা করার পর আল্লাহ আমাদের রাসুল (স) কে অনন্যসাধারণ একটি শব্দ দিয়ে অভিহিত করেন। তিনি তাকে “সিরাজাম মুনিরা” বলে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, এমন একটি বাতি যা আলো ছড়ায় এবং সবকিছু আলোকিত করে তোলে।
এখানে আরেকটি ব্যাপার হল, কুরআনে ‘সিরাজ’ শব্দটি সূর্যের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا – “এবং একটি উজ্জ্বল প্রদীপ সৃষ্টি করেছি।” (সূরা নাবায় সূর্যের জন্য ‘সিরাজ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর সূরা আহজাবে ব্যবহার করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ (স) এর জন্য) আমাদের রাসুলুল্লাহ (স) কে সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সূরা ইয়াসিন বলছে, সূর্যের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে আবার চাঁদেরও নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে।
এখন, আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) কে যখন সূর্যের সাথে তুলনা করা হচ্ছে, তখন এর দ্বারা আসলে কী বুঝায়? এর অর্থ হল কেউ রাসূলুল্লাহ (স) এর সান্নিধ্য পেয়ে থাকলে তাঁর জ্যোতি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এমনটি ঘটা অসম্ভব। তার জ্যোতির প্রভাবে অন্ধকার দূরীভূত হবেই। কারণ সূর্যের আগমন ঘটেছে।
কিন্তু আল্লাহর নিয়ম হল, সূর্য সবসময় আকাশে অবস্থান করবে না। সূর্য অস্ত যায়। আর সূর্য যখন অস্ত যায় তখন কার পালা আসে? চাঁদের। আমাদের মহানবী (স) আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু কে আছে? আমরা আছি। প্রসঙ্গত, সূর্য নেতৃত্বের জায়গায় আর চাঁদ তার অনুসারী মাত্র। বৈজ্ঞানিকভাবেও আমরা এখন এটা জানি। চাঁদ অনুসারী মাত্র। আমাদের সৌরজগতের সকল গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহগুলো সূর্যের মহাকর্ষ বলের বন্ধনে আবদ্ধ। আর চাঁদের আলো সূর্যের আলোর প্রতিবিম্ব মাত্র। আমরা এখন অন্ধকারময় এক বিশ্বে বসবাস করছি। আমরা বিশ্বাসীরা তমসাচ্ছন্ন এক দুনিয়ায় বাস করছি। আমাদেরকে তুলনা করা হয়েছে চাঁদের সাথে। আমাদের কাছে একমাত্র যে জ্যোতি আছে তার উৎস হল রাসূলুল্লাহ (স)। আমাদের সবার ঈমান রাসূলুল্লাহ (স) এর মূল শিক্ষার প্রতিফলন মাত্র। ঠিক চাঁদের আলো যেমন সূর্যের আলোর প্রতিফলন মাত্র।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করুন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের যে সূর্য দিয়েছেন তা চাঁদের মত পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে যায় না। সূর্য একই রকম থাকে, সবসময়। কিন্তু চাঁদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো এটি পূর্ণ চাঁদ আবার কখনো কখনো এটি খুব দুর্বল চাঁদ। ঠিক মুমিনদের মত। আমাদের অবস্থা একই রকম থাকে না। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের রাসূল (স) এর হৃদয়কে বর্ণনা করেছেন – لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ – “এর মাধ্যমে আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় করব।” অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ (স) এর অন্তরে ঈমানের আলো সুদৃঢ়, মজবুত। ঠিক যেমন সূর্যের আলোর কোন কমতি নেই, এটি প্রতিনিয়ত আলো দিয়েই যাচ্ছে। আমরা যখন সূর্য দেখতে পাই তখনো এটি বর্তমান আছে আবার যখন দেখতে পাই না তখনো এটি বর্তমান থেকে চাঁদকে আলো দিয়ে যাচ্ছে। (এখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর শিক্ষা বর্তমান আছে এবং মুমিনদেরকে আলো দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।)
কিন্তু চাঁদ বিভিন্ন পর্যায় ক্রমের ভেতর দিয়ে যায়, ঠিক যেমন একজন বিশ্বাসী বিভিন্ন পর্যায় ক্রমের ভেতর দিয়ে যায়। কখনো কখনো বিশ্বাসীর ঈমানের আলো এতো দুর্বল থাকে যে ঈমানটা কোনরকম টিকে থাকে, ঠিক চাঁদকে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে – حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ – “অবশেষে সেটি খেজুরের শুষ্ক পুরাতন শাখার মত হয়ে যায়।” এমনকি আপনার ঈমানের অবস্থা এতো দুর্বল হলেও তখনো কিন্তু আপনি রাসূলুল্লাহ (স) এর বার্তার প্রতিনিধিত্ব করছেন।
পরেরবার যখন আকাশে চাঁদের দিকে তাকাবেন আপনি আসলে তখন নিজেকে দেখছেন। আপনি তখন নিজের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই উম্মাহকে পছন্দ করেছেন যেন ঘোর তমসায়ও আমরা রাসূলুল্লাহ (স) এর জ্যোতি দিয়ে এই দুনিয়াকে জ্যোতির্ময় করতে পারি। وَدَاعِيًا إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا
এর ফলে কি রকম বিশাল এক দায়িত্বের বোঝা আমাদের কাঁধে অর্পিত হয়! এটা কী করে জানেন? এটা হযরত উমর (রা) এর উক্তি বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হল – ”আনা রাসুলু রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” অর্থাৎ, আমি রাসূলুল্লাহ (স) এর একজন রাসূল (বার্তাবাহক)।
উক্তিটির মাধ্যমে এই উম্মাহর একজন সদস্য হওয়ার মানে কী – এই বিষয়ে তিনি আমাদেরকে অসাধারণ একটি পাঠ শিক্ষা দিলেন। আমাদের প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহ (স) এর একজন প্রতিনিধি। আমাদের প্রত্যেকে। যখন আমরা তাঁর কথামত চলি, আর যখন চলি না উভয় অবস্থাতেই। যখন আমাদের যেভাবে চলা উচিত সেভাবে চলি আর যখন চলি না। যখন আমরা অন্যদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করি এবং যখন অন্যদের সম্পর্কে ভালো কথা বলি। যখন আমরা চোখ নিয়ন্ত্রণ করি আর যখন করি না। আমরা পছন্দ করি বা না করি আমাদের তো রাসূলুল্লাহ (স) এর আলোর প্রতিনিধিত্ব করার কথা। আমরা সেই দায়িত্বের বোঝা সর্বদা বহন করে চলছি।
অনেক সময় আমরা দায়িত্বটি ভালভাবে পালন করতে পারি না, আমাদের কাজ কর্ম পূর্ণ চাঁদের মত নয়। মাঝে মাঝে এটি খুবই দুর্বল। আর দুর্বল মানে হারিয়ে যাওয়া নয়। কারণ আল্লাহ চাঁদকে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যে চাঁদ যখন একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে ঠিক তখনি এর পুনর্জাগরণের সময় হয়। আমাদের মহানবী (স) বিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, “তাদের ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটবে, সময়ে সময়ে।” আপনি সবসময় একই রকম উৎসাহ উদ্দীপনা অনুভব করবেন না। কিন্তু রাসূল (স) এর সাথে আমাদের সম্পর্ক আমাদের ঈমানকে বার বার সবল করে তুলবে। ইয়া রব! রাসূলুল্লাহ (স) এর সাথে আমাদের সম্পর্কের স্বরূপটা এমনই। তিনি আমাদের নিকট এমনই একজন।
এই প্রজ্ঞা আমার আপনার জন্য আর কি কি বার্তা বহন করে? রাসূলুল্লাহ (স) এর বার্তা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদেরকে পছন্দ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (স) যখন আমাদের মাঝে আর থাকবেন না, যেভাবে তিনি সাহাবাদের সাথে ছিলেন – তখন এমন মনে হবে যেন সূর্য ডুবে গিয়েছে এবং রাতের আগমন ঘটেছে। আর যখন রাতের আগমন ঘটেছে তখন চারদিকে হতাশা শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার, ভয়, উদ্বেগ, অজ্ঞতা পৃথিবীকে আবার ঢেকে ফেলেছে। অজ্ঞতা দ্বারা আমি কী বুঝাচ্ছি? দিনের আলোতে আপনি সহজেই পথ খুঁজে পাবেন কিন্তু রাতের অন্ধকারে সহজেই হারিয়ে যেতে পারেন। দিনের আলোতে যে পথটি নিরাপদ, রাতের বেলা সে পথটিই ভয়ংকর। দিনের বেলা চারিদিকে জীবনের চাঞ্চল্য আর রাতের বেলা চারিদিকে মৃত্যুর নীরবতা।
এমন ঘোর তমসায় আলোর একমাত্র উৎস হিসেবে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই উম্মাহকে পছন্দ করেছেন। সবাই যখন চার দিক থেকে অন্ধকার দ্বারা বেষ্টিত, তখন চাঁদ হয়ে চারদিকে আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি আমাদেরকে পছন্দ করলেন। মানুষ যেন কিছুটা আশার আলো খুঁজে পায় সেজন্য তিনি আমাদেরকে পছন্দ করলেন। তাই, অন্যরা যখন আমাদের দিকে তাকায় তখন তারা আমাদের মাঝে হাবিবুনা (স) এর আলোর কিছুটা আভাস দেখতে পায়। আমাদের তো এমনই হওয়ার কথা। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের ঠিক এমনই একটি দায়িত্ব দিয়েছেন।
ইনশাআল্লাহ, পরের বার যখন রাসূলুল্লাহ (স) সম্পর্কে কথা বলব, তখন কুরআনের অন্যতম শক্তিশালী একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। যে আয়াতে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা নিজে রাসূলুল্লাহ (স) এর প্রতি সালাওয়াত প্রেরণ করেছেন। যা এই পাঠের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমরা অন্য কোন সময় এ সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু এখন, আমি চাই আপনারা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন। আল্লাহ যে নিদর্শনগুলো আমাদের দিয়েছেন চাঁদ, সূর্য, বাতাস, গাছপালা …এই সবগুলো নিদর্শনের পেছনে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। তাই, এই শিক্ষা পাওয়ার পর একজন বিশ্বাসী সূর্যকে কখনো আর আগের দৃষ্টিতে দেখবে না। একজন বিশ্বাসী চাঁদের দিকেও আর কখনো আগের দৃষ্টিতে তাকাবে না।
এখন আল্লাহর রাসূলের উপর দরুদ পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে আর খুৎবা শুনতে হবে না, আপনি সূর্যের দিকে তাকালেই রাসূলের কথা মনে করে পড়বেন – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এখন সূর্যকে দেখলেই আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) এর কথা মনে পড়বে। এটাই কুরআনের সৌন্দর্য। যদি সর্বদা কুরআনের দৃষ্টিতে চারপাশের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে রিমাইন্ডার এড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ, সবকিছু আপনাকে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের কথা মনে করিয়ে দিবে বা চরম সত্য সম্পর্কে আপনাকে কোন না কোন জ্ঞান দান করবে।
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের সকলকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা রাসূলুল্লাহ (স) এর আলো ধারণ করে এবং সে আলো চারদিকে ছড়িয়ে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় যেন অন্যরাও সেই সূর্যের দিকে তাদের পথ খুঁজে পায়। বারাকাল্লাহু লিই ওয়ালাকুম।
———————- * ——————————-