ক্ষমতা বনাম সম্মান – উস্তাদ নোমান আলী খান

“قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء …”- “হে আল্লাহ তুমিই সর্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেও আর যার নিকট হতে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেও।” (সূরা আল ইমরান ৩ঃ ২৬)। এটাই বাস্তবতা। এই স্বীকার করি এই ক্ষমতা শুধু আল্লাহর হাতেই, তিনি যাকে যখন ইচ্ছা দেন আর যখন ইচ্ছা তার থেকে কেরে নেও। এখানে একটা ব্যাপার বেশ নজর কাড়ে, আরবী শব্দ “মুলক” এখানে দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে। “تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء” এবং “تَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء”। এখানে “দমীর” বা সর্বনাম ব্যবহার করা যেত। অর্থাৎ “মুলক” শব্দ দুইবার ব্যবহার না করে একবার মূল শব্দ আরেকবার সর্বনাম ব্যবহার করতে পারতেন। তাহলে আয়াতটা হতো এমন, “তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেও আর যার নিকট হতে ইচ্ছা সেটা কেড়ে নেও।” পরেরবার ‘মুলক” ব্যবহার না করে “সেটা” বা এরকম কিছু ব্যবহার করা যেত। কিন্তু আল্লাহ “মুলক” অর্থাৎ ক্ষমতা বা রাজত্ব এই শব্দটি দুইবার ব্যবহার করেছেন। আরবীর নিয়ম অনুসারে আপনি যখন একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করছেন তখন দুইটি শব্দ দ্বারা আলাদা দুইটি বিষয় বা এই আয়াতে আলাদা দুইটি ক্ষমতা বুঝায় না। এখানে একটি জিনিসের কথায় বলা হচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা যদি চিন্তাকরি, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন ও যার থেকে ইচ্ছা থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন একজনকে রাজত্ব দেওয়া হচ্ছে আর অন্য একজন থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বিষয়টা এমন না। “মুলক” শব্দটির দুইবার ব্যবহারের ফলে এর আরেকটা অর্থ দাড়াচ্ছে। অর্থাৎ তিনি যাকে ক্ষমতা দিয়েছেন চাইলে তার থেকেই কেড়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি থেকেই ক্ষমতা আল্লাহ চাইলে নিয়ে নিচ্ছেন। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আবারো বলছি, বিষয়টা এমন না যে, একজনকে দিলেন এবং অন্যজন থেকে কেড়ে নিলেন। 

আল্লাহ এমন করেননি যে, তোমাকে একবার ক্ষমতা দিয়েছি তারমানে সারাজীবন তুমিই শাসন করবে। এই ব্যাপারে আল্লাহই সিদ্ধান্ত নিবেন, কখন কাকে দিবেন আর কখন কার থেকে কেড়ে নিবেন। এই ক্ষমতা বলতে দুনিয়াবী ক্ষমতা না। ইলেকশন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা, শাসকের প্রদত্ত ক্ষমতা এসব না এটা সরাসরি আল্লাহ থেকে প্রদত্ত ক্ষমতা এবং তিনি যখন ইচ্ছা দিবেন আর যখন ইচ্ছা কেড়ে নিবেন। এটা হলো প্রথম আলোচনা।

এখন পরের বিষয় হলো, আল্লাহ এই “মুলক” শব্দটা আলাদা করেছেন “ইজ্জাহ” থেকে। “قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء”- ”আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন আর যার নিকট হতে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত প্রদান করেন … ”। এখানে আল্লাহ বলেছেন, “ وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء”। এখন এই “ইজ্জাহ” শব্দটি দুইটি অর্থ দেয়। একটা হলো কর্তৃত্ব অর্থাৎ আমাদের উপর যাদের কর্তৃত্ব আছে তাদের এক প্রকার ইজ্জাহ আছে দেই আরেকটা অর্থ হলো সম্মান।

কিছু লোক আছে যাদের কর্তৃত্ব আছে কিন্তু সম্মান নেই। যেমন ধরুন কোন পুলিশ অফিসার, তার কর্তৃত্ব আছে কিন্তু সে অত্যাচারী হলে সমাজে তার সম্মান থাকে না। আবার কোন রাষ্ট্রের সরকারের কর্তৃত্ব থাকে কিন্তু সম্মান যে সর্বদা থাকবে এমন না। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে। কিছু কিছু লোককে সম্মান করা হয় যদিও তাদের সমাজে সরাসরি কর্তৃত্ব নেই। হতে পারে তিনি শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী বা লেখক। তাদেরকে তাদের চিন্তা-ভাবনার জন্য সম্মান করা হয় কিন্তু তাদের এই চিন্তা-ভাবনা সমাজে চালু করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কেউ কাজ করে না। অর্থাৎ তাদের সম্মান আছে, কর্তৃত্ব নেই। এটাও খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কারোর ক্ষেত্রে যখন “ইজ্জাহ” শব্দটি ব্যবহৃত হয় তার ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ও সম্মান দুইটি বিষয়ই থাকে। 

আল্লাহ এখানে “মুলক” অর্থাৎ ক্ষমতা বা রাজত্ব থেকে “ইজ্জাহ” অর্থাৎ কর্তৃত্ব ও সম্মান শব্দটিকে আলাদা করেছেন। এর কারণ হলো, আপনার ক্ষমতা আছে মানেই যে আপনার সম্মান থাকবে এমনটা না। আপনার ক্ষমতা হয়তো কাগজে কলমে আছে কিন্তু মানুষের অন্তরে আপনার জন্য স্থান নেই। হতে পারেন আপনি একজন রাজা বা শাসক, কিন্তু এর মানে এই না যে সবাই আপনাকে সম্মান করে আপনার কর্তৃত্ব মেনে নিবে। আল্লাহ বলছেন, তিনি রাজত্ব দিতে পারেন, ক্ষমতা দিতে পারেন আবার তা কেড়েও নিতে পারেন। এই রাজত্ব ও ক্ষমতা যে তাকে “ইজ্জত” দিবে এমনটা নাও হতে পারে। তিনি এই দুইটি বিষয়কে খুব সুন্দর করে আলাদা করেছেন। কারণ, অনেক সময় আমাদের মনে হয় যার ক্ষমতা আছে তার সম্মানও আছে। কিন্তু বাস্তবে অনেকেই ক্ষমতাসীনের কাছে আসেন লোক দেখানো সম্মান করতে কারণ তাদের কাজ হাসিল করতে হবে। এই মেকি সম্মান দেখানোর ফলে হলেও সমাজে একটা কর্তৃত্ব পাওয়া যায়, শাসকের কাছে আসা যায়। কিন্তু আল্লাহ খুব ভালো করেই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, আসল সম্মান, ইজ্জত, মর্যাদা কখনোই লোক দেখানো কিছুতে হয় না। আপনি হয়তো একটা কাগজের লেখা বা আপনার অবস্থানের কারণে নিজেকে সম্মানিত ভাবতে পারেন কিন্তু প্রকৃত বিষয়টা এমন না। 

আল্লাহ কারো ব্যাপারে “ইজ্জত” মানুষের অন্তরে দিয়ে দেন। তাই কেউ সুউচ্চ প্রাসাদে বাস করলেও তার কোন সম্মান নাও থাকতে পারে। তাদের “মুলক” থাকলেও “ইজ্জাহ” নেই। তাই আল্লাহ বলেন, “قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء”। 

“ইজ্জাহ” শব্দটি দ্বারা আবার শক্তিও বুঝায়। এই বিষয়টাও বেশ আকর্ষণীয়, শুধু সম্মানই না, শক্তিও বুঝাচ্ছে এই শব্দটি। যেমনটা আল্লাহ বলেন, “فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ”- “আমি দুইজন নবীকে শক্তিশালী করেছিলাম তৃতীয় একজন দ্বারা……” (সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ১৪)। এখানে “ইজ্জাহ” বলতে শক্তি বুঝানো হয়েছে।  অন্য দৃষ্টিতে দেখলে, আপনার রাজত্ব আছে মানেই যে আপনি শক্তিশালী এমন না। অনেক সময় আমরা এমন অনেক লোক দেখি যাদের একটা উঁচু অবস্থান আছে কিন্তু কোন শক্তি বা ক্ষমতা নেই। তাদের কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই। এদের শুধু নামকাওয়াস্তে উঁচু একটা অবস্থান আছে। আমাদের জীবনে কি আমরা এমন ঘটনা দেখি না? শুধু রাজনৈতিক দিক না দেখে ব্যক্তিজীবনের দিকেও আমাদের তাকানো উচিত। যেমন ধরুন, একজন বাবা। সাধারণ দৃষ্টিতে তিনি পরিবারের মধ্যে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, তার একটা আলাদা ক্ষমতা থাকা দরকার কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় তিনি তার সন্তানদের কিছু বলতে পারেন না বা তাদের দ্বারা কিছু করাতে পারেন না। তিনি নামেই ক্ষমতাসীন কাজে না আবার অনেক সময় প্রকৃত ক্ষমতা থাকলেও সেখানে সম্মান থাকে না। আবারো আয়াতটা খেয়াল করুন, “قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء”। “তু যিললু” অর্থ অপমান। এর অর্থ তিনি যাকে ইচ্ছা অপমান করেন এমনটাও হতে পারে আবার তিনি যাকে ইচ্ছা শক্তিহীন করেন এমনটাও হতে পারে।”