— নোমান আলী খান
ভাইদের ষড়যন্ত্রের কারণে দাস হিসেবে ইউসুফ (আ) বিক্রিত হন। ফলে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগ পাননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আপনাকে সার্টিফিকেট দেয়, অনেকাংশেই বাস্তব দুনিয়ার পরিবর্তিত কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা দেয় না। ফলে, এই তত্ত্বীয় সার্টিফিকেটও আপনার কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগে না অনেক ক্ষেত্রে। কারণ, এটা আপনার কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনমাফিক বাস্তব শিক্ষা দেয়নি।
ইউসুফ (আ) ছিলেন মন্ত্রীর বাড়িতে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাকেন্দ্র না, অভিজ্ঞতার কেন্দ্র। তাই, তিনি সার্টিফিকেটকে কেন্দ্র আগান নাই জীবনে। তিনি বরং বাস্তবিক কর্মক্ষেত্র দেখে শিখেছেন মন্ত্রীর কাছ থেকে।
মন্ত্রীর আস্থাভাজন ও প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণে তিনি মন্ত্রীর কাজ দেখাশোনা করতেন। ফলে, মন্ত্রী যে বড় বড় লোকেদের সাথে কথাবার্তা বলতেন, কাজ নিয়ে দেনদরবার করতেন, আলাপ করতেন, সমস্যা নিয়ে কথা বলে সমাধান দিতেন – এসবই তিনি লক্ষ্য করতেন ও শিখতেন।
এরপর তিনি আরেক বড় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে চলে যান। এখানে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতেন থাকেন। এমন অবস্থায় বাদশাহ খারাপ স্বপ্ন দেখেন। কেউ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারে না। ইউসুফ (আ) কে আল্লাহ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও প্রজ্ঞা দিয়েছিলেন। ইউসুফ (আ) স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ তাকে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি সেটা পান।
রাজার স্বপ্নের ব্যাখা ছিলো আসন্ন ৭ বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে। ৭ বছর ভালো ফলন হবে, এরপরের ৭ বছর দুর্ভিক্ষ হবে। টানা ৭ বছর দুর্ভিক্ষ মানে মিশর একদম শেষ হয়ে যাবে। না খেয়ে তো ৭ দিনও থাকা যায় না, আবার ৭ বছর! মানে বিরাট বিপদ, একটা জাতি পৃথিবীতে থেকে উজাড় হয়ে যাবে এই অবস্থার কারণে।
ইউসুফ (আ) অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন কেন? কারণ তার এই বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা রয়েছে। প্রজ্ঞা(হিকমাহ) হলো সেই জ্ঞান যা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কল্যাণ দেয়; এটা সার্টিফিকেট বা তত্ত্বীয় কোনো জ্ঞান নয়।
তো, মিশরে ঐ সময়ে যত ফসল হতো সকলের প্রয়োজনের বাইরে সবটুকু তিনি সরকারীভাবে কোষাগারে রাখতেন। এটাকে আমরা হিমাগার বলি। এই প্রজ্ঞা আগে কারো ছিলো না। অতিরিক্ত খাদ্য কীভাবে বাচিয়ে রেখে, অপচয় না করে গোদামজাত করে সংরক্ষণ করা যায়- এই হিমাগার সিস্টেমের তিনিই আল্লাহপ্রদত্ত প্রথম প্রবক্তা-আবিষ্কারক।
মিশরবাসীরা খাদ্য উতপাদন করত, কিন্তু অর্থনীতি বিষয়ে এডভান্সড নলেজ বা আরো উন্নত জ্ঞান ছিলো না। আল্লাহ ইউসুফ (আ) যেমন প্রজ্ঞা দান করেছিলেন, তেমনি তিনি মন্ত্রীর বাড়িতে থেকে দক্ষতাও শিখেছিলেন। তাই, পর্যাপ্ত সম্পদের কীভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিশরীয় লোকেদের রক্ষা করা যায়, সেই অর্থনীতির প্রজ্ঞা ও দক্ষতা তিনি প্রয়োগ করেন। প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি অপচয় বন্ধ করেন, এবং অতিরিক্ত খাদ্য তিনি সংরক্ষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এভাবে আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা (অপচয় না করা, এটাকে কল্যাণে ব্যবহার করা) এবং দুনিয়াবী দক্ষতা (কীভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করা যায়) এর সমন্বয়ে মিশরবাসীকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে আজো পড়াশোনা আছে, জানেন তো? এটাকে বলে এজিপ্টলজি। সেই মিশরীর সভ্যতা কার হাত ধরে দাড়িয়েছিলো? ইউসুফ (আ) এর এর হাত ধরে। আল্লাহপ্রদত্ত্ব প্রজ্ঞা আর নবী ইউসুফের শেখা দক্ষতার কারণেই মিশর দেশ ও জনগণ টিকে যায়, জন্ম হয় মিশর সভ্যতার।
ইউসুফ (আ) প্রথমবার কূপে পড়েন। এটা ছিলো ছোট বিপদ। এই ছোট বিপদ থেকে রাজদরবারে তুলনামূলক ভালো অবস্থান নিশ্চিত হয়। এরপর মন্ত্রীর স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে জেলে যান। এটা আগেরটার তুলনায় বড় বিপদ। এই বড় বিপদ থেকে তিনি আগের তুলনায় অনেক বড় কিছু পান – একেবারে অর্থমন্ত্রীর পদ। দেশের অনেক বড় ও উপরের পদ। ছোট বিপদ থেকে ছোট কল্যাণ এসেছে। বড় বিপদ থেকে অনেক বড় নেয়ামত এসেছে। হতাশ হবেন না কখনো। নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে সুখ, অবশ্যই কষ্টের সাথে রয়েছে সুখ (সূরা ইনশিরাহ).
আল্লাহর দ্বীন পালন করুন – তিনি সত্য-মিথ্যা দেখিয়ে সঠিক পথ দেখাবেন। কল্যাণের প্রজ্ঞা দিবেন। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকলেও দুনিয়াবী দক্ষতা অর্জন করুন – আশা করা যায় উন্নতি করতে পারবেন। কারণ, দুনিয়া আপনাকে অর্থ ও সম্পদ দিবে দক্ষতাভিত্তিক কাজের কারণে। এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হালাল উপার্জনের মাধ্যম। হালাল উপার্জনের জন্য প্রজ্ঞা ও দুনিয়াবী দক্ষতা অর্জন দ্বীনেরই অংশ।